একদিকে হতাশা, অন্যদিকে উৎসব
সেই হাসিখুশি ভাবটা আর নেই। ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে আসা গ্রায়েম স্মিথ যেন প্রচণ্ড ঝড়ে ডুবে যাওয়া কোনো জাহাজের বেঁচে যাওয়া কাপ্তান। শোক আর হতাশায় পাথরমূর্তি। মাথার ওপর আবারও চেপে বসেছে ‘চোকার’ অপবাদ। হাত ফসকে যাওয়া সেমিফাইনালের সুযোগটা যেন দূর থেকে উপহাস করছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিদায়ী অধিনায়ককে। অন্যদিকে ড্যানিয়েল ভেট্টোরির মুখে বিজয়ীর হাসি।্রঅধরা ফাইনাল ধরা দেবে কি না, কে জানে, সেমিফাইনাল খেলার অধিকারটুকু তো থাকল!
২২১ রানও তাড়া করা গেল না! স্মিথ স্বীকার করলেন, এত বড় অঘটন যে ঘটে গেছে, সেটা তিনিও বিশ্বাস করতে পারছেন না, ‘আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে নিউজিল্যান্ড ভালো খেলে জিতেছে। ২২১ তাড়া করে জেতা উচিত ছিল আমাদের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সেটা পারিনি।’ কেন পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা, তারও একটা সহজ ব্যাখ্যা আছে স্মিথের, ‘আমরা জেতার মতো ভালো খেলিনি।’
২ উইকেটে ১০৮ রান করার পর ২৫ থেকে ২৮ ওভারের মধ্যে ৩ উইকেট পড়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার। ম্যাচ থেকেও ছিটকে যাওয়ার শুরু তখনি।্রচাপের মুখে দক্ষিণ আফ্রিকার ভেঙে পড়া মানেই ‘চোকার’ ‘চোকার’ বলে রব ওঠা। কালও উঠল। কেউ কেউ তো বিদ্রূপ করে এমনও বলল, ‘চোকার নয়, জোকার।’ প্রেসবক্স থেকে এই পরিহাস ঢুকে পড়ল সংবাদ সম্মেলন কক্ষে। তবে বরাবরের মতো স্মিথ মানলেন না, তাঁরা ‘চোকার’, ‘ভেবেছিলাম, বোলিংটা ম্যাচ জেতানোর মতো হয়েছে। কিন্তু মাঝখানের ব্যাটিংটাই আমাদের ডুবিয়েছে। এ ছাড়া আর কিছু নয়।’
পরাজয়ের দায় বাজে ব্যাটিংকে যেমন দিয়েছেন, স্মিথ টেনেছেন শিশির ভেজা উইকেট প্রসঙ্গও, ‘নিউজিল্যান্ড আমাদের চেপে ধরেছিল। সঙ্গে বলটা একটু নরম হয়ে যাওয়াতে আমরাও বুঝতে পারছিলাম, পরিস্থিতি কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বল খুব মন্থর এবং নিচু হয়ে আসছিল। ওই সময়ে আমাদের আরও ধীরস্থির ক্রিকেট খেলা দরকার ছিল, কিন্তু আমরা তা পারিনি।’ মাঝে মাত্র পাঁচ ওভারের ব্যবধানে ৪ উইকেট হারানোটাকেই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট মনে হয়েছে তাঁর কাছে।
বারবার আশা জাগিয়েও আশাভঙ্গের বেদনায় পুড়তে পুড়তে এসবে যেন অভ্যস্তই হয়ে উঠেছে দক্ষিণ আফ্রিকানরা। সংবাদ সম্মেলন কক্ষে বসেই যেমন স্মিথ বলে দিলেন, ‘দল দেশে ফিরলে মানুষ পাথর ছুড়ে মারা থেকে শুরু করে যা যা করা যায়, তার সবই করবে। ১৯৯২ সাল থেকেই এটা হচ্ছে। আমরা বিশ্বকাপ জিততে পারছি না।’
দক্ষিণ আফ্রিকার হতাশার রাতটা কিউইদের জন্য হলো উৎসবের রাত। গত অক্টোবরে যে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ‘বাংলাওয়াশের’ লজ্জায় ডুবতে হয়েছিল, কাল রাতে সেখানেই হওয়া আতশবাজির উৎসবটা যেন নিউজিল্যান্ডের জন্যই উৎসর্গীকৃত। সদা গম্ভীর ভেট্টোরির আনন্দের প্রকাশটা সব সময়ই সীমিত। কালও মৃদু হেসে বললেন, ‘আমরা আসলেই খুশি। শুধু সেমিফাইনালে যাওয়াতেই নয়, আমাদের মনে হয়েছিল, জেতার জন্য এই উইকেটে ২৫০ রানই ভালো স্কোর।’ তার পরও ২২১ রান করেই জেতা গেল বোলিং পরিকল্পনাটা ঠিকঠাকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারায়। ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল ওদের মিডল অর্ডারটাকে নাড়িয়ে দেওয়া। কারণ, আমরা জানতাম, টপ অর্ডারে তাদের খুব ভালো ভালো ব্যাটসম্যান আছে’—বলেছেন ভেট্টোরি।
ব্যাটসম্যানরা বড় রান করে দিলেই বোলাররা বেশি নির্ভার হয়ে বোলিং করতে পারেন। কিন্তু কিউই বোলারদের অনুপ্রাণিত করল ২২১ রানই! অল্প রানের পুঁজি হওয়াতে জয়ের জন্য প্রতিপক্ষের ১০ উইকেট নেওয়াটাই একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিউজিল্যান্ডের জন্য। ভেট্টোরির দৃষ্টিতেও ওটাই ছিল তাঁদের জন্য প্লাস পয়েন্ট।
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য যেমন হতাশার হয়ে থাকল কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনালটা যদি সে রকমই কিছু হয়ে দাঁড়ায় নিউজিল্যান্ডের জন্য! বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে এর আগে পাঁচবার গিয়েও ফাইনালের দেখা পায়নি যে দল, সেমিফাইনাল জেতার আশা এবার কতটা করতে পারে তারা? ভেট্টোরি বললেন এ রকম পরিস্থিতিতে নিউজিল্যান্ড অধিনায়কদের বলা পুরোনো কথাটাই, ‘আমরা এটাকে মোটেও নেতিবাচকভাবে দেখছি না। আমাদের দেশে মাত্র চার মিলিয়ন মানুষ। তাদের জন্য এটাও অনেক বড় প্রাপ্তি।’
No comments