হার্টা ম্যুলার-এর গল্প 'অন্ত্যেষ্টির বয়ান'
রেলস্টেশনে লোকজন ট্রেনের সাথে সাথে দৌড়াচ্ছে আর হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে।
এক যুবক ট্রেনের জানালার নিচে দাঁড়িয়ে। শার্সিটা একদম তার বগল পর্যন্ত। দুমড়ানো একগোছা ফুল সে বুকে চেপে রেখেছে। মুখ পুরা শুকনো।
এক কুঁজো তরুণী শান্ত এক বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এগোচ্ছে।
ট্রেন যাচ্ছে যুদ্ধের দিকে।
আমি টিভি বন্ধ করে দিলাম।
ঘরের মাঝে বাবা শুয়ে আছে। কফিনে। সারা দেয়াল জুড়ে অনেক ছবি। দেয়াল যে আছে তাই বোঝা যাচ্ছে না।
প্রথম ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাবা তাঁর চেয়ে দ্বিগুণ লম্বা চেয়ারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে।
অন্য ছবিতে বাবা বরের সাজে। বুকের অর্ধেকটা কেবল দেখা যায়। মায়ের হাতের বিশাল ফুলের তোড়ায় বাকি কিছু দেখার উপায় নেই। দুজনের মাথা এত কাছাকাছি, কানের লতি ছুঁয়ে ছুঁয়ে আছে।
আরেকটাতে বাবা কোনো বেড়ার পাশে একদম সিধা দাঁড়িয়ে। জুতোর নিচে বরফ। ভীষণ রকমের সাদা। বাবাকে মনে হচ্ছে শূন্যে একা। বাবার স্যালুট করা অবস্থার ছবি। কলারে নানান ব্যাজ।
এর পাশের ছবি। বাবা দাঁড়িয়ে। শাবল কাঁধে। পিছনে ক্ষেত। মাথায় টুপি। টুপিটার লম্বা ছায়ায় মুখ ঢেকে গেছে প্রায়।
এর পরের ছবিতে ট্রাকের স্টিয়ারিংয়ের পিছনে বাবা। গরুতে বোঝাই ট্রাক। সপ্তায় সপ্তায় বাবা গরু বোঝাই করে নিয়ে যেত কসাইখানায়। বাবার মুখ দেখাচ্ছে সরু। চোয়াড়ে।
সব ছবিতেই বাবাকে নিষ্প্রাণ লাগছে। যেন বাবা বুঝতে পারছে না কী করা লাগবে। অথচ বাবা খুব জেনে বুঝে কাজকারবার করতো। সব ছবি তাই অহেতুক। মুখোশ পরা মুখের ছবি। চেয়ার থেকে উঠতে চাইলাম। কিন্তু আমার জামা যেন চেয়ারের সাথে জমে গেছে। আমি পরে আছি কালো স্বচ্ছ জামা। নড়লেই পাট ভাঙার শব্দ শোনা যায়। উঠে এসে বাবার মুখে হাত রাখলাম। ঘরের অন্য সব কিছুর চেয়ে বাবার মুখ কতো ঠাণ্ডা। বাইরে তেতো রোদের হলকা। মাছি উড়ে উড়ে ডিম পাড়ছে। চওড়া ধুলোট রাস্তা গ্রামটাকে বাড়িয়ে নিয়ে গেছে। তপ্ত তামাটে পথ। তাকালে চোখ পুড়িয়ে দেয়।
কবরস্থানটা পাথরে ভরা। সমাধির উপর বড় বড় পাথর ঢাঁই করে রাখা।
নিচে তাকিয়ে দেখি আমার চটি ছিঁড়ে গেছে। বাকিটা সময় ফিতা টেনে হাটঁতে হবে।
নড়বড়ে চেহারার দুজন বাবার কফিনটা শবযান থেকে বের করলো। পরে আস্তে আস্তে রশি দিয়ে কবরের গর্তের মধ্যে ঢুকাতে লাগল। কফিন ভীষণ দুলছে। বাইরে খরা অথচ গর্ত পানিতে উপচে পড়ছে।
মদখেকো ছোটখাট গড়নের এক লোক আসল। বললো, ‘তোমার বাবা খুনী। অনেক লোক মেরেছে।’
‘বাবা তো যুদ্ধে ছিল। পঁচিশ করে লোক মারলে একটা করে পদক পেত। বেশ কয়টা পদক বাবার।’ আমি উত্তর দিলাম।
লোকটা বকে চললো, ‘ওলকপির ক্ষেতে সে মেয়েটাকে বলাৎকার করলো। সাথে আরো চার সেনা জুটিয়েছিল।
‘মেয়েটার দুপায়ের ফাঁকে তোমার বাবা এক আস্ত ওলকপি ঢুকিয়ে দিল। পরে ওকে রক্তাক্ত ফেলে রেখে চলে গেল। এর পরে আমরা আমাদের সব অস্ত্রের নাম রাখলাম ওলকপি। তখন হেমন্তের শেষ। ওলকপির পাতা কালচে মেরে গেছে। শীতে যেন একদম কুঁচকে কুঁচকে।’ বলা থামিয়ে লোকটা একটা পাথরের উপর বসলো। তারপর আবার বলা ধরলো, ‘বছরের শুরুতে আমরা সবাই মিলে জার্মানির ছোট্ট এক শহরে গেলাম অপেরা দেখতে। গায়কের গলা রাশিয়ান মহিলার চেঁচানোর মতোন লাগল। আস্তে আস্তে আমরা সবাই সটকে পড়লাম। শুধু থেকে গেলেন তোমার বাবা। শেষ পর্যন্ত। কিছুদিন পর তার মুখে শোনা গেল, গান মানে ওলকপি, মাইয়ামানুষও তাই’।
লোকটা মদ চালিয়ে যাচ্ছে সমানে। তার পেটের ভেতরের গুড়ুক গুড়ুক আওয়াজ আমার কানে লাগে। পরে বললো, ‘আমার পেটে যতো মদ তোমার বাবার কবরে ততো পানি।’
বলা শেষে সে আরেকটা ইয়া পাথরের উপর গিয়ে বসে থাকলো।
সাদা মার্বেলের ক্রসের পাশে দাঁড়িয়ে একজন অন্ত্যেষ্টির বয়ান করছে। আমার দিকে এগিয়ে এল। কোটের পকেটে তার দুহাত ঢুকানো। পুরা হাতের সমান বড়ো একটা গোলাপ তার বুকপকেটে। কাছাকাছি এসে একটা হাত বের করল। আঙুলগুলা টান টান করতে গিয়ে পারলো না। ব্যথায় যেন তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এলো। কাঁদা আরম্ভ করলো চুপে।
‘যুদ্ধে সবসময় দেশের লোকের পাশে থাকা যায় না। সব তো তখন নিজের মতো চলে না।’ বলা শেষে অন্ত্যেষ্টির বয়ান বলা লোকটা বড় এক পাথরের উপরে বসলো।
এবার আসলো মোটা মতন একজন। মাথা একদম মুখ ছাড়া চোঙ্গার মতো। কাছে এসে বললো, ‘তোমার বাবায় আমার বউয়ের লগে ওইসব আকাম করতো। আমার মদ খাওনের সময় আইসা আমারে অকথা-কুকথা কইতো। আমার টাকা পর্যন্ত চুরি করছে সে।’ বলে সে পাথরের উপর বসলো।
তারপরে চর্মসার বুড়ো এক মহিলা আমার দিকে এগিয়ে এসে মাটিতে থুথু ছিটোল। শাপ দিতে লাগলো আমায়।
অন্ত্যেষ্টির লোকজন কবরের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। আমি নিজের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। ওরা কি আমার স্তন দেখতে পাচ্ছে? আমি একদম দড় হয়ে গেলাম।
সবাই মিলে আমায় দেখছে। চোখে শূন্যতা। মনি যেন ঠিকরে বেরিয়ে যাবে। ছেলেরা কাঁধে অস্ত্র নিয়ে, মেয়েদের হাতে জপমালার খড়খড়ানির শব্দ।
অন্ত্যেষ্টির বয়ান বলা লোকটা তার গোলাপ বুকে চেপে ধরে রাখে। ওখান থেকে লাল একটা পাপড়ি ছিঁড়ে মুখে পুরলো। হাত নেড়ে আমায় ইশারায় বোঝাল আমার কিছু বলা লাগবে। সবাই অপেক্ষায়।
আমার মাথায় একটা বর্ণ কি শব্দ আসে না। চোখজোড়া যেন চোয়াল থেকে মাথা পর্যন্ত ঘুরপাক খাচ্ছে। মুখে হাত দিলাম। আঙুলে কষে কামড় লাগলো। লাল ছোপ দাগ পড়ে গেল আঙুলের মাথায়। তেতে গেছে দাঁত। মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়লো আমার কাঁধে।
বাতাসে আমার জামার একটা হাতা ছিঁড়ে গেল। উড়তে থাকল কালো লম্বা একটা ঢেউ হয়ে।
পাথরের উপর বসে থাকা একজন গুলি করে হাতাটাকে ফেলে দিল। আমার সামনে দিয়ে মাটিতে পড়ার পর দেখলাম রক্তের দাগ। লোকজন উল্লাসে ফেটে পড়লো।
আমার বাহু উন্মুক্ত। বাতাসের হলকা এসে লাগতে থাকলো।
এক বক্তার ইশারায় সবাই থামলো।
‘আমাদের গোত্রের জন্য আমরা গর্বিত। পতন থেকে আমরা ফিরে এসেছি। নিজেদের গায়ে আমরা কাদা মাখাবো না। লোকে যেন আমাদের মন্দ না বলে। এটা সত্যি, এখানকার কিছু জার্মানের জন্য আমরা মরতে বসছিলাম।’
সবাই আমার দিকে বন্দুক তাক করলো। আমার মাথার মধ্যে এক বোবা আওয়াজ হল।
আমি পড়ে গেলাম। তবে মাটিতে শরীরের ছোঁয়া লাগলো না। লোকের মাথার উপর ভেসে ভেসে আমি নিজের ঘরে চলে গেলাম।
মা পুরা বাসা পরিষ্কার করে রেখেছে।
আচ্ছা এই লম্বা টেবিলে কি বাবাকে এনে রাখা হয়েছিল? কসাইয়ের টেবিল। কয়েকটা সাদা প্লেট আর দুমড়ানো ফুলসহ একটা ফুলদানি পড়ে আছে সেখানে।
মার পরনে কাল স্বচ্ছ কাপড়। হাতে বড় একটা ছুরি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মা তাঁর মাথার ধূসর বড় খোঁপা ছুরি দিয়ে কাটলো। তারপর দুহাতে ধরে রাখল টেবিলের উপর। অন্য মাথাটা রাখা হলো সাদা প্লেটটার উপরে। বললো, ‘আর জীবনে কালো জামা পড়বো না।’
পরে খোঁপার এক মাথায় আগুন ধরানো হল। আস্তে আস্তে এক প্রান্ত ছেড়ে চলে গেল অন্য প্রান্তে। দপদপ করে জ্বলে যাচ্ছিল সব।
‘রাশিয়ায় ওরা আমার মাথার চুল কেটে দিয়েছিল। সবচে কম শাস্তি। ক্ষুধায় আমি কাতরাচ্ছিলাম। রাতে লুকোলাম ওলকপির ক্ষেতে। পাহারাদারের হাতে বন্দুক ছিল। দেখলে গুলি করে মারতো। তখন হেমন্তের শেষ। ওলকপির পাতায় কালো ধরেছিল। কুঁচকে ছিল শীতে।’
মা একনাগাড়ে বলে গেল।
মাকে আর দেখা যাচ্ছে না। খোঁপা জ্বলতে থাকে। ঘর ভরে যায় ধোঁয়ায়। মা বলে ওঠে, ‘তোমাকে ওরা মেরে ফেলেছে।’
মাকে আর দেখা যাচ্ছে না। ঘরে আর কোনো ধোঁয়া নেই।
মার পায়ের খসখস কানে আসে। দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরার জন্য মুখিয়ে থাকি।
মাথায় মার শক্ত হাত অনুভব করি। কেন জানি আমার মাথা ঝাঁকাতে থাকে। আমি খুব ভয় পেয়ে যাই।
হঠাৎ আমার চোখ খুলে গেল। ঘরটা ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাসি সাদাটে সব ফুলের মধ্যে আমি পড়ে আছি। বেরনোর পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ।
বুঝলাম আমার বাড়ি কেঁপে উঠছে। আস্তে আস্তে হেলে পড়ছে মাটির দিকে।
এলার্ম ঘড়িটা বেজে ওঠে। শনিবার সকাল। এখন পাঁচটা বেজে পঁয়ত্রিশ।
==============এক যুবক ট্রেনের জানালার নিচে দাঁড়িয়ে। শার্সিটা একদম তার বগল পর্যন্ত। দুমড়ানো একগোছা ফুল সে বুকে চেপে রেখেছে। মুখ পুরা শুকনো।
এক কুঁজো তরুণী শান্ত এক বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এগোচ্ছে।
ট্রেন যাচ্ছে যুদ্ধের দিকে।
আমি টিভি বন্ধ করে দিলাম।
ঘরের মাঝে বাবা শুয়ে আছে। কফিনে। সারা দেয়াল জুড়ে অনেক ছবি। দেয়াল যে আছে তাই বোঝা যাচ্ছে না।
প্রথম ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাবা তাঁর চেয়ে দ্বিগুণ লম্বা চেয়ারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে।
অন্য ছবিতে বাবা বরের সাজে। বুকের অর্ধেকটা কেবল দেখা যায়। মায়ের হাতের বিশাল ফুলের তোড়ায় বাকি কিছু দেখার উপায় নেই। দুজনের মাথা এত কাছাকাছি, কানের লতি ছুঁয়ে ছুঁয়ে আছে।
আরেকটাতে বাবা কোনো বেড়ার পাশে একদম সিধা দাঁড়িয়ে। জুতোর নিচে বরফ। ভীষণ রকমের সাদা। বাবাকে মনে হচ্ছে শূন্যে একা। বাবার স্যালুট করা অবস্থার ছবি। কলারে নানান ব্যাজ।
এর পাশের ছবি। বাবা দাঁড়িয়ে। শাবল কাঁধে। পিছনে ক্ষেত। মাথায় টুপি। টুপিটার লম্বা ছায়ায় মুখ ঢেকে গেছে প্রায়।
এর পরের ছবিতে ট্রাকের স্টিয়ারিংয়ের পিছনে বাবা। গরুতে বোঝাই ট্রাক। সপ্তায় সপ্তায় বাবা গরু বোঝাই করে নিয়ে যেত কসাইখানায়। বাবার মুখ দেখাচ্ছে সরু। চোয়াড়ে।
সব ছবিতেই বাবাকে নিষ্প্রাণ লাগছে। যেন বাবা বুঝতে পারছে না কী করা লাগবে। অথচ বাবা খুব জেনে বুঝে কাজকারবার করতো। সব ছবি তাই অহেতুক। মুখোশ পরা মুখের ছবি। চেয়ার থেকে উঠতে চাইলাম। কিন্তু আমার জামা যেন চেয়ারের সাথে জমে গেছে। আমি পরে আছি কালো স্বচ্ছ জামা। নড়লেই পাট ভাঙার শব্দ শোনা যায়। উঠে এসে বাবার মুখে হাত রাখলাম। ঘরের অন্য সব কিছুর চেয়ে বাবার মুখ কতো ঠাণ্ডা। বাইরে তেতো রোদের হলকা। মাছি উড়ে উড়ে ডিম পাড়ছে। চওড়া ধুলোট রাস্তা গ্রামটাকে বাড়িয়ে নিয়ে গেছে। তপ্ত তামাটে পথ। তাকালে চোখ পুড়িয়ে দেয়।
কবরস্থানটা পাথরে ভরা। সমাধির উপর বড় বড় পাথর ঢাঁই করে রাখা।
নিচে তাকিয়ে দেখি আমার চটি ছিঁড়ে গেছে। বাকিটা সময় ফিতা টেনে হাটঁতে হবে।
নড়বড়ে চেহারার দুজন বাবার কফিনটা শবযান থেকে বের করলো। পরে আস্তে আস্তে রশি দিয়ে কবরের গর্তের মধ্যে ঢুকাতে লাগল। কফিন ভীষণ দুলছে। বাইরে খরা অথচ গর্ত পানিতে উপচে পড়ছে।
মদখেকো ছোটখাট গড়নের এক লোক আসল। বললো, ‘তোমার বাবা খুনী। অনেক লোক মেরেছে।’
‘বাবা তো যুদ্ধে ছিল। পঁচিশ করে লোক মারলে একটা করে পদক পেত। বেশ কয়টা পদক বাবার।’ আমি উত্তর দিলাম।
লোকটা বকে চললো, ‘ওলকপির ক্ষেতে সে মেয়েটাকে বলাৎকার করলো। সাথে আরো চার সেনা জুটিয়েছিল।
‘মেয়েটার দুপায়ের ফাঁকে তোমার বাবা এক আস্ত ওলকপি ঢুকিয়ে দিল। পরে ওকে রক্তাক্ত ফেলে রেখে চলে গেল। এর পরে আমরা আমাদের সব অস্ত্রের নাম রাখলাম ওলকপি। তখন হেমন্তের শেষ। ওলকপির পাতা কালচে মেরে গেছে। শীতে যেন একদম কুঁচকে কুঁচকে।’ বলা থামিয়ে লোকটা একটা পাথরের উপর বসলো। তারপর আবার বলা ধরলো, ‘বছরের শুরুতে আমরা সবাই মিলে জার্মানির ছোট্ট এক শহরে গেলাম অপেরা দেখতে। গায়কের গলা রাশিয়ান মহিলার চেঁচানোর মতোন লাগল। আস্তে আস্তে আমরা সবাই সটকে পড়লাম। শুধু থেকে গেলেন তোমার বাবা। শেষ পর্যন্ত। কিছুদিন পর তার মুখে শোনা গেল, গান মানে ওলকপি, মাইয়ামানুষও তাই’।
লোকটা মদ চালিয়ে যাচ্ছে সমানে। তার পেটের ভেতরের গুড়ুক গুড়ুক আওয়াজ আমার কানে লাগে। পরে বললো, ‘আমার পেটে যতো মদ তোমার বাবার কবরে ততো পানি।’
বলা শেষে সে আরেকটা ইয়া পাথরের উপর গিয়ে বসে থাকলো।
সাদা মার্বেলের ক্রসের পাশে দাঁড়িয়ে একজন অন্ত্যেষ্টির বয়ান করছে। আমার দিকে এগিয়ে এল। কোটের পকেটে তার দুহাত ঢুকানো। পুরা হাতের সমান বড়ো একটা গোলাপ তার বুকপকেটে। কাছাকাছি এসে একটা হাত বের করল। আঙুলগুলা টান টান করতে গিয়ে পারলো না। ব্যথায় যেন তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এলো। কাঁদা আরম্ভ করলো চুপে।
‘যুদ্ধে সবসময় দেশের লোকের পাশে থাকা যায় না। সব তো তখন নিজের মতো চলে না।’ বলা শেষে অন্ত্যেষ্টির বয়ান বলা লোকটা বড় এক পাথরের উপরে বসলো।
এবার আসলো মোটা মতন একজন। মাথা একদম মুখ ছাড়া চোঙ্গার মতো। কাছে এসে বললো, ‘তোমার বাবায় আমার বউয়ের লগে ওইসব আকাম করতো। আমার মদ খাওনের সময় আইসা আমারে অকথা-কুকথা কইতো। আমার টাকা পর্যন্ত চুরি করছে সে।’ বলে সে পাথরের উপর বসলো।
তারপরে চর্মসার বুড়ো এক মহিলা আমার দিকে এগিয়ে এসে মাটিতে থুথু ছিটোল। শাপ দিতে লাগলো আমায়।
অন্ত্যেষ্টির লোকজন কবরের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। আমি নিজের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। ওরা কি আমার স্তন দেখতে পাচ্ছে? আমি একদম দড় হয়ে গেলাম।
সবাই মিলে আমায় দেখছে। চোখে শূন্যতা। মনি যেন ঠিকরে বেরিয়ে যাবে। ছেলেরা কাঁধে অস্ত্র নিয়ে, মেয়েদের হাতে জপমালার খড়খড়ানির শব্দ।
অন্ত্যেষ্টির বয়ান বলা লোকটা তার গোলাপ বুকে চেপে ধরে রাখে। ওখান থেকে লাল একটা পাপড়ি ছিঁড়ে মুখে পুরলো। হাত নেড়ে আমায় ইশারায় বোঝাল আমার কিছু বলা লাগবে। সবাই অপেক্ষায়।
আমার মাথায় একটা বর্ণ কি শব্দ আসে না। চোখজোড়া যেন চোয়াল থেকে মাথা পর্যন্ত ঘুরপাক খাচ্ছে। মুখে হাত দিলাম। আঙুলে কষে কামড় লাগলো। লাল ছোপ দাগ পড়ে গেল আঙুলের মাথায়। তেতে গেছে দাঁত। মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়লো আমার কাঁধে।
বাতাসে আমার জামার একটা হাতা ছিঁড়ে গেল। উড়তে থাকল কালো লম্বা একটা ঢেউ হয়ে।
পাথরের উপর বসে থাকা একজন গুলি করে হাতাটাকে ফেলে দিল। আমার সামনে দিয়ে মাটিতে পড়ার পর দেখলাম রক্তের দাগ। লোকজন উল্লাসে ফেটে পড়লো।
আমার বাহু উন্মুক্ত। বাতাসের হলকা এসে লাগতে থাকলো।
এক বক্তার ইশারায় সবাই থামলো।
‘আমাদের গোত্রের জন্য আমরা গর্বিত। পতন থেকে আমরা ফিরে এসেছি। নিজেদের গায়ে আমরা কাদা মাখাবো না। লোকে যেন আমাদের মন্দ না বলে। এটা সত্যি, এখানকার কিছু জার্মানের জন্য আমরা মরতে বসছিলাম।’
সবাই আমার দিকে বন্দুক তাক করলো। আমার মাথার মধ্যে এক বোবা আওয়াজ হল।
আমি পড়ে গেলাম। তবে মাটিতে শরীরের ছোঁয়া লাগলো না। লোকের মাথার উপর ভেসে ভেসে আমি নিজের ঘরে চলে গেলাম।
মা পুরা বাসা পরিষ্কার করে রেখেছে।
আচ্ছা এই লম্বা টেবিলে কি বাবাকে এনে রাখা হয়েছিল? কসাইয়ের টেবিল। কয়েকটা সাদা প্লেট আর দুমড়ানো ফুলসহ একটা ফুলদানি পড়ে আছে সেখানে।
মার পরনে কাল স্বচ্ছ কাপড়। হাতে বড় একটা ছুরি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মা তাঁর মাথার ধূসর বড় খোঁপা ছুরি দিয়ে কাটলো। তারপর দুহাতে ধরে রাখল টেবিলের উপর। অন্য মাথাটা রাখা হলো সাদা প্লেটটার উপরে। বললো, ‘আর জীবনে কালো জামা পড়বো না।’
পরে খোঁপার এক মাথায় আগুন ধরানো হল। আস্তে আস্তে এক প্রান্ত ছেড়ে চলে গেল অন্য প্রান্তে। দপদপ করে জ্বলে যাচ্ছিল সব।
‘রাশিয়ায় ওরা আমার মাথার চুল কেটে দিয়েছিল। সবচে কম শাস্তি। ক্ষুধায় আমি কাতরাচ্ছিলাম। রাতে লুকোলাম ওলকপির ক্ষেতে। পাহারাদারের হাতে বন্দুক ছিল। দেখলে গুলি করে মারতো। তখন হেমন্তের শেষ। ওলকপির পাতায় কালো ধরেছিল। কুঁচকে ছিল শীতে।’
মা একনাগাড়ে বলে গেল।
মাকে আর দেখা যাচ্ছে না। খোঁপা জ্বলতে থাকে। ঘর ভরে যায় ধোঁয়ায়। মা বলে ওঠে, ‘তোমাকে ওরা মেরে ফেলেছে।’
মাকে আর দেখা যাচ্ছে না। ঘরে আর কোনো ধোঁয়া নেই।
মার পায়ের খসখস কানে আসে। দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরার জন্য মুখিয়ে থাকি।
মাথায় মার শক্ত হাত অনুভব করি। কেন জানি আমার মাথা ঝাঁকাতে থাকে। আমি খুব ভয় পেয়ে যাই।
হঠাৎ আমার চোখ খুলে গেল। ঘরটা ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাসি সাদাটে সব ফুলের মধ্যে আমি পড়ে আছি। বেরনোর পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ।
বুঝলাম আমার বাড়ি কেঁপে উঠছে। আস্তে আস্তে হেলে পড়ছে মাটির দিকে।
এলার্ম ঘড়িটা বেজে ওঠে। শনিবার সকাল। এখন পাঁচটা বেজে পঁয়ত্রিশ।
রুমানিয়ার লেখিকা হার্টা ম্যুলার
ছোটগল্প সংকলন নাদিরস (‘নিদারুনজেন’) বা ‘Lowlands’ ২০০৯ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী রুমানিয়ার লেখিকা হার্টা ম্যুলারের প্রথম প্রকাশিত বই। ১৯৮২ সালে প্রকাশ পাবার পরপরই বইটি সেন্সরশিপের কবলে পড়ে। চসেস্কুর নির্মম শাসনকালে রুমানিয়ার গ্রামজীবনে যে দুর্বিপাক নেমে এসেছিল Lowlands-এ তার চিত্র ফুটে উঠেছে। লেখিকা গল্প লিখেছেন তাঁর অনবদ্য কাব্যিক গদ্যে। Lowlands বইয়ের প্রথম গল্প ‘The Funeral Sermon’।
অনুবাদ: শুভাশীষ দাশএই গল্পটি পড়া হয়েছে....
No comments