কুসংস্কার দূরীকরণে ইসলাম by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
চিরন্তন ও পরিপূর্ণ জীবনদর্শনে যা কিছু সত্য, সুন্দর ও মার্জিত, ইসলামে তা-ই অনুমোদিত। অন্যদিকে অন্যায়, অসত্য, অসুন্দর বা কদর্যতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতা ইসলামে অননুমোদিত। দিশেহারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরব জাতিকে অমানিশার অন্ধকার থেকে আলোর পথের দিশা দিয়ে তাদের তপ্ত হূদয়ে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতেই ইসলামের আগমন ঘটেছিল। মানুষের জীবনকে সুন্দর ও পবিত্র করার জন্য যত রকমের সহজ পন্থা রয়েছে, তার সবই ইসলাম ধর্মে বিদ্যমান। তাই এই ধর্মকে মধ্যপন্থীদের ধর্ম বলা হয়। যাবতীয় নিষ্ঠুরতা, অসহিষ্ণুতা ও বর্বরতার বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মই একমাত্র রক্ষাকবচ। তা সত্ত্বেও ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কার সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান। আমাদের সমাজজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাস সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ ইসলামে কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই।
কুসংস্কারের ফলে সৃষ্টিকর্তার ওপর সুদৃঢ় আস্থা ও ধর্মবিশ্বাস এবং পরম করুণাময়ের প্রতি নির্ভরতা বহুলাংশে লোপ পায়। কুসংস্কার হলো ধর্মীয় বিধানের বাইরে এমন একটি প্রচলিত নিয়মবিধি, যার প্রতি মানুষ অন্ধবিশ্বাস স্থাপন করে এবং কর্মক্ষেত্রে এ বিশ্বাসকে আশ্রয় করেই চলে। কুসংস্কারজনিত অন্ধবিশ্বাসের মোহজালে পড়ে মানুষ নিজেদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে এবং আল্লাহর প্রতি পরম আস্থা ও নির্ভরতা থেকে নিজেদের ঈমানের শক্তি দুর্বল করে তুলছে। একজন মুসলমানের আত্মবিশ্বাস ও আল্লাহর ওপর ভরসাই যথেষ্ট। তাই ইসলামি শরিয়তের ঘোরতর পরিপন্থী এমন প্রচলিত কুনীতিগুলোর মূলোচ্ছেদ করা বা বর্জন করা মুসলমানদের অবশ্যকর্তব্য। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘অশুভ বা কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই, বরং তা শুভ বলে মনে করা ভালো। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! শুভ লক্ষণ কী?’ তিনি বললেন, ‘এরূপ অর্থবোধক কথা, যা তোমাদের কেউ শুনতে পায়।’ (বুখারি) তাই কুসংস্কার বন্ধের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা চালানো সবার ঈমানি দায়িত্ব।
ইসলামে জ্ঞান অর্জনকে ফরজ বা অত্যাবশ্যক করা হয়েছে। কেননা, অজ্ঞতা থেকেই সৃষ্টি হয় যাবতীয় কুসংস্কার, যাতে সমাজে নানা রকম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। জাতি ও গোত্রে বিভেদ, অন্যায়, অত্যাচার প্রভৃতি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নেয়। বর্তমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করার জন্য সবার মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাধ্যমে সমাজে মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তাই অজানাকে জানতে হবে, অচেনাকে চিনতে হবে। যত দূর সম্ভব প্রতিটি বিষয়ে সুস্পষ্ট জ্ঞান ও পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। এ জন্য চাই সঠিকভাবে জ্ঞান অন্বেষণ ও বিদ্যার্জন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আজ আমাদের থেকে কুসংস্কার ও সংকীর্ণ মনোভাব ক্রমশ দূরীভূত হচ্ছে। ব্যাপক গণসচেতনতার মাধ্যমেই আমাদের সমাজ থেকে দূরীভূত হতে পারে অজ্ঞতা ও কুসংস্কার। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান রাখে আর যে জ্ঞান রাখে না, তারা উভয় কি সমান হতে পারে?’ (সূরা আল-যুমার, আয়াত: ৯)
সাধারণত গ্রামীণ লোকালয়ে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার বেশি লক্ষ করা যায়। গ্রামবাংলায় সমাজ-সংসারে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে মানুষের মনগড়া মতবাদ ও ভ্রান্ত পথ অনুযায়ী কাজকর্ম সম্পন্ন হয় এবং আল্লাহর নির্ধারিত বিধান সম্পাদনের মধ্যে বিরাট পার্থক্য প্রত্যক্ষ করা যায়। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এসব কুসংস্কার বা কুপ্রথাকে বিশ্বাস করা হারাম বলে অভিহিত করেছেন। ইসলাম ধর্মমতে, একজন লোকের একই সঙ্গে চারটি বিয়ে করার সম্ভাবনা থাকলেও একই ব্যক্তি চারজন স্ত্রীর দায়িত্ব সমানভাবে পালন করতে পারে না—এ বিষয়টি বহুবিবাহে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের অবগত করার ব্যবস্থা করা দরকার। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম, মসজিদের ইমাম-খতিব, এনজিওদের কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষকে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে, যাতে তারা ধর্ম সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করে পরিকল্পিত পরিবার গঠনে জন্মনিয়ন্ত্রণের উৎসাহ ও উদ্দীপনা লাভ করে।
দেশের বেশির ভাগ নারী আজও অবহেলা আর কুসংস্কারের শিকার। গর্ভধারণ প্রত্যেক মায়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময় তাঁর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য সবার আগে তাঁর স্বামীর সহযোগিতা প্রয়োজন। এ সময়টায় অনেক গর্ভবতীরই কোনো ধরনের চিকিৎসা হয় না। তাই দেশে মাতৃমৃত্যুর হার উদ্বেগজনক। অথচ পরিবারের পুরুষ কেউ অসুস্থ হলে দেশে-বিদেশে চিকিৎসাসেবা পেয়ে থাকেন। আর নারীর সাধারণ চিকিৎসার কথাও পরিবারের কেউ ভাবেন না। গর্ভাবস্থায় কোনো চিকিৎসক দেখানোর সুযোগ থাকে না, এমনকি স্বাস্থ্যকর্মীর সহযোগিতায় নিজেদের টিকা এবং শিশুর জন্মের পর রোগ প্রতিষেধক টিকা গ্রহণও সম্ভব হয় না। শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবার হলে কেউ কেউ সন্তান প্রসবকালে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হন। আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন অনেকে মৃত্যুঝুঁকির সম্মুখীন হয়েও এলাকার ধাত্রীর সাহায্যেই শিশু ভূমিষ্ঠের চেষ্টা করেন। নারীরা বিনা মূল্যে পরিবারে সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে থাকলেও তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের কোনো সুযোগ দেওয়া হয় না।
মানুষ আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে সত্য, কিন্তু এতেও সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর হয়নি। ১৪-১৫ বছরের বিবাহিত জীবনে অনেক নারীরই সন্তানসংখ্যা পাঁচ-ছয়। এসব সন্তানের শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টির অভাবেই এ দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। শিশুটি যদি কন্যা হয়, তাহলে শুরু হয় ভিন্নধর্মী অবহেলা আর বঞ্চনা। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া তো দূরের কথা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন নারীদের যুক্তি হলো, ছেলেরা বড় হয়ে আয় করে খাওয়াবে। তাই তাদের ছোটবেলা থেকেই বেশি খাওয়ানো দরকার। আর মেয়েরা যেহেতু ঘরসংসার করবে, সেহেতু তাদের বেশি খাওয়ার দরকার নেই। দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবের পরিবর্তন জরুরি।
বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারে শুভ-অশুভ মেনে চলা ইসলামি শরিয়তগর্হিত কাজ ও শিরকতুল্য। তাই আমাদের সব ধরনের কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে হবে। শিক্ষিত নারীদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করলে একদিকে যেমন নারীরা তাঁদের সামাজিক অধিকার ফিরে পাবেন, অন্যদিকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি তথা পরিবার-পরিকল্পনা গ্রহণের সুযোগ বাড়বে। এতে চাকরিজীবী নারীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে এবং তাঁদের পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে। বিবাহের ক্ষেত্রে ধর্মীয়, সামাজিক ও সরকারি আইন হুবহু মেনে চলতে পারলে তা জন্মনিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। কুসংস্কারে বিশ্বাস স্থাপন কোনো কিছুর প্রতি কুলক্ষণ ভেবে মেনে চলা আর তার প্রতি আস্থাশীল হওয়াও মহাপাপ। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে উল্লেখ আছে, ‘গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট লোক আল্লাহর রহমত থেকে অনেক দূরে অবস্থান করবে।’
সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে নোংরা অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস প্রভাব বিস্তার করেছে। অশ্লীলতা ও কুসংস্কার সমাজকে ব্যাধিগ্রস্ত করছে। বর্তমানে হত্যা, ধর্ষণ, খুন-খারাবি, ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায়, অত্যাচার, জবরদখল, সম্পত্তি আত্মসাৎ প্রভৃতি অনৈতিক কর্মকাণ্ড সমাজে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিকতার নামে তরুণ প্রজন্ম ইসলাম-পরিপন্থী যৌনাচার, অবাধ মেলামেশা, নগ্নতা, অশ্লীলতা প্রভৃতি অপকর্মে লিপ্ত। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভান্ডার তথা ইসলামি শরিয়তের মূল উৎস আল-কোরআনকে সঠিকভাবে বুঝতে ব্যর্থ হলে ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের অতল গহ্বরে মানুষ হারিয়ে যাবে। তাই সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে কুসংস্কার জাতীয় যাবতীয় প্রচলিত নিয়মনীতি প্রতিরোধে সচেষ্ট হওয়া এবং কুসংস্কারের অলীক ধ্যান-ধারণা পরিত্যাগ করে সত্যিকারভাবে ইসলাম-নির্দেশিত মধ্যমপন্থায় জীবন পরিচালনা করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান:সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@prothom-alo.info
কুসংস্কারের ফলে সৃষ্টিকর্তার ওপর সুদৃঢ় আস্থা ও ধর্মবিশ্বাস এবং পরম করুণাময়ের প্রতি নির্ভরতা বহুলাংশে লোপ পায়। কুসংস্কার হলো ধর্মীয় বিধানের বাইরে এমন একটি প্রচলিত নিয়মবিধি, যার প্রতি মানুষ অন্ধবিশ্বাস স্থাপন করে এবং কর্মক্ষেত্রে এ বিশ্বাসকে আশ্রয় করেই চলে। কুসংস্কারজনিত অন্ধবিশ্বাসের মোহজালে পড়ে মানুষ নিজেদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে এবং আল্লাহর প্রতি পরম আস্থা ও নির্ভরতা থেকে নিজেদের ঈমানের শক্তি দুর্বল করে তুলছে। একজন মুসলমানের আত্মবিশ্বাস ও আল্লাহর ওপর ভরসাই যথেষ্ট। তাই ইসলামি শরিয়তের ঘোরতর পরিপন্থী এমন প্রচলিত কুনীতিগুলোর মূলোচ্ছেদ করা বা বর্জন করা মুসলমানদের অবশ্যকর্তব্য। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘অশুভ বা কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই, বরং তা শুভ বলে মনে করা ভালো। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! শুভ লক্ষণ কী?’ তিনি বললেন, ‘এরূপ অর্থবোধক কথা, যা তোমাদের কেউ শুনতে পায়।’ (বুখারি) তাই কুসংস্কার বন্ধের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা চালানো সবার ঈমানি দায়িত্ব।
ইসলামে জ্ঞান অর্জনকে ফরজ বা অত্যাবশ্যক করা হয়েছে। কেননা, অজ্ঞতা থেকেই সৃষ্টি হয় যাবতীয় কুসংস্কার, যাতে সমাজে নানা রকম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। জাতি ও গোত্রে বিভেদ, অন্যায়, অত্যাচার প্রভৃতি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নেয়। বর্তমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করার জন্য সবার মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাধ্যমে সমাজে মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তাই অজানাকে জানতে হবে, অচেনাকে চিনতে হবে। যত দূর সম্ভব প্রতিটি বিষয়ে সুস্পষ্ট জ্ঞান ও পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। এ জন্য চাই সঠিকভাবে জ্ঞান অন্বেষণ ও বিদ্যার্জন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আজ আমাদের থেকে কুসংস্কার ও সংকীর্ণ মনোভাব ক্রমশ দূরীভূত হচ্ছে। ব্যাপক গণসচেতনতার মাধ্যমেই আমাদের সমাজ থেকে দূরীভূত হতে পারে অজ্ঞতা ও কুসংস্কার। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান রাখে আর যে জ্ঞান রাখে না, তারা উভয় কি সমান হতে পারে?’ (সূরা আল-যুমার, আয়াত: ৯)
সাধারণত গ্রামীণ লোকালয়ে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার বেশি লক্ষ করা যায়। গ্রামবাংলায় সমাজ-সংসারে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে মানুষের মনগড়া মতবাদ ও ভ্রান্ত পথ অনুযায়ী কাজকর্ম সম্পন্ন হয় এবং আল্লাহর নির্ধারিত বিধান সম্পাদনের মধ্যে বিরাট পার্থক্য প্রত্যক্ষ করা যায়। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এসব কুসংস্কার বা কুপ্রথাকে বিশ্বাস করা হারাম বলে অভিহিত করেছেন। ইসলাম ধর্মমতে, একজন লোকের একই সঙ্গে চারটি বিয়ে করার সম্ভাবনা থাকলেও একই ব্যক্তি চারজন স্ত্রীর দায়িত্ব সমানভাবে পালন করতে পারে না—এ বিষয়টি বহুবিবাহে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের অবগত করার ব্যবস্থা করা দরকার। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম, মসজিদের ইমাম-খতিব, এনজিওদের কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষকে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে, যাতে তারা ধর্ম সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করে পরিকল্পিত পরিবার গঠনে জন্মনিয়ন্ত্রণের উৎসাহ ও উদ্দীপনা লাভ করে।
দেশের বেশির ভাগ নারী আজও অবহেলা আর কুসংস্কারের শিকার। গর্ভধারণ প্রত্যেক মায়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময় তাঁর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য সবার আগে তাঁর স্বামীর সহযোগিতা প্রয়োজন। এ সময়টায় অনেক গর্ভবতীরই কোনো ধরনের চিকিৎসা হয় না। তাই দেশে মাতৃমৃত্যুর হার উদ্বেগজনক। অথচ পরিবারের পুরুষ কেউ অসুস্থ হলে দেশে-বিদেশে চিকিৎসাসেবা পেয়ে থাকেন। আর নারীর সাধারণ চিকিৎসার কথাও পরিবারের কেউ ভাবেন না। গর্ভাবস্থায় কোনো চিকিৎসক দেখানোর সুযোগ থাকে না, এমনকি স্বাস্থ্যকর্মীর সহযোগিতায় নিজেদের টিকা এবং শিশুর জন্মের পর রোগ প্রতিষেধক টিকা গ্রহণও সম্ভব হয় না। শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবার হলে কেউ কেউ সন্তান প্রসবকালে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হন। আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন অনেকে মৃত্যুঝুঁকির সম্মুখীন হয়েও এলাকার ধাত্রীর সাহায্যেই শিশু ভূমিষ্ঠের চেষ্টা করেন। নারীরা বিনা মূল্যে পরিবারে সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে থাকলেও তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের কোনো সুযোগ দেওয়া হয় না।
মানুষ আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে সত্য, কিন্তু এতেও সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর হয়নি। ১৪-১৫ বছরের বিবাহিত জীবনে অনেক নারীরই সন্তানসংখ্যা পাঁচ-ছয়। এসব সন্তানের শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টির অভাবেই এ দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। শিশুটি যদি কন্যা হয়, তাহলে শুরু হয় ভিন্নধর্মী অবহেলা আর বঞ্চনা। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া তো দূরের কথা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন নারীদের যুক্তি হলো, ছেলেরা বড় হয়ে আয় করে খাওয়াবে। তাই তাদের ছোটবেলা থেকেই বেশি খাওয়ানো দরকার। আর মেয়েরা যেহেতু ঘরসংসার করবে, সেহেতু তাদের বেশি খাওয়ার দরকার নেই। দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবের পরিবর্তন জরুরি।
বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারে শুভ-অশুভ মেনে চলা ইসলামি শরিয়তগর্হিত কাজ ও শিরকতুল্য। তাই আমাদের সব ধরনের কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে হবে। শিক্ষিত নারীদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করলে একদিকে যেমন নারীরা তাঁদের সামাজিক অধিকার ফিরে পাবেন, অন্যদিকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি তথা পরিবার-পরিকল্পনা গ্রহণের সুযোগ বাড়বে। এতে চাকরিজীবী নারীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে এবং তাঁদের পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে। বিবাহের ক্ষেত্রে ধর্মীয়, সামাজিক ও সরকারি আইন হুবহু মেনে চলতে পারলে তা জন্মনিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। কুসংস্কারে বিশ্বাস স্থাপন কোনো কিছুর প্রতি কুলক্ষণ ভেবে মেনে চলা আর তার প্রতি আস্থাশীল হওয়াও মহাপাপ। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে উল্লেখ আছে, ‘গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট লোক আল্লাহর রহমত থেকে অনেক দূরে অবস্থান করবে।’
সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে নোংরা অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস প্রভাব বিস্তার করেছে। অশ্লীলতা ও কুসংস্কার সমাজকে ব্যাধিগ্রস্ত করছে। বর্তমানে হত্যা, ধর্ষণ, খুন-খারাবি, ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায়, অত্যাচার, জবরদখল, সম্পত্তি আত্মসাৎ প্রভৃতি অনৈতিক কর্মকাণ্ড সমাজে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিকতার নামে তরুণ প্রজন্ম ইসলাম-পরিপন্থী যৌনাচার, অবাধ মেলামেশা, নগ্নতা, অশ্লীলতা প্রভৃতি অপকর্মে লিপ্ত। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভান্ডার তথা ইসলামি শরিয়তের মূল উৎস আল-কোরআনকে সঠিকভাবে বুঝতে ব্যর্থ হলে ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের অতল গহ্বরে মানুষ হারিয়ে যাবে। তাই সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে কুসংস্কার জাতীয় যাবতীয় প্রচলিত নিয়মনীতি প্রতিরোধে সচেষ্ট হওয়া এবং কুসংস্কারের অলীক ধ্যান-ধারণা পরিত্যাগ করে সত্যিকারভাবে ইসলাম-নির্দেশিত মধ্যমপন্থায় জীবন পরিচালনা করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান:সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@prothom-alo.info
No comments