বেসরকারি খাতকে চালিকাশক্তি করতে হবে -অর্থনীতি by মামুন রশীদ
স্বাধীনতা-পরবর্তী ৩৮ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক উদারীকরণ ও যথেষ্ট সংস্কার সাধিত হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার হার বাড়ানো ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রোধের ক্ষেত্রে টেকসই অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। বিশেষ করে শিল্পোন্নয়নের সম্ভাবনায় গোল্ডম্যান অ্যান্ড স্যাক্স বাংলাদেশকে ‘পরবর্তী ১১ জাতির একটি’ এবং জেপি মরগ্যানও ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভ’-এর অন্তর্ভুক্ত করেছে। আবার বিশ্বব্যাংক বলেছে, মোট দেশজ উত্পাদনে (জিডিপি) বছরে সাড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ ২০১৬ সাল নাগাদ একটি মধ্যম-আয়ের দেশে পরিণত হবে।
বিশ্ব-অর্থনীতিতে আমরা এরই মধ্যে অমিত সম্ভাবনার আশাবাদ নিয়ে পদচারণা শুরু করেছি। সে জন্য স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদায় থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনায় ‘বিকাশমান অর্থনীতি’ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। দেশের এ সাফল্যের পেছনে বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়ার একটি ভালো ভূমিকা রয়েছে। এখন আমাদের উন্নত অর্থনীতির মর্যাদা পাওয়ার লক্ষ্যে নতুন রোডম্যাপ নিয়ে এগোতে হবে। উন্নয়ন-সমৃদ্ধির পরবর্তী ধাপে উন্নীত হতে হলে আমাদের বেসরকারি খাতের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো উতরে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা, উত্পাদনশীলতা, মানবসম্পদের ব্যবস্থাপনা এবং প্রতিযোগিতার সক্ষমতা দেখিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য অবশ্য সরকারকেও পর্যাপ্ত নীতি-সহায়তা ও অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
বাণিজ্য উদারীকরণ: বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বাণিজ্য উদারীকরণের মাধ্যমে বাজারমুখী অর্থনীতিতে প্রবেশ করেছে। বিগত শতকের আশির দশক থেকে কাঠামোগত সংস্কারও করে আসছে। এর ফলে দেশের বাণিজ্যনীতিও রক্ষণশীলতা ছেড়ে বহির্মুখী হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া আমদানি খাতে শুল্ক রেয়াত এবং রপ্তানিতে আর্থিক ও নীতি-সহায়তাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এর সুফলও পাওয়া গেছে। উদারীকরণের সুবাদে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য-বৈষম্য নিয়ে দরকষাকষিতে আমাদের এগোনোর কৌশলগত অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়েছে।
এফডিআই প্রবাহ: বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে বড় ও মাঝারি শিল্পের জাতীয়করণের নীতি গ্রহণ করে। ১৯৮০ সালের দিকে এসে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে থাকে। ১৯৮০ সালের দিকে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ পর্যন্ত দেশে আটটি ইপিজেড স্থাপিত হয়েছে। স্থানীয় বেসরকারি খাত ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উত্সাহিত করতে ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় বিনিয়োগ বোর্ড। বিশেষ করে ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মোট এফডিআইয়ের প্রবাহ বাড়লেও ২০০৫ সাল থেকে তা কমতে থাকে। তবে ২০০৮-০৯ সালে এফডিআই বেড়ে ৯৪ কোটি ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়ে যায়।
পুঁজিবাজার: বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত শেয়ারের মোট সংখ্যা ৪৪৪টি এবং বাজার মূলধনের আকার হলো দুই হাজার ৭০০ কোটি ডলার, যা জিডিপির ৩২ শতাংশের সমান। তবে এই বাজার মূলধন উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় কম। গত দুই বছরে গ্রামীণফোন, ম্যারিকো বাংলাদেশ ও তিতাস গ্যাসসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে শেয়ার ছেড়েছে, আরও কিছু আসছে। এ অবস্থায় পুঁজিবাজারে যাতে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে, সেদিকে গভীর মনোযোগ দেওয়া দরকার।
কৃষি খাত: দেশের রপ্তানি আয়ে দিন দিন কৃষি খাতের অবদান বাড়ছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি আয় আসে কৃষির উপখাত চিংড়ি থেকে। এ ছাড়া মত্স্য রপ্তানিও বাড়ছে। কৃষি খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের সংস্কারের উল্লেখযোগ্য দিক হলো বেসরকারি খাতের মাধ্যমে সার বিতরণ ও ব্যবস্থাপনা। উদারীকরণের মাধ্যমে কৃষিকাজে ব্যবহূত যন্ত্রপাতির ব্যবসায়, বীজ আমদানি ও সরবরাহ এবং পণ্য উত্পাদন ও প্রক্রিয়াকরণে সুবিধা দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কৃষি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রান্তিক কৃষকের হাতে সুফল পৌঁছানোর জন্য তাদের মুনাফা বাড়াতে কৃষি উপকরণের দাম কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে।
শিল্প খাত: বর্তমানে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান প্রায় ৩০ শতাংশ। এর মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উত্পাদন খাতের অবদানই হচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৭ শতাংশ। উত্পাদন খাতের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক, ওষুধ ও কেমিক্যালস ইত্যাদি উপখাতেই বেসরকারি বিনিয়োগ বেশি হয়েছে।
বস্ত্র ও তৈরি পোশাক: দেশের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পে ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে। তবে শ্রমের সহজলভ্যতা এবং দামের দিক থেকেও সুবিধাজনক অবস্থায় থাকায় ২৫ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানকারী ও ৭৯ শতাংশ রপ্তানি-আয়ের খাত তৈরি পোশাকশিল্পে এখনো বিনিয়োগের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, বিশ্বের পোশাকশিল্পের ৪১ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বাজারে বাংলাদেশের অংশ এখনো মাত্র দুই শতাংশে সীমিত রয়ে গেছে। এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে পোশাকশিল্প মালিকদের শ্রমিকদের উত্পাদন বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অস্থিরতা রোধ এবং সুপারভাইজার-শ্রমিক সম্পর্কোন্নয়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। এই শিল্পের বিকাশের জন্য সরকারি নীতি-সহায়তা এবং অর্থায়ন সুবিধার পাশাপাশি, ফ্যাশন ডিজাইন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং নিত্যনতুন রপ্তানিবাজার খুঁজে বের করতে হবে।
ওষুধশিল্প: গত দুই দশকে দেশে ওষুধশিল্পের সন্তোষজনক বিকাশ ঘটেছে। এই খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২১ শতাংশের ওপর। যেটির আরও অনেক বিকাশের সুযোগ এবং প্রচুর পরিমাণে রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ জন্য প্রয়োজন এফডিআই আকৃষ্ট করা। আরও বেশি দরকার অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্টস উত্পাদনকারী খাতকে সুবিধাদি দেওয়া।
বিদ্যুত্ খাত: দেশে বর্তমানে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ হয় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। বিদ্যুতের চাহিদা বছরে প্রায় পাঁচ শতাংশ করে বাড়ছে। অন্যদিকে দেশে গ্যাসের প্রমাণিত মজুদের পরিমাণ ৮ দশমিক ৪ টিসিএফ। নতুন মজুদের সন্ধান না পেলে ২০১৫ সালের পর থেকে বর্ধিত চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নসাধন এবং জ্বালানি সংকট লাঘব করা মহা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সরকার অবশ্য আগামী পাঁচ বছরে সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্যে এক হাজার কোটি ডলারের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বেসরকারি বিদ্যুেকন্দ্র বা আইপিপি, ছোট বিদ্যুেকন্দ্র বা এসপিপি এবং পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনে স্থানীয় বেসরকারি ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে হবে। নিতে হবে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন এবং আঞ্চলিক বিদ্যুত্ গ্রিড স্থাপনের উদ্যোগ।
নির্মাণ খাত: বর্তমানে জিডিপিতে নির্মাণ খাতের অবদান ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। যেহেতু উন্নয়নের এক অপরিহার্য পূর্বশর্ত হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন, সেহেতু সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) এবং এফডিআই আকৃষ্ট করার মাধ্যমে এই খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
সেবা খাত: আমাদের জিডিপিতে এখন সেবা খাতের অবদান ৪৯ শতাংশের মতো। এই খাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেওয়া উচিত। গত এক দশকে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি ও বেসরকারি বিনিয়োগ এসেছে এবং যা অব্যাহত রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিগত বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ, সমাধান ও সম্ভাবনা: আমাদের দেশের বেসরকারি খাতের সামনে এখনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, করপোরেট সুশাসনে দুর্বলতা, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা এবং মেধাবী তরুণদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা প্রভৃতি অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়ে গেছে। এ ছাড়া দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখনো সরকারি খাতের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ এবং ‘মানসিকতা’য় পরিচালিত হচ্ছে। বেসরকারি খাতও পুঁজিবাজারের মতো যুগোপযোগী উেসর পরিবর্তে সেকেলে পদ্ধতিতে মূলধন সংগ্রহ করছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হলে বেসরকারি খাতকে চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় নীতি-সহায়তা দিতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারকে নিতে হবে সার্বিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা দূরীকরণ এবং তথ্যের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদারের পদক্ষেপ। এ ছাড়া বেসরকারি খাতকেও পরিহার করতে হবে কারণে-অকারণে, কথায় কথায় সরকারি সমর্থন চাওয়ার মানসিকতা। তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়ে জোর দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের হিসাব সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করতে হবে।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। নিবন্ধটি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্টোবরে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধের আলোকে রচিত।
বিশ্ব-অর্থনীতিতে আমরা এরই মধ্যে অমিত সম্ভাবনার আশাবাদ নিয়ে পদচারণা শুরু করেছি। সে জন্য স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদায় থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনায় ‘বিকাশমান অর্থনীতি’ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। দেশের এ সাফল্যের পেছনে বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়ার একটি ভালো ভূমিকা রয়েছে। এখন আমাদের উন্নত অর্থনীতির মর্যাদা পাওয়ার লক্ষ্যে নতুন রোডম্যাপ নিয়ে এগোতে হবে। উন্নয়ন-সমৃদ্ধির পরবর্তী ধাপে উন্নীত হতে হলে আমাদের বেসরকারি খাতের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো উতরে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা, উত্পাদনশীলতা, মানবসম্পদের ব্যবস্থাপনা এবং প্রতিযোগিতার সক্ষমতা দেখিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য অবশ্য সরকারকেও পর্যাপ্ত নীতি-সহায়তা ও অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
বাণিজ্য উদারীকরণ: বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বাণিজ্য উদারীকরণের মাধ্যমে বাজারমুখী অর্থনীতিতে প্রবেশ করেছে। বিগত শতকের আশির দশক থেকে কাঠামোগত সংস্কারও করে আসছে। এর ফলে দেশের বাণিজ্যনীতিও রক্ষণশীলতা ছেড়ে বহির্মুখী হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া আমদানি খাতে শুল্ক রেয়াত এবং রপ্তানিতে আর্থিক ও নীতি-সহায়তাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এর সুফলও পাওয়া গেছে। উদারীকরণের সুবাদে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য-বৈষম্য নিয়ে দরকষাকষিতে আমাদের এগোনোর কৌশলগত অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়েছে।
এফডিআই প্রবাহ: বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে বড় ও মাঝারি শিল্পের জাতীয়করণের নীতি গ্রহণ করে। ১৯৮০ সালের দিকে এসে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে থাকে। ১৯৮০ সালের দিকে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ পর্যন্ত দেশে আটটি ইপিজেড স্থাপিত হয়েছে। স্থানীয় বেসরকারি খাত ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উত্সাহিত করতে ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় বিনিয়োগ বোর্ড। বিশেষ করে ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মোট এফডিআইয়ের প্রবাহ বাড়লেও ২০০৫ সাল থেকে তা কমতে থাকে। তবে ২০০৮-০৯ সালে এফডিআই বেড়ে ৯৪ কোটি ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়ে যায়।
পুঁজিবাজার: বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত শেয়ারের মোট সংখ্যা ৪৪৪টি এবং বাজার মূলধনের আকার হলো দুই হাজার ৭০০ কোটি ডলার, যা জিডিপির ৩২ শতাংশের সমান। তবে এই বাজার মূলধন উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় কম। গত দুই বছরে গ্রামীণফোন, ম্যারিকো বাংলাদেশ ও তিতাস গ্যাসসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে শেয়ার ছেড়েছে, আরও কিছু আসছে। এ অবস্থায় পুঁজিবাজারে যাতে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে, সেদিকে গভীর মনোযোগ দেওয়া দরকার।
কৃষি খাত: দেশের রপ্তানি আয়ে দিন দিন কৃষি খাতের অবদান বাড়ছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি আয় আসে কৃষির উপখাত চিংড়ি থেকে। এ ছাড়া মত্স্য রপ্তানিও বাড়ছে। কৃষি খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের সংস্কারের উল্লেখযোগ্য দিক হলো বেসরকারি খাতের মাধ্যমে সার বিতরণ ও ব্যবস্থাপনা। উদারীকরণের মাধ্যমে কৃষিকাজে ব্যবহূত যন্ত্রপাতির ব্যবসায়, বীজ আমদানি ও সরবরাহ এবং পণ্য উত্পাদন ও প্রক্রিয়াকরণে সুবিধা দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কৃষি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রান্তিক কৃষকের হাতে সুফল পৌঁছানোর জন্য তাদের মুনাফা বাড়াতে কৃষি উপকরণের দাম কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে।
শিল্প খাত: বর্তমানে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান প্রায় ৩০ শতাংশ। এর মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উত্পাদন খাতের অবদানই হচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৭ শতাংশ। উত্পাদন খাতের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক, ওষুধ ও কেমিক্যালস ইত্যাদি উপখাতেই বেসরকারি বিনিয়োগ বেশি হয়েছে।
বস্ত্র ও তৈরি পোশাক: দেশের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পে ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে। তবে শ্রমের সহজলভ্যতা এবং দামের দিক থেকেও সুবিধাজনক অবস্থায় থাকায় ২৫ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানকারী ও ৭৯ শতাংশ রপ্তানি-আয়ের খাত তৈরি পোশাকশিল্পে এখনো বিনিয়োগের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, বিশ্বের পোশাকশিল্পের ৪১ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বাজারে বাংলাদেশের অংশ এখনো মাত্র দুই শতাংশে সীমিত রয়ে গেছে। এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে পোশাকশিল্প মালিকদের শ্রমিকদের উত্পাদন বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অস্থিরতা রোধ এবং সুপারভাইজার-শ্রমিক সম্পর্কোন্নয়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। এই শিল্পের বিকাশের জন্য সরকারি নীতি-সহায়তা এবং অর্থায়ন সুবিধার পাশাপাশি, ফ্যাশন ডিজাইন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং নিত্যনতুন রপ্তানিবাজার খুঁজে বের করতে হবে।
ওষুধশিল্প: গত দুই দশকে দেশে ওষুধশিল্পের সন্তোষজনক বিকাশ ঘটেছে। এই খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২১ শতাংশের ওপর। যেটির আরও অনেক বিকাশের সুযোগ এবং প্রচুর পরিমাণে রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ জন্য প্রয়োজন এফডিআই আকৃষ্ট করা। আরও বেশি দরকার অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্টস উত্পাদনকারী খাতকে সুবিধাদি দেওয়া।
বিদ্যুত্ খাত: দেশে বর্তমানে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ হয় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। বিদ্যুতের চাহিদা বছরে প্রায় পাঁচ শতাংশ করে বাড়ছে। অন্যদিকে দেশে গ্যাসের প্রমাণিত মজুদের পরিমাণ ৮ দশমিক ৪ টিসিএফ। নতুন মজুদের সন্ধান না পেলে ২০১৫ সালের পর থেকে বর্ধিত চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নসাধন এবং জ্বালানি সংকট লাঘব করা মহা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সরকার অবশ্য আগামী পাঁচ বছরে সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্যে এক হাজার কোটি ডলারের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বেসরকারি বিদ্যুেকন্দ্র বা আইপিপি, ছোট বিদ্যুেকন্দ্র বা এসপিপি এবং পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনে স্থানীয় বেসরকারি ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে হবে। নিতে হবে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন এবং আঞ্চলিক বিদ্যুত্ গ্রিড স্থাপনের উদ্যোগ।
নির্মাণ খাত: বর্তমানে জিডিপিতে নির্মাণ খাতের অবদান ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। যেহেতু উন্নয়নের এক অপরিহার্য পূর্বশর্ত হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন, সেহেতু সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) এবং এফডিআই আকৃষ্ট করার মাধ্যমে এই খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
সেবা খাত: আমাদের জিডিপিতে এখন সেবা খাতের অবদান ৪৯ শতাংশের মতো। এই খাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেওয়া উচিত। গত এক দশকে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি ও বেসরকারি বিনিয়োগ এসেছে এবং যা অব্যাহত রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিগত বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ, সমাধান ও সম্ভাবনা: আমাদের দেশের বেসরকারি খাতের সামনে এখনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, করপোরেট সুশাসনে দুর্বলতা, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা এবং মেধাবী তরুণদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা প্রভৃতি অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়ে গেছে। এ ছাড়া দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখনো সরকারি খাতের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ এবং ‘মানসিকতা’য় পরিচালিত হচ্ছে। বেসরকারি খাতও পুঁজিবাজারের মতো যুগোপযোগী উেসর পরিবর্তে সেকেলে পদ্ধতিতে মূলধন সংগ্রহ করছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হলে বেসরকারি খাতকে চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় নীতি-সহায়তা দিতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারকে নিতে হবে সার্বিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা দূরীকরণ এবং তথ্যের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদারের পদক্ষেপ। এ ছাড়া বেসরকারি খাতকেও পরিহার করতে হবে কারণে-অকারণে, কথায় কথায় সরকারি সমর্থন চাওয়ার মানসিকতা। তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়ে জোর দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের হিসাব সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করতে হবে।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। নিবন্ধটি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্টোবরে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধের আলোকে রচিত।
No comments