নারী উন্নয়ন নীতির ভবিষ্যৎ কী by ফিরোজ জামান চৌধুরী
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষিত হয়েছিল এক যুগ আগে, ১৯৯৭ সালে। এর পর অনেক চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে গেছে। নারী উন্নয়ন নীতির প্রশ্নে অনেক দেনদরবার হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে লাভ-লোকসানের নানা হিসাব-নিকাশ হয়েছে। কিন্তু সম-অধিকারের প্রশ্নে নারীর ভাগ্যের শিকে ছিঁড়েনি। সবচেয়ে দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, ১২ বছরেও নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি সরকারগুলো। আমাদের নারী উন্নয়ন নীতির অবস্থা হয়েছে সেই প্রবাদের মতো, ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’।
তবে নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক বলেই মনে হচ্ছে। রোকেয়া পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত নারী উন্নয়ন নীতিমালা চালু ও বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করতে নতুন আইন প্রণয়নের পরিকল্পনা সরকারের আছে।’ (প্রথম আলো, ১১ ডিসেম্বর ২০০৯)
১৯৯৭ সালে ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অভাবে তা দীর্ঘ ১২ বছর ধরে স্থবির হয়ে রয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে আওয়ামী লীগের নারী উন্নয়ন নীতি ছিল অনেকটাই উদার ও নারীবান্ধব। কিন্তু যেকোনো নীতিমালা ও আইন প্রণয়নের চেয়ে তার বাস্তব প্র্রয়োগই বড় কথা। ১৯৯৭ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি প্রবর্তনের যোগ্য সম্মান পাওয়ার দাবিদার আওয়ামী লীগ। কিন্তু তারাই আবার একে হিমাগারে ফেলে রাখতেও কার্পণ্য করেনি। নানা অজুহাতে সময় ক্ষেপণ করে পার করেছে তাদের শাসনামলের বাকি চার বছর। আর বিএনপি-জামায়াত সরকার ‘নারী উন্নয়ন নীতি’তে চাতুর্যপূর্ণ পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের রক্ষণশীল অবস্থান বুঝিয়ে দিয়েছে। তারা গোপনে কাটাছেঁড়া করে ২০০৫ সালে ‘নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৪’ সালের নামে যা প্রকাশ করে, তাকে আর নারী উন্নয়ন নীতি বলার জো নেই। বিএনপি-জামায়াত সরকারের ওই সংশোধিত নীতি কোনো মহলই সমর্থন করেনি। প্রগতিশীল নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একটা সুযোগ এসেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৪ সালের সংশোধনীগুলো বাতিল করে নারী উন্নয়ন নীতি-২০০৮ ঘোষণা করে। কিন্তু সময়স্বল্পতা আর সুযোগসন্ধানী একশ্রেণীর মৌলবাদীর আস্ফাালনের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারও নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এ নীতি ছিল বহুলাংশে ১৯৯৭-এর নারী নীতির আলোকে প্রণীত। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতিতে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে। ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতি এবং বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতির মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। সুতরাং যেকোনো একটা বেছে নিয়ে দ্রুত কাজ শুরু করা দরকার। তবে সর্বশেষ, অর্থাত্ ২০০৮ সালের নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে কাজে হাত দেওয়াই হবে বেশি যুক্তিযুক্ত।
২.
বেইজিং কর্মপরিকল্পনা (পিএফএ), আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ ও বাংলাদেশের সংবিধানের মূল ভিত্তিকে বিবেচনায় নিয়ে ১৯৯৭ সালে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ‘নারী উন্নয়ন নীতি’তে রাজনীতির মূল ধারায় নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি, নারীর সম-অধিকার, সম্পদে নারীর উত্তরাধিকার প্রভৃতি বিষয় অনেক ইতিবাচক ও স্পষ্ট ছিল। ২০০৪ সালে সংশোধিত (২০০৫-এ ঘোষিত) ‘নারী উন্নয়ন নীতি’র ৭.১ ধারায় বর্ণিত ‘অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা’ বাক্যটি সংশোধন করে ‘সমান অধিকার’ বাদ দিয়ে ‘সংবিধানসম্মত অধিকার’ শব্দ যোগ করা হয়েছে। সংবিধানসম্মত অধিকার শব্দযুগল নিয়ে আপত্তির কিছু না থাকলেও এর মাধ্যমে ‘সমান অধিকার’ বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। একইভাবে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় ‘সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেওয়া’ শীর্ষক বাক্যে ‘সম্পদ’ ও ‘অংশীদারিত্ব’ শব্দ দুটো বাদ দেওয়া হয়েছে। ৭.২ ধারায় ‘নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’ অংশের সংশোধনীতে ‘উত্তরাধিকার’, ‘সম্পদ’ ও ‘ভূমির ওপর অধিকার’ শব্দগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। ‘নারীর প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক ধারা ৯-এ উল্লিখিত ‘বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে রাষ্ট্রদূতসহ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, পরিকল্পনা কমিশন, বিচার বিভাগের উচ্চপদে নারী নিয়োগ প্রদান করা’ অংশটুকু সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়েছে। উপরিউক্ত সংশোধনীগুলো পর্যবেক্ষণ করলে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া খুব কঠিন নয়, বিএনপি ও তার মিত্র রাজনৈতিক শক্তির হাতে নারী উন্নয়ন নীতির বাস্তবায়ন হবে না। ১৯৯৭-এর নারী উন্নয়ন নীতির মৌলিক ভিত্তিগুলোকে পরিবর্তন করে বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকার স্পষ্টতই নারী অধিকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
নারী উন্নয়ন নীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে, ‘নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক ধারা ৮। ধারা ৮-এ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আগের বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধান প্রণয়নের নামে শুধুই কালক্ষেপণ করেছে। তাদের যুক্তি ছিল, সংসদে আওয়ামী লীগ সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, বিরোধী দলের সমর্থন ছাড়া এ বিল পাস করা সম্ভব নয়। ফলে সংসদীয় কমিটির আঁতুড়ঘরেই বিলটির মৃত্যু হয়েছে। আগের আওয়ামী লীগ সরকার ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোয় এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধান করেছিল। স্থানীয় সরকারে নারীদের জন্য সরাসরি নির্বাচনের বিধান রাখা সম্ভব হলে জাতীয় সংসদের জন্য একই বিধান রাখতে বাধা কোথায়? এবার আমাদের সামনে ভিন্ন এক রাজনৈতিক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। জাতীয় সংসদে এখন আওয়ামী লীগের একারই রয়েছে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন। সুতরাং এবার আর পুরোনো অজুহাত খাড়া করার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারের ১২.২ ধারায় উল্লেখ করেছে, ‘জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করা হবে।’ এ সংসদেই সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই সরকারের অঙ্গীকার অনুযায়ী সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়ে সংবিধান সংশোধন করে আইন প্রণয়ন করতে হবে। সমাজের মূলধারায় নারীকে সম্পৃক্ত করতে হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারীর সরাসরি নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।
২০০৮ সালের নারী উন্নয়ন নীতিতে মাতৃত্বকালীন ছুটি চার মাসের বদলে পাঁচ মাস করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এখনো কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। চাকরিজীবী নারীর জন্য এ ছুটি খুবই প্রয়োজনীয়। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের কালবিলম্ব করা ঠিক হবে না।
নারীর ক্ষমতায়নের স্বার্থে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। অভিন্ন উত্তরাধিকার আইন এবং অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন (ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড) করে তা জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা খুবই জরুরি। আশা করা যায়, সরকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে তা বাস্তবায়ন করবে।
বর্তমানে দাপ্তরিক সব কাজে সন্তানের পরিচয়ে বাবার সঙ্গে মায়ের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে—নারী অধিকারের প্রশ্নে ১৯৯৮ সালে গৃহীত তত্কালীন শেখ হাসিনার সরকারের এ পদক্ষেপটি নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত। এরই মধ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এবারের সরকার নারী অধিকার বাস্তবায়নে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংসদ উপনেতা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর নিয়োগ নারীর ক্ষমতায়নের পথে বড় ধরনের অগ্রগতি হিসেবে দেশ-বিদেশে আলোচিত হচ্ছে। তাই এ সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক।
সম্প্রতি মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শিরিন শারমীন চৌধুরীও ইঙ্গিত দিয়েছেন, সরকার খুব শিগগির আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করবে। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন পরিষদের আগামী সভাতেই নারী উন্নয়ন নীতিসংক্রান্ত জটিলতার অবসান ঘটবে। (সূত্র: প্রথম আলো, ২১ নভেম্বর ২০০৯)। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল ধারার বাইরে রেখে কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। জাতীয় সংসদেও নারী উন্নয়ন নীতির বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। আশা করা যায়, মহাজোট সরকার নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন করে পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। তবে শুধু ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, আইন করে নারী উন্নয়ন নীতির প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। জীবনের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ ও অধিকারের সুযোগ সরকারকেই করে দিতে হবে।
ফিরোজ জামান চৌধুরী: সাংবাদিক।
firoz.choudhury@yahoo.com
তবে নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক বলেই মনে হচ্ছে। রোকেয়া পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত নারী উন্নয়ন নীতিমালা চালু ও বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করতে নতুন আইন প্রণয়নের পরিকল্পনা সরকারের আছে।’ (প্রথম আলো, ১১ ডিসেম্বর ২০০৯)
১৯৯৭ সালে ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অভাবে তা দীর্ঘ ১২ বছর ধরে স্থবির হয়ে রয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে আওয়ামী লীগের নারী উন্নয়ন নীতি ছিল অনেকটাই উদার ও নারীবান্ধব। কিন্তু যেকোনো নীতিমালা ও আইন প্রণয়নের চেয়ে তার বাস্তব প্র্রয়োগই বড় কথা। ১৯৯৭ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি প্রবর্তনের যোগ্য সম্মান পাওয়ার দাবিদার আওয়ামী লীগ। কিন্তু তারাই আবার একে হিমাগারে ফেলে রাখতেও কার্পণ্য করেনি। নানা অজুহাতে সময় ক্ষেপণ করে পার করেছে তাদের শাসনামলের বাকি চার বছর। আর বিএনপি-জামায়াত সরকার ‘নারী উন্নয়ন নীতি’তে চাতুর্যপূর্ণ পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের রক্ষণশীল অবস্থান বুঝিয়ে দিয়েছে। তারা গোপনে কাটাছেঁড়া করে ২০০৫ সালে ‘নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৪’ সালের নামে যা প্রকাশ করে, তাকে আর নারী উন্নয়ন নীতি বলার জো নেই। বিএনপি-জামায়াত সরকারের ওই সংশোধিত নীতি কোনো মহলই সমর্থন করেনি। প্রগতিশীল নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একটা সুযোগ এসেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৪ সালের সংশোধনীগুলো বাতিল করে নারী উন্নয়ন নীতি-২০০৮ ঘোষণা করে। কিন্তু সময়স্বল্পতা আর সুযোগসন্ধানী একশ্রেণীর মৌলবাদীর আস্ফাালনের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারও নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এ নীতি ছিল বহুলাংশে ১৯৯৭-এর নারী নীতির আলোকে প্রণীত। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতিতে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে। ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতি এবং বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতির মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। সুতরাং যেকোনো একটা বেছে নিয়ে দ্রুত কাজ শুরু করা দরকার। তবে সর্বশেষ, অর্থাত্ ২০০৮ সালের নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে কাজে হাত দেওয়াই হবে বেশি যুক্তিযুক্ত।
২.
বেইজিং কর্মপরিকল্পনা (পিএফএ), আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ ও বাংলাদেশের সংবিধানের মূল ভিত্তিকে বিবেচনায় নিয়ে ১৯৯৭ সালে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ‘নারী উন্নয়ন নীতি’তে রাজনীতির মূল ধারায় নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি, নারীর সম-অধিকার, সম্পদে নারীর উত্তরাধিকার প্রভৃতি বিষয় অনেক ইতিবাচক ও স্পষ্ট ছিল। ২০০৪ সালে সংশোধিত (২০০৫-এ ঘোষিত) ‘নারী উন্নয়ন নীতি’র ৭.১ ধারায় বর্ণিত ‘অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা’ বাক্যটি সংশোধন করে ‘সমান অধিকার’ বাদ দিয়ে ‘সংবিধানসম্মত অধিকার’ শব্দ যোগ করা হয়েছে। সংবিধানসম্মত অধিকার শব্দযুগল নিয়ে আপত্তির কিছু না থাকলেও এর মাধ্যমে ‘সমান অধিকার’ বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। একইভাবে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় ‘সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেওয়া’ শীর্ষক বাক্যে ‘সম্পদ’ ও ‘অংশীদারিত্ব’ শব্দ দুটো বাদ দেওয়া হয়েছে। ৭.২ ধারায় ‘নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’ অংশের সংশোধনীতে ‘উত্তরাধিকার’, ‘সম্পদ’ ও ‘ভূমির ওপর অধিকার’ শব্দগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। ‘নারীর প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক ধারা ৯-এ উল্লিখিত ‘বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে রাষ্ট্রদূতসহ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, পরিকল্পনা কমিশন, বিচার বিভাগের উচ্চপদে নারী নিয়োগ প্রদান করা’ অংশটুকু সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়েছে। উপরিউক্ত সংশোধনীগুলো পর্যবেক্ষণ করলে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া খুব কঠিন নয়, বিএনপি ও তার মিত্র রাজনৈতিক শক্তির হাতে নারী উন্নয়ন নীতির বাস্তবায়ন হবে না। ১৯৯৭-এর নারী উন্নয়ন নীতির মৌলিক ভিত্তিগুলোকে পরিবর্তন করে বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকার স্পষ্টতই নারী অধিকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
নারী উন্নয়ন নীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে, ‘নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক ধারা ৮। ধারা ৮-এ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আগের বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধান প্রণয়নের নামে শুধুই কালক্ষেপণ করেছে। তাদের যুক্তি ছিল, সংসদে আওয়ামী লীগ সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, বিরোধী দলের সমর্থন ছাড়া এ বিল পাস করা সম্ভব নয়। ফলে সংসদীয় কমিটির আঁতুড়ঘরেই বিলটির মৃত্যু হয়েছে। আগের আওয়ামী লীগ সরকার ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোয় এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধান করেছিল। স্থানীয় সরকারে নারীদের জন্য সরাসরি নির্বাচনের বিধান রাখা সম্ভব হলে জাতীয় সংসদের জন্য একই বিধান রাখতে বাধা কোথায়? এবার আমাদের সামনে ভিন্ন এক রাজনৈতিক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। জাতীয় সংসদে এখন আওয়ামী লীগের একারই রয়েছে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন। সুতরাং এবার আর পুরোনো অজুহাত খাড়া করার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারের ১২.২ ধারায় উল্লেখ করেছে, ‘জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করা হবে।’ এ সংসদেই সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই সরকারের অঙ্গীকার অনুযায়ী সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়ে সংবিধান সংশোধন করে আইন প্রণয়ন করতে হবে। সমাজের মূলধারায় নারীকে সম্পৃক্ত করতে হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারীর সরাসরি নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।
২০০৮ সালের নারী উন্নয়ন নীতিতে মাতৃত্বকালীন ছুটি চার মাসের বদলে পাঁচ মাস করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এখনো কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। চাকরিজীবী নারীর জন্য এ ছুটি খুবই প্রয়োজনীয়। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের কালবিলম্ব করা ঠিক হবে না।
নারীর ক্ষমতায়নের স্বার্থে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। অভিন্ন উত্তরাধিকার আইন এবং অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন (ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড) করে তা জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা খুবই জরুরি। আশা করা যায়, সরকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে তা বাস্তবায়ন করবে।
বর্তমানে দাপ্তরিক সব কাজে সন্তানের পরিচয়ে বাবার সঙ্গে মায়ের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে—নারী অধিকারের প্রশ্নে ১৯৯৮ সালে গৃহীত তত্কালীন শেখ হাসিনার সরকারের এ পদক্ষেপটি নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত। এরই মধ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এবারের সরকার নারী অধিকার বাস্তবায়নে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংসদ উপনেতা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর নিয়োগ নারীর ক্ষমতায়নের পথে বড় ধরনের অগ্রগতি হিসেবে দেশ-বিদেশে আলোচিত হচ্ছে। তাই এ সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক।
সম্প্রতি মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শিরিন শারমীন চৌধুরীও ইঙ্গিত দিয়েছেন, সরকার খুব শিগগির আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করবে। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন পরিষদের আগামী সভাতেই নারী উন্নয়ন নীতিসংক্রান্ত জটিলতার অবসান ঘটবে। (সূত্র: প্রথম আলো, ২১ নভেম্বর ২০০৯)। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল ধারার বাইরে রেখে কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। জাতীয় সংসদেও নারী উন্নয়ন নীতির বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। আশা করা যায়, মহাজোট সরকার নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন করে পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। তবে শুধু ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, আইন করে নারী উন্নয়ন নীতির প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। জীবনের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ ও অধিকারের সুযোগ সরকারকেই করে দিতে হবে।
ফিরোজ জামান চৌধুরী: সাংবাদিক।
firoz.choudhury@yahoo.com
No comments