ক্ষমতা কীভাবে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে by আনিসুল হক
একটা মজার লেখা পেয়েছি দি আটলান্টিক নামের অন্তর্জাল পত্রিকার ডেইলি ডিশ সংস্করণে। জোনাহ লেহরার নামের একজন বিখ্যাত আমেরিকান মনোবিজ্ঞান-লেখক জানাচ্ছেন, ক্ষমতা কীভাবে মানুষকে দূষিত করে। তাঁর মতে, আমরা যখন সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি, তখন আর দশজন মানুষের অনুভূতিগুলো উপলব্ধি করা বন্ধ করে দিই। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ড্যাচার কেল্টনার গবেষণা করে বের করেছেন, ‘বহু ক্ষেত্রে ক্ষমতাবান মানুষেরা মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত-পাওয়া মানুষদের মতো ব্যবহার করতে শুরু করেন। ক্ষমতাবান মানুষদের আচরণ এমন হয়, যেন কেউ তাঁদের মাথা খুলে মগজের সেই অংশ সরিয়ে নিয়েছে, যা একজন মানুষের সহানুভূতি ও সঠিক আচরণের জন্য জরুরি। তখন আপনি খ্যাপাটে ও সংবেদনহীন আচরণ করতে থাকবেন।’
জোনাহ লেহরার বলছেন, ‘ক্ষমতা মানুষকে দেয় অর্থকড়ি। তার তখন আলাদা গাড়িচালক থাকে, তিনি তখন আলাদা রেস্তোরাঁয় খান, আর তিনি বিমানে ভিড় এড়িয়ে আলাদাভাবে গিয়ে সবার আগে বসেন। এরা কোনো কাজেরই না। এই কারণেই প্রেসিডেন্ট ওবামা সর্বদা চেষ্টা করেন যেন তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়েন, যেন চারপাশের খবর তাঁর জানা থাকে, তাই তিনি প্রতিদিন অন্তত ১০টা চিঠি পড়েন, যেগুলো আসে তাঁর নিজের নির্বাচনী এলাকা থেকে আর চেষ্টা করেন যত বেশিসংখ্যক ব্লগ অনুসরণ করতে।’
২. বাংলাদেশ একটা গণতান্ত্রিক দেশ, এই দেশে আছে সংসদীয় গণতন্ত্র, আছে মন্ত্রিপরিষদচালিত সরকার, কিন্তু আমরা সবাই জানি, এটা আসলে চলছে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের আদলে, শুধু রাষ্ট্রপতির জায়গায় প্রধানমন্ত্রী চালাচ্ছেন সরকার। আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতেন সরাসরি জনগণের ভোটে, আর এখন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সংসদ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য।
মন্ত্রিপরিষদ সম্মিলিতভাবে দেশ চালাচ্ছে, আর মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে জনগণের, তাঁরা জবাবদিহি করছেন সংসদের কাছে, আর দলের কাছে, আর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জনগণের কাছে—এটা হওয়া উচিত আদর্শ। জবাবদিহিটাও আসল নয়, আসল হলো জনগণের চাওয়া-পাওয়াটা উপলব্ধি করা, জনগণের মনের খবরটা পড়তে পারা। এই কাজটা, আমাদের মতো কলামলেখকদের চেয়েও অনেক ভালোভাবে পারেন রাজনীতিবিদেরা, জনঘনিষ্ঠ রাজনীতিকেরা। এবং আমাদের চেয়ে অনেক ভালোভাবে পারে আওয়ামী লীগ, টেবিলের তর্কে এটা আমি সব সময় বলে এসেছি।
আওয়ামী লীগ, তার নামের মধ্যেই আছে আম শব্দটা, যার মানে জনগণ, জনগণেরই দল ছিল চিরটাকাল—সেই পাকিস্তান গঠনের পর থেকেই, যেদিন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল, সেদিন থেকেই। মুসলিম লীগ ছিল অভিজাত বা আশরাফদের দল, তার বিপরীতে ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ যে দলটি গঠন করেন, তা ছিল বাংলাদেশের কৃষকদের দল, বাংলাদেশের মানুষের নাড়ি বোঝার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল এই দলের, একই ক্ষমতা ছিল এই দলের তখনকার তরুণ নেতা, পরবর্তীকালে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।
বঙ্গবন্ধুর জনসম্পৃক্ততার কোনো তুলনা ছিল না। অসাধারণ ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি, একজন মানুষের সঙ্গে একবার পরিচয় হলে তার নাম ভুলতেন না, যেখানেই দেখা হতো, নাম ধরে ডেকে উঠতেন আর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। বঙ্গবন্ধু তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। যুব ইউনিয়নের দুই নেতা গেছেন তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়িতে। কী রে, তোরা কী চাস। বঙ্গবন্ধু, পাসপোর্ট লাগবে। দরখাস্ত এনেছিস? দে। তারা দরখাস্ত এগিয়ে দিলেন, বঙ্গবন্ধু তাতে লিখে দিলেন, পাসপোর্ট দেওয়া হোক। তারপর বললেন, তোরা আমার সঙ্গে গাড়িতে ওঠ। তাঁরা গাড়িতে উঠলেন এ দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। গাড়ি ৩২ নম্বর থেকে বেরিয়ে এলিফ্যান্ট রোড ধরে চলছে বঙ্গভবনের দিকে। এলিফ্যান্ট রোডের ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি থামল। রাস্তার ভিক্ষুকেরা জানে, রোজ এই পথ দিয়ে বঙ্গবন্ধু যান। মোড়ে লালবাতি জ্বললে গাড়ি দাঁড়ায়। তারা বঙ্গবন্ধুর গাড়ি দেখলেই ছুটে যায়। বঙ্গবন্ধু গাড়িতে তাই রাখেন খুচরো টাকা। হাত বাড়িয়ে ভিক্ষুকদের টাকা দেন। হায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এই ছিল তাঁর নিরাপত্তা আর প্রটোকল।
সেই বঙ্গবন্ধুও ক্রমাগতভাবে নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন।
সেখান থেকে আজকের প্রধানমন্ত্রী। মধ্যখানে অনেক বছর চলে গেছে। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোনো ভিক্ষুক তো ভিক্ষুক, কোনো নেতা-কর্মীর পক্ষে ঘেঁষাও কঠিন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই দেশ চলছে। তিনি দেশের খবর পাচ্ছেন কী করে? তাঁর অফিস আছে। তাঁকে খবর দেওয়ার পদ্ধতি আছে, নিয়ম আছে। সকালবেলাই তাঁর টেবিলে খবরের কাগজের চুম্বক অংশ, বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া প্রতিবেদন, প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই করা সংবাদ পৌঁছে যায়।
কিন্তু এই সংস্থাগুলো কি দেশের মানুষের মনের খবরটা দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষটার কান পর্যন্ত পৌঁছাতে দেয়? তারা কি সঠিক খবর দেয়? নাকি সেই খবরগুলোই দেয়, যা শুনলে কর্তা খুশি হবেন, তাঁর দিবসের প্রথম প্রহরটা ভালো যাবে?
এই সংস্থাগুলোর সংগৃহীত সংবাদ কি জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটায়? আমরা জানি, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ইয়াহিয়া খান সরকারের কাছে খবর দেওয়া হয়েছিল, আওয়ামী লীগ দুই প্রদেশ মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। আমরা জানি, ২০০১-এর নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার সরকারের কাছে খবর দেওয়া হয়েছিল, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করতে যাচ্ছে। দুটো খবরের কোনোটাই ঠিক ছিল না।
আমি মোটামুটি একজন বিবরবাসী লেখক। দেশের সাধারণ মানুষ, কৃষক-শ্রমিক, গরিব মানুষ, প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। শুধু এক ধরনের যোগাযোগ আছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে, তরুণদের সঙ্গে। গল্প-উপন্যাস, টিভি-নাটক ইত্যাদি লেখার কারণে তাদের মনোভাবটা আমাদের যেমন বুঝতে হয়, তাদের মন তৈরিতেও গণমাধ্যমকর্মীদের একজন হিসেবে আমারও হয়তো ভূমিকা আছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দেড় বছর আগের নির্বাচনে তরুণেরা ব্যাপকভাবে ভোট দিয়েছিল পরিবর্তনের পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদের বিপক্ষে। কাজেই আজ যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়, আর সেটা যদি আন্তর্জাতিক মানের হয়, তাহলে দেশের বেশির ভাগ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা সেটাকে সমর্থন দেবে। যেমন—এক ঐতিহাসিক মতৈক্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায়ের দিন, সব গণমাধ্যম একযোগে সেই রায়ের পক্ষে, ন্যায়বিচারের পক্ষে অনন্যসাধারণ সমর্থন ব্যক্ত করেছিল। বিচারপদ্ধতিতে ত্রুটি না থাকলে এবং অপরাধীদের সাজা পেতে দেখলে বেশির ভাগ মানুষ সন্তুষ্টই হবে। অপরদিকে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলকে যতই মহিউদ্দিন চৌধুরীর ব্যক্তিগত পরাজয় বলে আমরা বিবেচনা করি না কেন, তার মাধ্যমে একটা বার্তা কিন্তু স্পষ্টতই ঘোষিত হয়েছে, এই দেশের ভোটারদের মনটা সাদা কাগজের মতো পরিষ্কার—তুমি সুশাসন দাও তো সমর্থন পাবে, না দিলে পাবে না। ‘ইসলাম গেল’ কি ‘ভারত এল’ বলেও ভোট পাওয়া যাবে না, আবার যুদ্ধাপরাধীরা ওদের সঙ্গে আছে বলেই ভোট পাওয়া থেকে ওদের বিরত রাখা যাবে না।
এখানে আসে জনগণের চাওয়াটা পূরণ করার প্রসঙ্গ। সেটা করতে পারতেই হবে। আর তা করতে হলে জনগণ কী চায়, সেটা জানতে হবে। সেটা করতে হলে সরকার ও সরকারপ্রধানের জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। প্রেসিডেন্ট ওবামা যদি রোজ সরাসরি সাধারণ নাগরিকের ১০টা চিঠি পড়তে পারেন, ইন্টারনেটে সাধারণ নাগরিকের ব্লগ পড়তে পারেন, আমাদের নেতারা কেন জনগণের সঙ্গে সংযোগ বাড়াবেন না?
রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের রাষ্ট্রপ্রধানের মতো প্রধানমন্ত্রীর যে একচ্ছত্র ক্ষমতা সেটা বদলে ব্যাপারটাকে আরও বেশি বহুবাচনিক করে তোলার কথাটা তাই সামনে আসছে, বিশেষ করে যখন সংবিধান বিষয়ে কমিটি গঠিত হয়েছে। সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। কিন্তু আরেকটা প্রসঙ্গ বিবেচনায় নিতে বলি, যা ঠিক কাগুজে নয়, বাস্তবিক। সরকার ও সরকারপ্রধান কি তাঁর নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা ঘোচানোর জন্য সচেষ্ট থাকতে পারেন না? অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, আমরা শুনতে পাই, দলের শীর্ষ নেতাদের, প্রধান নেতাদের অগোচরে নেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদ জানে না অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কোত্থেকে আসছে। আবার দল জানে না, মন্ত্রিপরিষদ এই সিদ্ধান্ত কেন নিচ্ছে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা, পিতার অনেক ভালো, মানবিক গুণ লাভ করেছেন। নিমতলী দুর্ঘটনায় স্বজনহারা কন্যাদের নিজের মেয়ে হিসেবে যখন তিনি বরণ করে নেন, সেটা কেবল লোক-দেখানো নয়, এই পরার্থপরতা, এই মানবিকতা তার রক্তের মধ্যে নিহিত আছে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু শুধু ছোটখাটো মানবিক বিষয়ে নয়, বড় বড় জাতীয়, আন্তর্জাতিক বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণের জন্য তিনি কি তাঁর পরিধিটা বাড়িয়ে নিতে পারেন না?
বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, আইনবিদ, রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, সাংবাদিক-সম্পাদক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, খেলোয়াড়, প্রযুক্তিবিদ—এরা স্বভাবতই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও মুক্তবুদ্ধির পক্ষে। ক্ষমতায় যাওয়ার পরে এদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, এদের সক্ষমতাকে কাজে লাগানোর তেমন কোনো উদ্যোগ ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। এমনকি আওয়ামী লীগের নিজের দলের মধ্যেই অনেক যোগ্য দক্ষ নেতা আছেন, কর্মী আছেন। আগে দেখা যেত, আমলারা নেতাদের চেয়ে ভালো বলেন, ভালো কাজ করেন, কিন্তু বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আন্তর্জাতিক সভায় দেখছি, আমলাদের চেয়ে ভালো কথা বলেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এবং কথা শুনে স্পষ্ট বোঝা যায়, ব্যাপারটা তাঁরা বেশ ভালো বোঝেন। আওয়ামী লীগের নিজের এই সম্পদটাই কি সরকার দেশের কল্যাণে ঠিকভাবে ব্যবহার করছে?
সংবিধান সংশোধিত হয়ে আরও গণতান্ত্রিক, আরও আধুনিক আরও ভবিষ্যৎমুখী হোক। যারা বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে পিঠমোড়া করে হাত বেঁধে নিয়ে গেছে শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী, সিরাজউদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, ফজলে রাব্বি প্রমুখকে, তাদের বিচার হোক—দেশের মানুষ ন্যায়বিচারের পক্ষে থাকবে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ছাত্রলীগ প্রভৃতির টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি-নৈরাজ্য বন্ধ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি সমস্যার সমাধান, যোগাযোগব্যবস্থার অধুনায়ন, শিক্ষাঙ্গনে শিল্পাঙ্গনে অফিসে আদালতে কাজের উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখা, কর্মসংস্থান—এই কাজগুলোও করতে হবে দক্ষতার সঙ্গে। গত নির্বাচনে একটা প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল দুর্নীতি, পরিবারকরণ, দলীয়করণ। সরকার কেন মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করছে না? মন্ত্রিপরিষদের কাজের একটা মধ্যবর্তী মূল্যায়নও হওয়া উচিত। দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়নকে নির্মূল করার চেষ্টা করা উচিত কঠোরতার সঙ্গে।
কাজগুলো কঠিন। এই ধরনের উদ্যোগ ক্ষমতাকেন্দ্রকে আরও নিঃসঙ্গও করতে পারে। কিন্তু প্লুরালিজম, সবাই মিলে চলা—দল, সংসদ, মন্ত্রিপরিষদ, নির্দলীয় বিশেষজ্ঞ, বিরোধী দল, নাগরিকসমাজ, জনগণ—সবাইকে দেশ গড়ার কর্মযজ্ঞে শামিল করতে পারলেই না ক্ষমতাকেন্দ্রের নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি হ্রাস পাবে। সেটা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকেও নিষ্ক্রিয় করতে সাহায্য করবে।
আর বলি, বিরোধী দলকে কথা বলতে দিন। বিরোধী মতকে প্রকাশিত হতে দিন। আমি তার কথার সঙ্গে একমত হতে না পারি, কিন্তু আমি তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে দেব—এই আপ্তবাক্য কেবল একটা অবাস্তব আদর্শবচন নয়, বাস্তবে এর প্রয়োগ গণতন্ত্রকে সুসংহত করে, দেশকে সুন্দর করে। মনে রাখা দরকার, বিরোধী মত প্রকাশিত হতে না পারলে তা কেবল সরকারের জন্য বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে না, সেটা প্রকাশের জন্য চোরাগোপ্তা পথ খোঁজে, যা জঙ্গিবাদ ও অগণতান্ত্রিক শক্তিকে উৎসাহিত করে। গণতন্ত্র মানে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, সংখ্যালঘু, সে যদি একজনও হয়, তার মতকে, তার অবস্থানকে সম্মান করাটাও গণতন্ত্র।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
জোনাহ লেহরার বলছেন, ‘ক্ষমতা মানুষকে দেয় অর্থকড়ি। তার তখন আলাদা গাড়িচালক থাকে, তিনি তখন আলাদা রেস্তোরাঁয় খান, আর তিনি বিমানে ভিড় এড়িয়ে আলাদাভাবে গিয়ে সবার আগে বসেন। এরা কোনো কাজেরই না। এই কারণেই প্রেসিডেন্ট ওবামা সর্বদা চেষ্টা করেন যেন তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়েন, যেন চারপাশের খবর তাঁর জানা থাকে, তাই তিনি প্রতিদিন অন্তত ১০টা চিঠি পড়েন, যেগুলো আসে তাঁর নিজের নির্বাচনী এলাকা থেকে আর চেষ্টা করেন যত বেশিসংখ্যক ব্লগ অনুসরণ করতে।’
২. বাংলাদেশ একটা গণতান্ত্রিক দেশ, এই দেশে আছে সংসদীয় গণতন্ত্র, আছে মন্ত্রিপরিষদচালিত সরকার, কিন্তু আমরা সবাই জানি, এটা আসলে চলছে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের আদলে, শুধু রাষ্ট্রপতির জায়গায় প্রধানমন্ত্রী চালাচ্ছেন সরকার। আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতেন সরাসরি জনগণের ভোটে, আর এখন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সংসদ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য।
মন্ত্রিপরিষদ সম্মিলিতভাবে দেশ চালাচ্ছে, আর মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে জনগণের, তাঁরা জবাবদিহি করছেন সংসদের কাছে, আর দলের কাছে, আর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জনগণের কাছে—এটা হওয়া উচিত আদর্শ। জবাবদিহিটাও আসল নয়, আসল হলো জনগণের চাওয়া-পাওয়াটা উপলব্ধি করা, জনগণের মনের খবরটা পড়তে পারা। এই কাজটা, আমাদের মতো কলামলেখকদের চেয়েও অনেক ভালোভাবে পারেন রাজনীতিবিদেরা, জনঘনিষ্ঠ রাজনীতিকেরা। এবং আমাদের চেয়ে অনেক ভালোভাবে পারে আওয়ামী লীগ, টেবিলের তর্কে এটা আমি সব সময় বলে এসেছি।
আওয়ামী লীগ, তার নামের মধ্যেই আছে আম শব্দটা, যার মানে জনগণ, জনগণেরই দল ছিল চিরটাকাল—সেই পাকিস্তান গঠনের পর থেকেই, যেদিন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল, সেদিন থেকেই। মুসলিম লীগ ছিল অভিজাত বা আশরাফদের দল, তার বিপরীতে ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ যে দলটি গঠন করেন, তা ছিল বাংলাদেশের কৃষকদের দল, বাংলাদেশের মানুষের নাড়ি বোঝার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল এই দলের, একই ক্ষমতা ছিল এই দলের তখনকার তরুণ নেতা, পরবর্তীকালে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।
বঙ্গবন্ধুর জনসম্পৃক্ততার কোনো তুলনা ছিল না। অসাধারণ ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি, একজন মানুষের সঙ্গে একবার পরিচয় হলে তার নাম ভুলতেন না, যেখানেই দেখা হতো, নাম ধরে ডেকে উঠতেন আর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। বঙ্গবন্ধু তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। যুব ইউনিয়নের দুই নেতা গেছেন তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়িতে। কী রে, তোরা কী চাস। বঙ্গবন্ধু, পাসপোর্ট লাগবে। দরখাস্ত এনেছিস? দে। তারা দরখাস্ত এগিয়ে দিলেন, বঙ্গবন্ধু তাতে লিখে দিলেন, পাসপোর্ট দেওয়া হোক। তারপর বললেন, তোরা আমার সঙ্গে গাড়িতে ওঠ। তাঁরা গাড়িতে উঠলেন এ দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। গাড়ি ৩২ নম্বর থেকে বেরিয়ে এলিফ্যান্ট রোড ধরে চলছে বঙ্গভবনের দিকে। এলিফ্যান্ট রোডের ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি থামল। রাস্তার ভিক্ষুকেরা জানে, রোজ এই পথ দিয়ে বঙ্গবন্ধু যান। মোড়ে লালবাতি জ্বললে গাড়ি দাঁড়ায়। তারা বঙ্গবন্ধুর গাড়ি দেখলেই ছুটে যায়। বঙ্গবন্ধু গাড়িতে তাই রাখেন খুচরো টাকা। হাত বাড়িয়ে ভিক্ষুকদের টাকা দেন। হায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এই ছিল তাঁর নিরাপত্তা আর প্রটোকল।
সেই বঙ্গবন্ধুও ক্রমাগতভাবে নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন।
সেখান থেকে আজকের প্রধানমন্ত্রী। মধ্যখানে অনেক বছর চলে গেছে। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোনো ভিক্ষুক তো ভিক্ষুক, কোনো নেতা-কর্মীর পক্ষে ঘেঁষাও কঠিন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই দেশ চলছে। তিনি দেশের খবর পাচ্ছেন কী করে? তাঁর অফিস আছে। তাঁকে খবর দেওয়ার পদ্ধতি আছে, নিয়ম আছে। সকালবেলাই তাঁর টেবিলে খবরের কাগজের চুম্বক অংশ, বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া প্রতিবেদন, প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই করা সংবাদ পৌঁছে যায়।
কিন্তু এই সংস্থাগুলো কি দেশের মানুষের মনের খবরটা দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষটার কান পর্যন্ত পৌঁছাতে দেয়? তারা কি সঠিক খবর দেয়? নাকি সেই খবরগুলোই দেয়, যা শুনলে কর্তা খুশি হবেন, তাঁর দিবসের প্রথম প্রহরটা ভালো যাবে?
এই সংস্থাগুলোর সংগৃহীত সংবাদ কি জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটায়? আমরা জানি, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ইয়াহিয়া খান সরকারের কাছে খবর দেওয়া হয়েছিল, আওয়ামী লীগ দুই প্রদেশ মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। আমরা জানি, ২০০১-এর নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার সরকারের কাছে খবর দেওয়া হয়েছিল, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করতে যাচ্ছে। দুটো খবরের কোনোটাই ঠিক ছিল না।
আমি মোটামুটি একজন বিবরবাসী লেখক। দেশের সাধারণ মানুষ, কৃষক-শ্রমিক, গরিব মানুষ, প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। শুধু এক ধরনের যোগাযোগ আছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে, তরুণদের সঙ্গে। গল্প-উপন্যাস, টিভি-নাটক ইত্যাদি লেখার কারণে তাদের মনোভাবটা আমাদের যেমন বুঝতে হয়, তাদের মন তৈরিতেও গণমাধ্যমকর্মীদের একজন হিসেবে আমারও হয়তো ভূমিকা আছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দেড় বছর আগের নির্বাচনে তরুণেরা ব্যাপকভাবে ভোট দিয়েছিল পরিবর্তনের পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদের বিপক্ষে। কাজেই আজ যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়, আর সেটা যদি আন্তর্জাতিক মানের হয়, তাহলে দেশের বেশির ভাগ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা সেটাকে সমর্থন দেবে। যেমন—এক ঐতিহাসিক মতৈক্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায়ের দিন, সব গণমাধ্যম একযোগে সেই রায়ের পক্ষে, ন্যায়বিচারের পক্ষে অনন্যসাধারণ সমর্থন ব্যক্ত করেছিল। বিচারপদ্ধতিতে ত্রুটি না থাকলে এবং অপরাধীদের সাজা পেতে দেখলে বেশির ভাগ মানুষ সন্তুষ্টই হবে। অপরদিকে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলকে যতই মহিউদ্দিন চৌধুরীর ব্যক্তিগত পরাজয় বলে আমরা বিবেচনা করি না কেন, তার মাধ্যমে একটা বার্তা কিন্তু স্পষ্টতই ঘোষিত হয়েছে, এই দেশের ভোটারদের মনটা সাদা কাগজের মতো পরিষ্কার—তুমি সুশাসন দাও তো সমর্থন পাবে, না দিলে পাবে না। ‘ইসলাম গেল’ কি ‘ভারত এল’ বলেও ভোট পাওয়া যাবে না, আবার যুদ্ধাপরাধীরা ওদের সঙ্গে আছে বলেই ভোট পাওয়া থেকে ওদের বিরত রাখা যাবে না।
এখানে আসে জনগণের চাওয়াটা পূরণ করার প্রসঙ্গ। সেটা করতে পারতেই হবে। আর তা করতে হলে জনগণ কী চায়, সেটা জানতে হবে। সেটা করতে হলে সরকার ও সরকারপ্রধানের জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। প্রেসিডেন্ট ওবামা যদি রোজ সরাসরি সাধারণ নাগরিকের ১০টা চিঠি পড়তে পারেন, ইন্টারনেটে সাধারণ নাগরিকের ব্লগ পড়তে পারেন, আমাদের নেতারা কেন জনগণের সঙ্গে সংযোগ বাড়াবেন না?
রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের রাষ্ট্রপ্রধানের মতো প্রধানমন্ত্রীর যে একচ্ছত্র ক্ষমতা সেটা বদলে ব্যাপারটাকে আরও বেশি বহুবাচনিক করে তোলার কথাটা তাই সামনে আসছে, বিশেষ করে যখন সংবিধান বিষয়ে কমিটি গঠিত হয়েছে। সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। কিন্তু আরেকটা প্রসঙ্গ বিবেচনায় নিতে বলি, যা ঠিক কাগুজে নয়, বাস্তবিক। সরকার ও সরকারপ্রধান কি তাঁর নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা ঘোচানোর জন্য সচেষ্ট থাকতে পারেন না? অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, আমরা শুনতে পাই, দলের শীর্ষ নেতাদের, প্রধান নেতাদের অগোচরে নেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদ জানে না অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কোত্থেকে আসছে। আবার দল জানে না, মন্ত্রিপরিষদ এই সিদ্ধান্ত কেন নিচ্ছে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা, পিতার অনেক ভালো, মানবিক গুণ লাভ করেছেন। নিমতলী দুর্ঘটনায় স্বজনহারা কন্যাদের নিজের মেয়ে হিসেবে যখন তিনি বরণ করে নেন, সেটা কেবল লোক-দেখানো নয়, এই পরার্থপরতা, এই মানবিকতা তার রক্তের মধ্যে নিহিত আছে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু শুধু ছোটখাটো মানবিক বিষয়ে নয়, বড় বড় জাতীয়, আন্তর্জাতিক বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণের জন্য তিনি কি তাঁর পরিধিটা বাড়িয়ে নিতে পারেন না?
বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, আইনবিদ, রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, সাংবাদিক-সম্পাদক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, খেলোয়াড়, প্রযুক্তিবিদ—এরা স্বভাবতই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও মুক্তবুদ্ধির পক্ষে। ক্ষমতায় যাওয়ার পরে এদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, এদের সক্ষমতাকে কাজে লাগানোর তেমন কোনো উদ্যোগ ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। এমনকি আওয়ামী লীগের নিজের দলের মধ্যেই অনেক যোগ্য দক্ষ নেতা আছেন, কর্মী আছেন। আগে দেখা যেত, আমলারা নেতাদের চেয়ে ভালো বলেন, ভালো কাজ করেন, কিন্তু বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আন্তর্জাতিক সভায় দেখছি, আমলাদের চেয়ে ভালো কথা বলেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এবং কথা শুনে স্পষ্ট বোঝা যায়, ব্যাপারটা তাঁরা বেশ ভালো বোঝেন। আওয়ামী লীগের নিজের এই সম্পদটাই কি সরকার দেশের কল্যাণে ঠিকভাবে ব্যবহার করছে?
সংবিধান সংশোধিত হয়ে আরও গণতান্ত্রিক, আরও আধুনিক আরও ভবিষ্যৎমুখী হোক। যারা বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে পিঠমোড়া করে হাত বেঁধে নিয়ে গেছে শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী, সিরাজউদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, ফজলে রাব্বি প্রমুখকে, তাদের বিচার হোক—দেশের মানুষ ন্যায়বিচারের পক্ষে থাকবে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ছাত্রলীগ প্রভৃতির টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি-নৈরাজ্য বন্ধ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি সমস্যার সমাধান, যোগাযোগব্যবস্থার অধুনায়ন, শিক্ষাঙ্গনে শিল্পাঙ্গনে অফিসে আদালতে কাজের উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখা, কর্মসংস্থান—এই কাজগুলোও করতে হবে দক্ষতার সঙ্গে। গত নির্বাচনে একটা প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল দুর্নীতি, পরিবারকরণ, দলীয়করণ। সরকার কেন মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করছে না? মন্ত্রিপরিষদের কাজের একটা মধ্যবর্তী মূল্যায়নও হওয়া উচিত। দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়নকে নির্মূল করার চেষ্টা করা উচিত কঠোরতার সঙ্গে।
কাজগুলো কঠিন। এই ধরনের উদ্যোগ ক্ষমতাকেন্দ্রকে আরও নিঃসঙ্গও করতে পারে। কিন্তু প্লুরালিজম, সবাই মিলে চলা—দল, সংসদ, মন্ত্রিপরিষদ, নির্দলীয় বিশেষজ্ঞ, বিরোধী দল, নাগরিকসমাজ, জনগণ—সবাইকে দেশ গড়ার কর্মযজ্ঞে শামিল করতে পারলেই না ক্ষমতাকেন্দ্রের নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি হ্রাস পাবে। সেটা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকেও নিষ্ক্রিয় করতে সাহায্য করবে।
আর বলি, বিরোধী দলকে কথা বলতে দিন। বিরোধী মতকে প্রকাশিত হতে দিন। আমি তার কথার সঙ্গে একমত হতে না পারি, কিন্তু আমি তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে দেব—এই আপ্তবাক্য কেবল একটা অবাস্তব আদর্শবচন নয়, বাস্তবে এর প্রয়োগ গণতন্ত্রকে সুসংহত করে, দেশকে সুন্দর করে। মনে রাখা দরকার, বিরোধী মত প্রকাশিত হতে না পারলে তা কেবল সরকারের জন্য বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে না, সেটা প্রকাশের জন্য চোরাগোপ্তা পথ খোঁজে, যা জঙ্গিবাদ ও অগণতান্ত্রিক শক্তিকে উৎসাহিত করে। গণতন্ত্র মানে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, সংখ্যালঘু, সে যদি একজনও হয়, তার মতকে, তার অবস্থানকে সম্মান করাটাও গণতন্ত্র।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments