পাকিস্তানিদের নৃশংসতা ও একজন শর্মিলা বসু by আবদুল মান্নান
শর্মিলা বসুর সঙ্গে ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসের আগে আমার পরিচয় ছিল না। যদিও তিনি আমার শৈশবের একজন প্রাতঃস্মরণীয় মহানায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভাই শিশির বসুর কন্যা। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে, আর বিয়ে করেছেন একজন ইংরেজ—অ্যালান রজলিংককে; লেখাপড়া কলকাতা, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৩ সালে প্রথমে যখন কলকাতায় যাই, তখন সেই মহানগরের যে কটি দর্শনীয় স্থান দেখব বলে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম, সেগুলোর মধ্যে নেতাজির এলগিন রোডের বাড়ি একটি। সেটি তখন নেতাজি জাদুঘর। ২০০৫ সালে শর্মিলা বসুর সঙ্গে আমার পরিচয় তাঁর একটি লেখাকে কেন্দ্র করে। ‘Anatomy of Violence: Analysis of Civil War in East Pakistan 1971’ শিরোনামে শর্মিলা বসুর একটি প্রবন্ধ ছাপা হয় মুম্বাই থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জার্নাল ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে। একটি ভালো মানের পত্রিকা, যা মোটামুটি আমি অনলাইনে নিয়মিত পড়ার চেষ্টা করি। তিনি তাঁর এই লেখায় মূলত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের শৌর্যবীর্যের গুণকীর্তন করেছেন এবং বলার চেষ্টা করেছেন, আসলে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাদের ভূমিকাকে যেভাবে চিত্রায়িত করা হয়, তারা তত খারাপ লোক ছিল না! তিনি তাঁর সব লেখাতেই পাকিস্তানি সেনা অফিসার এবং তাঁদের লিখিত বইপুস্তক থেকে উদ্ধৃতি প্রমাণ হিসেবে হাজির করেন।
শর্মিলা বসু বোধগম্য কারণেই পাকিস্তানি প্রচারমাধ্যমে বেশ জনপ্রিয়। কারণ, তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত, হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করেন এবং নেতাজির মতো একজন মহান ব্যক্তির আত্মীয়। ২০১০ সালের ৯ নভেম্বর তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ লাহোর থেকে প্রকাশিত অনলাইন পত্রিকা পাকিস্তান টাইমস প্রকাশ করে। লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘Pakistan Army shined in 1971’। প্রবন্ধটিতে লেখিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিয়ানমার ফ্রন্টে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁর কাকা নেতাজি সুভাষ বসুর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে জেনারেল নিয়াজিকে হাজির করেন। আসলে সেটাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, তাঁর কাকা নন। তিনি বলেছেন, যে জেনারেল নিয়াজি (তখন তিনি একজন জুনিয়র অফিসার ছিলেন) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এত বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে ব্রিটিশদের নজর কাড়তে পারেন এবং বীরত্বসূচক সম্মানে ভূষিত হতে পারেন, তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা চালাতে পারেন অথবা তাঁর অধীন পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে ধর্ষণ চালাতে পারে, তা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।
২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মিস বসুর আরেকটি ন্যক্কারজনক লেখা প্রকাশ করে সাপ্তাহিক ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি, যার শিরোনাম ছিল ‘Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War’। এ প্রবন্ধেও তিনি ব্যবহার করেছেন পাকিস্তানি সব রেফারেন্স। তবে তাঁর এই লেখার মূল বিষয় ছিল এটি প্রমাণ করা যে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি প্রায়ই বলে বা লেখে যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাতে আড়াই লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তা সর্বৈব অসত্য এবং এত কম সময়ে ২০ বা ৪০ হাজার সেনার পক্ষে আড়াই লাখ নারীকে ধর্ষণ করা সম্ভব নয়। তিনি তাঁর এই উপসংহারের জন্য ২০০৩ সালে তাঁর নেওয়া জেনারেল নিয়াজির সাক্ষাৎকার ব্যবহার করেছেন। ২০০৭ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন, যত নারী ধর্ষিত হয়েছেন বলে বাংলাদেশ দাবি করে, তা যদি সত্য হয়, তাহলে প্রত্যেক পাকিস্তানি সেনাকে গড়ে ছয় থেকে ১২ জন নারীকে ধর্ষণ করতে হবে, যা দৈনিক হিসাবে দাঁড়ায় ৭৫৫ থেকে এক হাজার ৫০৯ জন, যা অসম্ভব। তিনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেননি। তাঁর হিসাবমতে, সে সময় বাংলাদেশে সর্বমোট ৩৪ হাজার পাকিস্তানি সেনা ছিল। এতে তিনি ১১ হাজার পাকিস্তানি সিভিল পুলিশ ও অন্য অস্ত্রধারীদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন নিয়াজির স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ এবং হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট।
অথচ সারা দুনিয়া জানে, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরেরা মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। মিস বসু দাবি করেছেন, তিনি তাঁর প্রবন্ধটি মাঠপর্যায় থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচনা করেছেন এবং দাবি করেছেন, পাকিস্তানি সেনারা যুদ্ধের সময় শুধু প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের হত্যা করলেও নারী ও শিশুদের রেহাই দিয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, মিস বসু হয়তো তাঁর তথ্য কলকাতার গড়ের মাঠে বসে সংগ্রহ করেছেন। এখানে আরও উল্লেখযোগ্য, শর্মিলা বসু তাঁর সব লেখায় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে সব সময় ‘গৃহযুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অবশ্য শুধু একজন শর্মিলা বসুই যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ হিসেবে দেখেছেন, তা নয়, বাংলাদেশের অনেক লেখক-কলামিস্টও তা-ই দেখেন। এমন একজন লেখকের একটি প্রবন্ধ ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে ২০০৭ সালে প্রকাশিত হলে আমি তার প্রতিবাদ করে তাঁকে একটি মেইল পাঠিয়েছিলাম। তিনি ফিরতি মেইলে আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধ’ই লিখেছিলেন, কিন্তু ওই পত্রিকার সম্পাদক তা ‘গৃহযুদ্ধ’ করে দিয়েছেন।
শর্মিলা বসু তাঁর পাকিস্তান তোষণনীতির অংশ হিসেবে সর্বশেষ মিথ্যা-আশ্রিত বোমাটি ফাটানোর চেষ্টা করেছেন ১৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির উড্রো উইলসন সেন্টারে। এদিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা তাঁর বই ডেড রেকনিং: মেমোরিজ অব দ্য ১৯৭১ ওয়ার-এর প্রকাশনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল এই সেন্টারে। এর তিন দিন আগে বইটি ছাপার কাজ শেষ হয়। বলে নেওয়া ভালো, একাত্তরে বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন ১২ বছর বয়সী শর্মিলা বসু কলকাতায় একজন স্কুলছাত্রী ছিলেন। তখন তিনি বড়জোড় কলকাতার রাস্তায় আমাদের কিছু শরণার্থী দেখেছেন, একটি জাতির মুক্তির জন্য যুদ্ধে যাওয়ার মুহূর্ত এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি করার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনোটাই তাঁর হয়নি। তিনি লিখছেন সেই যুদ্ধের স্মৃতি! অবশ্য সেসব স্মৃতির বেশির ভাগই পাকিস্তানি পক্ষের, সে দেশের সামরিক কর্মকর্তাদের, যাঁরা একাত্তরে এ দেশে রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিলেন। শর্মিলা বসুর বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান হচ্ছে জেনে ডিসির আশপাশে যাঁরা থাকেন, তাঁরা ওই অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য বেশ উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন। এঁদের অন্যতম হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা ড. নূরুন্নবী। পেশায় তিনি একজন বিজ্ঞানী। ১৫ তারিখের অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ভয়েস অব আমেরিকার অনুজপ্রতিম সাংবাদিক আনিস আহমেদ, সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ, ১৯৭১-এ পাকিস্তানে কর্তব্যরত এপির সাংবাদিক আর্নল্ড জেটলিন, একসময় বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম প্রমুখ। শর্মিলা বসু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর এই সর্বশেষ প্রকাশনায়ও বলার চেষ্টা করেছেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা কোনো বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করেনি অথবা গণহত্যার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিল না। তিনি লিখেছেন, একাত্তরে ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ এবং দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম হারানোর তথ্য সঠিক নয়। এ সংখ্যা প্রচার করা হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের মদদে। শিল্পী কামরুল হাসান ঘাতক ও মদ্যপ ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে ‘এই জানোয়ারটিকে হত্যা করতে হবে’ শিরোনামে যে ঐতিহাসিক পোস্টারটি এঁকেছিলেন, তাতেও মিস বসুর আপত্তি। তাঁর মতে, পাকিস্তানের সর্বোচ্চ র্যাংকধারী একজন সামরিক কর্মকর্তাকে নিয়ে এমন ছবি আঁকাটা বিবেকপ্রসূত ছিল না। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের তীব্র সমালোচনা করে লিখেছেন, এটি ছিল একধরনের উগ্র নৃতাত্ত্বিক (ethnic) আচরণ এবং অসহযোগ আন্দোলন কখনো অহিংস ছিল না। মিস বসু আরও বলেছেন, একাত্তরের মার্চ মাসে জাতীয় নেতারা (আওয়ামী লীগ) সব সময় দ্বিচারী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি কোথাও ভুট্টো বা ইয়াহিয়া খানের তেমন কোনো দ্বিচারিতা দেখতে পাননি।
বলা বাহুল্য, সেদিন যাঁরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন—জামায়াত-জাতীয়তাবাদী ঘরানার কয়েকজন ছাড়া—তাঁরা শর্মিলা বসুর বই সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য শুনে বেশ আহত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং তাৎক্ষণিক তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। ড. নবী সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন কিছুদিন আগে তাঁর রচিত ও প্রকাশিত একাত্তরের যুদ্ধদিনের স্মৃতিমূলক গ্রন্থ Bullets of 1971। সেখান থেকে উদ্ধৃতি এবং একাত্তরে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে প্রমাণ করেছেন, শর্মিলা বসু একজন ভাড়াটে লেখক বৈ অন্য কিছু নন। সাংবাদিক আর্নল্ড জেটলিন একাত্তরে তাঁর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের সাক্ষাতের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, তিনি সব সময় মাতাল থাকতেন এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা নষ্ট করার জন্য তাঁকে গালাগাল করতেন। সাংবাদিক আনিস মন্তব্য করেন, একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের আচরণ যাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা কখনোই তাদের পক্ষ অবলম্বন করতে পারেন না। আরশাদ মাহমুদ মিস বসুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি পাকিস্তানের আইএসআইয়ের অর্থায়নে এই বই রচনা করেছেন কি না। শর্মিলা বসু অবশ্য তা অস্বীকার করেন। উইলিয়াম বি মাইলাম মন্তব্য করেন, একাত্তরে বাংলাদেশে নারী ধর্ষণ ও গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। তবে এ বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে। চতুর্মুখী সমালোচনার মুখে শেষতক মিস বসু ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যান।
সম্ভবত আসল সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশে যখন স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু হয়েছে, তখন মিস বসু জামায়াত ও তাদের আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি অশুভ মিশনে নেমেছেন। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকার কতটুকু সজাগ আছে, জানি না। তবে এটি ঠিক, এ রকম আরও অনেক শর্মিলা বসু ভবিষ্যতে আত্মপ্রকাশ করবেন। ইন্টারনেটে একজন ব্লগারের মন্তব্য দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। তিনি লিখেছেন, একাত্তরে যদি মিস বসু অথবা তাঁর কোনো নিকটাত্মীয় কোনো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে সম্ভ্রম হারাতেন, তাহলে বুঝতেন, বাঙালিরা তাদের স্বাধীনতার জন্য কত বড় আত্মবিসর্জন দিয়েছে। সবশেষে সরকারের কাছে একটা বিনীত অনুরোধ, অবিলম্বে শর্মিলা বসুকে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হোক। লেখার কলেবর বৃদ্ধি পাবে বলে সুজান ব্রাউমিলারের গ্রন্থ Against Our Will: Men, Women and Rape, স্যামুয়েল ও অন্যদের লেখা Century of Genocide: Eyewitness Accounts and Critical Views বা Adam Jones সম্পাদিত Genocide, War Crimes and the West থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া সম্ভব হলো না। কারও সুযোগ থাকলে বইগুলোর বাংলাদেশ অংশটুকু পড়ে নিতে পারেন।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব, ঢাকা।
শর্মিলা বসু বোধগম্য কারণেই পাকিস্তানি প্রচারমাধ্যমে বেশ জনপ্রিয়। কারণ, তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত, হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করেন এবং নেতাজির মতো একজন মহান ব্যক্তির আত্মীয়। ২০১০ সালের ৯ নভেম্বর তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ লাহোর থেকে প্রকাশিত অনলাইন পত্রিকা পাকিস্তান টাইমস প্রকাশ করে। লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘Pakistan Army shined in 1971’। প্রবন্ধটিতে লেখিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিয়ানমার ফ্রন্টে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁর কাকা নেতাজি সুভাষ বসুর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে জেনারেল নিয়াজিকে হাজির করেন। আসলে সেটাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, তাঁর কাকা নন। তিনি বলেছেন, যে জেনারেল নিয়াজি (তখন তিনি একজন জুনিয়র অফিসার ছিলেন) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এত বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে ব্রিটিশদের নজর কাড়তে পারেন এবং বীরত্বসূচক সম্মানে ভূষিত হতে পারেন, তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা চালাতে পারেন অথবা তাঁর অধীন পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে ধর্ষণ চালাতে পারে, তা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।
২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মিস বসুর আরেকটি ন্যক্কারজনক লেখা প্রকাশ করে সাপ্তাহিক ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি, যার শিরোনাম ছিল ‘Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War’। এ প্রবন্ধেও তিনি ব্যবহার করেছেন পাকিস্তানি সব রেফারেন্স। তবে তাঁর এই লেখার মূল বিষয় ছিল এটি প্রমাণ করা যে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি প্রায়ই বলে বা লেখে যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাতে আড়াই লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তা সর্বৈব অসত্য এবং এত কম সময়ে ২০ বা ৪০ হাজার সেনার পক্ষে আড়াই লাখ নারীকে ধর্ষণ করা সম্ভব নয়। তিনি তাঁর এই উপসংহারের জন্য ২০০৩ সালে তাঁর নেওয়া জেনারেল নিয়াজির সাক্ষাৎকার ব্যবহার করেছেন। ২০০৭ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন, যত নারী ধর্ষিত হয়েছেন বলে বাংলাদেশ দাবি করে, তা যদি সত্য হয়, তাহলে প্রত্যেক পাকিস্তানি সেনাকে গড়ে ছয় থেকে ১২ জন নারীকে ধর্ষণ করতে হবে, যা দৈনিক হিসাবে দাঁড়ায় ৭৫৫ থেকে এক হাজার ৫০৯ জন, যা অসম্ভব। তিনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেননি। তাঁর হিসাবমতে, সে সময় বাংলাদেশে সর্বমোট ৩৪ হাজার পাকিস্তানি সেনা ছিল। এতে তিনি ১১ হাজার পাকিস্তানি সিভিল পুলিশ ও অন্য অস্ত্রধারীদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন নিয়াজির স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ এবং হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট।
অথচ সারা দুনিয়া জানে, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরেরা মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। মিস বসু দাবি করেছেন, তিনি তাঁর প্রবন্ধটি মাঠপর্যায় থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচনা করেছেন এবং দাবি করেছেন, পাকিস্তানি সেনারা যুদ্ধের সময় শুধু প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের হত্যা করলেও নারী ও শিশুদের রেহাই দিয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, মিস বসু হয়তো তাঁর তথ্য কলকাতার গড়ের মাঠে বসে সংগ্রহ করেছেন। এখানে আরও উল্লেখযোগ্য, শর্মিলা বসু তাঁর সব লেখায় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে সব সময় ‘গৃহযুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অবশ্য শুধু একজন শর্মিলা বসুই যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ হিসেবে দেখেছেন, তা নয়, বাংলাদেশের অনেক লেখক-কলামিস্টও তা-ই দেখেন। এমন একজন লেখকের একটি প্রবন্ধ ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে ২০০৭ সালে প্রকাশিত হলে আমি তার প্রতিবাদ করে তাঁকে একটি মেইল পাঠিয়েছিলাম। তিনি ফিরতি মেইলে আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধ’ই লিখেছিলেন, কিন্তু ওই পত্রিকার সম্পাদক তা ‘গৃহযুদ্ধ’ করে দিয়েছেন।
শর্মিলা বসু তাঁর পাকিস্তান তোষণনীতির অংশ হিসেবে সর্বশেষ মিথ্যা-আশ্রিত বোমাটি ফাটানোর চেষ্টা করেছেন ১৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির উড্রো উইলসন সেন্টারে। এদিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা তাঁর বই ডেড রেকনিং: মেমোরিজ অব দ্য ১৯৭১ ওয়ার-এর প্রকাশনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল এই সেন্টারে। এর তিন দিন আগে বইটি ছাপার কাজ শেষ হয়। বলে নেওয়া ভালো, একাত্তরে বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন ১২ বছর বয়সী শর্মিলা বসু কলকাতায় একজন স্কুলছাত্রী ছিলেন। তখন তিনি বড়জোড় কলকাতার রাস্তায় আমাদের কিছু শরণার্থী দেখেছেন, একটি জাতির মুক্তির জন্য যুদ্ধে যাওয়ার মুহূর্ত এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি করার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনোটাই তাঁর হয়নি। তিনি লিখছেন সেই যুদ্ধের স্মৃতি! অবশ্য সেসব স্মৃতির বেশির ভাগই পাকিস্তানি পক্ষের, সে দেশের সামরিক কর্মকর্তাদের, যাঁরা একাত্তরে এ দেশে রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিলেন। শর্মিলা বসুর বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান হচ্ছে জেনে ডিসির আশপাশে যাঁরা থাকেন, তাঁরা ওই অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য বেশ উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন। এঁদের অন্যতম হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা ড. নূরুন্নবী। পেশায় তিনি একজন বিজ্ঞানী। ১৫ তারিখের অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ভয়েস অব আমেরিকার অনুজপ্রতিম সাংবাদিক আনিস আহমেদ, সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ, ১৯৭১-এ পাকিস্তানে কর্তব্যরত এপির সাংবাদিক আর্নল্ড জেটলিন, একসময় বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম প্রমুখ। শর্মিলা বসু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর এই সর্বশেষ প্রকাশনায়ও বলার চেষ্টা করেছেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা কোনো বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করেনি অথবা গণহত্যার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিল না। তিনি লিখেছেন, একাত্তরে ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ এবং দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম হারানোর তথ্য সঠিক নয়। এ সংখ্যা প্রচার করা হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের মদদে। শিল্পী কামরুল হাসান ঘাতক ও মদ্যপ ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে ‘এই জানোয়ারটিকে হত্যা করতে হবে’ শিরোনামে যে ঐতিহাসিক পোস্টারটি এঁকেছিলেন, তাতেও মিস বসুর আপত্তি। তাঁর মতে, পাকিস্তানের সর্বোচ্চ র্যাংকধারী একজন সামরিক কর্মকর্তাকে নিয়ে এমন ছবি আঁকাটা বিবেকপ্রসূত ছিল না। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের তীব্র সমালোচনা করে লিখেছেন, এটি ছিল একধরনের উগ্র নৃতাত্ত্বিক (ethnic) আচরণ এবং অসহযোগ আন্দোলন কখনো অহিংস ছিল না। মিস বসু আরও বলেছেন, একাত্তরের মার্চ মাসে জাতীয় নেতারা (আওয়ামী লীগ) সব সময় দ্বিচারী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি কোথাও ভুট্টো বা ইয়াহিয়া খানের তেমন কোনো দ্বিচারিতা দেখতে পাননি।
বলা বাহুল্য, সেদিন যাঁরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন—জামায়াত-জাতীয়তাবাদী ঘরানার কয়েকজন ছাড়া—তাঁরা শর্মিলা বসুর বই সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য শুনে বেশ আহত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং তাৎক্ষণিক তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। ড. নবী সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন কিছুদিন আগে তাঁর রচিত ও প্রকাশিত একাত্তরের যুদ্ধদিনের স্মৃতিমূলক গ্রন্থ Bullets of 1971। সেখান থেকে উদ্ধৃতি এবং একাত্তরে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে প্রমাণ করেছেন, শর্মিলা বসু একজন ভাড়াটে লেখক বৈ অন্য কিছু নন। সাংবাদিক আর্নল্ড জেটলিন একাত্তরে তাঁর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের সাক্ষাতের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, তিনি সব সময় মাতাল থাকতেন এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা নষ্ট করার জন্য তাঁকে গালাগাল করতেন। সাংবাদিক আনিস মন্তব্য করেন, একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের আচরণ যাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা কখনোই তাদের পক্ষ অবলম্বন করতে পারেন না। আরশাদ মাহমুদ মিস বসুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি পাকিস্তানের আইএসআইয়ের অর্থায়নে এই বই রচনা করেছেন কি না। শর্মিলা বসু অবশ্য তা অস্বীকার করেন। উইলিয়াম বি মাইলাম মন্তব্য করেন, একাত্তরে বাংলাদেশে নারী ধর্ষণ ও গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। তবে এ বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে। চতুর্মুখী সমালোচনার মুখে শেষতক মিস বসু ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যান।
সম্ভবত আসল সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশে যখন স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু হয়েছে, তখন মিস বসু জামায়াত ও তাদের আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি অশুভ মিশনে নেমেছেন। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকার কতটুকু সজাগ আছে, জানি না। তবে এটি ঠিক, এ রকম আরও অনেক শর্মিলা বসু ভবিষ্যতে আত্মপ্রকাশ করবেন। ইন্টারনেটে একজন ব্লগারের মন্তব্য দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। তিনি লিখেছেন, একাত্তরে যদি মিস বসু অথবা তাঁর কোনো নিকটাত্মীয় কোনো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে সম্ভ্রম হারাতেন, তাহলে বুঝতেন, বাঙালিরা তাদের স্বাধীনতার জন্য কত বড় আত্মবিসর্জন দিয়েছে। সবশেষে সরকারের কাছে একটা বিনীত অনুরোধ, অবিলম্বে শর্মিলা বসুকে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হোক। লেখার কলেবর বৃদ্ধি পাবে বলে সুজান ব্রাউমিলারের গ্রন্থ Against Our Will: Men, Women and Rape, স্যামুয়েল ও অন্যদের লেখা Century of Genocide: Eyewitness Accounts and Critical Views বা Adam Jones সম্পাদিত Genocide, War Crimes and the West থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া সম্ভব হলো না। কারও সুযোগ থাকলে বইগুলোর বাংলাদেশ অংশটুকু পড়ে নিতে পারেন।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব, ঢাকা।
No comments