লালনের ছায়া by আজাদুর রহমান
দৌলতপুরের হোসেনাবাদ গ্রামে জন্ম নেওয়া বাউল শফি মণ্ডলের কাছে লালনই সব কথা। তাঁর ভাষায়, ‘গুরুকেই আমি লালন ভাবি। গুরুভাবনায় থাকতে থাকতে কখনো আবার নিজের মধ্যেই লালন প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। তখন মন অন্য রকম হয়ে যায়। গানের সুর ভালো হয়। মনে হয়, যার গান সেই গাইছে, আমি খালি খালি মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি।’ শ্যামলা রঙের মনোহরি এই বাউলের ভাবের অভাব হয় না। কথা বলতে বলতে তিনি গান ধরেন—
‘ভাবের ঘরে কী কুদরতি
ভাবের লণ্ঠন ভাবের বাতি
ভাবের অভাব হলে এক রতি
অমনি ওই রূপ যায় সরে...’
গান শেষ করে শফি পুনরায় কথায় ফেরেন, ‘যখন গান করি, তখন কিছুই দেখতে পাই না। শুধু আমার রূপে গুরুর রূপ বিলীন করে নিজের রূপটাই আমি দেখতে চেষ্টা করি। রূপের দিকে “ধিয়ান” না থাকলে সে রূপ থাকে না আর।’ গুরু ও লালন প্রসঙ্গে শফি জানান, ‘গুরু কিংবা লালন যা-ই বলুন, ওনারা তো ধিয়ানলোকে বিরাজ করেন। কাজিপুরের দবিরউদ্দিনকে দেখে আসুন, তিনি আমার গুরু, তাঁকে দেখলে লালনের ছোঁয়া পাবেন।’
দবিরউদ্দিন নিভৃত গ্রামে থাকেন। অনেকবার গাড়ি ও রাস্তা বদল করে তাঁর কাছে যেতে হয়। দৌলতপুর-মেহেরপুরের সীমানা বরাবর হওয়ায় কেউ বলেন দৌলতপুরে বাড়ি, কেউ বলেন মেহেরপুরে। যা হোক, কুষ্টিয়া শহর থেকে খলিষাকুণ্ডি হয়ে প্রথমে বাসে করে প্রায় ৪০-৫০ কিলোমিটার দূরের মেহেরপুরের বামুন্দিতে নামতে হয়। সেখান থেকে ভ্যানের রাস্তায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার যাওয়ার পর নওদাপাড়া বাজার। এরপর হাতের বাঁয়ে নদী ধরে হাঁটাপথ প্রায় মাইলখানেক পেরোলে ঝুপড়িগ্রাম-কাজিপুরের মাঠপাড়া। মাঠপাড়ার মাঝামাঝি জায়গায় পিঁড়ালি দেওয়া খড়ের চৌচালা ঘরের আঙিনায় খেজুরের পাটিতে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন দবিরউদ্দিন। সালাম দেওয়ার পর মুখোমুখি হতেই একটা অন্য রকম ভাব নেমে এল—কল্পনার লালন বুঝি ছেঁউড়িয়া থেকে এখানে এসে বসতি গেড়েছে। লালনের মতোই নাক, কপাল, কান—যেন অদ্ভুত এক মুহূর্তে সাক্ষাত্ লালনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। গায়ের রংটা হালকা কালো হলেও তাতে তামাটে উজ্জ্বলতা। দাঁড়ালে দবির উদ্দিনের হাত দুটো লালনের মতো হাঁটুর নিচে পড়ে। আগ্রহ নিয়ে তাঁর দিকে চেয়ে থাকি।
দবিরউদ্দিনকে কী বলা যায়, সব গুলিয়ে গেছে। দবিরের সেবাদাসী আনজিরা বেগম চিঁড়া, গুড়, মুড়ি আনলেন। খেজুরপাটিতে বসে পরস্পর আলাপচারিতা। খেতে খেতে জানা গেল, প্রাগপুরের গরুড়া গ্রামের আনজিরা বেগম দবিরউদ্দিনের স্ত্রী বেঁচে থাকতেই সংসার থেকে সম্মতি নিয়ে তাঁর সেবায় নিজেকে নিয়োগ করেছেন। আনজিরার বয়স ৬০ পেরিয়ে গেছে। দবিরউদ্দিন স্ত্রী সারেজান বিবিকে খুব ভালোবাসতেন। প্রতিবছর স্ত্রীর প্রয়াণ দিনে সাধুসেবা করেন। স্ত্রী বছরখানেক আগে গত হয়েছেন। প্রয়াত স্ত্রীর কথা মনে করে দবির আফসোস করে ওঠেন, ‘সারেজানের মৃত্যুটা অন্য রকমভাবে হয়েছিল। সেদিন সকালে সাধুসংঘ ছিল। বাল্যসেবার পর দুপুরে সাধুসেবা। বাল্যসেবা নেওয়া হলে সারেজান সবাইকে বললেন, “আমি তো দুপুরের সাধুসংঘ শেষ করতে পারব না। আমাকে বিদায় দিতে হবে।” এ কথা শোনার পর সবাই ব্যথিত হলো। সারেজান প্রয়োজনীয় কথা সেরে নিলেন, তারপর আমাকে শিষ্যদের হাতে সঁপে দিয়ে কথা বলতে বলতে তিনি মারা গেলেন।’ দবিরের গুরুমা অর্থাত্ গুরু মোফাজ্জল শাহের স্ত্রীও তাঁর জীবদ্দশায় অনুরূপ সাধুসংঘে একই প্রক্রিয়ায় মারা গিয়েছিলেন। দবিরের গুরুর নাম মোফাজ্জল ফকির। মোফাজ্জল ফকিরের গুরুর নাম সাধনশাহ্। মোফাজ্জল ফকিরের বাড়ি ছিল খলিষাকুণ্ডিতে। দবিরের বাবা তৈয়ব আলী একসময় জোতদার ছিলেন। তখন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছে বাড়ি ছিল। দবির নিজে কোনো লেখাপড়া করেননি। সংসারে উদাসী দবির ফকির গান গেয়েই বেড়াতেন—পাল্লার গান। গানে গানেই একসময় জমিজমা শেষ হয়ে যায়। দবির এখন যে বাড়িতে আছেন, সেটা গুরু মোজাম্মেলের আখড়া ছিল। ঘরের পাশেই মোজাম্মেল ফকিরের কবর। মৃত্যুকালে তিনি দবিরকে এই বাড়ি দিয়ে যান। সেই থেকে দবির এখানেই থাকেন। একটা ঘর— খেজুরপাতার বেড়া দেওয়া—ওইটাই সব।
লালনের গান ছাড়া দবিরের তেমন কোনো নেশা নেই, তবে পান খান। গুরুর প্রতি তাঁর ভক্তি অপরিসীম। একসময় লালনের দ্বিতীয় পর্যায়ের শিষ্য ইসমাইল ও কোকিল শাহের সঙ্গে তাঁর সঙ্গ ছিল। দবিরউদ্দিনের গুরুর গুরু সাধনশাহ্, সাধনের গুরু ছিলেন আবদুল্লাহ্। আবদুল্লাহ্ লালনের প্রাথমিক পর্যায়ের শিষ্য ছিলেন। তিনি তরিকা মেনে নামাজ পড়েন, রোজাও করেন। সর্বোপরি মানবতাই তাঁর কাছে বড় ধর্ম। সে কারণে সারা জীবনের অর্জিত অর্থ তিনি মানবসেবায় ব্যয় করেন। তাঁর মতে, মানবসেবা হলো সাধুসংঘ করে মানুষকে বোঝানো।
সাধনা বলতে দবির নিষ্কাম ভজনাকেই বোঝেন। ‘সোনার মানুষ ভাসছে রসে’—লালনের এই গান শোনার পর দবির মুগ্ধ হয়ে লালনপথে এসেছিলেন।
লালনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় কি না—এ রকম কথার জবাবে দবির বলেন, ‘স্বপ্নে তাঁর সঙ্গে আমার স্বরূপে দেখা হয়। লালন আমার মাথায়-মুখে ফুঁ দিয়ে দোয়া করেন। কথা বলেন না, তবে আকার-ইঙ্গিতে কথাবার্তা হয়। আমাকে কী দিয়েছেন, আলোচনা কী হয়—সেসব গুরুরহস্য এত অল্প সময়ে আপনাকে দেওয়া যাবে না।’
লোকে বলে, দবির এখন ১০৩ বছরের শক্তসমর্থ বৃদ্ধ বাউল। ৪৫ বছর ধরে নিরামিষভোজি দবির ফকিরের সুনির্দিষ্ট কোনো শিষ্য নেই। তাঁর ভক্ত-শিষ্যরা ছড়িয়ে থাকেন সারা দেশে। দবিরের ওখানে বছরে দুবার সাধুসংঘ হয়। সাধুসংঘের ধরন অন্য রকম। অগ্রহায়ণের ১৯ তারিখে পুরুষদের সাধুসংঘ, অন্যদিকে নারীদের সাধুসংঘ হয় আশ্বিনের ১৯ তারিখে।
‘ভাবের ঘরে কী কুদরতি
ভাবের লণ্ঠন ভাবের বাতি
ভাবের অভাব হলে এক রতি
অমনি ওই রূপ যায় সরে...’
গান শেষ করে শফি পুনরায় কথায় ফেরেন, ‘যখন গান করি, তখন কিছুই দেখতে পাই না। শুধু আমার রূপে গুরুর রূপ বিলীন করে নিজের রূপটাই আমি দেখতে চেষ্টা করি। রূপের দিকে “ধিয়ান” না থাকলে সে রূপ থাকে না আর।’ গুরু ও লালন প্রসঙ্গে শফি জানান, ‘গুরু কিংবা লালন যা-ই বলুন, ওনারা তো ধিয়ানলোকে বিরাজ করেন। কাজিপুরের দবিরউদ্দিনকে দেখে আসুন, তিনি আমার গুরু, তাঁকে দেখলে লালনের ছোঁয়া পাবেন।’
দবিরউদ্দিন নিভৃত গ্রামে থাকেন। অনেকবার গাড়ি ও রাস্তা বদল করে তাঁর কাছে যেতে হয়। দৌলতপুর-মেহেরপুরের সীমানা বরাবর হওয়ায় কেউ বলেন দৌলতপুরে বাড়ি, কেউ বলেন মেহেরপুরে। যা হোক, কুষ্টিয়া শহর থেকে খলিষাকুণ্ডি হয়ে প্রথমে বাসে করে প্রায় ৪০-৫০ কিলোমিটার দূরের মেহেরপুরের বামুন্দিতে নামতে হয়। সেখান থেকে ভ্যানের রাস্তায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার যাওয়ার পর নওদাপাড়া বাজার। এরপর হাতের বাঁয়ে নদী ধরে হাঁটাপথ প্রায় মাইলখানেক পেরোলে ঝুপড়িগ্রাম-কাজিপুরের মাঠপাড়া। মাঠপাড়ার মাঝামাঝি জায়গায় পিঁড়ালি দেওয়া খড়ের চৌচালা ঘরের আঙিনায় খেজুরের পাটিতে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন দবিরউদ্দিন। সালাম দেওয়ার পর মুখোমুখি হতেই একটা অন্য রকম ভাব নেমে এল—কল্পনার লালন বুঝি ছেঁউড়িয়া থেকে এখানে এসে বসতি গেড়েছে। লালনের মতোই নাক, কপাল, কান—যেন অদ্ভুত এক মুহূর্তে সাক্ষাত্ লালনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। গায়ের রংটা হালকা কালো হলেও তাতে তামাটে উজ্জ্বলতা। দাঁড়ালে দবির উদ্দিনের হাত দুটো লালনের মতো হাঁটুর নিচে পড়ে। আগ্রহ নিয়ে তাঁর দিকে চেয়ে থাকি।
দবিরউদ্দিনকে কী বলা যায়, সব গুলিয়ে গেছে। দবিরের সেবাদাসী আনজিরা বেগম চিঁড়া, গুড়, মুড়ি আনলেন। খেজুরপাটিতে বসে পরস্পর আলাপচারিতা। খেতে খেতে জানা গেল, প্রাগপুরের গরুড়া গ্রামের আনজিরা বেগম দবিরউদ্দিনের স্ত্রী বেঁচে থাকতেই সংসার থেকে সম্মতি নিয়ে তাঁর সেবায় নিজেকে নিয়োগ করেছেন। আনজিরার বয়স ৬০ পেরিয়ে গেছে। দবিরউদ্দিন স্ত্রী সারেজান বিবিকে খুব ভালোবাসতেন। প্রতিবছর স্ত্রীর প্রয়াণ দিনে সাধুসেবা করেন। স্ত্রী বছরখানেক আগে গত হয়েছেন। প্রয়াত স্ত্রীর কথা মনে করে দবির আফসোস করে ওঠেন, ‘সারেজানের মৃত্যুটা অন্য রকমভাবে হয়েছিল। সেদিন সকালে সাধুসংঘ ছিল। বাল্যসেবার পর দুপুরে সাধুসেবা। বাল্যসেবা নেওয়া হলে সারেজান সবাইকে বললেন, “আমি তো দুপুরের সাধুসংঘ শেষ করতে পারব না। আমাকে বিদায় দিতে হবে।” এ কথা শোনার পর সবাই ব্যথিত হলো। সারেজান প্রয়োজনীয় কথা সেরে নিলেন, তারপর আমাকে শিষ্যদের হাতে সঁপে দিয়ে কথা বলতে বলতে তিনি মারা গেলেন।’ দবিরের গুরুমা অর্থাত্ গুরু মোফাজ্জল শাহের স্ত্রীও তাঁর জীবদ্দশায় অনুরূপ সাধুসংঘে একই প্রক্রিয়ায় মারা গিয়েছিলেন। দবিরের গুরুর নাম মোফাজ্জল ফকির। মোফাজ্জল ফকিরের গুরুর নাম সাধনশাহ্। মোফাজ্জল ফকিরের বাড়ি ছিল খলিষাকুণ্ডিতে। দবিরের বাবা তৈয়ব আলী একসময় জোতদার ছিলেন। তখন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছে বাড়ি ছিল। দবির নিজে কোনো লেখাপড়া করেননি। সংসারে উদাসী দবির ফকির গান গেয়েই বেড়াতেন—পাল্লার গান। গানে গানেই একসময় জমিজমা শেষ হয়ে যায়। দবির এখন যে বাড়িতে আছেন, সেটা গুরু মোজাম্মেলের আখড়া ছিল। ঘরের পাশেই মোজাম্মেল ফকিরের কবর। মৃত্যুকালে তিনি দবিরকে এই বাড়ি দিয়ে যান। সেই থেকে দবির এখানেই থাকেন। একটা ঘর— খেজুরপাতার বেড়া দেওয়া—ওইটাই সব।
লালনের গান ছাড়া দবিরের তেমন কোনো নেশা নেই, তবে পান খান। গুরুর প্রতি তাঁর ভক্তি অপরিসীম। একসময় লালনের দ্বিতীয় পর্যায়ের শিষ্য ইসমাইল ও কোকিল শাহের সঙ্গে তাঁর সঙ্গ ছিল। দবিরউদ্দিনের গুরুর গুরু সাধনশাহ্, সাধনের গুরু ছিলেন আবদুল্লাহ্। আবদুল্লাহ্ লালনের প্রাথমিক পর্যায়ের শিষ্য ছিলেন। তিনি তরিকা মেনে নামাজ পড়েন, রোজাও করেন। সর্বোপরি মানবতাই তাঁর কাছে বড় ধর্ম। সে কারণে সারা জীবনের অর্জিত অর্থ তিনি মানবসেবায় ব্যয় করেন। তাঁর মতে, মানবসেবা হলো সাধুসংঘ করে মানুষকে বোঝানো।
সাধনা বলতে দবির নিষ্কাম ভজনাকেই বোঝেন। ‘সোনার মানুষ ভাসছে রসে’—লালনের এই গান শোনার পর দবির মুগ্ধ হয়ে লালনপথে এসেছিলেন।
লালনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় কি না—এ রকম কথার জবাবে দবির বলেন, ‘স্বপ্নে তাঁর সঙ্গে আমার স্বরূপে দেখা হয়। লালন আমার মাথায়-মুখে ফুঁ দিয়ে দোয়া করেন। কথা বলেন না, তবে আকার-ইঙ্গিতে কথাবার্তা হয়। আমাকে কী দিয়েছেন, আলোচনা কী হয়—সেসব গুরুরহস্য এত অল্প সময়ে আপনাকে দেওয়া যাবে না।’
লোকে বলে, দবির এখন ১০৩ বছরের শক্তসমর্থ বৃদ্ধ বাউল। ৪৫ বছর ধরে নিরামিষভোজি দবির ফকিরের সুনির্দিষ্ট কোনো শিষ্য নেই। তাঁর ভক্ত-শিষ্যরা ছড়িয়ে থাকেন সারা দেশে। দবিরের ওখানে বছরে দুবার সাধুসংঘ হয়। সাধুসংঘের ধরন অন্য রকম। অগ্রহায়ণের ১৯ তারিখে পুরুষদের সাধুসংঘ, অন্যদিকে নারীদের সাধুসংঘ হয় আশ্বিনের ১৯ তারিখে।
No comments