হারুকি মুরাকামির গল্প 'নিখুঁত মেয়েটির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর'
এপ্রিলের এক অপরূপ সকালে, টোকিওর কেতাদুরস্ত হারাজুকু এলাকার সংকীর্ণ রাস্তায় আমি মুখোমুখি হেঁটে গেলাম আমার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়েটির সামনে দিয়ে।
সত্যি কথা বলতে কী, সে যে দেখতে খুব সুন্দর তা নয়। ভিড়ের মধ্যে তাকে আলাদা করা যাবে না। এমন বিশেষ চমকদার পোশাকও পরেনি সে। ঘুম ভেঙে এইমাত্র উঠে আসার কারণে অপরিপাটি পেছনের চুল। বয়সও খুব কম নয় — তিরিশের কাছাকাছি হবে। সেভাবে বললে, তাকে ‘মেয়ে’ই বলা চলে না। তবু পঞ্চাশ গজ দূর থেকেও আমি টের পেলাম: সে আমার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে। তাকে দেখামাত্র আমার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে থাকলো, মরুভূমির মতো শুকিয়ে গেল জিহ্বা।
আপনাদের হয়তো নিজ নিজ প্রিয় ধাঁচের মেয়ে আছে — কারো বা হয়তো, ধরা যাক, চিকন হাঁটুর মেয়ে পছন্দ, কারো বড় বড় চোখের, কারো বা কোমনীয় আঙুলের, অথবা আপনি হয়তো তেমন কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াই কোনো মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। আমার নিজেরও কিছু বিশেষ পছন্দ-অপছন্দ আছে। মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টে পাশের টেবিলের কোনো মেয়ের দিকে আমার চোখ আটকে যায় শুধু তার নাকটা আমার ভালো লেগে গেছে বলে।
তবে কেউ জোর গলায় বলতে পারবে না, তার জীবনের ১০০% নিখুঁত মেয়েটি আগে থেকে ঠিক করে রাখা কোনো ধাঁচের। এই যে নাকের ব্যাপারে আমার এতো বাছবিচার, কিন্তু সেই ১০০% নিখুঁত মেয়েটির নাকের আকৃতি আমি মনেই করতে পারছি না — এমনকি তার নাক ছিল কিনা সেটাই আমার মনে নেই। শুধু এটুকু আমি নিশ্চিত মনে করতে পারি যে, সে তেমন একটা সুন্দর ছিল না। অদ্ভুত ব্যাপার।
‘গতকাল রাস্তায় যেতে যেতে ১০০% নিখুঁত মেয়ের দেখা পেয়েছি,’ কোনো এক লোককে বললাম আমি।
লোকটা বলল, ‘তাই নাকি? খুব সুন্দর দেখতে?’
‘না তেমন একটা নয়।’
‘তাহলে তোমার পছন্দের ধাঁচের, তাই না?’
‘জানি না। তার কোনো কিছুই মনে নাই — চোখ বা বুকের আকার।’
‘অদ্ভুত।’
‘হ্যাঁ। অদ্ভুত।’
বিরক্ত হয়ে লোকটা বলে, ‘তা, তুমি কী করলা? কথা বললা? পিছন পিছন গেলা?’
‘নাহ। শুধু রাস্তায় পাশ কাটিয়ে গেলাম।’
মেয়েটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে হেঁটে যাচ্ছে, আমি যাচ্ছি পশ্চিম থেকে পূবে। এপ্রিলের অপূর্ব এক সকাল।
ইস্, যদি কথা বলতে পারি মেয়েটার সাথে। আধা ঘণ্টা কথা বলতে পারলেই হয়ে যায়: মেয়েটাকে শুধু তার নিজের সম্পর্কে বলতে বলবো, আমার সম্পর্কেও অনেক কিছু বলবো তাকে, আর তাকে বলবো — বলতে পারলে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগবে — ১৯৮১ সালের এপ্রিলের এক অপূর্ব সকালে হারাজুকু এলাকার এক সরু রাস্তায় আমাদের এভাবে মুখোমুখি হেঁটে যাওয়ার ঘটনাটি ঘটনোর পেছনে ভাগ্যের কী যে জটিল এক ষড়যন্ত্র কাজ করছে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই বহু গোপন ব্যাপার ঠাসা আছে, শান্তির সময়ে বানানো একটা প্রাচীন ঘড়ির মতো।
রাস্তায় কথা বলার পর আমরা হয়তো কোথাও লাঞ্চ করতে বসবো, হয়তো উডি অ্যালানের কোনো সিনেমা দেখবো, ককটেল খেতে কোনো হোটেল বারে গিয়ে বসবো। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে, ব্যাপারটা হয়তো বিছানা পর্যন্ত গড়াবে।
একের পর এক সম্ভাবনা আমার মনের দরজায় কড়া নাড়ছে।
আমাদের দুজনের মধ্যেকার দূরত্ব এবার পঞ্চাশ গজে কমে এসেছে।
কীভাবে শুরু করবো? কী বলবো?
‘গুড মর্নিং, মিস। আপনার সাথে একটু কথা বলতাম, এই আধা ঘণ্টার মতো। সময় হবে কি?’
হাস্যকর। ইন্সুরেন্সের দালালের মতো শোনাবে।
‘মাপ করবেন, এখানে আশপাশে সারারাত খোলা থাকে এমন ধোপার দোকান আছে নাকি, বলতে পারেন?’
না, এটাও সমান হাস্যকর। প্রথম কথা হলো, আমার হাতে ময়লা কাপড়ের গাট্টি নেই। এরকম একটা বাক্য কার বিশ্বাস হবে?
হয়তো সহজ সত্য কথাটা বলে দিলেই কাজ হয়ে যাবে। ‘গুড মর্নিং, আপনি আমার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে।’
না, সে এই কথা বিশ্বাস করবে না। কিংবা বিশ্বাস যদি করেও, আমার সাথে হয়তো কথা বলতে চাইবে না। স্যরি, সে হয়তে বলবে, আপনার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে আমি হলে হতেও পারি, কিন্তু আপনি আমার জন্য ১০০% নিখুঁত ছেলে নন। এমনটা হতেই পারে। আর যদি এই পরিস্থিতি হয়, আমি সম্ভবত খানখান হয়ে যাবো। এ আঘাত আমার পক্ষে আর কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। আমার বয়স এখন বত্রিশ, আর বয়স বাড়লে এরকম আঘাত সামলানো দায় হয়ে যায়।
একটা ফুলের দোকানের সামনে আমরা একে অপরকে পেরিয়ে গেলাম। একটা মৃদু, উষ্ণ বাতাসের ঝাপটা আমাকে ছুঁয়ে গেল। রাস্তার এসফল্ট স্যাঁতস্যাতে, আর আমার নাকে এসে লাগলো গোলাপের গন্ধ। তার সাথে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব না। মেয়েটা একটা সাদা সোয়েটার পরেছে, আর তার ডান হাতে একটা ধবধবে সাদা খাম ধরা, খামে একটা ডাকটিকেট লাগানো। সে তাহলে কাউকে চিঠি লিখেছে, হয়তো সারা রাত জেগে চিঠিটা লিখেছে সে, তার ঘুমঘুম চোখ দেখে এমনটা অনুমান করাই যায়। ওই খামের ভিতর হয়তো তার জীবনের সব গোপন কথা লেখা আছে।
আমি আরো কয়েক কদম এগিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম: মেয়েটা ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
* * *
এখন আমি নিশ্চিত করে জানি, ঠিক কোন কথাটা বলা যেতো মেয়েটাকে। সেটা একটা লম্বা বক্তৃতাই হয়ে যেত, এত লম্বা যে, আমি ঠিকঠাক মতো বলতে পারতাম কিনা, কে জানে। আমার মাথায় যেসব বুদ্ধি আসে, কোনোটাই খুব বাস্তববাদী হয় না।
সে যাই হোক। আমি শুরু করতে পারতাম, ‘এক যে ছিল,’ দিয়ে, আর শেষ করতাম,‘বড় করুণ কাহিনি, তাই না?’ দিয়ে।
* * *
এক যে ছিল ছেলে, আর এক যে ছিল মেয়ে। ছেলেটার বয়স ছিল আঠার আর মেয়েটার ষোল। ছেলেটা দেখতে এমন কোনো রাজপুত্তুর ছিল না, আর মেয়েটাও ছিল না তেমন বলার মতো সুন্দর। আর দশজনের মতো তারা ছিল কেবলই সাধারণ নিঃসঙ্গ এক ছেলে আর সাধারণ নিঃসঙ্গ এক মেয়ে। তবে তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো যে, পৃথিবীতে কোথাও তার জন্য ১০০% নিখুঁত একটা ছেলে আর ১০০% নিখুঁত একটা মেয়ে আছে। হ্যাঁ, তারা বিশ্বাস করতো একদিন অলৌকিক একটা কিছু ঘটবে। আর সেই অলৌকিক ঘটনাটা সত্যি সত্যি ঘটেছিল।
একদিন একটা রাস্তার কোণায় তাদের একে অপরের দেখা হয়ে গেল।
‘অবিশ্বাস্য ঘটনা,’ ছেলেটা বলল। ‘আমি সারা জীবন ধরে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু তুমি হচ্ছো আমার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে।‘
‘আর তুমি,’ মেয়েটি বলল ছেলেটিকে, ‘তুমি হচ্ছো আমার জন্য ১০০% নিখুঁত ছেলে। তোমাকে যে-যে ভাবে কল্পনা করেছিলাম, তুমি ঠিক ঠিক তাই। এ যে একেবারে স্বপ্ন।’
তারা একটা পার্কের বেঞ্চে বসলো, হাতে হাত ধরে। আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা একে অপরকে তাদের নিজ নিজ কাহিনি বললো। এখন তারা আর নিঃসঙ্গ নয়। তারা একে অপরের ১০০% নিখুঁত অপরকে খুঁজে পেয়েছে। ১০০% নিখুঁত অপরকে আবিষ্কার করা এবং নিজে তার দ্বারা আবিষ্কৃত হওয়া কী বিস্ময়করই না এক ব্যাপার। এ এক দৈব ঘটনা, মহাজাগতিক দৈব।
তারা যখন বসে কথা বলছিল, তখন ক্ষীণ এক চিলতে সন্দেহের রেখা তাদের মনে আসন গেড়ে বসলো। এতো সহজে কারো স্বপ্ন সত্যি হয়ে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে?
আর তাই, তাদের দুজনের কথা মধ্যে যখন মুহূর্তের নীরবতা নেমে এসেছে, ছেলেটা মেয়েটাকে বললো, ‘চলো নিজেদের পরীক্ষা করি — শুধু একবারের জন্য। আমরা যদি সত্যি সত্যি একে অন্যের ১০০% নিখুঁত মনের মানুষ হই, তাহলে অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে আমাদের আবার দেখা হবে। হবেই। যখন সেটা ঘটবে, আমরা সেবারও জেনে যাবো যে, আমরা একে অপরেরর ১০০% নিখুঁত জুটি, আর তক্ষুণি আমরা বিয়ে করবো। তোমার কী মত?’
‘হ্যাঁ,’ মেয়েটি বললো, ‘ঠিক তাই করা উচিৎ আমাদের।’
আর তারা আলাদা হয়ে গেল। মেয়েটা গেল পুব দিকে, ছেলেটা পশ্চিমে।
নিজেদের ওরকম একটা পরীক্ষার মুখে ঠেলে দেওয়ার তাদের কোনোই প্রয়োজন ছিল না। এরকম একটা পরীক্ষায় নিজেদের দাঁড় করানো তাদের উচিৎই হয়নি, কেননা তারা আসলেই ছিল একে অপরের ১০০% নিখুঁত জুটি, আর তাদের যে দেখা হয়ে গেছে, এটাই ছিল একটা দৈব। কিন্তু এটা জানা তো আর তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাদের যে বয়স কম। ভাগ্যের হিমশীতল, অকরুণ ঢেউ এসে তাদের শূন্যে ছুড়ে দিলো বড় নিষ্ঠুরভাবে।
এক শীতের মৌসুমে ছেলে আর মেয়ে দুজনেরই কঠিন ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগে ধরলো, কয়েক সপ্তাহ ধরে জীবন আর মৃত্যুর দোলাচলে দুলতে দুলতে তারা দুজন তাদের দেখা হওয়ার সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলল। যখন তারা জাগলো, তখন তাদের মাথা শিশু ডি এএইচ লরেন্সের পয়সা জমানোর মাটির ব্যাংকটার মতো ফাঁকা হয়ে গেছে।
দুজনেই তারা প্রতিভাবান, শক্ত মনের মানুষ। তাই নিজেদের নিরলস চেষ্টায় তারা আবার সেই জ্ঞান আর অনুভূতি অর্জন করে নিতে পারলো, যার গুণে তারা সমাজের পরিপূর্ণ সদস্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আর ঈশ্বরের কী কৃপা, তারা এমন সুযোগ্য নাগরিক হয়ে উঠলো, যারা জানে এক সাবওয়ে লাইন বদলে কীভাবে আরেক সাবওয়ে লাইনে যেতে হয়, জানে কীভাবে পোস্টাপিসে গিয়ে বিশেষ-ডেলিভারি চিঠি পাঠাতে হয়। আর, কথা হলো, পরবর্তীকালে প্রেমের অভিজ্ঞতাও তাদের হয়েছে, কখনও কখনও ৭৫%, এমনকি কখনও ৮৫% পর্যন্ত প্রেম।
এরপর সময় গড়াতে থাকলো ঝড়ের গতিতে। দেখতে না দেখতে ছেলেটা বত্রিশে পা দিলো, আর মেয়েটা ত্রিশে।
এবং এপ্রিলের এক চমৎকার সকালে দিনের প্রথম কফিটার সন্ধানে ছেলেটা পশ্চিম থেকে পুবে হেঁটে যাচ্ছিল, আর একটা বিশেষ-ডেলিভারি চিঠি পোস্ট করার জন্য ঠিক সেই সময় মেয়েটা হেঁটে যাচ্ছিল পুব থেকে পশ্চিমে। দুজনেই হাঁটছিল টোকিওর হারাজুকু এলাকার একই সংকীর্ণ রাস্তা ধরে। রাস্তাটার ঠিক মাঝখানে তারা একে অপরকে পেরিয়ে গেল। আর তখন তাদের হৃদয়ের কোনো এক কোণায় মুহূর্তের তরে দোলা দিয়ে গেল নিজ নিজ হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির খুবই আবছা এক উদ্ভাস। দুজনেরই বুকের ভেতরটা একটু ধুকপুক করে উঠলো। আর তারা বুঝতে পারলো:
এই হলো আমার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে।
এই হলো আমার জন্য ১০০% নিখুঁত ছেলে।
কিন্তু তাদের স্মৃতির সেই আভা বড়ই আবছা। আর তাদের চিন্তায়ও চৌদ্দ বছর আগের সেই টলটলে ভাব ক্ষয়ে গেছে। তাই কোনো কথা না বলে তারা একে অপরকে পেরিয়ে গেল, মিশে গেল ভিড়ের মধ্যে। চিরকালের জন্যে।
খুব করুণ গল্প, তাই না?
সত্যি কথা বলতে কী, সে যে দেখতে খুব সুন্দর তা নয়। ভিড়ের মধ্যে তাকে আলাদা করা যাবে না। এমন বিশেষ চমকদার পোশাকও পরেনি সে। ঘুম ভেঙে এইমাত্র উঠে আসার কারণে অপরিপাটি পেছনের চুল। বয়সও খুব কম নয় — তিরিশের কাছাকাছি হবে। সেভাবে বললে, তাকে ‘মেয়ে’ই বলা চলে না। তবু পঞ্চাশ গজ দূর থেকেও আমি টের পেলাম: সে আমার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে। তাকে দেখামাত্র আমার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে থাকলো, মরুভূমির মতো শুকিয়ে গেল জিহ্বা।
আপনাদের হয়তো নিজ নিজ প্রিয় ধাঁচের মেয়ে আছে — কারো বা হয়তো, ধরা যাক, চিকন হাঁটুর মেয়ে পছন্দ, কারো বড় বড় চোখের, কারো বা কোমনীয় আঙুলের, অথবা আপনি হয়তো তেমন কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াই কোনো মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। আমার নিজেরও কিছু বিশেষ পছন্দ-অপছন্দ আছে। মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টে পাশের টেবিলের কোনো মেয়ের দিকে আমার চোখ আটকে যায় শুধু তার নাকটা আমার ভালো লেগে গেছে বলে।
তবে কেউ জোর গলায় বলতে পারবে না, তার জীবনের ১০০% নিখুঁত মেয়েটি আগে থেকে ঠিক করে রাখা কোনো ধাঁচের। এই যে নাকের ব্যাপারে আমার এতো বাছবিচার, কিন্তু সেই ১০০% নিখুঁত মেয়েটির নাকের আকৃতি আমি মনেই করতে পারছি না — এমনকি তার নাক ছিল কিনা সেটাই আমার মনে নেই। শুধু এটুকু আমি নিশ্চিত মনে করতে পারি যে, সে তেমন একটা সুন্দর ছিল না। অদ্ভুত ব্যাপার।
‘গতকাল রাস্তায় যেতে যেতে ১০০% নিখুঁত মেয়ের দেখা পেয়েছি,’ কোনো এক লোককে বললাম আমি।
লোকটা বলল, ‘তাই নাকি? খুব সুন্দর দেখতে?’
‘না তেমন একটা নয়।’
‘তাহলে তোমার পছন্দের ধাঁচের, তাই না?’
‘জানি না। তার কোনো কিছুই মনে নাই — চোখ বা বুকের আকার।’
‘অদ্ভুত।’
‘হ্যাঁ। অদ্ভুত।’
বিরক্ত হয়ে লোকটা বলে, ‘তা, তুমি কী করলা? কথা বললা? পিছন পিছন গেলা?’
‘নাহ। শুধু রাস্তায় পাশ কাটিয়ে গেলাম।’
মেয়েটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে হেঁটে যাচ্ছে, আমি যাচ্ছি পশ্চিম থেকে পূবে। এপ্রিলের অপূর্ব এক সকাল।
ইস্, যদি কথা বলতে পারি মেয়েটার সাথে। আধা ঘণ্টা কথা বলতে পারলেই হয়ে যায়: মেয়েটাকে শুধু তার নিজের সম্পর্কে বলতে বলবো, আমার সম্পর্কেও অনেক কিছু বলবো তাকে, আর তাকে বলবো — বলতে পারলে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগবে — ১৯৮১ সালের এপ্রিলের এক অপূর্ব সকালে হারাজুকু এলাকার এক সরু রাস্তায় আমাদের এভাবে মুখোমুখি হেঁটে যাওয়ার ঘটনাটি ঘটনোর পেছনে ভাগ্যের কী যে জটিল এক ষড়যন্ত্র কাজ করছে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই বহু গোপন ব্যাপার ঠাসা আছে, শান্তির সময়ে বানানো একটা প্রাচীন ঘড়ির মতো।
রাস্তায় কথা বলার পর আমরা হয়তো কোথাও লাঞ্চ করতে বসবো, হয়তো উডি অ্যালানের কোনো সিনেমা দেখবো, ককটেল খেতে কোনো হোটেল বারে গিয়ে বসবো। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে, ব্যাপারটা হয়তো বিছানা পর্যন্ত গড়াবে।
একের পর এক সম্ভাবনা আমার মনের দরজায় কড়া নাড়ছে।
আমাদের দুজনের মধ্যেকার দূরত্ব এবার পঞ্চাশ গজে কমে এসেছে।
কীভাবে শুরু করবো? কী বলবো?
‘গুড মর্নিং, মিস। আপনার সাথে একটু কথা বলতাম, এই আধা ঘণ্টার মতো। সময় হবে কি?’
হাস্যকর। ইন্সুরেন্সের দালালের মতো শোনাবে।
‘মাপ করবেন, এখানে আশপাশে সারারাত খোলা থাকে এমন ধোপার দোকান আছে নাকি, বলতে পারেন?’
না, এটাও সমান হাস্যকর। প্রথম কথা হলো, আমার হাতে ময়লা কাপড়ের গাট্টি নেই। এরকম একটা বাক্য কার বিশ্বাস হবে?
হয়তো সহজ সত্য কথাটা বলে দিলেই কাজ হয়ে যাবে। ‘গুড মর্নিং, আপনি আমার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে।’
না, সে এই কথা বিশ্বাস করবে না। কিংবা বিশ্বাস যদি করেও, আমার সাথে হয়তো কথা বলতে চাইবে না। স্যরি, সে হয়তে বলবে, আপনার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে আমি হলে হতেও পারি, কিন্তু আপনি আমার জন্য ১০০% নিখুঁত ছেলে নন। এমনটা হতেই পারে। আর যদি এই পরিস্থিতি হয়, আমি সম্ভবত খানখান হয়ে যাবো। এ আঘাত আমার পক্ষে আর কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। আমার বয়স এখন বত্রিশ, আর বয়স বাড়লে এরকম আঘাত সামলানো দায় হয়ে যায়।
একটা ফুলের দোকানের সামনে আমরা একে অপরকে পেরিয়ে গেলাম। একটা মৃদু, উষ্ণ বাতাসের ঝাপটা আমাকে ছুঁয়ে গেল। রাস্তার এসফল্ট স্যাঁতস্যাতে, আর আমার নাকে এসে লাগলো গোলাপের গন্ধ। তার সাথে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব না। মেয়েটা একটা সাদা সোয়েটার পরেছে, আর তার ডান হাতে একটা ধবধবে সাদা খাম ধরা, খামে একটা ডাকটিকেট লাগানো। সে তাহলে কাউকে চিঠি লিখেছে, হয়তো সারা রাত জেগে চিঠিটা লিখেছে সে, তার ঘুমঘুম চোখ দেখে এমনটা অনুমান করাই যায়। ওই খামের ভিতর হয়তো তার জীবনের সব গোপন কথা লেখা আছে।
আমি আরো কয়েক কদম এগিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম: মেয়েটা ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
* * *
এখন আমি নিশ্চিত করে জানি, ঠিক কোন কথাটা বলা যেতো মেয়েটাকে। সেটা একটা লম্বা বক্তৃতাই হয়ে যেত, এত লম্বা যে, আমি ঠিকঠাক মতো বলতে পারতাম কিনা, কে জানে। আমার মাথায় যেসব বুদ্ধি আসে, কোনোটাই খুব বাস্তববাদী হয় না।
সে যাই হোক। আমি শুরু করতে পারতাম, ‘এক যে ছিল,’ দিয়ে, আর শেষ করতাম,‘বড় করুণ কাহিনি, তাই না?’ দিয়ে।
* * *
এক যে ছিল ছেলে, আর এক যে ছিল মেয়ে। ছেলেটার বয়স ছিল আঠার আর মেয়েটার ষোল। ছেলেটা দেখতে এমন কোনো রাজপুত্তুর ছিল না, আর মেয়েটাও ছিল না তেমন বলার মতো সুন্দর। আর দশজনের মতো তারা ছিল কেবলই সাধারণ নিঃসঙ্গ এক ছেলে আর সাধারণ নিঃসঙ্গ এক মেয়ে। তবে তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো যে, পৃথিবীতে কোথাও তার জন্য ১০০% নিখুঁত একটা ছেলে আর ১০০% নিখুঁত একটা মেয়ে আছে। হ্যাঁ, তারা বিশ্বাস করতো একদিন অলৌকিক একটা কিছু ঘটবে। আর সেই অলৌকিক ঘটনাটা সত্যি সত্যি ঘটেছিল।
একদিন একটা রাস্তার কোণায় তাদের একে অপরের দেখা হয়ে গেল।
‘অবিশ্বাস্য ঘটনা,’ ছেলেটা বলল। ‘আমি সারা জীবন ধরে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু তুমি হচ্ছো আমার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে।‘
‘আর তুমি,’ মেয়েটি বলল ছেলেটিকে, ‘তুমি হচ্ছো আমার জন্য ১০০% নিখুঁত ছেলে। তোমাকে যে-যে ভাবে কল্পনা করেছিলাম, তুমি ঠিক ঠিক তাই। এ যে একেবারে স্বপ্ন।’
তারা একটা পার্কের বেঞ্চে বসলো, হাতে হাত ধরে। আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা একে অপরকে তাদের নিজ নিজ কাহিনি বললো। এখন তারা আর নিঃসঙ্গ নয়। তারা একে অপরের ১০০% নিখুঁত অপরকে খুঁজে পেয়েছে। ১০০% নিখুঁত অপরকে আবিষ্কার করা এবং নিজে তার দ্বারা আবিষ্কৃত হওয়া কী বিস্ময়করই না এক ব্যাপার। এ এক দৈব ঘটনা, মহাজাগতিক দৈব।
তারা যখন বসে কথা বলছিল, তখন ক্ষীণ এক চিলতে সন্দেহের রেখা তাদের মনে আসন গেড়ে বসলো। এতো সহজে কারো স্বপ্ন সত্যি হয়ে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে?
আর তাই, তাদের দুজনের কথা মধ্যে যখন মুহূর্তের নীরবতা নেমে এসেছে, ছেলেটা মেয়েটাকে বললো, ‘চলো নিজেদের পরীক্ষা করি — শুধু একবারের জন্য। আমরা যদি সত্যি সত্যি একে অন্যের ১০০% নিখুঁত মনের মানুষ হই, তাহলে অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে আমাদের আবার দেখা হবে। হবেই। যখন সেটা ঘটবে, আমরা সেবারও জেনে যাবো যে, আমরা একে অপরেরর ১০০% নিখুঁত জুটি, আর তক্ষুণি আমরা বিয়ে করবো। তোমার কী মত?’
‘হ্যাঁ,’ মেয়েটি বললো, ‘ঠিক তাই করা উচিৎ আমাদের।’
আর তারা আলাদা হয়ে গেল। মেয়েটা গেল পুব দিকে, ছেলেটা পশ্চিমে।
নিজেদের ওরকম একটা পরীক্ষার মুখে ঠেলে দেওয়ার তাদের কোনোই প্রয়োজন ছিল না। এরকম একটা পরীক্ষায় নিজেদের দাঁড় করানো তাদের উচিৎই হয়নি, কেননা তারা আসলেই ছিল একে অপরের ১০০% নিখুঁত জুটি, আর তাদের যে দেখা হয়ে গেছে, এটাই ছিল একটা দৈব। কিন্তু এটা জানা তো আর তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাদের যে বয়স কম। ভাগ্যের হিমশীতল, অকরুণ ঢেউ এসে তাদের শূন্যে ছুড়ে দিলো বড় নিষ্ঠুরভাবে।
এক শীতের মৌসুমে ছেলে আর মেয়ে দুজনেরই কঠিন ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগে ধরলো, কয়েক সপ্তাহ ধরে জীবন আর মৃত্যুর দোলাচলে দুলতে দুলতে তারা দুজন তাদের দেখা হওয়ার সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলল। যখন তারা জাগলো, তখন তাদের মাথা শিশু ডি এএইচ লরেন্সের পয়সা জমানোর মাটির ব্যাংকটার মতো ফাঁকা হয়ে গেছে।
দুজনেই তারা প্রতিভাবান, শক্ত মনের মানুষ। তাই নিজেদের নিরলস চেষ্টায় তারা আবার সেই জ্ঞান আর অনুভূতি অর্জন করে নিতে পারলো, যার গুণে তারা সমাজের পরিপূর্ণ সদস্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আর ঈশ্বরের কী কৃপা, তারা এমন সুযোগ্য নাগরিক হয়ে উঠলো, যারা জানে এক সাবওয়ে লাইন বদলে কীভাবে আরেক সাবওয়ে লাইনে যেতে হয়, জানে কীভাবে পোস্টাপিসে গিয়ে বিশেষ-ডেলিভারি চিঠি পাঠাতে হয়। আর, কথা হলো, পরবর্তীকালে প্রেমের অভিজ্ঞতাও তাদের হয়েছে, কখনও কখনও ৭৫%, এমনকি কখনও ৮৫% পর্যন্ত প্রেম।
এরপর সময় গড়াতে থাকলো ঝড়ের গতিতে। দেখতে না দেখতে ছেলেটা বত্রিশে পা দিলো, আর মেয়েটা ত্রিশে।
এবং এপ্রিলের এক চমৎকার সকালে দিনের প্রথম কফিটার সন্ধানে ছেলেটা পশ্চিম থেকে পুবে হেঁটে যাচ্ছিল, আর একটা বিশেষ-ডেলিভারি চিঠি পোস্ট করার জন্য ঠিক সেই সময় মেয়েটা হেঁটে যাচ্ছিল পুব থেকে পশ্চিমে। দুজনেই হাঁটছিল টোকিওর হারাজুকু এলাকার একই সংকীর্ণ রাস্তা ধরে। রাস্তাটার ঠিক মাঝখানে তারা একে অপরকে পেরিয়ে গেল। আর তখন তাদের হৃদয়ের কোনো এক কোণায় মুহূর্তের তরে দোলা দিয়ে গেল নিজ নিজ হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির খুবই আবছা এক উদ্ভাস। দুজনেরই বুকের ভেতরটা একটু ধুকপুক করে উঠলো। আর তারা বুঝতে পারলো:
এই হলো আমার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে।
এই হলো আমার জন্য ১০০% নিখুঁত ছেলে।
কিন্তু তাদের স্মৃতির সেই আভা বড়ই আবছা। আর তাদের চিন্তায়ও চৌদ্দ বছর আগের সেই টলটলে ভাব ক্ষয়ে গেছে। তাই কোনো কথা না বলে তারা একে অপরকে পেরিয়ে গেল, মিশে গেল ভিড়ের মধ্যে। চিরকালের জন্যে।
খুব করুণ গল্প, তাই না?
=================
জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির
জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির জন্ম কিয়োতো শহরে ১৯৪৯ সালের ১২ জানুয়ারি। ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে টোকিওতে একটি জাজবার খোলেন। বেসবল খেলা দেখার সময় আকস্মিকভাবেই উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা তার মাথায় আসে। প্রথম সেই উপন্যাসটির নাম হিয়ার দ্য উইন্ড সিংস। নোমো সাহিত্য পুরষ্কার লাভ করে বইটি। এরপরে নরওয়েজিয়ান উড লিখে জাপানসহ সারা বিশ্বে হৈ চৈ ফেলে দেন। কাফকা অন দ্য শোওর-এর জন্য পান কাফকা পুরষ্কার।
মুরাকামির উল্লেখ্যযোগ্য অন্য বইগুলো হচ্ছে: দ্য উইন্ড আপ বার্ড ক্রনিকল, আন্ডারগ্রাউন্ড, স্পুটনিক সুইট হার্ট, আফটার দ্য কোয়েক, ব্লাইন্ড উইলো স্লিপিং উইমেন, আফটার ডার্ক, এলিফ্যান্ট ভ্যানিশেস।
bdnews24 এর সৌজন্যে
অনুবাদ: দিলওয়ার হাসান
---------------
এই ওয়েব্লগের আরো গল্প....
পিটার নাজারেথ-এর গল্প 'মালদার' ইতালো কালভিনোর গল্প : ‘জেদ’ হারুকি মুরাকামির গল্প 'উড়োজাহাজ' হার্টা ম্যুলার-এর গল্প 'আমার পরিবার' হার্টা ম্যুলার-এর গল্প 'অন্ত্যেষ্টির বয়ান' আর. কে. নারায়ণ-এর গল্প 'ঈশ্বরণ' স্টিভেন মিলহসার-এর গল্প 'বহির্জাগতিক আক্রমণ' আর. কে. নারায়ণ-এর গল্প 'মাসে পঁয়তাল্লিশ টাকা' এনগুগি ওয়া থিওংগ্’ও-এর গল্প ‘ফেরা’ আর. কে. নারায়ণ-এর গল্প 'বাবার সাহায্য' মানুয়েল মুহিকা লাইনেস-এর গল্প ‘গুরুত্ব’
এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
No comments