শিল্পি- ড্রয়িং, স্কেচ না পূর্ণাঙ্গ চিত্রকর্ম by সৈয়দ গোলাম দস্তগীর

বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক চিত্রচর্চার দ্বিতীয় প্রজন্মের একজন প্রধান শিল্পী রফিকুন নবী। টোকাই চরিত্রের কারণে তিনি রনবী নামেই বেশি পরিচিত। টোকাই, রনবী, রফিকুন নবী—নামগুলো পর পর সাজালে এমন একটা চরিত্র দাঁড়ায়, যিনি অনায়াসে হাসতে হাসতে সমাজের কঠিনতম বাস্তবতা ও অসংগতি তুলে ধরেন বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসের মাধ্যমে। এই মানুষটাই আবার সিরিয়াস ছবি আঁকেন, অলংকরণ করেন। লেখেনও। রফিকুন নবী যখন বাংলাদেশের চিত্রচর্চার অঙ্গনে প্রবেশ করেন, তখন এ দেশের চিত্রচর্চার প্রধান ধারা ছিল বিমূর্ত-আশ্রয়ী।
অনেক ক্ষেত্রে মূর্ত-বিমূর্তের দোলাচল ছিল দেশের শিল্পীদের মধ্যে। সমাজসচেতন রফিকুন নবী কোন অবস্থান নেবেন? তিনি বিমূর্ত ছবির টেক্সচার ও রঙের মিষ্টি আবেশের মাধুর্য নিয়েই বললেন বাস্তবতার কথা।
আজ ৩ ডিসেম্বর ২০১০, শুক্রবার, বিকেল চারটায় ধানমন্ডির গ্যালারি চিত্রকে শুরু হচ্ছে ‘ড্রয়িংস অব রফিকুন নবী’। ৫০টি ড্রয়িং নিয়ে এই প্রদর্শনী। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রফিকুন নবীর শিল্পীসত্তার বিকাশ হয়েছে একজন দক্ষ ছাপচিত্রী হিসেবে। ছাপচিত্রীদের রেখার প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা থাকেই। রফিকুন নবী এর ব্যতিক্রম নন। তাঁর তেলরং, জলরং বা ছাপাইকর্ম—সব মাধ্যমেই তিনি গুরুত্বসহ রেখার ব্যবহার করছেন। আর চেনা অবজেক্ট তো আছেই। ফলে একটা গল্পও আছে। সেদিক থেকে তাঁর আগের প্রদর্শনীর চেয়ে এটি ব্যতিক্রম নয়। ব্যতিক্রম একটি ক্ষেত্রে—এটা ড্রয়িংয়ের প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীর কিছু কাজ অগ্রিম দেখার সুবাদে বলা যায়, কাজগুলো নিছক ড্রয়িংকে ছাপিয়ে চলে গেছে পরিপূর্ণ ছবির পর্যায়ে। এই বিবেচনায় তাঁর কাজগুলোকে বড়জোর স্কেচ বলা চলে। কালার স্কেচ বা স্কেচের প্রদর্শনী এ দেশে বিরল। সেই বিবেচনায় এটি একটি ব্যতিক্রমী আয়োজন, সন্দেহ নেই। রেখা ও রঙের সমন্বয়ে আঁকা কাজগুলোতে তাঁর কাজের অতি পরিচিত চরিত্র আছে, এদের আবার জমির বিন্যাস, গঠনশৈলী—সবই একান্তই শিল্পীর নিজস্ব। সেই পরিচিত মহিষ, সহজ ফর্মে আঁকা পাখি, নিরীহ সরল বালিকার হাতে কবুতর—এগুলো সম্ভবত আমাদের লোকশিল্পের ফর্ম থেকে নেওয়া। সঙ্গে অবশ্যসম্ভাবীভাবে তাঁর বিখ্যাত চরিত্র ‘টোকাই’।
কয়লা, অ্যাক্রিলিক, জলরং, প্যাস্টেল আবার কখনো কখনো এগুলোর মিশ্র ব্যবহারে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর কাজগুলো সরল তির্যক ফর্মের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা। একটা কাজে আল দেওয়া জমি, মানুষ, গবাদিপশু, গাছ, পাখি, জল—সব মিলে গ্রামবাংলার চেনা রূপের একটি বিন্যাস। একটি কাজে এক দঙ্গল মহিষ, চেহারায় সরল নিরীহ এবং অনেকটা নির্বিকার কিন্তু অনেক শক্তি ধারণ করে আছে। এই আপাতবিপরীত দুই চরিত্রকে তিনি ধারণ করেছেন রেখার তির্যক ব্যবহার ও অভিব্যক্তির সারল্য দিয়ে। তাঁর ছবির ফর্মগুলো আমাদের চেনা, কিন্তু তার পরও তারা একান্তই রফিকুন নবীর। আবার এগুলো একান্তই বাংলাদেশের মানুষের স্থানিক ঘটনাবলির প্রতিনিধিত্ব করে।
বাংলার সমাজ, ভাবালুতা, কঠোর-কোমল স্বভাব—এই নিয়েই তাঁর জগৎ। একটি ছবিতে এক যুবক দুমড়ে-মুচড়ে গেছে যন্ত্রণায়। তার শহুরে বদ্ধ ঘরে ব্যথাতুর কোমল আলো, দেয়ালে নোনা ধরা অংশগুলো বোধহয় তার মনোজাগতিক গঠনের ছায়া। আরেকটি কাজে তির্যক আকৃতির মাছ, অস্থির রেখায় জালের ও জলের আবহ রয়েছে। কাজটি দেখলে মনে হতে পারে এটি এচিং অ্যাকোয়াটিন্টে করা একটি সম্পূর্ণ ছবি। রেখার প্রয়োগের বিবেচনায় এগুলোকে যদি কেউ ড্রয়িং বলতে চান, সে বলার একটা যাথার্থ্য থাকলেও থাকতে পারে। তবে সার্বিক বিবেচনায় এগুলোকে হয় পূর্ণাঙ্গ কাজ অথবা বড়জোর স্কেচতুল্য বলা যায়। এ শিল্পী ভূচিত্র থেকে শুরু করে পাখি, মাছ, গাছ যা-ই আঁকুন না কেন, তাঁর ছবির চরিত্রগুলোতে ফর্মের পাশাপাশি আর একটি বিষয় দর্শককে আকৃষ্ট করবে, তা হলো পরিপ্রেক্ষিতের ব্যবহার। শিল্পী তাঁর ছবিতে যে পরিপ্রেক্ষিত ব্যবহার করেন, তা তাঁর ছবির ফর্মের সঙ্গে মিশে এক ধরনের বিশেষত্ব অর্জন করেছে যা একান্তই তার দৃশ্যভাষার অনুগত।
প্রদর্শনীর আরেকটি ছবির কথা বলে আলোচনা শেষ করতে চাই। তিনি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথকে, পেছনে একটি জীর্ণ দেয়াল, তার ওপর অনেকটা গ্রাফিতির মতো করে লেখা রবীন্দ্র-সাহিত্যের নানা ছত্র, সামনে চিন্তামগ্ন রবীন্দ্রনাথ। দেখে যে কারও মনে পড়তে পারে, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে...’। সব মিলে তাঁর চর্চার মর্মমূলে আমরা যা পাই, তা তাঁর দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যসৃষ্টির এক নিরলস সাধনা এবং এই সুন্দর রবীন্দ্রসাহিত্যের নন্দনবোধের সাধারণ প্রয়োগের ধারণার গোত্রীয় বলে মনে হয়, যেখানে কঠোরতার মধ্যেও থাকে কোমল সুরের নিয়ন্ত্রণ।
প্রদর্শনীটি ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত আটটা খোলা থাকবে।
=========================
গল্পসল্প- নারী শিক্ষা মন্দির  স্মৃতি ও গল্প- ছিন্নস্মৃতি  স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর  ফিচার- তাঁহাদের দান  ফিচার- ডায়ানার আংটি  গল্প- 'অভিমান'  গল্প- 'মাটির ব্যাংক'  গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন'  স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'  সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে  আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা'  আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি'  আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ  শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং  আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর  আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত'  আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক'  আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা'


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ সৈয়দ গোলাম দস্তগীর


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.