শবে বরাত সৌভাগ্য ও মুক্তির রজনী -ধর্ম by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
শবে বরাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশেষ তাৎপর্যময় রজনী। পরম সৌভাগ্যের রাত। শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত সৌভাগ্যের রজনী হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। ‘শব’ ফার্সি শব্দ, এর অর্থ রজনী বা রাত্রি। ‘বরাত’ শব্দটির ব্যবহার ফার্সি ও আরবি উভয় ভাষাতেই রয়েছে। ফার্সিতে ‘বরাত’ শব্দের অর্থ ভাগ্য বা সৌভাগ্য, এদিক থেকে ফার্সি ভাষায় ‘শবে বরাত’ অর্থ ভাগ্যের রজনী বা সৌভাগ্যের রাত। শব্দটির অন্য অর্থও আছে। শবে বরাতকে আরবিতে ‘লাইলাতুল বারাআত’ নামে অভিহিত করা হয়। ‘লাইলাতুন’ একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ রাত বা রজনী, আরবিতে ‘বারাআত’ শব্দের অর্থ মুক্তি, নাজাত, নিষ্কৃতি, দায়মুক্তি, অব্যাহতি প্রভৃতি। ‘লাইলাতুল বারাআত’ মানে মুক্তির রজনী বা নিষ্কৃতির রজনী। এ রাতে আল্লাহর খাঁটি বান্দারা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে মার্জনা লাভ করে থাকেন, তাই এ রাতকে ‘লাইলাতুল বারাআত’ বা শবে বরাত বলা হয়।
নবী করিম (সা.) এ রাত্রিকে ‘লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান’ অর্থাৎ অর্ধ শাবানের রাত্রি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাই ইসলামের অনুসারীদের কাছে শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাত তথা হাদিসের পরিভাষায় নিসেফ শাবানের রাত্রিটি অত্যন্ত বরকতময় ও মহিমান্বিত বলে বিবেচিত। আল্লাহ তাআলা মানবজাতির জন্য তাঁর অসীম রহমতের দরজা এ রাতে খুলে দেন। শবে বরাত পরম করুণাময়ের দরবারে নিজের সারা জীবনের দোষ-ত্রুটি, পাপকাজ ও অন্যায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার রাত। এ রাতে মনে-প্রাণে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করে স্রষ্টার কাছে নিজের গুনাহ ও অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তা কবুল করেন এবং অনুতপ্ত বান্দাকে পাপ থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে মাফ করে দেন। এ কারণেই এ রাত মুক্তির রজনী বা নিষ্কৃতির রজনী।
শবে বরাতকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারটি রজনীর অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়। কেননা, এ রাতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ পরবর্তী বছরের জন্য বান্দার রিজিক নির্ধারণ করে সবার ভাগ্যলিপি লেখেন এবং বান্দার সব গুনাহ মাফ করে দেন। এ রাতের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, পরবর্তী বছরের যাবতীয় ফয়সালা হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলত, আমল ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আদেশ-নিষেধসমূহ উক্ত রাত্রিতে লওহে মাহফুজ থেকে উদ্ধৃত করে কার্যনির্বাহক ফেরেশতাদের কাছে সোপর্দ করা হয়। এ রাতে মানুষের ভালো-মন্দ কাজকর্মের হিসাব-নিকাশ আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। নবী করিম (সা.)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী এ পবিত্র রাতে নফল ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে নিমগ্ন থাকাই প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাজ।
লাইলাতুল বরাতের ফজিলত সম্পর্কে বলা হয়েছে, বরকতময় এ রাতে মুমিন বান্দাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ বর্ষিত হয়। মানুষের আমলগুলো আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। মানব জাতির আগামী এক বছরের রিজিক নির্ধারিত হয়। এ রাতেই পরবর্তী বছরের মৃত্যুবরণকারী এবং পরবর্তী বছরের জন্মগ্রহণকারী শিশুদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। এ রাতে ২০ ধরনের বিশেষ অপরাধী ছাড়া বাকি সবাইকে ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। এ রাতে আল্লাহ তাআলা মাখলুকাতের দিকে বিশেষ রহমতের দৃষ্টিতে তাকান। বান্দাদের আকুতি-মিনতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণেরও রাত্রি এটা। আল্লাহ তাআলা ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং বিপদগ্রস্তদের উত্তরণের পথ দেখান। এ জন্যই মুসলমানদের কাছে শবে বরাত বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ বরকতময় রজনীতে কী কী ঘটে, এ প্রসঙ্গে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে, রাসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘হে আয়েশা! তুমি কি জানো মধ্য শাবানের রজনীতে কী হয়?’ তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! এতে কী হয়?’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘এ রাতে লেখা হয় সেসব আদমসন্তানের কথা, যারা আগামী এক বছরে মৃত্যুবরণ করবে। এ রাতে বান্দার আমল ঊর্ধ্বজগতে উত্তোলিত হয় এবং বান্দার রিজিক নাজিল করা হয়।’ (বায়হাকি)
শবে বরাতের এ রাতে মাগরিবের সময় থেকে আল্লাহ তাআলা আসমানে অবস্থান করেন এবং ফজর পর্যন্ত তাঁর অশেষ রহমত বিতরণ করেন। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কাছে আহ্বান করেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো জীবিকার সন্ধানী আছে কি? আমি তাকে জীবিকা দান করব। আছে কি কোনো ব্যথিত, বিপদগ্রস্ত, নিষ্কৃতি লাভের প্রত্যাশী? আমি তাকে নিষ্কৃতিদান করব। এভাবে সব শ্রেণীর মুমিনের জন্য মহান প্রতিপালক তাঁর সাধারণ ক্ষমা ও দানের দুয়ার অবারিত করে দেন এ রাতে। মানবজীবনের এক একটি সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি তা দূর করে দেওয়ার আশ্বাস দেন। একজন মানুষের একেকটি আকাঙ্ক্ষার কথা উল্লেখ করে করে তা মঞ্জুর করিয়ে নেওয়ার জন্য ডাকেন। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন অর্ধ শাবানের রাত্রি আসে, তখন তোমরা রাত জেগে ইবাদত কর এবং পরের দিনটিতে রোজা রাখ। কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিজিকপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দান করব। কোনো বিপদগ্রস্ত আছে কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করব। আর সুবহে সাদেক পর্যন্ত এ ডাক অব্যাহত থাকে।’ (ইবনে মাজা)
রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও গভীর স্রষ্টাপ্রেম আর আকুতি নিয়ে এ রাতে শয্যা ত্যাগ করে ইবাদতে নিমগ্ন হতেন। একদা উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.)-এর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে তিনি নীরবে জান্নাতুল বাকির নির্জন সমাধিস্থলে চলে গিয়েছিলেন। ক্ষমা, মুক্তি ও ভাগ্যের রজনী শবে বরাতে কোনো ধরাবাঁধা ইবাদত নেই। তবে বিশেষভাবে নবী করিম (সা.)-এর তিনটি আমলের কথা জানা যায়; ১. কবরস্থানে গমন এবং মৃত ব্যক্তিদের জন্য বিশেষভাবে দোয়া ও দান-খয়রাতের মাধ্যমে ইসালে সওয়াব। ২. যথাসাধ্য রাত্রি জাগরণ করে নফল নামাজ আদায়, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, নিজের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্ব্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবসহ মুসলমানদের জন্য কল্যাণ কামনা ও ক্ষমা প্রার্থনা ইত্যাদি। ৩. শবে বরাতে সেহরি খেয়ে পরবর্তী দিনটিতে রোজা রাখা। এগুলো অনুসরণ করা আমাদের জন্য সুন্নত এবং তা বরকতের বিশেষ উপায়।
শবে বরাতে করণীয় আমলের সঙ্গে কতগুলো বর্জনীয় বিষয়ও সম্পৃক্ত আছে। এসব অনৈসলামিক বিদাআত কার্যকলাপ বর্জন না করলে শবে বরাতের বরকত থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তাই এ রাতে অপব্যয় না করে এবং অযথা আতশবাজিতে অনর্থক অর্থ অপচয় না করে মানবতার কল্যাণকর কাজে বা গরিব-মিসকিনের মাঝে দান করে দেওয়া অনেক সওয়াব ও বরকতের কাজ। প্রকৃতপক্ষে শবে বরাতের বৈশিষ্ট্য অনুষ্ঠানের আড়ম্বরতার মধ্যে নয়, বরং চরিত্রবলের সাধনার মাধ্যমে দয়াময়ের করুণা লাভের আন্তরিক প্রয়াসই এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। এ রাতে অহেতুক আলোকসজ্জা করা, তারাবাতি জ্বালানো, আতশবাজি পোড়ানো, পটকা ফোটানো প্রভৃতি শরিয়ত গর্হিত কাজ। এতে ইবাদতে বিঘ্ন ঘটে। শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের এ বিষয়ে সতর্ক করা অবশ্যকর্তব্য। এ পবিত্র রজনীর দিকে লক্ষ রেখে শরিয়ত বিবর্জিত ও অনাহূত অর্থের অপচয় করে ইবাদত-বন্দেগিরত ধর্মপ্রাণ মানুষের আল্লাহর ধ্যানে বিঘ্ন না ঘটে, সেদিকে সবার দৃষ্টি রাখা উচিত।
একজন সজাগ মুমিন মুসলমানকেও শবে বরাতের সব ধরনের গর্হিত কুসংস্কার এড়িয়ে চলতে হয়, অন্যথায় লাভের বদলে লোকসানের আশঙ্কা দেখা দেয়। সাবধানতা অবলম্বনের বিশেষ দিকগুলোর অন্যতম এই যে, রাতভর ইবাদত-বন্দেগি করে যেন ফজর নামাজ বা ফজরের জামাত ছুটে না যায়। কারণ ফজরের নামাজ হচ্ছে ফরজ এবং তা জামাতে আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। পক্ষান্তরে শবে বরাতের অতিরিক্ত ইবাদত-বন্দেগি হচ্ছে নফল। তাই নফলের আবেগে ফরজ বা সুন্নতে মুয়াক্কাদা ছুটে যাওয়ার বিষয়টি মোটেই লাভজনক নয়। অতএব, শবে বরাতের ইবাদত প্রত্যেকের দৈহিক ও মানসিক সাধ্য অনুপাতে হতে হবে। আর ভোজন-বিলাসিতার অতিরিক্ত আয়োজনও শবে বরাতে কাম্য নয়। কারণ শবে বরাত ভোজের উৎসব নয়, বরং ইবাদতের রজনী। পুণ্যময় এ রজনীর আলোকমালায় সবার অন্তর হোক উদ্ভাসিত, দূর হোক কালিমা, সুখ-সমৃদ্ধি আসুক দেশের প্রতিটি ঘরে, এ রাত্রি সমগ্র জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনুক—স্রষ্টার কাছে কায়মনোবাক্যে এটাই হোক প্রার্থনা!
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com
নবী করিম (সা.) এ রাত্রিকে ‘লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান’ অর্থাৎ অর্ধ শাবানের রাত্রি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাই ইসলামের অনুসারীদের কাছে শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাত তথা হাদিসের পরিভাষায় নিসেফ শাবানের রাত্রিটি অত্যন্ত বরকতময় ও মহিমান্বিত বলে বিবেচিত। আল্লাহ তাআলা মানবজাতির জন্য তাঁর অসীম রহমতের দরজা এ রাতে খুলে দেন। শবে বরাত পরম করুণাময়ের দরবারে নিজের সারা জীবনের দোষ-ত্রুটি, পাপকাজ ও অন্যায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার রাত। এ রাতে মনে-প্রাণে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করে স্রষ্টার কাছে নিজের গুনাহ ও অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তা কবুল করেন এবং অনুতপ্ত বান্দাকে পাপ থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে মাফ করে দেন। এ কারণেই এ রাত মুক্তির রজনী বা নিষ্কৃতির রজনী।
শবে বরাতকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারটি রজনীর অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়। কেননা, এ রাতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ পরবর্তী বছরের জন্য বান্দার রিজিক নির্ধারণ করে সবার ভাগ্যলিপি লেখেন এবং বান্দার সব গুনাহ মাফ করে দেন। এ রাতের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, পরবর্তী বছরের যাবতীয় ফয়সালা হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলত, আমল ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আদেশ-নিষেধসমূহ উক্ত রাত্রিতে লওহে মাহফুজ থেকে উদ্ধৃত করে কার্যনির্বাহক ফেরেশতাদের কাছে সোপর্দ করা হয়। এ রাতে মানুষের ভালো-মন্দ কাজকর্মের হিসাব-নিকাশ আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। নবী করিম (সা.)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী এ পবিত্র রাতে নফল ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে নিমগ্ন থাকাই প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাজ।
লাইলাতুল বরাতের ফজিলত সম্পর্কে বলা হয়েছে, বরকতময় এ রাতে মুমিন বান্দাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ বর্ষিত হয়। মানুষের আমলগুলো আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। মানব জাতির আগামী এক বছরের রিজিক নির্ধারিত হয়। এ রাতেই পরবর্তী বছরের মৃত্যুবরণকারী এবং পরবর্তী বছরের জন্মগ্রহণকারী শিশুদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। এ রাতে ২০ ধরনের বিশেষ অপরাধী ছাড়া বাকি সবাইকে ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। এ রাতে আল্লাহ তাআলা মাখলুকাতের দিকে বিশেষ রহমতের দৃষ্টিতে তাকান। বান্দাদের আকুতি-মিনতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণেরও রাত্রি এটা। আল্লাহ তাআলা ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং বিপদগ্রস্তদের উত্তরণের পথ দেখান। এ জন্যই মুসলমানদের কাছে শবে বরাত বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ বরকতময় রজনীতে কী কী ঘটে, এ প্রসঙ্গে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে, রাসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘হে আয়েশা! তুমি কি জানো মধ্য শাবানের রজনীতে কী হয়?’ তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! এতে কী হয়?’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘এ রাতে লেখা হয় সেসব আদমসন্তানের কথা, যারা আগামী এক বছরে মৃত্যুবরণ করবে। এ রাতে বান্দার আমল ঊর্ধ্বজগতে উত্তোলিত হয় এবং বান্দার রিজিক নাজিল করা হয়।’ (বায়হাকি)
শবে বরাতের এ রাতে মাগরিবের সময় থেকে আল্লাহ তাআলা আসমানে অবস্থান করেন এবং ফজর পর্যন্ত তাঁর অশেষ রহমত বিতরণ করেন। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কাছে আহ্বান করেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো জীবিকার সন্ধানী আছে কি? আমি তাকে জীবিকা দান করব। আছে কি কোনো ব্যথিত, বিপদগ্রস্ত, নিষ্কৃতি লাভের প্রত্যাশী? আমি তাকে নিষ্কৃতিদান করব। এভাবে সব শ্রেণীর মুমিনের জন্য মহান প্রতিপালক তাঁর সাধারণ ক্ষমা ও দানের দুয়ার অবারিত করে দেন এ রাতে। মানবজীবনের এক একটি সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি তা দূর করে দেওয়ার আশ্বাস দেন। একজন মানুষের একেকটি আকাঙ্ক্ষার কথা উল্লেখ করে করে তা মঞ্জুর করিয়ে নেওয়ার জন্য ডাকেন। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন অর্ধ শাবানের রাত্রি আসে, তখন তোমরা রাত জেগে ইবাদত কর এবং পরের দিনটিতে রোজা রাখ। কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিজিকপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দান করব। কোনো বিপদগ্রস্ত আছে কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করব। আর সুবহে সাদেক পর্যন্ত এ ডাক অব্যাহত থাকে।’ (ইবনে মাজা)
রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও গভীর স্রষ্টাপ্রেম আর আকুতি নিয়ে এ রাতে শয্যা ত্যাগ করে ইবাদতে নিমগ্ন হতেন। একদা উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.)-এর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে তিনি নীরবে জান্নাতুল বাকির নির্জন সমাধিস্থলে চলে গিয়েছিলেন। ক্ষমা, মুক্তি ও ভাগ্যের রজনী শবে বরাতে কোনো ধরাবাঁধা ইবাদত নেই। তবে বিশেষভাবে নবী করিম (সা.)-এর তিনটি আমলের কথা জানা যায়; ১. কবরস্থানে গমন এবং মৃত ব্যক্তিদের জন্য বিশেষভাবে দোয়া ও দান-খয়রাতের মাধ্যমে ইসালে সওয়াব। ২. যথাসাধ্য রাত্রি জাগরণ করে নফল নামাজ আদায়, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, নিজের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্ব্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবসহ মুসলমানদের জন্য কল্যাণ কামনা ও ক্ষমা প্রার্থনা ইত্যাদি। ৩. শবে বরাতে সেহরি খেয়ে পরবর্তী দিনটিতে রোজা রাখা। এগুলো অনুসরণ করা আমাদের জন্য সুন্নত এবং তা বরকতের বিশেষ উপায়।
শবে বরাতে করণীয় আমলের সঙ্গে কতগুলো বর্জনীয় বিষয়ও সম্পৃক্ত আছে। এসব অনৈসলামিক বিদাআত কার্যকলাপ বর্জন না করলে শবে বরাতের বরকত থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তাই এ রাতে অপব্যয় না করে এবং অযথা আতশবাজিতে অনর্থক অর্থ অপচয় না করে মানবতার কল্যাণকর কাজে বা গরিব-মিসকিনের মাঝে দান করে দেওয়া অনেক সওয়াব ও বরকতের কাজ। প্রকৃতপক্ষে শবে বরাতের বৈশিষ্ট্য অনুষ্ঠানের আড়ম্বরতার মধ্যে নয়, বরং চরিত্রবলের সাধনার মাধ্যমে দয়াময়ের করুণা লাভের আন্তরিক প্রয়াসই এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। এ রাতে অহেতুক আলোকসজ্জা করা, তারাবাতি জ্বালানো, আতশবাজি পোড়ানো, পটকা ফোটানো প্রভৃতি শরিয়ত গর্হিত কাজ। এতে ইবাদতে বিঘ্ন ঘটে। শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের এ বিষয়ে সতর্ক করা অবশ্যকর্তব্য। এ পবিত্র রজনীর দিকে লক্ষ রেখে শরিয়ত বিবর্জিত ও অনাহূত অর্থের অপচয় করে ইবাদত-বন্দেগিরত ধর্মপ্রাণ মানুষের আল্লাহর ধ্যানে বিঘ্ন না ঘটে, সেদিকে সবার দৃষ্টি রাখা উচিত।
একজন সজাগ মুমিন মুসলমানকেও শবে বরাতের সব ধরনের গর্হিত কুসংস্কার এড়িয়ে চলতে হয়, অন্যথায় লাভের বদলে লোকসানের আশঙ্কা দেখা দেয়। সাবধানতা অবলম্বনের বিশেষ দিকগুলোর অন্যতম এই যে, রাতভর ইবাদত-বন্দেগি করে যেন ফজর নামাজ বা ফজরের জামাত ছুটে না যায়। কারণ ফজরের নামাজ হচ্ছে ফরজ এবং তা জামাতে আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। পক্ষান্তরে শবে বরাতের অতিরিক্ত ইবাদত-বন্দেগি হচ্ছে নফল। তাই নফলের আবেগে ফরজ বা সুন্নতে মুয়াক্কাদা ছুটে যাওয়ার বিষয়টি মোটেই লাভজনক নয়। অতএব, শবে বরাতের ইবাদত প্রত্যেকের দৈহিক ও মানসিক সাধ্য অনুপাতে হতে হবে। আর ভোজন-বিলাসিতার অতিরিক্ত আয়োজনও শবে বরাতে কাম্য নয়। কারণ শবে বরাত ভোজের উৎসব নয়, বরং ইবাদতের রজনী। পুণ্যময় এ রজনীর আলোকমালায় সবার অন্তর হোক উদ্ভাসিত, দূর হোক কালিমা, সুখ-সমৃদ্ধি আসুক দেশের প্রতিটি ঘরে, এ রাত্রি সমগ্র জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনুক—স্রষ্টার কাছে কায়মনোবাক্যে এটাই হোক প্রার্থনা!
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments