ক্ষমতায় যাওয়ার পর by সাযযাদ কাদির
সরওয়ার আহমদ নিজের পরিচয় দেন লেখক ও সাংবাদিক হিসেবে। তিনি মানবজমিন-এর স্টাফ রিপোর্টার মৌলভীবাজার।
তবে
এটুকুই নয় কেবল, আরও বড় ও কীর্তিধন্য পরিচয় আছে তাঁর। তবে স্বভাবে
প্রচ্ছন্নতা, চারিত্র্যে অন্তর্মুখিনতা যাঁর বৈশিষ্ট্য তাঁর পরিচয় এই
মিডিয়া-ধাঁধানো যুগে অন্তরালে থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। তাই কোনও এক কাজের
সূত্রে মৌলভীবাজারে গিয়ে, এক সাহিত্যিক-সাংবাদিক সমাবেশে, যখন সরওয়ার
আহমদের কবি পরিচয় প্রকাশ করি তখন হাঁ হয়ে যান উপস্থিত সকলে। একজন
স্থানীয়ভাবে সুপরিচিত কবি তো সবিস্ময়ে বলেই ফেলেন, ‘কবি! উনি কবিতা লেখেন!
কোনও দিন শুনি নি তো!’ কিন্তু সরওয়ার আহমদের সংবাদলিখনের বৈশিষ্ট্য থেকেই
বুঝেছিলাম, তিনি নিশ্চিত এক কবি। জিজ্ঞেস করাতে প্রথমে এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন,
সবিনয়ে বলেছেন, সে সব তাঁর এক অক্ষম প্রয়াস। কিন্তু পুরনো পত্রিকা থেকে
উদ্ধার করে আনা বেশ কিছু কবিতা পড়ে বুঝতে পারি, সরওয়ার আহমদের রচনা চিরায়ত
ধারায় অনুধ্যানী। বলতে গেলে আমার এবং আরও অনেকের প্রবল চাপে প্রকাশিত তাঁর
কাব্যগ্রন্থ “দিব্যচোখে কবিমুখ” (২০০৪) যাঁরা পড়েছেন তাঁরা বলবেন বাংলা
কবিতায় মধুসূদন-সুধীন্দ্রনাথ-ফররুখ সৃষ্ট দার্ঢ্যগুণের মহিমায় স্নাত হয়েছেন
তিনিও, তাই তাঁর কবিকণ্ঠ ধীরোদাত্ত। সেই সঙ্গে মন্দ্রিত হয়েছে তাঁর
দার্শনিক চেতনা ও ইতিহাসবোধ। এ দু’টি বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল করেছে তাঁর
‘বিলেতের পথে প্রান্তরে’ (২০০৭) নামের ভ্রমণবৃত্তান্তটিকে, বিশেষ করে
আমাদের দেশ ও জাতির সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গত অমর একুশে
গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত তাঁর শ্রমসাধ্য গবেষণার এক অসাধারণ বীরগাথা “জাতীয়
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে মৌলভীবাজার” (প্রকাশক: গদ্যপদ্য, পৃষ্ঠা
৬২৩, দাম ৳ ৬০০.০০)। অসামান্য গ্রন্থটি বিশেষ প্রচার পায় নি প্রকাশকালীন
বিশেষ পরিস্থিতির কারণে। মেলায় মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উন্মোচক হিসেবে আমি
ছিলাম, মঞ্চে ছিলেন লেখকসহ আর দু’জন। তারপর অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয় এই
মূল্যবান ইতিহাসগ্রন্থের প্রায় সমুদয় কপি। শেষ পর্যন্ত কিছু কপি কোনও মতে
পৌঁছেছে বিদগ্ধ পাঠকের কাছে। সরওয়ার আহমদের নিজস্ব মতাদর্শ আছে, একটি
রাজনৈতিক দলের প্রতি তাঁর ঘোষিত অঙ্গীকারও আছে, কিন্তু এ গ্রন্থ রচনায়
ইতিহাসের প্রতি যে আনুগত্য তিনি দেখিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে স্থাপন করেছে এক
বিরল দৃষ্টান্ত। গবেষকের নির্মোহ দৃষ্টি, ঐতিহাসিকের নৈর্ব্যক্তিকতা দিয়ে
তুলে ধরেছেন আমার দেশ, জাতি ও জনগণের সবচেয়ে গর্বিত গৌরবের কীর্তিকথা। বয়সে
তিনি আমার চেয়ে সাত বছরের ছোট, কিন্তু পঞ্চাশ-ষাট দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের
প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমরা উভয়েই। কিন্তু একসঙ্গে একই সময়ে দেখলেও অনেক বিষয়
তাঁর মতো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি নি, তাই অনেক ক্ষেত্রে তাঁর
পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ বিস্মিত ও মুগ্ধ করেছে আমাকে। তাঁর
দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি অনেক বিষয়কে উদ্ভাসিত করেছে নতুন আলোকে। তিনি
স্পষ্টতই ব্যতিক্রমী, কিন্তু সত্য ও প্রকৃত। “জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও
মুক্তিযুদ্ধে মৌলভীবাজার” গ্রন্থের উৎসর্গপত্রেই আছে এর প্রমাণ - “বঙ্গমাতা
বেগম ফজিলতুন্নেছা মুজিব - যাঁর নেপথ্য ও প্রত্যক্ষ অভিনিবেশে জাতি পৌঁছতে
পেরেছিল কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে -”। এমন ভিন্নতর চিন্তাভঙ্গির অনেক উদাহরণ তুলে
ধরা যায় বইটি থেকে, কিন্তু আজ এখানে মাত্র একটি ব্যতিক্রমী উদ্ধার। এ
মূল্যায়ন ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে। তিনি লিখেছেন, “৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে
সময়ে পাকিস্তানী বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডবের জন্য তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে এককভাবে
দায়ী করার একটি প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। কিন্তু এ অপকীর্তির নেপথ্য ভূমিকায় ছিল
সামরিক জান্তা, পশ্চিমা রাজনীতিবিদ, আমলা ও পুঁজিপতিমহল। তাদের সম্মিলিত
পরিকল্পনার ফসল ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ব্যক্তিগতভাবে ইয়াহিয়া খান মদ্যপ,
উগ্রমেজাজি, নারীলোভীসহ অন্যান্য উপাচারে দুষ্ট থাকলেও কালের মূল্যায়নে
জেনারেল ইয়াহিয়া খান একজন ব্যতিক্রমী সামরিক শাসক হিসেবে গণ্য। এ উপমহাদেশ
তথা পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে সামরিক জান্তার আবির্ভাব ঘটেছে
ক্ষমতাকে স্থায়ী ও পাকাপোক্ত করার মানসে। এ উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে
নিজেদের উদ্যোগে দল গঠন কিংবা কোন রাজনৈতিক দলকে পক্ষপুটে টেনে নিয়ে
প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখাই হচ্ছে এতদঞ্চলীয়
সামরিক শাসকদের আসল প্রতিকৃতি। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ছিলেন তার
ব্যতিক্রম। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তার অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল একটি গ্রহণযোগ্য
সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা
হস্তান্তর। এ লক্ষ্যে তিনি অগ্রসরও হয়েছিলেন। ৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত
সাধারণ নির্বাচনটি ছিল তৎকালীন পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে নিরপেক্ষ ও
আলোড়ন সৃষ্টিকারী নির্বাচনী। এ নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন
একজন বাঙালি। নির্বাচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রবর্তিত উভয় পাকিস্তানের
সংখ্যাসাম্যনীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে জনসংখ্যার অনুপাতে জাতীয় পরিষদের আসন
নিশ্চিত হয়েছিল। ফলে পূর্ব বাংলার ভাগে ২৪টি আসন বেশি পড়েছিল। অনুষ্ঠিত
নির্বাচন নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনি। এই কৃতিত্বের পুরোটাই ছিল
ইয়াহিয়া খানের। নির্বাচন শেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকার করে
নেয়াটাও ছিল ইয়াহিয়া খানের উদার মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু তার পরবর্তী
সময়ের ডিগবাজি ছিল রহস্যে ঘেরা। যে শক্তির ওপর ভর দিয়ে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায়
অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, সেই সামরিক জান্তা, পশ্চিমা পুঁজিপতি আমলা ও
রাজনীতিকদের কায়েমি স্বার্থের নিকট ইয়াহিয়া খান দৃশ্যত জিম্মি হয়ে
পড়েছিলেন। তার চারদিকে যে বেষ্টনী গড়ে উঠেছিল সেটি অতিক্রম তার পক্ষে
সম্ভব ছিল না। বিধায় তিনি পরিণত হয়েছিলেন শিখণ্ডিতে। জাতীয় ও রাজনৈতিক
রঙ্গমঞ্চে যতটুকু ঘটার, ততটুকু সম্পন্ন হওয়ার পরও ইয়াহিয়া খানই ছিলেন
ব্যতিক্রমী সামরিক জেনারেল যিনি খণ্ডিত পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও ক্ষমতা
হস্তান্তর করেছিলেন নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানের নিকট। এ কারণে
জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ইতিহাসের অনুকম্পা লাভের হকদার।”
sazzadqadir@rediffmail.com
No comments