স্টিভেন মিলহসার-এর গল্প 'বহির্জাগতিক আক্রমণ'
আমরা প্রস্তুত ছিলাম শুরু থেকে, আমরা জানতাম কী করতে হবে, কেননা কত শত বার কী এ ঘটনা দেখিনি আমরা?—শহরের অনুগত অধিবাসীরা ব্যস্ত তাদের প্রাত্যহিক কাজে, অকস্মাৎ থামিয়ে দেয়া টিভি প্রোগ্রাম, ভিড়ের সবার আকাশের দিকে উঠে যাওয়া দৃষ্টি, একটা ছোট্ট মেয়ের বাতাসে তাক করা আঙুল, সকলের হাঁ করা মুখ, কুকুরের ঘেউ ঘেউ, থেমে যাওয়া যানবাহন, ফুটপাথে পড়ে যেতে থাকা শপিং ব্যাগ, আর ওই যে, আকাশে, ক্রমশ আরো কাছে আসছে… এইসব; ফলে, ঘটনাটা যখন সত্যি সত্যি ঘটে গেল—কেননা এটা অনিবার্য ছিল, আমরা জানতাম এটা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র—তখন আমাদের কৌতূহল আর আতঙ্কের মধ্যেও একপ্রকার অবিচল স্থিরতা অনুভব করলাম আমরা, পরিচয়ের কারণে যেরকম অবিচলতা তৈরি হয়, সেরকম; আমরা জানতাম আমাদের কী করতে বলা হবে, এরকম পরিস্থিতিতে। খবরটা ছড়ালো সকাল দশটার পর। টিভি উপস্থাপক-উপস্থাপিকাদের ঠিক সেরকমই দেখাচ্ছিল, যেমনটা দেখানোর কথা, তাদের মুখে একটা উদ্বেল ভাব, পরিপাটি চুল, উদগ্রীব কাঁধ, তারা আমাদের সতর্কবার্তা শোনাচ্ছে, আবার একই সঙ্গে এই আশ্বাসও দিচ্ছে যে, সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে, কেননা তাদেরকেও এর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, এক অর্থে তারা এর জন্য অপেক্ষাই করে ছিল, এই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য। আকাশে একটা কিছু যে দেখা গেছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু কী দেখা গেছে, নিশ্চিত নয়। মহাকাশে কিছু একটা শনাক্ত করা গেছে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সেটা অত্যন্ত দ্রুত বেগে আমাদের আবহমণ্ডলের দিকে ধেয়ে আসছে, পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে পেন্টাগন। আমাদের বলা হয়েছে শান্ত থাকতে, ঘর থেকে বের না হতে আর পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে। আমরা কেউ কেউ সঙ্গে সঙ্গে দপ্তর থেকে ছুটি নিয়ে দ্রুত বাসায় পরিবারের পানে ছুটেছি, বাকিরা টিভি, রেডিও, কম্পিউটারের সামনে বসে থেকেছে, আমরা সবাই সেল ফোনে কথা বলছিলাম। আমাদের জানালা দিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম অন্যেরা তাদের নিজ নিজ জানালাপথে উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। যেভাবে শিশুরা অন্ধকারে ঝড়বজ্রের আওয়াজ শুনতে থাকে, সারাটা সকাল আমরা সেরকম অনুপুঙ্খে খবর শুনলাম। বাইরে মহাকাশে যা-ই থাক না কেন, তা তখনও অজ্ঞাত, বিজ্ঞানীরা সেটার প্রকৃতি শনাক্ত করতে পারেননি, সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে, কিন্তু আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ তখনও ঘটেনি। আমাদের কর্তব্য শুধু রেডিও-টিভি খোলা রাখা, উৎকর্ণ বসে থাকা আর কী ঘটে তার জন্য অপেক্ষা করা। আর যদিও আমরা ছিলাম উদ্বিগ্ন, যদিও অস্থিরতা ইঁদুরের মতো আমাদের দেহের ভেতর দিয়ে হাঁটাচলা করছিল, তবু বাইরে ওটা যাই হোক না কেন, আমাদের দেখার সাধ জাগছিল, সাধ জাগছিল ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে, কেননা হাজার হলেও এটা আমাদের দিকে আসছে, আমাদেরকেই সাক্ষী হতে হবে, যেনবা আকাশের অপর প্রান্ত থেকে তারা আমাদেরই বেছে নিয়েছে। কেননা ইতিমধ্যে প্রচার করা শুরু হয়েছে যে, আমাদের শহরই সম্ভাব্য অবতরণ ক্ষেত্র, এরই মধ্যে টিভি ক্রুরা আসতে শুরু করেছে এ শহরে। আমরা ভাবছিলাম শহরের কোথায় এটা নামতে পারে: পার্কে পদ্মপুকুর আর বাচ্চাদের দোলনার মাঝখানে, অথবা শহরের উত্তর প্রান্তে ঘন জঙ্গলের ভেতর, কিংবা হতে পারে মলের পাশে মাঠের মধ্যে, যেখানে নতুন করে একটা খোড়াখুড়ির কাজ চলছে, অথবা হতে পারে এটা মেইন স্ট্রিটে পুরনো ডিপার্টমেন্ট স্টোরের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে “ম্যানজিওনস পিজা অ্যান্ড ক্যাফের” ওপরে তিন তলা অ্যাপার্টমেন্টগুলোয় আছড়ে পড়বে, ইট আর কাচ ছিটকে পড়বে চারপাশে, হয়তো এটা পড়বে ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে আর আমরা দেখতে পাবো আঠারো-চাকার গাড়িগুলো উল্টে পড়ছে, উঠে আসছে রাস্তার কংক্রিটের বড় বড় ধারালো টুকরো, শত শত কার গার্ডরেইল ভেঙে বাঁধের গা বেয়ে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে।
দুপুর ১টার আগে আগে আকাশে কিছু একটার আবির্ভাব ঘটলো। আমাদের অনেকে তখনও লাঞ্চ করছি, বাকিরা ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে, রাস্তায় বা ফুটপাথে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি আকাশপানে। চিৎকার, হৈ-চৈ, বাতাসে হাত ছোড়া, এ ওকে দেখাচ্ছে, ও তাকে। আর সত্যি সত্যি, কিছু একটা জ্বলজ্বল করছে, উপরে আকাশে, কিছু একটা কাঁপছে তিরতির করে গ্রীষ্মের নীল বাতাসে—জিনিসটা যাই হোক না কেন, আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। অফিসের সেক্রেটারিরা ছুটে গেল জানালার কাছে, দোকানিরা ক্যাশ রেজিস্টার ফেলে রেখে ছুটল দরজার বাইরে, কমলা রঙা শক্ত টুপি পড়া সড়ক শ্রমিকরা অ্যাসফল্ট থেকে মাথা তুলে চোখ ঢেকে তাকিয়ে থাকল ওপরের দিকে। এই দূরবর্তী আভা, এই চিকচিক করা বিন্দুটি সম্ভবত তিন কি চার মিনিট একভাবে ছিল। তারপর এটা বড় হতে থাকলো, হতে হতে একটা আধুলির সমান আকৃতি নিলো। হঠাৎ গোটা আকাশটা, মনে হলো, ভরে গেছে সোনালী বিন্দুতে। তারপর সেগুলো সোজা আমাদের ওপর ঝরে পড়তো থাকলো, মিহি রেণুর মতো, হলুদ ধূলিকণার মতো। আমাদের ঢালু ছাদে এগুলো পড়ে থাকলো, উড়ে এসে পড়তে থাকলো রাস্তার ফুটপাথে, আমাদের জামার হাতা, গাড়ির ছাদ ভরে গেল ধূলায়। আমরা বুঝতে পারছিলাম না, এগুলোকে কী বলবো।
প্রায় তের মিনিট ধরে নেমে আসতে থাকলো এই হলুদ ধূলা। এই সময়টা জুড়ে আকাশ দেখা যাচ্ছিল না। তারপর শেষ হলো এই বর্ষণ। রোদ উঠল, আকাশ আবার নীল। যতক্ষণ বর্ষণ হচ্ছিল, ততক্ষণ আমাদের হুশিয়ার করে বলা হলো, ঘরের ভেতরে থাকুন, সাবধানে থাকুন, বহির্বিশ্ব থেকে আসা বস্তু স্পর্শ করবেন না। কিন্তু ঘটনাটা এমন চট করে ঘটে গেল যে, আমাদের অনেকেরই জামা আর মাথার চুলে হলুদ ধূলার আস্তরণ। এই সতর্কবার্তার পরপরই এলো একটি সতর্ক আশ্বাসবাণী : প্রাথমিক পরীক্ষায় ক্ষতিকর কিছু ধরা পড়েনি, যদিও এই হলুদ ধূলার প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যায়নি কিছু। যেসব প্রাণী এই ধূলা খেয়েছে, তাদের শরীরে দেখা দেয়নি কোনো উপসর্গ। আমাদের আহ্বান জানালো হলো, আমরা যেন এই ধূলা এড়িয়ে চলি এবং আরো পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করি। ইত্যবসরে এ ধূলা আমাদের আমাদের বাগানে, সাইডওয়াকে, সিড়ির গোড়ায় পড়ে থাকলো, আমাদের মেপল গাছ আর টেলিফোন পোল আবৃত করে রাখলো এই ধূলা। সকালে ঘুম ভেঙে প্রথম তুষারপাত দেখার মতো মনে হলো। নিজ নিজ পোর্চে দাঁড়িয়ে আমরা দেখলাম, তিন-চাকার সুইপারগুলো আমাদের রাস্তায় ধীর গতিতে চলছে, বড় বড় হপার লাগানো এক একটার সাথে। হোস পাইপে পানির ঝাপটা দিয়ে আমরা আমাদের বাগানের ঘাস, সুড়িপথ, পোর্চে রাখা আসবাবপত্রের ধূলা পরিষ্কার করলাম। আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, অপেক্ষা করতে থাকলাম নিউজের জন্য—ইতিমধ্যে আমরা খবর পাচ্ছিলাম, এই ধূলা আসলে এককোষী জীব—আর এই খবরে আমরা আমাদের উপচে পড়া হতাশা টের পাচ্ছিলাম।
আমরা চেয়েছিলাম, আমরা চেয়েছিলাম—ওহ, কে জানে আমরা আসলে ঠিক কী চেয়েছিলাম? আমরা চেয়েছিলাম রক্তারক্তি, পিষে ফেলা হাড়, যন্ত্রণায় কাতরানি। আমরা চেয়েছিলাম রাস্তায় রাস্তায় ধসে পড়বে ভবন, আগুনের হল্কায় ছিটকে উঠবে গাড়ি। আমরা চেয়েছিলাম আমাদেরই দানবীয় কোনো সংস্করণ, বিশাল মাথা, কাঠির মতো চিকণ গলা, নির্দয় মসৃণ রোবটিক বাহু যার মধ্য দিয়ে বের হবে মারণরশ্মি। আমরা চেয়েছিলাম মহাবিশ্বের বনেদী কোনো প্রভু, দয়ার্দ্র চোখ, যারা এক নতুন যুগের সূচনা ঘটাবে পৃথিবীতে। আমরা চেয়েছিলাম আতঙ্ক ও উল্লাস—এই হলুদ ধূলিকণা বাদে অন্য যে কোনো কিছু। এটাকে কি আগ্রাসন বলার যো আছে? আরো পরে, বিকেলবেলা আমরা জানতে পেলাম বিজ্ঞানীরা সবাই একমত হয়েছেন যে, এই ধূলা আসলে জীবন্ত কিছু। এগুলোর নমুনা বোস্টন, শিকাগো, ওয়াশিংটন ডিসিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এককোষী এই জীবগুলো আপাতদৃষ্টিতে নিরুপদ্রব মনে হচ্ছে, যদিও আমাদের সাবধান করে দেওয়া হলো কোনোকিছু স্পর্শ না করতে, জানালা বন্ধ রাখতে আর হাত ধুয়ে রাখতে। কোষগুলো একটা থেকে দুটা, দুটা থেকে চারটা—এভাবে বাইনারি ফিশনে বংশবৃদ্ধি করছে। নিজেদের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া এরা আর কিছু করছে না।
সকালে হলুদ ধূলায় ছেয়ে যাওয়া এক পৃথিবীতে আমাদের ঘুম ভাঙলো। আমাদের বাগানের বেড়া, টেলিফোন খুঁটির আড়কাঠে ধূলার আস্তরণ। হলুদ হয়ে যাওয়া রাস্তায় গাড়ির টায়ারের কালো দাগ। পাখিরা ডানা ঝাপটে হলুদ গুড়ো ছড়াচ্ছে বাতাসে। আবার এলো ঝাড়ুদার গাড়ি, সুড়িপথ আর বাগানে আবার হোসপাইপের পানির তোড়, হলুদ কুয়াশা উড়িয়ে নিচের কালো আর সবুজকে উঁকি দেওয়ানোর ব্যবস্থা করা গেল। কিন্তু ঘণ্টা না পেরোতেই সুড়িপথ আর বাগান আবার হলুদ মাঠ। ইলেকট্রিক আর টেলিফোন তার যেখানে ছিল, সেখানে এখন হলুদ হলুদ রেখা।
নিউজে জানানো হলো, এককোষী অণুজীবগুলো রড আকৃতির এবং সালোক-সংশ্লেষণের মাধ্যমে তারা নিজেদের পুষ্টি যোগায়। একটা একক কোষকে কোনো আলোকিত টেস্টটিউবে রাখলে এটা এতো দ্রুতগতিতে বংশবৃদ্ধি করে যে, প্রায় চল্লিশ মিনিটে পুরো টিউব ভরে যায়। উজ্জ্বল আলোয় ছয় ঘণ্টায় ভরে যায় পুরো একটা কক্ষ। আমাদের জৈব-শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতিতে এসব জীব কোথাও খাপ খায় না, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নীলচে-সবুজ শৈবালের সঙ্গে এদের কিছু মিল পাওয়া যায়। এরা মানুষ বা কোনো প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর—এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আমরা আক্রান্ত হয়েছি এক “নাস্তি” দিয়ে, এক শূন্যতা দিয়ে, জীবন্ত ধূলিকণা দিয়ে। শুধু দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারা ছাড়া আগ্রাসনকারীর আর কোনো স্বভাব আছে বলে মনে হচ্ছে না। এই আগ্রাসনকারী আমাদের ঘৃণা করে না। আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার বাসনা এদের নেই। নেই আমাদের পদানত করা বা অপমান করার খায়েশ। আমাদেরকে কোনো বিপদ থেকে রক্ষা করা বা আমাদের উদ্ধার করা, অথবা আমাদের অনন্ত জীবনের রহস্য শেখানোর কোনো ইচ্ছাও নেই এদের। এদের শুধু একটাই ইচ্ছা, নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে যাওয়া। এই আদিম আগন্তুকের বিস্তার সীমিত করে দেওয়া হয়তো সম্ভব, হয়তো সম্ভব এদেরকে ঝাড়েবংশে নির্মূল করে দেওয়া; আবার হতে পারে আমরা ব্যর্থ হবো, আর আমাদের শহরগুলো ধীরে ধীরে ডুবে যাবে এই সর্বনাশা ধূলার স্তুপের নিচে। দিনে দিনে যতোই খবর শুনছি, ততোই আমাদের মধ্যে এই অনুভূতি জেগে উঠছে যে, আমাদের প্রাপ্য ছিল অন্যকিছু, আরো ভারি কিছু, আরো জাঁকালো কিছু, আরো রোমাঞ্চকর কিছু, এমন কিছু যা শোরগোলময় অথবা ধুন্দুমার, এমন কিছু যা নিজেকে একটি আত্মপ্রকাশ বা নিয়তি হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে। মনে মনে আমরা কল্পনা করেছি, একটা কাঁৎ হয়ে থাকা স্পেসশিপের চারপাশে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, অপেক্ষা করছি দরজা খুলে যাওয়ার। আমরা কল্পনা করেছি, আমাদের শিশুদের আমরা রক্ষা করার চেষ্টা করছি, আর তা করতে গিয়ে সেলারের ভাঙা জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া শুড় কোপ বসিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে দিচ্ছি। কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই হয়নি, তার বদলে আমরা এখন আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছি, পানি ছিটিয়ে সাফসুতরো করছি আমাদের পোর্চ, জুতা আর মোজা ঝাঁকিয়ে ধুলো ঝাড়ছি। আগ্রাসনকারীরা ঢুকে পড়েছে আমাদের বাড়ির ভিতর। জানালার শার্সি বন্ধ, পর্দা টেনে দেওয়া, কিন্তু তবু টেবিলে, জানালা-চত্বরে পুরু ধূলোর আস্তরণ। আমাদের ফ্ল্যাট-স্ক্রিন টেলিভিশনের গায়ে, আমাদের শেলফে পুরে রাখা ডিভিডির চিকণ পিঠে শুয়ে আছে ধূলা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে যতদূর চোখ যায়, ধূলায় ঢাকা পড়েছে সবকিছু, উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো ধূলার আস্তরণ। আমরা একেবারে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি এই আস্তরণ ক্রমশ ফুলে উঠছে, পাউরুটির মতো। এখানে-সেখানে রোদ ঠিকরে পড়লে ঠিক যেন গমক্ষেতের মতো লাগে।
সত্যি খুব শান্তিপূর্ণ উপায়ে ঘটনাটা ঘটছে, নিজের মতো করে।
দুপুর ১টার আগে আগে আকাশে কিছু একটার আবির্ভাব ঘটলো। আমাদের অনেকে তখনও লাঞ্চ করছি, বাকিরা ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে, রাস্তায় বা ফুটপাথে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি আকাশপানে। চিৎকার, হৈ-চৈ, বাতাসে হাত ছোড়া, এ ওকে দেখাচ্ছে, ও তাকে। আর সত্যি সত্যি, কিছু একটা জ্বলজ্বল করছে, উপরে আকাশে, কিছু একটা কাঁপছে তিরতির করে গ্রীষ্মের নীল বাতাসে—জিনিসটা যাই হোক না কেন, আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। অফিসের সেক্রেটারিরা ছুটে গেল জানালার কাছে, দোকানিরা ক্যাশ রেজিস্টার ফেলে রেখে ছুটল দরজার বাইরে, কমলা রঙা শক্ত টুপি পড়া সড়ক শ্রমিকরা অ্যাসফল্ট থেকে মাথা তুলে চোখ ঢেকে তাকিয়ে থাকল ওপরের দিকে। এই দূরবর্তী আভা, এই চিকচিক করা বিন্দুটি সম্ভবত তিন কি চার মিনিট একভাবে ছিল। তারপর এটা বড় হতে থাকলো, হতে হতে একটা আধুলির সমান আকৃতি নিলো। হঠাৎ গোটা আকাশটা, মনে হলো, ভরে গেছে সোনালী বিন্দুতে। তারপর সেগুলো সোজা আমাদের ওপর ঝরে পড়তো থাকলো, মিহি রেণুর মতো, হলুদ ধূলিকণার মতো। আমাদের ঢালু ছাদে এগুলো পড়ে থাকলো, উড়ে এসে পড়তে থাকলো রাস্তার ফুটপাথে, আমাদের জামার হাতা, গাড়ির ছাদ ভরে গেল ধূলায়। আমরা বুঝতে পারছিলাম না, এগুলোকে কী বলবো।
প্রায় তের মিনিট ধরে নেমে আসতে থাকলো এই হলুদ ধূলা। এই সময়টা জুড়ে আকাশ দেখা যাচ্ছিল না। তারপর শেষ হলো এই বর্ষণ। রোদ উঠল, আকাশ আবার নীল। যতক্ষণ বর্ষণ হচ্ছিল, ততক্ষণ আমাদের হুশিয়ার করে বলা হলো, ঘরের ভেতরে থাকুন, সাবধানে থাকুন, বহির্বিশ্ব থেকে আসা বস্তু স্পর্শ করবেন না। কিন্তু ঘটনাটা এমন চট করে ঘটে গেল যে, আমাদের অনেকেরই জামা আর মাথার চুলে হলুদ ধূলার আস্তরণ। এই সতর্কবার্তার পরপরই এলো একটি সতর্ক আশ্বাসবাণী : প্রাথমিক পরীক্ষায় ক্ষতিকর কিছু ধরা পড়েনি, যদিও এই হলুদ ধূলার প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যায়নি কিছু। যেসব প্রাণী এই ধূলা খেয়েছে, তাদের শরীরে দেখা দেয়নি কোনো উপসর্গ। আমাদের আহ্বান জানালো হলো, আমরা যেন এই ধূলা এড়িয়ে চলি এবং আরো পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করি। ইত্যবসরে এ ধূলা আমাদের আমাদের বাগানে, সাইডওয়াকে, সিড়ির গোড়ায় পড়ে থাকলো, আমাদের মেপল গাছ আর টেলিফোন পোল আবৃত করে রাখলো এই ধূলা। সকালে ঘুম ভেঙে প্রথম তুষারপাত দেখার মতো মনে হলো। নিজ নিজ পোর্চে দাঁড়িয়ে আমরা দেখলাম, তিন-চাকার সুইপারগুলো আমাদের রাস্তায় ধীর গতিতে চলছে, বড় বড় হপার লাগানো এক একটার সাথে। হোস পাইপে পানির ঝাপটা দিয়ে আমরা আমাদের বাগানের ঘাস, সুড়িপথ, পোর্চে রাখা আসবাবপত্রের ধূলা পরিষ্কার করলাম। আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, অপেক্ষা করতে থাকলাম নিউজের জন্য—ইতিমধ্যে আমরা খবর পাচ্ছিলাম, এই ধূলা আসলে এককোষী জীব—আর এই খবরে আমরা আমাদের উপচে পড়া হতাশা টের পাচ্ছিলাম।
আমরা চেয়েছিলাম, আমরা চেয়েছিলাম—ওহ, কে জানে আমরা আসলে ঠিক কী চেয়েছিলাম? আমরা চেয়েছিলাম রক্তারক্তি, পিষে ফেলা হাড়, যন্ত্রণায় কাতরানি। আমরা চেয়েছিলাম রাস্তায় রাস্তায় ধসে পড়বে ভবন, আগুনের হল্কায় ছিটকে উঠবে গাড়ি। আমরা চেয়েছিলাম আমাদেরই দানবীয় কোনো সংস্করণ, বিশাল মাথা, কাঠির মতো চিকণ গলা, নির্দয় মসৃণ রোবটিক বাহু যার মধ্য দিয়ে বের হবে মারণরশ্মি। আমরা চেয়েছিলাম মহাবিশ্বের বনেদী কোনো প্রভু, দয়ার্দ্র চোখ, যারা এক নতুন যুগের সূচনা ঘটাবে পৃথিবীতে। আমরা চেয়েছিলাম আতঙ্ক ও উল্লাস—এই হলুদ ধূলিকণা বাদে অন্য যে কোনো কিছু। এটাকে কি আগ্রাসন বলার যো আছে? আরো পরে, বিকেলবেলা আমরা জানতে পেলাম বিজ্ঞানীরা সবাই একমত হয়েছেন যে, এই ধূলা আসলে জীবন্ত কিছু। এগুলোর নমুনা বোস্টন, শিকাগো, ওয়াশিংটন ডিসিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এককোষী এই জীবগুলো আপাতদৃষ্টিতে নিরুপদ্রব মনে হচ্ছে, যদিও আমাদের সাবধান করে দেওয়া হলো কোনোকিছু স্পর্শ না করতে, জানালা বন্ধ রাখতে আর হাত ধুয়ে রাখতে। কোষগুলো একটা থেকে দুটা, দুটা থেকে চারটা—এভাবে বাইনারি ফিশনে বংশবৃদ্ধি করছে। নিজেদের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া এরা আর কিছু করছে না।
সকালে হলুদ ধূলায় ছেয়ে যাওয়া এক পৃথিবীতে আমাদের ঘুম ভাঙলো। আমাদের বাগানের বেড়া, টেলিফোন খুঁটির আড়কাঠে ধূলার আস্তরণ। হলুদ হয়ে যাওয়া রাস্তায় গাড়ির টায়ারের কালো দাগ। পাখিরা ডানা ঝাপটে হলুদ গুড়ো ছড়াচ্ছে বাতাসে। আবার এলো ঝাড়ুদার গাড়ি, সুড়িপথ আর বাগানে আবার হোসপাইপের পানির তোড়, হলুদ কুয়াশা উড়িয়ে নিচের কালো আর সবুজকে উঁকি দেওয়ানোর ব্যবস্থা করা গেল। কিন্তু ঘণ্টা না পেরোতেই সুড়িপথ আর বাগান আবার হলুদ মাঠ। ইলেকট্রিক আর টেলিফোন তার যেখানে ছিল, সেখানে এখন হলুদ হলুদ রেখা।
নিউজে জানানো হলো, এককোষী অণুজীবগুলো রড আকৃতির এবং সালোক-সংশ্লেষণের মাধ্যমে তারা নিজেদের পুষ্টি যোগায়। একটা একক কোষকে কোনো আলোকিত টেস্টটিউবে রাখলে এটা এতো দ্রুতগতিতে বংশবৃদ্ধি করে যে, প্রায় চল্লিশ মিনিটে পুরো টিউব ভরে যায়। উজ্জ্বল আলোয় ছয় ঘণ্টায় ভরে যায় পুরো একটা কক্ষ। আমাদের জৈব-শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতিতে এসব জীব কোথাও খাপ খায় না, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নীলচে-সবুজ শৈবালের সঙ্গে এদের কিছু মিল পাওয়া যায়। এরা মানুষ বা কোনো প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর—এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আমরা আক্রান্ত হয়েছি এক “নাস্তি” দিয়ে, এক শূন্যতা দিয়ে, জীবন্ত ধূলিকণা দিয়ে। শুধু দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারা ছাড়া আগ্রাসনকারীর আর কোনো স্বভাব আছে বলে মনে হচ্ছে না। এই আগ্রাসনকারী আমাদের ঘৃণা করে না। আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার বাসনা এদের নেই। নেই আমাদের পদানত করা বা অপমান করার খায়েশ। আমাদেরকে কোনো বিপদ থেকে রক্ষা করা বা আমাদের উদ্ধার করা, অথবা আমাদের অনন্ত জীবনের রহস্য শেখানোর কোনো ইচ্ছাও নেই এদের। এদের শুধু একটাই ইচ্ছা, নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে যাওয়া। এই আদিম আগন্তুকের বিস্তার সীমিত করে দেওয়া হয়তো সম্ভব, হয়তো সম্ভব এদেরকে ঝাড়েবংশে নির্মূল করে দেওয়া; আবার হতে পারে আমরা ব্যর্থ হবো, আর আমাদের শহরগুলো ধীরে ধীরে ডুবে যাবে এই সর্বনাশা ধূলার স্তুপের নিচে। দিনে দিনে যতোই খবর শুনছি, ততোই আমাদের মধ্যে এই অনুভূতি জেগে উঠছে যে, আমাদের প্রাপ্য ছিল অন্যকিছু, আরো ভারি কিছু, আরো জাঁকালো কিছু, আরো রোমাঞ্চকর কিছু, এমন কিছু যা শোরগোলময় অথবা ধুন্দুমার, এমন কিছু যা নিজেকে একটি আত্মপ্রকাশ বা নিয়তি হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে। মনে মনে আমরা কল্পনা করেছি, একটা কাঁৎ হয়ে থাকা স্পেসশিপের চারপাশে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, অপেক্ষা করছি দরজা খুলে যাওয়ার। আমরা কল্পনা করেছি, আমাদের শিশুদের আমরা রক্ষা করার চেষ্টা করছি, আর তা করতে গিয়ে সেলারের ভাঙা জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া শুড় কোপ বসিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে দিচ্ছি। কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই হয়নি, তার বদলে আমরা এখন আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছি, পানি ছিটিয়ে সাফসুতরো করছি আমাদের পোর্চ, জুতা আর মোজা ঝাঁকিয়ে ধুলো ঝাড়ছি। আগ্রাসনকারীরা ঢুকে পড়েছে আমাদের বাড়ির ভিতর। জানালার শার্সি বন্ধ, পর্দা টেনে দেওয়া, কিন্তু তবু টেবিলে, জানালা-চত্বরে পুরু ধূলোর আস্তরণ। আমাদের ফ্ল্যাট-স্ক্রিন টেলিভিশনের গায়ে, আমাদের শেলফে পুরে রাখা ডিভিডির চিকণ পিঠে শুয়ে আছে ধূলা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে যতদূর চোখ যায়, ধূলায় ঢাকা পড়েছে সবকিছু, উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো ধূলার আস্তরণ। আমরা একেবারে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি এই আস্তরণ ক্রমশ ফুলে উঠছে, পাউরুটির মতো। এখানে-সেখানে রোদ ঠিকরে পড়লে ঠিক যেন গমক্ষেতের মতো লাগে।
সত্যি খুব শান্তিপূর্ণ উপায়ে ঘটনাটা ঘটছে, নিজের মতো করে।
====================
আমেরিকান ঔপন্যাসিক স্টিভেন মিলহসার
আমেরিকান ঔপন্যাসিক স্টিভেন মিলহসার
আমেরিকান ঔপন্যাসিক স্টিভেন মিলহসারের (Steven Millhauser) জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩ আগস্ট। তাঁর গল্প বলার ঢঙে অ্যাডগার অ্যালান পো এবং হোর্হে লুইস বোর্হেসের ছায়া অনেকে খুঁজে পান। ভ্লাদিমির নবোকভের ছাপও বেশ দৃষ্টিগ্রাহ্য। মার্টিন ড্রেসলার উপন্যাসের জন্য ১৯৯৭ সালে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পান।
('বহির্জাগতিক আক্রমণ') ‘আইজেনহেইম দ্য ইলিউশনিস্ট’ নামে তাঁর একটি ছোটগল্প অবলম্বনে জনপ্রিয় হলিউডি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, যেটির নাম দ্য ইলিউশনিস্ট। ‘বহির্জাগতিক আক্রমণ’ গল্পটি নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনের ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সংখ্যা থেকে নেওয়া। মূল গল্পটির নাম ‘The Invasion From Outer Space’।
bdnews24 এর সৌজন্যে
অনুবাদ: শিবব্রত বর্মন
এই গল্পটি পড়া হয়েছে....
অনুবাদ: শিবব্রত বর্মন
এই গল্পটি পড়া হয়েছে....
No comments