ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকার কবিতা ও প্রিয় বন্ধুর জন্য বিলাপ
ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াসের জন্য বিলাপ
(Llanto Por Ignacio Sanchez Mejias)
১. জখম ও মৃত্যু
(La Cogida y la Muerte)
ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা।
কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা।
এনেছে ছেলেটা শাদা এক থান
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
রয়েছে সাজানো লেবুর ঝুড়ি একখানা
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
বাকিটা মৃত্যু এবং কেবলই মৃত্যু সে।
বাতাস উড়িয়ে নিয়েছে উল কার্পাসের
যখন ঘড়িতে বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
আর অক্সাইড-গুঁড়ো-ছিটানো
উড়লো কাচ আর নিকেল
ঘড়িতে যখন বাজলো বিকেল পাঁচটা।
লড়াইয়ে এখন মেতেছে ঘুঘু ও চিতাবাঘে
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
গুঁতোগুঁতি করে ঊরুতে একটি একাকী শিঙ
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
আর উদারায় বাজলো তার
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
বিষের ঘণ্টা বাজলো আর উঠলো ধোঁয়া
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
কোনায় কোনায় জমাট নীরবতা
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
আর এলো ওই তুঙ্গ-হৃদয় একাকী ষাঁড়!
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
বরফ তখন অতিরিক্ত ঝরালো ঘাম
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা,
ষাঁড়-লড়াইয়ের বৃত্ত যখন আয়োডিনে ছয়লাপ
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
জখমের ’পর মৃত্যু তার পাড়লো ডিম
বিকেল পাঁচটায়।
বিকেল পাঁচটায়।
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা ।
চাকায় বসানো শবাধার এক শয্যা তার
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
কানে বাজে ওই বাঁশি ও হাড়ের অনুরণন
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
এখন তার কপাল ফুঁড়ে হাম্বা হাম্বা ডাকছে ষাঁড়
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
সারা ঘর করে যাতনায় ঝিলমিল
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
পচা-ক্ষত এক আসছে এখন দূর থেকে
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
সবুজাভ ওই কুঁচকি ফুঁড়ে জাগে পদ্মের একটি শুঁড়
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
ক্ষতেরা যখন সূর্যের মতো জ্বলছে, আর
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
আহা, নিদারুণ সেই বিকেলের পাঁচটা!
[সকল ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা!]
গাঢ় বিকেলের ছায়ায় তখন পাঁচটা!
২. ঝরে-পড়া রক্ত
(La Sangre Derramada)
আমি তা দেখবো না!
চাঁদকে বোলো, আসুক সে,
ইগনাসিওর রক্ত আমি
দেখতে চাই না বালির ’পর।
আমি তা দেখবো না!
হাঁ-খোলা চাঁদ।
অনড় মেঘমালার ঘোড়া, আর
উইলোর বেড়া-ঘেরা
স্বপ্নের ধুধু ষাঁড়-লড়াইয়ের বৃত্তটা।
আমি তা দেখবো না!
স্মৃতি আমার উঠুক জ্বলে!
অমল ধবল হাস্নুহেনায়
ছড়াক তার উষ্ণতা!
আমি তা দেখবো না!
আদি পৃথিবীর সেই গাভীটা
বালিতে গড়ানো লোহু-ভেজা সেই নাকে
বোলালো তার বিষাদমাখা জিভ,
আর যতো ষাঁড় গিসান্দোর
মৃত্যু তারা অংশত, পাথর তারা অংশত,
যেন তারা তুলছে ঢেঁকুর দু’শো বছর ধরে
এই দুনিয়ার চ’রে বেড়ানোর সুখে
না,
আমি তা দেখবো না!
নিজের মৃত্যু নিজের কাঁধে নিয়ে
ইগনাসিও উঠলো ধাপে ধাপে।
সে করেছে ভোরের সন্ধান
কিন্তু সে-ভোর পেল না খুঁজে আর।
খুঁজলো সে তার দীপ্ত মুখচ্ছবি
স্বপ্ন তাকে করলো বিহ্বল
খুঁজতে নিজের সুন্দর দেহখানি
নিজ রক্তের দেখলো সে উদ্গার।
বোলো না আমায় দেখতে একে আর!
ক্রম-নিস্তেজ ফিনকি সে-রক্তের
চাইনে আমি শুনতে বারবার:
আসনের ধাপ রক্ত-আলোয় হাসে
আর সে-লোহু ছিটকে গিয়ে পড়ে
তর-না-সওয়া হাজার লোকের
পোশাকে ও পাদুকায়।
চেঁচিয়ে কারা আমায় কাছে ডাকে!
বোলো না আমায় দেখতে একে আর !
দেখলো যখন আসছে ধেয়ে শিঙ
তখনো চোখে পড়েনি পলক তার,
সর্বনাশী মায়েরা তবুও সবে
তুললো তাদের মাথা।
আর গোপন স্বরের এক হাওয়া
উঠলো আর পেরলো খামার ষাঁড়ের,
রাখাল যতো হাল্কা কুয়াশার
চেঁচাল দিব্য-ষাঁড়কে লক্ষ্য করে।
ছিলো না এমন রাজার দুলাল কোনো
তুলনীয় তার হতে পারে সেভিয়ায়
তারটির মতো এমন তরবারি
এমন খাঁটি হৃদয় ছিলো না কোনো।
সিংহযুথের মতোন প্রবল ছিল
অবাক করা শৌর্যবীর্য তার,
মার্বেলে গড়া যেনবা ধড় এক
পরিমিত আর ছিল সুনির্ণিত।
আন্দালুসীয় রোমের গরিমা তার
মোহন শিরে করলো ঝলমল;
যেখানে মেধা ও সরস কৌতুকে
হাসিখানি তার হয়েছে সুরভিলতা ।
লড়াই-রিঙে কতো বড়ো মাতাদোর!
পাহাড়ি দেশের সুজন কৃষাণ এক!
কতো না দক্ষ ফসলের গোছা হাতে!
ঘোড়ার পিঠে কেমন অকুতোভয়!
শিশির-ছোঁয়ায় কেমন পরিস্নাত!
কতো ঝলমল আনন্দ উৎসব!
অন্ধকারের বান্দেরিয়া হাতে
কেমন মোহন রূপের বাহার তার!
অথচ এখন দিয়েছে সে কালঘুম।
ধ্রুব আঙুলে শ্যাওলা আর ঘাস
ফোটায় আজ তার করোটির ফুল।
গান গেয়ে তার রক্ত বেরিয়ে আসে;
গায় তৃণভূমি এবং জলার সাথে,
হিমায়িত শিঙে সে-গান গড়িয়ে নামে,
আত্মারা টলে সেই ঘন কুয়াশায়
হাজার খূরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে,
যেন দীঘল, কালো, বিষণ্ন জিভ,
বেদনার এক গড়েছে পুষ্করিণী
পাশে তারাভরা গুয়াদাল্কিভির;
আহা, স্পেনের ধবল প্রাচীরখানি!
আহা, বেদনার কালোবরণ ষাঁড়!
আহা রে, জমাট ইগনাসিওর খুন!
আহা রে, তার ধমনীর বুলবুল !
না।
আমি তা দেখবো না!
একে বুকে ধরে এমন পেয়ালা নেই,
একে পান করে এমন চাতক নেই,
আলোর তুহিন পারে না জুড়াতে একে,
কোনো গান কোনো শাদা লিলির বান,
কোনো কাচ নেই রক্তকে ঢাকে রুপোর আচ্ছাদনে।
না।
আমি তা দেখবো না!
৩. শুইয়ে রাখা শব
(Cuerpo Presente)
বাঁকাজল আর তুষারজমাট সাইপ্রেস তরুহীন
পাথর এক কপাল যাতে স্বপ্ন কেঁদে মরে।
সময় ব’য়ে নে’য়ার মতো পাথর এক কাঁধ
অশ্রু, রিবন, গ্রহে সাজানো গাছগাছালি ভরা।
দেখেছি ধূসর বৃষ্টিধারা ঢেউয়ের পানে ছোটে
চালুনিময় কোমল হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরে,
রক্ত শোষণ না ক’রে যারা এলিয়ে দেয় তাদের
সেই পাথরে হঠাৎ সে যেন না ধরা পড়ে।
যেহেতু পাথর কুড়ায় বীজ এবং মেঘমালা,
ছায়ার নেকড়ে, কংকালেরা তামাশা ক’রে যায়:
দেয় না শব্দ একটুখানি ফটিক, কিবা আগুন
দেয় শুধু রিঙ এবং রিঙ, ঘেরহীন ওই ষাঁড়-লড়াইয়ের রিঙ।
পাথরে এখন নিথর শুয়ে সুজাত ইগনাসিও
সবই তো শেষ! হচ্ছে কী! ওর মুখটি মনে আঁকো:
মৃত্যু এসে ঢেকেছে ওকে অগুরু গন্ধকে
কৃষ্ণ মিনোতারের মুণ্ডু বসিয়ে দিলো কাঁধে।
সবই তো শেষ। বৃষ্টি ওর মুখের ভেতর ঢোকে
চুপসানো ওর বুক ছেড়ে যায় হাওয়া যেন উন্মাদ,
আর বরফের অশ্রুভেজা প্রেম
দিচ্ছে ওম নিজেকে নিজে পালের অগ্রভাগে।
ওরা কী বলে? এসেছে নেমে আবিল নীরবতা।
শুইয়ে রাখা ক্রম-পাণ্ডুর শবকে ঘিরে আছি,
সেই নিরূপম তনুর গড়ন যেনবা পাপিয়ার
আর দেখি তা কতো না অতল গর্তে ভরে যায়।
কে করে ভাঁজ লাশের কাপড়? ওর কথা সব ঝুট!
গায় না কেউ এখানে গান, কাঁদে না ঘরের কোণে,
জুতোয় কেউ পরায় না নাল, দেখায় না ভয় সাপে।
চাইনে কিছু এখানে, শুধু পটলচেরা চোখে
দেখতে চাই ওর দেহটা কেবল নির্নিমেষে।
এখানে চাই দেখতে তাদের, যাদের কড়া গলা।
ঘোড়াকে যারা মানায় বশ, শাসন করে নদী;
শীর্ণ-পাঁজর যাদের গলা গানের সুরে মাতে
তাদের মুখ আগুনে পাথর, সূর্য দিয়ে ভরা।
এই পাথরের সামনে, আমি দেখতে চাই তাদের
ছিন্ন-লাগাম এই দেহের, এরই সম্মুখে ।
মরণে বাঁধা এই সেনানী, তার মুক্তির পথ
বাৎলে দিক তারা আমায় এখন, এইবেলা।
চাই তারা দেখাক আমায় নদীর মতো শোক
থাকবে যার গভীর তট, মধুর কুজ্ঝটি,
না শুনে আজ এসব ষাঁড়ের দ্বিগুণ ঘড়্ঘড়্
ইগনাসিওর লাশ ব’য়ে নিতে
যেখানে সে ফানা হবে।
নিজেকে হারাবে চাঁদের গোল ষাঁড়-লড়াইয়ের রিঙে
যে চাঁদ তার তরুণ-দিনে শান্ত-দুঃখী ষাঁড়ের ভাব করে,
মাছের গান-রিক্ত-রাতে হারায় নিজেকেই
আর জমাট ধোঁয়ার শাদা ঝোঁপের ওই আড়ে।
চাইনে আমি মুখটি ওর রুমালে ঢেকে দিতে
যেন যে-মরণ ব’য়ে সে বেড়ায়, মানিয়ে নিতে পারে।
ইগনাসিও! রেখো না মনে এসব কিছু, এসব হাম্বারব
যাও গে ঘুমোও, ওড়ো, জিরোও; সাগরও তো যায় মরে!
৪. গরহাজির আত্মা
(Alma Absente)
তোমাকে ষাঁড় চেনে না, ওই ডুমুরগাছও না,
নয় ঘোড়ারা, তোমার ওই বাড়ির পিঁপড়েরাও।
শিশুটি আর ওই যে বিকেল তোমায় চেনে না
কেননা তুমি গিয়েছ মরে চিরকালের তরে।
ওই পাথরের শক্ত কাঁধ তোমায় চেনে না
কালো রেশম, যেখানে তুমি বন্দি হ’য়ে আছো।
তোমার স্মৃতি নীরব, সে-ও তোমাকে চেনে না
কেননা তুমি গিয়েছ মরে চিরদিনের তরে।
আসবে শরৎ ছোট্ট শাদা শামুক সাথে নিয়ে,
তুষারে ভেজা আঙুর আর পাহাড়শ্রেণী নিয়ে,
কেউ তবুও রাখবে না তো তোমার চোখে চোখ
কেননা তুমি গিয়েছ মরে চিরকালের তরে।
যেহেতু তুমি গিয়েছ মরে চিরকালের তরে,
তাদেরই মতো এই দুনিয়ার গিয়েছে যারা মরে,
সেসব মৃতের মতো যারা মরা কুকুরদের
ভাগাড়ে লীন হওয়ার মতো হয়েছে বিস্মৃত।
তোমায় কেউ চেনে না। না, তবুও আমি গাই
তোমার তনুর রূপ-সুষমা ভাবীকালের তরে।
পরিণত তোমার মনের স্তব করে যাই গানে।
তোমার ওই মরণ-তিয়াস, তোমার মুখের স্বাদ
ছিলো যে-বিষাদ লুকিয়ে তোমার মুখর উল্লাসে।
এমন খাঁটি আন্দালুসি দুঃসাহসে ভরা
ফের যদিবা জন্ম নেয় তা-ও বহু যুগ পর
গুমরে-মরা কথায় আমি তার যশোগান করি
আর এসব জলপাইগাছ, ওদের ভেতর দিয়ে
বয়ে চলা করুণ হাওয়া স্মরণ করি আমি
================
ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকা (Federico García Lorca, ৫/৬/১৮৯৮ — ১৯/৮/১৯৩৬)
bdnews24 এর সৌজন্যে
অনুবাদ: জুয়েল মাজহার
এই কবিতা গুলো পড়া হয়েছে...
(Llanto Por Ignacio Sanchez Mejias)
১. জখম ও মৃত্যু
(La Cogida y la Muerte)
ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা।
কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা।
এনেছে ছেলেটা শাদা এক থান
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
রয়েছে সাজানো লেবুর ঝুড়ি একখানা
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
বাকিটা মৃত্যু এবং কেবলই মৃত্যু সে।
বাতাস উড়িয়ে নিয়েছে উল কার্পাসের
যখন ঘড়িতে বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
আর অক্সাইড-গুঁড়ো-ছিটানো
উড়লো কাচ আর নিকেল
ঘড়িতে যখন বাজলো বিকেল পাঁচটা।
লড়াইয়ে এখন মেতেছে ঘুঘু ও চিতাবাঘে
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
গুঁতোগুঁতি করে ঊরুতে একটি একাকী শিঙ
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
আর উদারায় বাজলো তার
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
বিষের ঘণ্টা বাজলো আর উঠলো ধোঁয়া
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
কোনায় কোনায় জমাট নীরবতা
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
আর এলো ওই তুঙ্গ-হৃদয় একাকী ষাঁড়!
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
বরফ তখন অতিরিক্ত ঝরালো ঘাম
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা,
ষাঁড়-লড়াইয়ের বৃত্ত যখন আয়োডিনে ছয়লাপ
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
জখমের ’পর মৃত্যু তার পাড়লো ডিম
বিকেল পাঁচটায়।
বিকেল পাঁচটায়।
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা ।
চাকায় বসানো শবাধার এক শয্যা তার
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
কানে বাজে ওই বাঁশি ও হাড়ের অনুরণন
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
এখন তার কপাল ফুঁড়ে হাম্বা হাম্বা ডাকছে ষাঁড়
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
সারা ঘর করে যাতনায় ঝিলমিল
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
পচা-ক্ষত এক আসছে এখন দূর থেকে
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
সবুজাভ ওই কুঁচকি ফুঁড়ে জাগে পদ্মের একটি শুঁড়
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
ক্ষতেরা যখন সূর্যের মতো জ্বলছে, আর
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
আহা, নিদারুণ সেই বিকেলের পাঁচটা!
[সকল ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা!]
গাঢ় বিকেলের ছায়ায় তখন পাঁচটা!
২. ঝরে-পড়া রক্ত
(La Sangre Derramada)
আমি তা দেখবো না!
চাঁদকে বোলো, আসুক সে,
ইগনাসিওর রক্ত আমি
দেখতে চাই না বালির ’পর।
আমি তা দেখবো না!
হাঁ-খোলা চাঁদ।
অনড় মেঘমালার ঘোড়া, আর
উইলোর বেড়া-ঘেরা
স্বপ্নের ধুধু ষাঁড়-লড়াইয়ের বৃত্তটা।
আমি তা দেখবো না!
স্মৃতি আমার উঠুক জ্বলে!
অমল ধবল হাস্নুহেনায়
ছড়াক তার উষ্ণতা!
আমি তা দেখবো না!
আদি পৃথিবীর সেই গাভীটা
বালিতে গড়ানো লোহু-ভেজা সেই নাকে
বোলালো তার বিষাদমাখা জিভ,
আর যতো ষাঁড় গিসান্দোর
মৃত্যু তারা অংশত, পাথর তারা অংশত,
যেন তারা তুলছে ঢেঁকুর দু’শো বছর ধরে
এই দুনিয়ার চ’রে বেড়ানোর সুখে
না,
আমি তা দেখবো না!
নিজের মৃত্যু নিজের কাঁধে নিয়ে
ইগনাসিও উঠলো ধাপে ধাপে।
সে করেছে ভোরের সন্ধান
কিন্তু সে-ভোর পেল না খুঁজে আর।
খুঁজলো সে তার দীপ্ত মুখচ্ছবি
স্বপ্ন তাকে করলো বিহ্বল
খুঁজতে নিজের সুন্দর দেহখানি
নিজ রক্তের দেখলো সে উদ্গার।
বোলো না আমায় দেখতে একে আর!
ক্রম-নিস্তেজ ফিনকি সে-রক্তের
চাইনে আমি শুনতে বারবার:
আসনের ধাপ রক্ত-আলোয় হাসে
আর সে-লোহু ছিটকে গিয়ে পড়ে
তর-না-সওয়া হাজার লোকের
পোশাকে ও পাদুকায়।
চেঁচিয়ে কারা আমায় কাছে ডাকে!
বোলো না আমায় দেখতে একে আর !
দেখলো যখন আসছে ধেয়ে শিঙ
তখনো চোখে পড়েনি পলক তার,
সর্বনাশী মায়েরা তবুও সবে
তুললো তাদের মাথা।
আর গোপন স্বরের এক হাওয়া
উঠলো আর পেরলো খামার ষাঁড়ের,
রাখাল যতো হাল্কা কুয়াশার
চেঁচাল দিব্য-ষাঁড়কে লক্ষ্য করে।
ছিলো না এমন রাজার দুলাল কোনো
তুলনীয় তার হতে পারে সেভিয়ায়
তারটির মতো এমন তরবারি
এমন খাঁটি হৃদয় ছিলো না কোনো।
সিংহযুথের মতোন প্রবল ছিল
অবাক করা শৌর্যবীর্য তার,
মার্বেলে গড়া যেনবা ধড় এক
পরিমিত আর ছিল সুনির্ণিত।
আন্দালুসীয় রোমের গরিমা তার
মোহন শিরে করলো ঝলমল;
যেখানে মেধা ও সরস কৌতুকে
হাসিখানি তার হয়েছে সুরভিলতা ।
লড়াই-রিঙে কতো বড়ো মাতাদোর!
পাহাড়ি দেশের সুজন কৃষাণ এক!
কতো না দক্ষ ফসলের গোছা হাতে!
ঘোড়ার পিঠে কেমন অকুতোভয়!
শিশির-ছোঁয়ায় কেমন পরিস্নাত!
কতো ঝলমল আনন্দ উৎসব!
অন্ধকারের বান্দেরিয়া হাতে
কেমন মোহন রূপের বাহার তার!
অথচ এখন দিয়েছে সে কালঘুম।
ধ্রুব আঙুলে শ্যাওলা আর ঘাস
ফোটায় আজ তার করোটির ফুল।
গান গেয়ে তার রক্ত বেরিয়ে আসে;
গায় তৃণভূমি এবং জলার সাথে,
হিমায়িত শিঙে সে-গান গড়িয়ে নামে,
আত্মারা টলে সেই ঘন কুয়াশায়
হাজার খূরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে,
যেন দীঘল, কালো, বিষণ্ন জিভ,
বেদনার এক গড়েছে পুষ্করিণী
পাশে তারাভরা গুয়াদাল্কিভির;
আহা, স্পেনের ধবল প্রাচীরখানি!
আহা, বেদনার কালোবরণ ষাঁড়!
আহা রে, জমাট ইগনাসিওর খুন!
আহা রে, তার ধমনীর বুলবুল !
না।
আমি তা দেখবো না!
একে বুকে ধরে এমন পেয়ালা নেই,
একে পান করে এমন চাতক নেই,
আলোর তুহিন পারে না জুড়াতে একে,
কোনো গান কোনো শাদা লিলির বান,
কোনো কাচ নেই রক্তকে ঢাকে রুপোর আচ্ছাদনে।
না।
আমি তা দেখবো না!
৩. শুইয়ে রাখা শব
(Cuerpo Presente)
বাঁকাজল আর তুষারজমাট সাইপ্রেস তরুহীন
পাথর এক কপাল যাতে স্বপ্ন কেঁদে মরে।
সময় ব’য়ে নে’য়ার মতো পাথর এক কাঁধ
অশ্রু, রিবন, গ্রহে সাজানো গাছগাছালি ভরা।
দেখেছি ধূসর বৃষ্টিধারা ঢেউয়ের পানে ছোটে
চালুনিময় কোমল হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরে,
রক্ত শোষণ না ক’রে যারা এলিয়ে দেয় তাদের
সেই পাথরে হঠাৎ সে যেন না ধরা পড়ে।
যেহেতু পাথর কুড়ায় বীজ এবং মেঘমালা,
ছায়ার নেকড়ে, কংকালেরা তামাশা ক’রে যায়:
দেয় না শব্দ একটুখানি ফটিক, কিবা আগুন
দেয় শুধু রিঙ এবং রিঙ, ঘেরহীন ওই ষাঁড়-লড়াইয়ের রিঙ।
পাথরে এখন নিথর শুয়ে সুজাত ইগনাসিও
সবই তো শেষ! হচ্ছে কী! ওর মুখটি মনে আঁকো:
মৃত্যু এসে ঢেকেছে ওকে অগুরু গন্ধকে
কৃষ্ণ মিনোতারের মুণ্ডু বসিয়ে দিলো কাঁধে।
সবই তো শেষ। বৃষ্টি ওর মুখের ভেতর ঢোকে
চুপসানো ওর বুক ছেড়ে যায় হাওয়া যেন উন্মাদ,
আর বরফের অশ্রুভেজা প্রেম
দিচ্ছে ওম নিজেকে নিজে পালের অগ্রভাগে।
ওরা কী বলে? এসেছে নেমে আবিল নীরবতা।
শুইয়ে রাখা ক্রম-পাণ্ডুর শবকে ঘিরে আছি,
সেই নিরূপম তনুর গড়ন যেনবা পাপিয়ার
আর দেখি তা কতো না অতল গর্তে ভরে যায়।
কে করে ভাঁজ লাশের কাপড়? ওর কথা সব ঝুট!
গায় না কেউ এখানে গান, কাঁদে না ঘরের কোণে,
জুতোয় কেউ পরায় না নাল, দেখায় না ভয় সাপে।
চাইনে কিছু এখানে, শুধু পটলচেরা চোখে
দেখতে চাই ওর দেহটা কেবল নির্নিমেষে।
এখানে চাই দেখতে তাদের, যাদের কড়া গলা।
ঘোড়াকে যারা মানায় বশ, শাসন করে নদী;
শীর্ণ-পাঁজর যাদের গলা গানের সুরে মাতে
তাদের মুখ আগুনে পাথর, সূর্য দিয়ে ভরা।
এই পাথরের সামনে, আমি দেখতে চাই তাদের
ছিন্ন-লাগাম এই দেহের, এরই সম্মুখে ।
মরণে বাঁধা এই সেনানী, তার মুক্তির পথ
বাৎলে দিক তারা আমায় এখন, এইবেলা।
চাই তারা দেখাক আমায় নদীর মতো শোক
থাকবে যার গভীর তট, মধুর কুজ্ঝটি,
না শুনে আজ এসব ষাঁড়ের দ্বিগুণ ঘড়্ঘড়্
ইগনাসিওর লাশ ব’য়ে নিতে
যেখানে সে ফানা হবে।
নিজেকে হারাবে চাঁদের গোল ষাঁড়-লড়াইয়ের রিঙে
যে চাঁদ তার তরুণ-দিনে শান্ত-দুঃখী ষাঁড়ের ভাব করে,
মাছের গান-রিক্ত-রাতে হারায় নিজেকেই
আর জমাট ধোঁয়ার শাদা ঝোঁপের ওই আড়ে।
চাইনে আমি মুখটি ওর রুমালে ঢেকে দিতে
যেন যে-মরণ ব’য়ে সে বেড়ায়, মানিয়ে নিতে পারে।
ইগনাসিও! রেখো না মনে এসব কিছু, এসব হাম্বারব
যাও গে ঘুমোও, ওড়ো, জিরোও; সাগরও তো যায় মরে!
৪. গরহাজির আত্মা
(Alma Absente)
তোমাকে ষাঁড় চেনে না, ওই ডুমুরগাছও না,
নয় ঘোড়ারা, তোমার ওই বাড়ির পিঁপড়েরাও।
শিশুটি আর ওই যে বিকেল তোমায় চেনে না
কেননা তুমি গিয়েছ মরে চিরকালের তরে।
ওই পাথরের শক্ত কাঁধ তোমায় চেনে না
কালো রেশম, যেখানে তুমি বন্দি হ’য়ে আছো।
তোমার স্মৃতি নীরব, সে-ও তোমাকে চেনে না
কেননা তুমি গিয়েছ মরে চিরদিনের তরে।
আসবে শরৎ ছোট্ট শাদা শামুক সাথে নিয়ে,
তুষারে ভেজা আঙুর আর পাহাড়শ্রেণী নিয়ে,
কেউ তবুও রাখবে না তো তোমার চোখে চোখ
কেননা তুমি গিয়েছ মরে চিরকালের তরে।
যেহেতু তুমি গিয়েছ মরে চিরকালের তরে,
তাদেরই মতো এই দুনিয়ার গিয়েছে যারা মরে,
সেসব মৃতের মতো যারা মরা কুকুরদের
ভাগাড়ে লীন হওয়ার মতো হয়েছে বিস্মৃত।
তোমায় কেউ চেনে না। না, তবুও আমি গাই
তোমার তনুর রূপ-সুষমা ভাবীকালের তরে।
পরিণত তোমার মনের স্তব করে যাই গানে।
তোমার ওই মরণ-তিয়াস, তোমার মুখের স্বাদ
ছিলো যে-বিষাদ লুকিয়ে তোমার মুখর উল্লাসে।
এমন খাঁটি আন্দালুসি দুঃসাহসে ভরা
ফের যদিবা জন্ম নেয় তা-ও বহু যুগ পর
গুমরে-মরা কথায় আমি তার যশোগান করি
আর এসব জলপাইগাছ, ওদের ভেতর দিয়ে
বয়ে চলা করুণ হাওয়া স্মরণ করি আমি
================
ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকা (Federico García Lorca, ৫/৬/১৮৯৮ — ১৯/৮/১৯৩৬)
গ্রানাদা জন্ম দিয়েছে বিশ্ববিশ্রুত অনেক কবি-লেখকের। কিন্তু জনপ্রিয়তা, খ্যাতি আর প্রভাবের বিচারে ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকার সঙ্গে কারোরই তুলনা চলে না। জীবৎকালেই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি। আর মৃত্যুর পর তার খ্যাতি স্বদেশ স্পেনের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সপ্তসিন্ধু দশদিগন্তে। সবচে’ বেশি সংখ্যক বিদেশি ভাষায় অনূদিত হিস্পানি ভাষার এই কবি-নাট্যকারের ভক্তের সংখ্যা উত্তরকালে কেবলই বেড়েছে। অন্যভাবে বললে স্পেনে ও স্পেনের বাইরে, আবিশ্ব নিখিলে, গার্থিয়া লোরকা আজ এক জাদুনাম।
লোরকার জন্ম ১৮৯৮ খিস্টাব্দের ৫ জুন, গ্রানাদা থেকে মাইল কয়েক দূরে গেনিল নদীতীরবর্তী ফেন্তে ভাকেরোস (Fuente Vaqueros) নামের এক ছোট্ট গ্রামে। জায়গাটা গ্রানাদার বিস্তীর্ণ উর্বর ভেগা অঞ্চলের ঠিক কেন্দ্রস্থলে। গ্রাম ঘিরে আছে নিবিড় পপলারকুঞ্জ। লোরকার বাবা দন ফেদেরিকো গার্থিয়া রদ্রিগেস (Don Federico Garcia Rodriguez) ছিলেন সে গ্রামেরই এক সম্পন্ন কৃষক। আর মা দোনা ভিসেন্তা লোরকা রোমিয়েরো (Dona Vicenta Lorca Romero) ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। লোরকার জীবনের প্রথম ১১টি বছর কাটে এই ভেগা অঞ্চলে — জলপাইবন আর সঘন পপলারকুঞ্জ, সদা কলস্বরা স্রোতোস্বিনী, পাহাড়, উপত্যকা আর তৃণভূমিঘেরা মায়াবী গ্রামীণ নিসর্গের কোলে। নিজের চাষাভুষোমার্কা চেহারাটাও তার সেখান থেকেই পাওয়া — রসিকতা করে প্রায়ই বলতেন লোরকা।
১৯০৯ সালে লোরকার পরিবার তার পড়াশুনার জন্য পাড়ি জমায় গ্রানাদা শহরে। নিউইয়র্কে আট মাস, কিউবাতে তিন মাস (১৯২৯-৩০) আর বুয়েনোস আইরিসে পাঁচ মাস (১৯৩৩-৩৪) — এই সময়টুকু বাদ দিলে লোরকার ঝোড়ো আর স্বপ্লায়ু জীবনের পুরোটাই কেটেছে মাদ্রিদ আর গ্রানাদায়। ১৯৩৬ সালের জুলাইতে, স্পেনে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার ঠিক আগে, বন্ধুদের নিষেধ উপেক্ষা করে লোরকা ফিরে যান গ্রানাদায়। আর তার এক মাস পরেই ১৯ আগস্ট স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রাঙ্কোর খুনে ফালাঙ্গিস্ত (Falangist) বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে প্রাণ দেন। ঐতিহ্যবাহী যে-প্রিয় মুরিশ শহরে বেড়ে উঠেছিলেন লোরকা, যে শহর বারবার ঝিল্কে উঠেছে তার কবিতা ও নাটকে, সেই গ্রানাদারই অনতিদূরে ঘাতকের বুলেটে অকালে লুটিয়ে পড়েছে তার তরুণ মেধাবী প্রাণ।
বলা বাহুল্য, প্রাগ্রসর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীই কাল হলো লোরকার। এ নিয়ে কোনো রাখঢাক ছিলো না তার। আর সেটাই ক্ষেপিয়ে তোলে উগ্র ডানপন্থিদের। তারা তাকে দুষমণ হিসেবে চিহ্নিত করে। গ্রানাদার উত্তর-পুবের আল্ফাকার (Alfaqar) নামের পাহাড়ঘেরা স্থানে একটি জলপাইগাছের নিচে গুলি করে মারা হয় ৩৮ বছর বয়সী লোরকাকে। আজও সেই জলপাইতরু ঠায় দাঁড়িয়ে। অবশ্য সেটি এখন ‘লোরকা স্মৃতিউদ্যান’-এর ভেতর দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সেখানটায় আরও তিন হতভাগার সঙ্গে সমাহিত করা হয় তাকে। ওদের একজন স্কুল শিক্ষক, বাকি দু’জন মাতাদোর (ষাঁড়-লড়িয়ে )।
লোরকার জন্ম ১৮৯৮ খিস্টাব্দের ৫ জুন, গ্রানাদা থেকে মাইল কয়েক দূরে গেনিল নদীতীরবর্তী ফেন্তে ভাকেরোস (Fuente Vaqueros) নামের এক ছোট্ট গ্রামে। জায়গাটা গ্রানাদার বিস্তীর্ণ উর্বর ভেগা অঞ্চলের ঠিক কেন্দ্রস্থলে। গ্রাম ঘিরে আছে নিবিড় পপলারকুঞ্জ। লোরকার বাবা দন ফেদেরিকো গার্থিয়া রদ্রিগেস (Don Federico Garcia Rodriguez) ছিলেন সে গ্রামেরই এক সম্পন্ন কৃষক। আর মা দোনা ভিসেন্তা লোরকা রোমিয়েরো (Dona Vicenta Lorca Romero) ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। লোরকার জীবনের প্রথম ১১টি বছর কাটে এই ভেগা অঞ্চলে — জলপাইবন আর সঘন পপলারকুঞ্জ, সদা কলস্বরা স্রোতোস্বিনী, পাহাড়, উপত্যকা আর তৃণভূমিঘেরা মায়াবী গ্রামীণ নিসর্গের কোলে। নিজের চাষাভুষোমার্কা চেহারাটাও তার সেখান থেকেই পাওয়া — রসিকতা করে প্রায়ই বলতেন লোরকা।
১৯০৯ সালে লোরকার পরিবার তার পড়াশুনার জন্য পাড়ি জমায় গ্রানাদা শহরে। নিউইয়র্কে আট মাস, কিউবাতে তিন মাস (১৯২৯-৩০) আর বুয়েনোস আইরিসে পাঁচ মাস (১৯৩৩-৩৪) — এই সময়টুকু বাদ দিলে লোরকার ঝোড়ো আর স্বপ্লায়ু জীবনের পুরোটাই কেটেছে মাদ্রিদ আর গ্রানাদায়। ১৯৩৬ সালের জুলাইতে, স্পেনে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার ঠিক আগে, বন্ধুদের নিষেধ উপেক্ষা করে লোরকা ফিরে যান গ্রানাদায়। আর তার এক মাস পরেই ১৯ আগস্ট স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রাঙ্কোর খুনে ফালাঙ্গিস্ত (Falangist) বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে প্রাণ দেন। ঐতিহ্যবাহী যে-প্রিয় মুরিশ শহরে বেড়ে উঠেছিলেন লোরকা, যে শহর বারবার ঝিল্কে উঠেছে তার কবিতা ও নাটকে, সেই গ্রানাদারই অনতিদূরে ঘাতকের বুলেটে অকালে লুটিয়ে পড়েছে তার তরুণ মেধাবী প্রাণ।
বলা বাহুল্য, প্রাগ্রসর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীই কাল হলো লোরকার। এ নিয়ে কোনো রাখঢাক ছিলো না তার। আর সেটাই ক্ষেপিয়ে তোলে উগ্র ডানপন্থিদের। তারা তাকে দুষমণ হিসেবে চিহ্নিত করে। গ্রানাদার উত্তর-পুবের আল্ফাকার (Alfaqar) নামের পাহাড়ঘেরা স্থানে একটি জলপাইগাছের নিচে গুলি করে মারা হয় ৩৮ বছর বয়সী লোরকাকে। আজও সেই জলপাইতরু ঠায় দাঁড়িয়ে। অবশ্য সেটি এখন ‘লোরকা স্মৃতিউদ্যান’-এর ভেতর দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সেখানটায় আরও তিন হতভাগার সঙ্গে সমাহিত করা হয় তাকে। ওদের একজন স্কুল শিক্ষক, বাকি দু’জন মাতাদোর (ষাঁড়-লড়িয়ে )।
দালি ও লোরকা
তার কালের মহান ফ্লামেঙ্কো (Flamenco) গায়ক হুয়ান ব্রেভা’র (Juan Breva) প্রশস্তি করে একটা কবিতা লিখেছিলেন লোরকা। সে কবিতারই কয়েকটি চরণ হতে পারতো সদা-হাসিমাখা-মুখের-কবি লোরকার নিজেরই এফিটাফ :
`…Era la misma
pena cantando
detrás de una sonrisa.’
উপরের তিনটি চরণের ইংরেজি ভাষান্তর হাতের কাছে নেই। স্প্যানিশ ভাষায় আমার হাঁটুভাঙা যেটুকু জ্ঞান তাতে বাংলা করলে অনেকটা এরকম দাঁড়ায়:
‘নিজের অসহ যাতনা
ছিলো সে নিজে
হাসিতে তা ঢেকে গেয়ে গেছে নিজ গান’
বহু সংস্কৃতির ঐকতান-ধ্বনিত গ্রানাদা, বহু শতাব্দীর বিস্ময়-খচিত গ্রানাদা এমন এক উন্মুক্ত স্বর্গের নাম একদা যাতে এসে মিশেছিল নানা জাতির রক্ত আর মেধা, পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের ঢেউয়ের কলতান আর নিকটপ্রাচ্যের বহুবর্ণিলতা, গ্রিক, আরব আর রোমানদের নানা গরিমা আর জিপসিদের অনিকেতবৃত্তি। এসব কিছুকেই সাঙ্গীকৃত করে এগিয়েছেন লোরকা। আন্দালুসিয়ার লোক-ঐতিহ্যের উদ্দীপক ইডিয়ম আর মেটাফরকে তিনি খুঁজে ফিরেছেন তার কবিতায় নাটকে। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার এমন সংরাগদীপ্ত মেলবন্ধন স্পেনের আর কোনো কবির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজো, তার মৃত্যুর এতোকাল পরেও, স্পেনের মানুষ লোরকার কবিতার মধ্য দিয়ে নিজেদের চেনাতে ভালোবাসে। সম্ভবত আধুনিক কালে তিনিই একমাত্র কবি যার কবিতাকে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত আর অশিক্ষিত সবাই ভালোবাসে;`…a poet whose worth is loved and acclaimed by the illiterate and the sophisticated alike.’ এ সত্ত্বেও লোরকা ছিলেন আধুনিক কালের সবচে’ জটিল কবিদের একজন। কেননা ব্যক্তিগত কাব্যভাষা ও ইডিয়ম তৈরির জন্য ক্রম অপসৃয়মান এক লোকজীবনের ভাবাবেগের সঙ্গে ক্রম আগ্রাসী, ক্রম জটিল আর শিল্পায়িত এক পৃথিবীর মূল্যবোধের মেলবন্ধন ঘটাবার প্রায়-অসম্ভব কাজে হাত দিতে হয়েছিল তাকে। কবিতার টেকনিক আর উপাদানের জন্য সমসাময়িকদের দিকে যেমন, তেমনি তিনি অকুণ্ঠিতভাবে হাত বাড়িয়েছেন মধ্যযুগের আরব কবিদের দিকে, গ্রিক-রোমান কাব্যের অতীত ঐতিহ্যের দিকে, পুরাণ-উপকথার দিকে ।
প্রেম, ভাবাবেগ আর সহিংস মৃত্যু — সর্বদাই এ তিনটি তার কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। সবকিছু ছাপিয়ে বারংবার নিজের মৃত্যুর প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তার কবিতা ও নাটকে। এমনকি লঘু রচনায়ও তার দেখা মেলে। তার নিতান্তই হাল্কারসের একটি লেখা শেষ হয়েছে মৃত্যুর অনুষঙ্গ দিয়ে: “Take me by the hands, my love, / for I come quite badly wounded / Dying of love!’’
লোরকার চোখে মৃত্যু এক নীরব আগন্তুক, সর্বদা মুখোশ-পরে-থাকা মনোলিথিক এক শক্তি, যে বিনা বাধায় জীবনের টুঁটি টিপে ধরে মেতে ওঠে অনিবার উল্লাসে। তার তীব্র নখরে বন্দি জীবনের ত্রস্ত বুলবুল:“…Three thousand men came armed with shining knives to assasinate the nightingale.’’
এ রকম অসংখ্য ভয় জাগানিয়া, রোমহর্ষক চিত্রকল্প ছড়িয়ে আছে তার কবিতায় কবিতায়। ‘নিউ ইয়র্কে কবি’ (Poeta en Nueva York) নামের কবিতায় এভাবেই নিজের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করেন লোরকা:
“ ..I sensed that they had murdered me.
They swept through cafes, graveyards, churches,
They opened the wine-casks and the closets,
They ravaged three skeletons to yank the gold teeth out.
But they never found me.
They never found me?
No, they never found me.’’
(Edwin Honig-এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত)
লোরকা হয়তো ফালাঙ্গিস্তদের দিক থেকে নিজের ঘনায়মান বিপদ আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ডানপন্থি এক বন্ধুর কাছে। তবু শেষরক্ষা হয়নি। বন্ধুটির অনুপস্থিতির সুযোগে খুনে ব্ল্যাক গার্ড বাহিনীর লোকেরা সিভিল গভর্নমেন্ট বিল্ডিংয়ে তার বন্ধুর বাসা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তার পরের ঘটনা সবার জানা। বিনা বিচারে পরদিন ভোরে গুলি করে মারা হয় স্পেনের সর্বকালের সেরা কবিরত্নটিকে। এক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, খুন করার আগে লোরকাকে তার নিজের কবর খুঁড়তে বাধ্য করে ওরা।
‘‘ওর (লোরকার) পায়ুপথে দু’দুটো গুলি ছুড়েছিলাম আমি…’’ — খুনিদের একজন পরে গর্ব করে বলেছিলো।
এমনই নৃশংস, বীভৎস সে মৃত্যু! খুন করার আগে লোরকাকে দিয়ে একটি চিরকুট লিখিয়ে নিয়ে বাহকের মাধ্যমে তা পাঠানো হয় তার বাবার কাছে। সেই চিরকুটে লোরকা লিখেছিলেন: ‘প্লিজ বাবা, এই লোকের হাতে আর্মির জন্য চাঁদা হিসেবে ১০০০ পেসেতা দিয়ে দিও।’’
তার বাবা দন ফেদেরিকো অশুভ সেই চিরকুট নিজের ওয়ালেটে বাকি জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। জনকের কাছে পুত্রের লাশের চেয়ে কম ভারি ছিলো না তা।
লোরকার মা দোনা ভিসেন্তা ছিলেন সুশিক্ষিত, সাহিত্য-সঙ্গীতের সমঝদার, কল্পনাপ্রতিভাধর এক নারী। ছেলে লোরকাকে সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন তিনি। মায়ের যাবতীয় সদগুণ জন্মদাগের মতো সঙ্গী হয়েছিলো লোরকার। শৈশবে অসুস্থতা ছিলো নিত্যসঙ্গী। চার বছর বয়স পর্যন্ত হাঁটার ক্ষমতা ছিলো না। পরে হাঁটতে শিখলেন বটে, তা-ও আবার খুঁড়িয়ে। খেলাধুলা করার মতো শারীরিক সামর্থ্য ছিলো না বলে মেতে থাকতেন অন্যসব শিশুতোষ আনন্দে, নতুন নতুন উদ্ভাবনের নেশায়। দু’বছর বয়সেই আধো আধো গলায় গান গেয়ে তাক লাগিয়ে দিতেন আশপাশের সবাইকে। তিন বছরে পা দিতে না দিতেই কল্পিত চার্চ মাস (Imaginary Church Mass)-এর আদলে মিনিয়েচার থিয়েটার সাজানো ছিলো শিশু লোরকার প্রিয় খেলাগুলোর একটি। বাড়ির পাশের গির্জার পাদ্রীকে নকল করে চলতো ‘খুৎবা পাঠ’ (Sermon)। আর সেটা এমনই উপভোগ্য হতো যে পাড়াসুদ্ধু লোক শুনতো নরম-নীরব হয়ে। তবে ফেদেরিকো নামের ছোট্ট সে পাদ্রী আগেভাগেই শর্ত দিয়ে রাখতো, ‘খুৎবা’ শুনে সবাইকে কাঁদতে হবে। অন্যরা কান্নার অভিনয় করলেও, গৃহকর্মীদের একজন সত্যি সত্যিই কাঁদতো। সে কান্না সহজে থামতো না। এমনই অভিনয়প্রতিভা ছিলো লোরকার।
ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলেন না। তবে তার সঙ্গীতপ্রতিভা বোদ্ধাদেরও প্রশংসা কুড়ায়। পিয়ানো আর গিটার বাদনে তার পারদর্শিতা ছিলো ঈর্ষণীয়। পিয়ানোতে বেটোফেনের (Bethoven) সোনাটা বাজিয়ে সেন্ত্রো র্আতিস্তিকো দ্য গ্রানাদার তৎকালীন প্রধান ফার্নান্দো দ্য লস রিয়োসকে পর্যন্ত তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। রিয়োসের ভাষায়, লোরকা এক অসাধারণ সঙ্গীতপ্রতিভা (Extraordinary Musical Talent)। বলা বাহুল্য লোরকার কবিতার সাঙ্গীতিক বৈশিষ্ট্য ও গীতলতার পেছনে তার এই সঙ্গীতপ্রেমের ভূমিকা অনেক।
উচ্চশিক্ষার জন্য লোরকা প্রথমে গ্রানাদা, পরে ভর্তি হন মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
লোরকার বন্ধুবৃত্তটা ছিলো অনেক তারায় ভরা। কে না ছিলেন সেখানে! কবিতা, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নাটক থেকে শুরু করে বুলফাইটের দুনিয়া-মশহুর নায়কেরা ছিলেন তার বন্ধু। চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি, চলচ্চিত্রনির্মাতা লুই বুনুয়েল, কবি পাবলো নেরুদা, রাফায়েল আলবের্তি, হোর্হে গিয়্যেন, হুয়ান রামোন হিমেনেথ, পেদ্রো সালিনাস, দামাসো আলোনসো, লুইস সেরনুদা, বুলফাইটার-কবি-নাট্যকার ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াস — কতো কতো প্রোজ্জ্বল নাম!
সালভাদর দালির সঙ্গে তার ঘটনাবহুল বন্ধুত্ব নানা কারণে আলোচিত। দালি-লোরকার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ১৯২৩ সালে। দালির প্রখর ব্যক্তিত্ব আর সুন্দর চেহারা দুটোরই প্রেমে পড়েছিলেন লোরকা। আর লোরকাও গভীরভাবে আলোড়িত করেছিলেন দালিকে। কিন্তু সে বন্ধুতায়ও ফাটল ধরলো যখন কিনা দালি আর বুনুয়েল মিলে নির্মাণ করলেন স্পল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র Un Chien Andalou (১৯২৮)। লোরকার ধারণা, তাকে নিয়েই বানানো হয়েছে এ ছবি। সমকামিতার প্রসঙ্গ ছিলো তাতে। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, দালির সঙ্গে তার বন্ধুত্বের প্রেরণায় আধুনিক শিল্পকলা ও সমকামিতার সাফাই গেয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন লোরকা। এছাড়া সমকামিতাকে উপজীব্য করে নাটকও লিখেছিলেন যা ছিলো তার সময়ে এক বিরাট ট্যাবু।
ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিক থেকে দালি-লোরকা যেমন ছিলেন মানিকজোড়, তেমনি শিল্পের সাধনায়ও ছিলেন যুগলবন্দি। সুবাদে কবিতা, নাটক আর চিত্রকলা হয়ে উঠেছিল একটি অন্যটির পরিপূরক।
দালি তার আত্মজীবনী Secret Life-এ লোরকার প্রশস্তি গেয়েছেন:
“The poetic phenomenon in its entirety and `in the raw’ presented itself before me suddenly in flesh and bone, confused, blood-red, viscious and sublime, quivering with a thousand fires of darkness and subterranean biology, like all matter endowed with originality of its own.’’
আর ‘Oda a Salvador Dali’ ( Ode to Salvador Dali) কবিতায় লোরকা লেখেন:
“O,Salvador Dali, voice steeped in olives!
I speak of what your person and your art tell me .
I praise not your imperfect adolescent brush,
but sing in the firm direction of your arrows.
I sing your handsome energy full of light.
Your love of what has a possible explanation.’’
(Edwin Honig-এর ইংরেজি অনুবাদ )
`…Era la misma
pena cantando
detrás de una sonrisa.’
উপরের তিনটি চরণের ইংরেজি ভাষান্তর হাতের কাছে নেই। স্প্যানিশ ভাষায় আমার হাঁটুভাঙা যেটুকু জ্ঞান তাতে বাংলা করলে অনেকটা এরকম দাঁড়ায়:
‘নিজের অসহ যাতনা
ছিলো সে নিজে
হাসিতে তা ঢেকে গেয়ে গেছে নিজ গান’
বহু সংস্কৃতির ঐকতান-ধ্বনিত গ্রানাদা, বহু শতাব্দীর বিস্ময়-খচিত গ্রানাদা এমন এক উন্মুক্ত স্বর্গের নাম একদা যাতে এসে মিশেছিল নানা জাতির রক্ত আর মেধা, পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের ঢেউয়ের কলতান আর নিকটপ্রাচ্যের বহুবর্ণিলতা, গ্রিক, আরব আর রোমানদের নানা গরিমা আর জিপসিদের অনিকেতবৃত্তি। এসব কিছুকেই সাঙ্গীকৃত করে এগিয়েছেন লোরকা। আন্দালুসিয়ার লোক-ঐতিহ্যের উদ্দীপক ইডিয়ম আর মেটাফরকে তিনি খুঁজে ফিরেছেন তার কবিতায় নাটকে। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার এমন সংরাগদীপ্ত মেলবন্ধন স্পেনের আর কোনো কবির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজো, তার মৃত্যুর এতোকাল পরেও, স্পেনের মানুষ লোরকার কবিতার মধ্য দিয়ে নিজেদের চেনাতে ভালোবাসে। সম্ভবত আধুনিক কালে তিনিই একমাত্র কবি যার কবিতাকে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত আর অশিক্ষিত সবাই ভালোবাসে;`…a poet whose worth is loved and acclaimed by the illiterate and the sophisticated alike.’ এ সত্ত্বেও লোরকা ছিলেন আধুনিক কালের সবচে’ জটিল কবিদের একজন। কেননা ব্যক্তিগত কাব্যভাষা ও ইডিয়ম তৈরির জন্য ক্রম অপসৃয়মান এক লোকজীবনের ভাবাবেগের সঙ্গে ক্রম আগ্রাসী, ক্রম জটিল আর শিল্পায়িত এক পৃথিবীর মূল্যবোধের মেলবন্ধন ঘটাবার প্রায়-অসম্ভব কাজে হাত দিতে হয়েছিল তাকে। কবিতার টেকনিক আর উপাদানের জন্য সমসাময়িকদের দিকে যেমন, তেমনি তিনি অকুণ্ঠিতভাবে হাত বাড়িয়েছেন মধ্যযুগের আরব কবিদের দিকে, গ্রিক-রোমান কাব্যের অতীত ঐতিহ্যের দিকে, পুরাণ-উপকথার দিকে ।
প্রেম, ভাবাবেগ আর সহিংস মৃত্যু — সর্বদাই এ তিনটি তার কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। সবকিছু ছাপিয়ে বারংবার নিজের মৃত্যুর প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তার কবিতা ও নাটকে। এমনকি লঘু রচনায়ও তার দেখা মেলে। তার নিতান্তই হাল্কারসের একটি লেখা শেষ হয়েছে মৃত্যুর অনুষঙ্গ দিয়ে: “Take me by the hands, my love, / for I come quite badly wounded / Dying of love!’’
লোরকার চোখে মৃত্যু এক নীরব আগন্তুক, সর্বদা মুখোশ-পরে-থাকা মনোলিথিক এক শক্তি, যে বিনা বাধায় জীবনের টুঁটি টিপে ধরে মেতে ওঠে অনিবার উল্লাসে। তার তীব্র নখরে বন্দি জীবনের ত্রস্ত বুলবুল:“…Three thousand men came armed with shining knives to assasinate the nightingale.’’
এ রকম অসংখ্য ভয় জাগানিয়া, রোমহর্ষক চিত্রকল্প ছড়িয়ে আছে তার কবিতায় কবিতায়। ‘নিউ ইয়র্কে কবি’ (Poeta en Nueva York) নামের কবিতায় এভাবেই নিজের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করেন লোরকা:
“ ..I sensed that they had murdered me.
They swept through cafes, graveyards, churches,
They opened the wine-casks and the closets,
They ravaged three skeletons to yank the gold teeth out.
But they never found me.
They never found me?
No, they never found me.’’
(Edwin Honig-এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত)
লোরকা হয়তো ফালাঙ্গিস্তদের দিক থেকে নিজের ঘনায়মান বিপদ আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ডানপন্থি এক বন্ধুর কাছে। তবু শেষরক্ষা হয়নি। বন্ধুটির অনুপস্থিতির সুযোগে খুনে ব্ল্যাক গার্ড বাহিনীর লোকেরা সিভিল গভর্নমেন্ট বিল্ডিংয়ে তার বন্ধুর বাসা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তার পরের ঘটনা সবার জানা। বিনা বিচারে পরদিন ভোরে গুলি করে মারা হয় স্পেনের সর্বকালের সেরা কবিরত্নটিকে। এক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, খুন করার আগে লোরকাকে তার নিজের কবর খুঁড়তে বাধ্য করে ওরা।
‘‘ওর (লোরকার) পায়ুপথে দু’দুটো গুলি ছুড়েছিলাম আমি…’’ — খুনিদের একজন পরে গর্ব করে বলেছিলো।
এমনই নৃশংস, বীভৎস সে মৃত্যু! খুন করার আগে লোরকাকে দিয়ে একটি চিরকুট লিখিয়ে নিয়ে বাহকের মাধ্যমে তা পাঠানো হয় তার বাবার কাছে। সেই চিরকুটে লোরকা লিখেছিলেন: ‘প্লিজ বাবা, এই লোকের হাতে আর্মির জন্য চাঁদা হিসেবে ১০০০ পেসেতা দিয়ে দিও।’’
তার বাবা দন ফেদেরিকো অশুভ সেই চিরকুট নিজের ওয়ালেটে বাকি জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। জনকের কাছে পুত্রের লাশের চেয়ে কম ভারি ছিলো না তা।
লোরকার মা দোনা ভিসেন্তা ছিলেন সুশিক্ষিত, সাহিত্য-সঙ্গীতের সমঝদার, কল্পনাপ্রতিভাধর এক নারী। ছেলে লোরকাকে সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন তিনি। মায়ের যাবতীয় সদগুণ জন্মদাগের মতো সঙ্গী হয়েছিলো লোরকার। শৈশবে অসুস্থতা ছিলো নিত্যসঙ্গী। চার বছর বয়স পর্যন্ত হাঁটার ক্ষমতা ছিলো না। পরে হাঁটতে শিখলেন বটে, তা-ও আবার খুঁড়িয়ে। খেলাধুলা করার মতো শারীরিক সামর্থ্য ছিলো না বলে মেতে থাকতেন অন্যসব শিশুতোষ আনন্দে, নতুন নতুন উদ্ভাবনের নেশায়। দু’বছর বয়সেই আধো আধো গলায় গান গেয়ে তাক লাগিয়ে দিতেন আশপাশের সবাইকে। তিন বছরে পা দিতে না দিতেই কল্পিত চার্চ মাস (Imaginary Church Mass)-এর আদলে মিনিয়েচার থিয়েটার সাজানো ছিলো শিশু লোরকার প্রিয় খেলাগুলোর একটি। বাড়ির পাশের গির্জার পাদ্রীকে নকল করে চলতো ‘খুৎবা পাঠ’ (Sermon)। আর সেটা এমনই উপভোগ্য হতো যে পাড়াসুদ্ধু লোক শুনতো নরম-নীরব হয়ে। তবে ফেদেরিকো নামের ছোট্ট সে পাদ্রী আগেভাগেই শর্ত দিয়ে রাখতো, ‘খুৎবা’ শুনে সবাইকে কাঁদতে হবে। অন্যরা কান্নার অভিনয় করলেও, গৃহকর্মীদের একজন সত্যি সত্যিই কাঁদতো। সে কান্না সহজে থামতো না। এমনই অভিনয়প্রতিভা ছিলো লোরকার।
ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলেন না। তবে তার সঙ্গীতপ্রতিভা বোদ্ধাদেরও প্রশংসা কুড়ায়। পিয়ানো আর গিটার বাদনে তার পারদর্শিতা ছিলো ঈর্ষণীয়। পিয়ানোতে বেটোফেনের (Bethoven) সোনাটা বাজিয়ে সেন্ত্রো র্আতিস্তিকো দ্য গ্রানাদার তৎকালীন প্রধান ফার্নান্দো দ্য লস রিয়োসকে পর্যন্ত তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। রিয়োসের ভাষায়, লোরকা এক অসাধারণ সঙ্গীতপ্রতিভা (Extraordinary Musical Talent)। বলা বাহুল্য লোরকার কবিতার সাঙ্গীতিক বৈশিষ্ট্য ও গীতলতার পেছনে তার এই সঙ্গীতপ্রেমের ভূমিকা অনেক।
উচ্চশিক্ষার জন্য লোরকা প্রথমে গ্রানাদা, পরে ভর্তি হন মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
লোরকার বন্ধুবৃত্তটা ছিলো অনেক তারায় ভরা। কে না ছিলেন সেখানে! কবিতা, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নাটক থেকে শুরু করে বুলফাইটের দুনিয়া-মশহুর নায়কেরা ছিলেন তার বন্ধু। চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি, চলচ্চিত্রনির্মাতা লুই বুনুয়েল, কবি পাবলো নেরুদা, রাফায়েল আলবের্তি, হোর্হে গিয়্যেন, হুয়ান রামোন হিমেনেথ, পেদ্রো সালিনাস, দামাসো আলোনসো, লুইস সেরনুদা, বুলফাইটার-কবি-নাট্যকার ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াস — কতো কতো প্রোজ্জ্বল নাম!
সালভাদর দালির সঙ্গে তার ঘটনাবহুল বন্ধুত্ব নানা কারণে আলোচিত। দালি-লোরকার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ১৯২৩ সালে। দালির প্রখর ব্যক্তিত্ব আর সুন্দর চেহারা দুটোরই প্রেমে পড়েছিলেন লোরকা। আর লোরকাও গভীরভাবে আলোড়িত করেছিলেন দালিকে। কিন্তু সে বন্ধুতায়ও ফাটল ধরলো যখন কিনা দালি আর বুনুয়েল মিলে নির্মাণ করলেন স্পল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র Un Chien Andalou (১৯২৮)। লোরকার ধারণা, তাকে নিয়েই বানানো হয়েছে এ ছবি। সমকামিতার প্রসঙ্গ ছিলো তাতে। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, দালির সঙ্গে তার বন্ধুত্বের প্রেরণায় আধুনিক শিল্পকলা ও সমকামিতার সাফাই গেয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন লোরকা। এছাড়া সমকামিতাকে উপজীব্য করে নাটকও লিখেছিলেন যা ছিলো তার সময়ে এক বিরাট ট্যাবু।
ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিক থেকে দালি-লোরকা যেমন ছিলেন মানিকজোড়, তেমনি শিল্পের সাধনায়ও ছিলেন যুগলবন্দি। সুবাদে কবিতা, নাটক আর চিত্রকলা হয়ে উঠেছিল একটি অন্যটির পরিপূরক।
দালি তার আত্মজীবনী Secret Life-এ লোরকার প্রশস্তি গেয়েছেন:
“The poetic phenomenon in its entirety and `in the raw’ presented itself before me suddenly in flesh and bone, confused, blood-red, viscious and sublime, quivering with a thousand fires of darkness and subterranean biology, like all matter endowed with originality of its own.’’
আর ‘Oda a Salvador Dali’ ( Ode to Salvador Dali) কবিতায় লোরকা লেখেন:
“O,Salvador Dali, voice steeped in olives!
I speak of what your person and your art tell me .
I praise not your imperfect adolescent brush,
but sing in the firm direction of your arrows.
I sing your handsome energy full of light.
Your love of what has a possible explanation.’’
(Edwin Honig-এর ইংরেজি অনুবাদ )
‘‘ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াসের মৃত্যু’’ প্রসঙ্গে
ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াস লোরকার প্রিয় বন্ধুদের একজন। ছিলেন একাধারে সুদক্ষ মাতাদোর (ষাঁড়-লড়িয়ে), কবি ও নাট্যকার। পরাবাস্তব....
ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াস লোরকার প্রিয় বন্ধুদের একজন। ছিলেন একাধারে সুদক্ষ মাতাদোর (ষাঁড়-লড়িয়ে), কবি ও নাট্যকার। পরাবাস্তব....
(ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াস (৬/৬/১৮৯১ — ১৩/৮/১৯৩৪)
একটি নাটকও আছে ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াসের। মাতাদোর হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে তখন গোটা স্পেনে। অবশ্য মাঝপথে ষাঁড়-লড়াইয়ে বেশ কিছুদিন ক্ষান্ত দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অন্যসব সৃষ্টির নেশায়। পরে আবার রক্তের টানে ফিরতে চেয়েছিলেন রিংয়ে। আর সেটাই শেষ। ষাঁড়-মানুষের লড়াইয়ে এ যাত্রা জয়ী হয় ষাঁড়।
রিংয়ে প্রিয় বন্ধু ইগনাসিও মেহিয়াসের মৃত্যু তীব্রভাবে নাড়া দেয় লোরকাকে। বন্ধুর মৃত্যুকে উপজীব্য করে লোরকা ১৯৩৫ সালে যে দীর্ঘ কবিতাটি রচনা করেন অনেক সমালোচকের চোখে তা লোরকার সর্বোত্তম কবিতা। হিস্পানি ভাষার শ্রেষ্ঠ ৪টি শোকগাথার একটি হিসেবেও গণ্য করা হয় একে। কবিতাটি ৪টি ভাগে বিভক্ত। তবে এদের আলাদা আলাদা মোটিফগুলো আবার একসূত্রে গ্রথিত। এ কবিতায় নিজের প্রথম দিককার কবিতার গীতলতার সঙ্গে ব্যালাডের বর্ণনাত্মক রীতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন লোরকা। সেই সঙ্গে ট্রাজেডির গভীর আবহ সৃষ্টির জন্য তাতে যোগ করেছেন জিপসি বিলাপগাথার রিদম, ব্যবহার করেছেন নাট্য আঙ্গিক আর লোকগাথার উপাদান।
‘‘ত্রাদিত্তোরে ত্রাদুত্তুরে’’ — অনুবাদক বিশ্বাসঘাতক। এই বদনাম মাথায় নিয়েও ‘তোমাকে শিকার করে ফিরি যেন, যদ্যপি না পাই’ — ভিন্ন ভাষার মধুরতাকে আপন ভাষায় শিকার করার নাছোড়, দুর্মর চেষ্টাটি সতত চলমান। যেহেতু ‘অনুবাদ আসলে একটা চমৎকার ছল, নিজেকে আবিষ্কার করার বিনীত উপায়’ — যেমনটি বলেছেন শক্তিমান দুই কবি-অনুবাদক শঙ্খ ঘোষ আর অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। তবে একথা মানছি, নিতান্ত আবেগ-সম্বল আমার মতো অক্ষম, বেলায়েক অনুবাদকের ‘স্থানে স্থানে প্রকাশিত নিজ মন উক্তি’ প্রায়শই মূল রচনার বারোটা বাজায়। বিশ্বাসহন্তাই শুধু নয়, বোধ করি অনুবাদক কখনো কখনো হয়ে ওঠে আততায়ী।
আবার অনুবাদ যদি রসোত্তীর্ণও হয় তবুও কি সবার মনপসন্দ হয় তা? মূলের আত্মা কি ধরা দেয় অপর ভাষায়? বিশেষত কবিতায়? দুটি ভাষার তীব্র চুম্বনের মাঝখানেও কি থেকে যায় না অদৃশ্য কাচের দেয়াল?
উল্টো পিঠেও কথা থাকে, এ ব্যবধানও ঘুচিয়ে দিতে পারেন কেউ কেউ, কঠিন নির্মোক ভেঙে এনে দেন মণি ও মুকুতা। করাঙ্গুলিগণনীয় তারা। আমার সময়ে, আমার প্রজন্মের কারো কারো মধ্যেও পেয়ে যাই এমন প্রায়-অলৌকিক গুণপনা। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ নামের একজন আছেন; মিদাসের স্পর্শ নিয়ে হস্ত তার সতত ফলিয়ে যাচ্ছে সোনা। ওর অনুবাদে কোলরিজের ‘কুবলা খান’ বারবার পড়ি। অবাক হয়ে ভাবি, কী করে ‘সারাক্ষণ কলস্বর রণিত আবেশে!’ আমারও উড়িবার হয় সাধ। আমা হেন তাঁতীরও ফার্সি পড়বার খায়েশ জাগে।
লোরকার এ দীর্ঘ ব্যঞ্জনামধুর, বিয়োগবেদনাদীপ্ত অসামান্য কবিতাটি অনুবাদ করতে গেছি ক্ষমতা নয়, শুধু প্রেম সম্বল করে। তাতে বালখিল্যতা আছে, আছে ভাবাবেগ আর নিজেকে পরখ, আবিষ্কার করে নেয়ার চেষ্টা। কবিতাটির আভা ও গরিমা বাংলায় আমার করা অনুবাদে কতোটা ধরা পড়েছে সে বিচার সংবেদী পাঠকের। অনুবাদকর্মটির (কাণ্ডটির?) প্রথম পাঠক আমার দুই গুণী বন্ধু। প্রথম জন কবি শরিফ শাহরিয়ার, দ্বিতীয় জন কবি-অনুবাদক সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। সুব্রতর বিস্তারিত মন্তব্য ও পরামর্শ আমার অনুবাদকর্মটির প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জনে দারুণ কাজে লেগেছে। অবশ্য অনেক স্থানে ওর পরামর্শ মানা সম্ভব হয়নি। সেটা কিছুটা আমার ব্যক্তিরুচি আর বাকিটা আমার ক্ষমতার দৌড়ের সীমাবদ্ধতার কারণে। যেসব স্থানে ওর পরামর্শ মানা সম্ভব হয়েছে, বোধ করি, সেখানটায় এসে অনুবাদ যৎকিঞ্চিৎ উৎরে (?) গেছে। বন্ধু হয়ে ওকে স্রেফ ধন্যবাদ জানানোর মতো ছোটোলোকি আমায় মানায় না। আমেন!!!
রিংয়ে প্রিয় বন্ধু ইগনাসিও মেহিয়াসের মৃত্যু তীব্রভাবে নাড়া দেয় লোরকাকে। বন্ধুর মৃত্যুকে উপজীব্য করে লোরকা ১৯৩৫ সালে যে দীর্ঘ কবিতাটি রচনা করেন অনেক সমালোচকের চোখে তা লোরকার সর্বোত্তম কবিতা। হিস্পানি ভাষার শ্রেষ্ঠ ৪টি শোকগাথার একটি হিসেবেও গণ্য করা হয় একে। কবিতাটি ৪টি ভাগে বিভক্ত। তবে এদের আলাদা আলাদা মোটিফগুলো আবার একসূত্রে গ্রথিত। এ কবিতায় নিজের প্রথম দিককার কবিতার গীতলতার সঙ্গে ব্যালাডের বর্ণনাত্মক রীতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন লোরকা। সেই সঙ্গে ট্রাজেডির গভীর আবহ সৃষ্টির জন্য তাতে যোগ করেছেন জিপসি বিলাপগাথার রিদম, ব্যবহার করেছেন নাট্য আঙ্গিক আর লোকগাথার উপাদান।
‘‘ত্রাদিত্তোরে ত্রাদুত্তুরে’’ — অনুবাদক বিশ্বাসঘাতক। এই বদনাম মাথায় নিয়েও ‘তোমাকে শিকার করে ফিরি যেন, যদ্যপি না পাই’ — ভিন্ন ভাষার মধুরতাকে আপন ভাষায় শিকার করার নাছোড়, দুর্মর চেষ্টাটি সতত চলমান। যেহেতু ‘অনুবাদ আসলে একটা চমৎকার ছল, নিজেকে আবিষ্কার করার বিনীত উপায়’ — যেমনটি বলেছেন শক্তিমান দুই কবি-অনুবাদক শঙ্খ ঘোষ আর অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। তবে একথা মানছি, নিতান্ত আবেগ-সম্বল আমার মতো অক্ষম, বেলায়েক অনুবাদকের ‘স্থানে স্থানে প্রকাশিত নিজ মন উক্তি’ প্রায়শই মূল রচনার বারোটা বাজায়। বিশ্বাসহন্তাই শুধু নয়, বোধ করি অনুবাদক কখনো কখনো হয়ে ওঠে আততায়ী।
আবার অনুবাদ যদি রসোত্তীর্ণও হয় তবুও কি সবার মনপসন্দ হয় তা? মূলের আত্মা কি ধরা দেয় অপর ভাষায়? বিশেষত কবিতায়? দুটি ভাষার তীব্র চুম্বনের মাঝখানেও কি থেকে যায় না অদৃশ্য কাচের দেয়াল?
উল্টো পিঠেও কথা থাকে, এ ব্যবধানও ঘুচিয়ে দিতে পারেন কেউ কেউ, কঠিন নির্মোক ভেঙে এনে দেন মণি ও মুকুতা। করাঙ্গুলিগণনীয় তারা। আমার সময়ে, আমার প্রজন্মের কারো কারো মধ্যেও পেয়ে যাই এমন প্রায়-অলৌকিক গুণপনা। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ নামের একজন আছেন; মিদাসের স্পর্শ নিয়ে হস্ত তার সতত ফলিয়ে যাচ্ছে সোনা। ওর অনুবাদে কোলরিজের ‘কুবলা খান’ বারবার পড়ি। অবাক হয়ে ভাবি, কী করে ‘সারাক্ষণ কলস্বর রণিত আবেশে!’ আমারও উড়িবার হয় সাধ। আমা হেন তাঁতীরও ফার্সি পড়বার খায়েশ জাগে।
লোরকার এ দীর্ঘ ব্যঞ্জনামধুর, বিয়োগবেদনাদীপ্ত অসামান্য কবিতাটি অনুবাদ করতে গেছি ক্ষমতা নয়, শুধু প্রেম সম্বল করে। তাতে বালখিল্যতা আছে, আছে ভাবাবেগ আর নিজেকে পরখ, আবিষ্কার করে নেয়ার চেষ্টা। কবিতাটির আভা ও গরিমা বাংলায় আমার করা অনুবাদে কতোটা ধরা পড়েছে সে বিচার সংবেদী পাঠকের। অনুবাদকর্মটির (কাণ্ডটির?) প্রথম পাঠক আমার দুই গুণী বন্ধু। প্রথম জন কবি শরিফ শাহরিয়ার, দ্বিতীয় জন কবি-অনুবাদক সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। সুব্রতর বিস্তারিত মন্তব্য ও পরামর্শ আমার অনুবাদকর্মটির প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জনে দারুণ কাজে লেগেছে। অবশ্য অনেক স্থানে ওর পরামর্শ মানা সম্ভব হয়নি। সেটা কিছুটা আমার ব্যক্তিরুচি আর বাকিটা আমার ক্ষমতার দৌড়ের সীমাবদ্ধতার কারণে। যেসব স্থানে ওর পরামর্শ মানা সম্ভব হয়েছে, বোধ করি, সেখানটায় এসে অনুবাদ যৎকিঞ্চিৎ উৎরে (?) গেছে। বন্ধু হয়ে ওকে স্রেফ ধন্যবাদ জানানোর মতো ছোটোলোকি আমায় মানায় না। আমেন!!!
------------------
bdnews24 এর সৌজন্যে
অনুবাদ: জুয়েল মাজহার
এই কবিতা গুলো পড়া হয়েছে...
No comments