দেশীয় অস্ত্রের ঠাট by সৈয়দ আবুল মকসুদ
জসীমউদ্দীনের অবিস্মরণীয় কীর্তি—তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ: নকশী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট। আজ যদি কবি বেঁচে থাকতেন তাহলে তাঁর কোনো কবিতার বইয়ের নামকরণ হতো: ‘দেশীয় অস্ত্রের ঠাট’। জসীমউদ্দীন যদিও পল্লির মানুষের কবি, সাজু ও রূপাদের প্রেম-পিরিতের কথাই যে শুধু লিখেছেন তাই নয়, মাথা-ফাটাফাটির কথাও আছে তাঁর কবিতায়। রূপার জবানীতে তাই আমরা শুনি: ‘লড়ায়ে আজিকে কত মাথা আমি ভাঙিয়াছি দুই হাতে/ আগে বুঝি নাই তোমার মাথার সিঁদুর ভেঙেছে তাতে।’
পত্রিকার ছবিটির ওপর চোখ পড়তেই আমি ভেবেছিলাম, আমার বন্ধু জনপ্রিয় নাট্যকার ও নাট্যশিল্পী মামুনুর রশীদ বা প্রয়াত বন্ধু সেলিম আল দীনের কোনো পথনাটকের দৃশ্য। সমকাল-এর শিরোনাম: ‘যেন যুদ্ধের ময়দান! সাজেদা পুত্রকে ঠেকানোর প্রস্তুতি’। তবে আল্লাহর অশেষ রহমতে কারও মাথা ফাটেনি। সড়কি ও বল্লমের আঘাতে কারও শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় হয়নি। কোনো নারীর মাথার সিঁদুর মোছার মতো ঘটনা ঘটেনি। ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালের শয্যাগুলো ও মেঝে-বারান্দা ভরে যায়নি আহতে। মফঃস্বল হাসপাতালের স্টোরে যেটুকু ব্যান্ডেজের কাপড়, গজ, তুলা ও কাটগাট ছিল তাতে কুলাতো না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওগুলো রয়ে গেল অদূর ভবিষ্যতের জন্য।
শুক্রবারের পত্রিকায় লেখা হয়: ‘রাজবাড়ী রাস্তার মোড় ও চুঙ্গির মোড়সহ ফরিদপুর শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট বৃহস্পতিবার যেন যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হয়। জেলা আওয়ামী লীগের দুগ্রুপের দ্বন্দ্বের জের ধরে এ ঘটনা ঘটে। সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে আয়মন আকবর বাবলুর ফরিদপুর আগমন ঠেকাতে শ্রমমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সমর্থকেরা সড়কি, দা, বল্লম, ঢালসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।’ [সমকাল]
শনিবারের কাগজে যে খবর বেরোয়, তা পড়ে দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘জাতীয় সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে আয়মন আকবরের ফরিদপুরে আগমন ঠেকাতে গত বৃহস্পতিবার শ্রমমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সমর্থকেরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ গড়েছিলেন। ওই দিন আর আয়মন ফরিদপুরে আসেননি। তবে গতকাল শুক্রবার এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মা সাজেদা চৌধুরী।...দুই শতাধিক মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলের বহর রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া ঘাটে সাজেদা ও আয়মনকে স্বাগত জানায়। পরে তাঁরা মোটর শোভাযাত্রা করে মা ও ছেলেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় নিয়ে আসেন।...ডাকবাংলোতে দুপুরের খাবার শেষ করে আয়মন আকবরসহ ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন সাজেদা।’ [প্রথম আলো]
পশ্চিমী প্রভু দেশগুলোর বিশেষ করে, আমেরিকা ও ইসরায়েলের তৈরি অস্ত্রেরই কদর আজ বিশ্বব্যাপী। আল-কায়েদা হোক অথবা তালেবান হোক বা মাওবাদী হোক—সবার কাছেই এখন আমেরিকার তৈরি অস্ত্র। অস্ত্র বিক্রি করেই আমেরিকা একমাত্র পরাশক্তি, ইসরায়েল ডেপুটি সুপার পাওয়ার। আমাদের দেশেও অস্ত্রের ব্যবহার আছে। প্রয়োজনে বিএনপি আমেরিকার অস্ত্রকেই অগ্রাধিকার দেবে। জামায়াত ও জেএমবি মধ্যযুগীয় অস্ত্র যেমন তলোয়ার, খঞ্জর, নেজা প্রভৃতি। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ যে দেশি অস্ত্রকেই প্রাধান্য দিচ্ছে, তা প্রশংসনীয়। সড়কি, বল্লম, চাপাতি, রামদা প্রভৃতি আবহমান বাংলার অস্ত্র। ধারণা করি, জেএমবি কস্মিনকালেও রামদা ব্যবহার করবে না, কারণ ওতে হিন্দুয়ানি গন্ধ আছে। তারা তলোয়ার—তাতে আছে ধর্মীয় জোশ। আমাদের চিনি, পেঁয়াজ, ডাল, আলু আমদানি করতে হচ্ছে, কিন্তু সুখের বিষয়, দেশীয় অস্ত্রে আজ আমরা আত্মনির্ভরশীল। দেশব্যাপী কামারের হাপরগুলোতে আজ দিনরাত জ্বলছে আগুন। তৈরি হচ্ছে চাপাতি, রামদা, বল্লম, সড়কি প্রভৃতি।
তবে বাংলাদেশে সব মানুষের অস্ত্র এস্তেমালের অধিকার নেই। বাঘাইছড়ি থেকে পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িঘর দেখে আমরা ফিরছিলাম খাগড়াছড়ি। পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সারা হোসেন, সৌরভ সিকদার, রোবায়েত ফেরদৌস, আমি ও মিডিয়ার লোকজন। পথে এক চামকা বৃদ্ধা আমাদের গাড়ির সামনে এসে বিলাপ করতে লাগলেন। দুই দিন আগে তাঁর ছেলেকে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা ধরে নিয়ে গেছে। তাঁর কান্না দেখে গেলাম সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে। সেনা কর্মকর্তা খুবই সৌজন্যমূলক ব্যবহার করলেন। বললাম, ছেলেটিকে আটক করেছেন কোন অপরাধে? তিনি বললেন, সে সন্ধ্যাবেলা অস্ত্র হাতে পাহাড়ে খাড়িতে বসে ছিল। বললাম, অস্ত্রটা কী? তিনি বারান্দায় আমাদের নিয়ে গেলেন। সেখানে একটি টেবিলের ওপর প্রদর্শিত হয়েছিল অস্ত্রটি: একটি পাখি মারার গুলতি ও মার্বেলের মতো মাটির তৈরি কয়েকটি গুলি। অফিসার আমাদের খাওয়াদাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন। বললাম, খাওয়া লাগবে না। ওকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন। ওর মা পাগল হয়ে গেছে।
অনুমান করছি, চুঙ্গির মোড়ে যারা বিপুল অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়েছে, তারা সবাই এখন হাজতে আছে। গুলতির চেয়ে তাদের অস্ত্র বেশি ভয়াবহ। যদি এখনো তারা বহাল তবিয়তে থেকে থাকে, তা হলে বুঝব এই দেশে দুই রকম মানুষ আছে: একশ্রেণী অস্ত্র ব্যবহারের অধিকার রাখে; আর একশ্রেণী ওই চাকমা ছেলেটি, যার হাতে গুলতি থাকলেই বিরাট অপরাধ।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
পত্রিকার ছবিটির ওপর চোখ পড়তেই আমি ভেবেছিলাম, আমার বন্ধু জনপ্রিয় নাট্যকার ও নাট্যশিল্পী মামুনুর রশীদ বা প্রয়াত বন্ধু সেলিম আল দীনের কোনো পথনাটকের দৃশ্য। সমকাল-এর শিরোনাম: ‘যেন যুদ্ধের ময়দান! সাজেদা পুত্রকে ঠেকানোর প্রস্তুতি’। তবে আল্লাহর অশেষ রহমতে কারও মাথা ফাটেনি। সড়কি ও বল্লমের আঘাতে কারও শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় হয়নি। কোনো নারীর মাথার সিঁদুর মোছার মতো ঘটনা ঘটেনি। ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালের শয্যাগুলো ও মেঝে-বারান্দা ভরে যায়নি আহতে। মফঃস্বল হাসপাতালের স্টোরে যেটুকু ব্যান্ডেজের কাপড়, গজ, তুলা ও কাটগাট ছিল তাতে কুলাতো না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওগুলো রয়ে গেল অদূর ভবিষ্যতের জন্য।
শুক্রবারের পত্রিকায় লেখা হয়: ‘রাজবাড়ী রাস্তার মোড় ও চুঙ্গির মোড়সহ ফরিদপুর শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট বৃহস্পতিবার যেন যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হয়। জেলা আওয়ামী লীগের দুগ্রুপের দ্বন্দ্বের জের ধরে এ ঘটনা ঘটে। সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে আয়মন আকবর বাবলুর ফরিদপুর আগমন ঠেকাতে শ্রমমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সমর্থকেরা সড়কি, দা, বল্লম, ঢালসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।’ [সমকাল]
শনিবারের কাগজে যে খবর বেরোয়, তা পড়ে দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘জাতীয় সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে আয়মন আকবরের ফরিদপুরে আগমন ঠেকাতে গত বৃহস্পতিবার শ্রমমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সমর্থকেরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ গড়েছিলেন। ওই দিন আর আয়মন ফরিদপুরে আসেননি। তবে গতকাল শুক্রবার এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মা সাজেদা চৌধুরী।...দুই শতাধিক মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলের বহর রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া ঘাটে সাজেদা ও আয়মনকে স্বাগত জানায়। পরে তাঁরা মোটর শোভাযাত্রা করে মা ও ছেলেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় নিয়ে আসেন।...ডাকবাংলোতে দুপুরের খাবার শেষ করে আয়মন আকবরসহ ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন সাজেদা।’ [প্রথম আলো]
পশ্চিমী প্রভু দেশগুলোর বিশেষ করে, আমেরিকা ও ইসরায়েলের তৈরি অস্ত্রেরই কদর আজ বিশ্বব্যাপী। আল-কায়েদা হোক অথবা তালেবান হোক বা মাওবাদী হোক—সবার কাছেই এখন আমেরিকার তৈরি অস্ত্র। অস্ত্র বিক্রি করেই আমেরিকা একমাত্র পরাশক্তি, ইসরায়েল ডেপুটি সুপার পাওয়ার। আমাদের দেশেও অস্ত্রের ব্যবহার আছে। প্রয়োজনে বিএনপি আমেরিকার অস্ত্রকেই অগ্রাধিকার দেবে। জামায়াত ও জেএমবি মধ্যযুগীয় অস্ত্র যেমন তলোয়ার, খঞ্জর, নেজা প্রভৃতি। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ যে দেশি অস্ত্রকেই প্রাধান্য দিচ্ছে, তা প্রশংসনীয়। সড়কি, বল্লম, চাপাতি, রামদা প্রভৃতি আবহমান বাংলার অস্ত্র। ধারণা করি, জেএমবি কস্মিনকালেও রামদা ব্যবহার করবে না, কারণ ওতে হিন্দুয়ানি গন্ধ আছে। তারা তলোয়ার—তাতে আছে ধর্মীয় জোশ। আমাদের চিনি, পেঁয়াজ, ডাল, আলু আমদানি করতে হচ্ছে, কিন্তু সুখের বিষয়, দেশীয় অস্ত্রে আজ আমরা আত্মনির্ভরশীল। দেশব্যাপী কামারের হাপরগুলোতে আজ দিনরাত জ্বলছে আগুন। তৈরি হচ্ছে চাপাতি, রামদা, বল্লম, সড়কি প্রভৃতি।
তবে বাংলাদেশে সব মানুষের অস্ত্র এস্তেমালের অধিকার নেই। বাঘাইছড়ি থেকে পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িঘর দেখে আমরা ফিরছিলাম খাগড়াছড়ি। পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সারা হোসেন, সৌরভ সিকদার, রোবায়েত ফেরদৌস, আমি ও মিডিয়ার লোকজন। পথে এক চামকা বৃদ্ধা আমাদের গাড়ির সামনে এসে বিলাপ করতে লাগলেন। দুই দিন আগে তাঁর ছেলেকে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা ধরে নিয়ে গেছে। তাঁর কান্না দেখে গেলাম সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে। সেনা কর্মকর্তা খুবই সৌজন্যমূলক ব্যবহার করলেন। বললাম, ছেলেটিকে আটক করেছেন কোন অপরাধে? তিনি বললেন, সে সন্ধ্যাবেলা অস্ত্র হাতে পাহাড়ে খাড়িতে বসে ছিল। বললাম, অস্ত্রটা কী? তিনি বারান্দায় আমাদের নিয়ে গেলেন। সেখানে একটি টেবিলের ওপর প্রদর্শিত হয়েছিল অস্ত্রটি: একটি পাখি মারার গুলতি ও মার্বেলের মতো মাটির তৈরি কয়েকটি গুলি। অফিসার আমাদের খাওয়াদাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন। বললাম, খাওয়া লাগবে না। ওকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন। ওর মা পাগল হয়ে গেছে।
অনুমান করছি, চুঙ্গির মোড়ে যারা বিপুল অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়েছে, তারা সবাই এখন হাজতে আছে। গুলতির চেয়ে তাদের অস্ত্র বেশি ভয়াবহ। যদি এখনো তারা বহাল তবিয়তে থেকে থাকে, তা হলে বুঝব এই দেশে দুই রকম মানুষ আছে: একশ্রেণী অস্ত্র ব্যবহারের অধিকার রাখে; আর একশ্রেণী ওই চাকমা ছেলেটি, যার হাতে গুলতি থাকলেই বিরাট অপরাধ।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments