প্রতিক্রিয়া -আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই বিপরীত মেরুর দল by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
৫ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে এম এম আকাশ এক নিবন্ধে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব নিরসনের প্রসঙ্গে যা লিখেছেন, তার সূত্রে আমার এই লেখা।
অধ্যাপক এম এম আকাশ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শ, একটি দ্বিদলীয় পদ্ধতির রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দল দুটোর চরিত্র, সেগুলোর ভবিষ্যত্ রূপান্তর নিয়ে যেসব কথা লিখেছেন, তা বাম রাজনৈতিক মহলে বহুল আলোচিত। তিনি সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই লিখেছেন, ‘এই প্রধান দুই বুর্জোয়া শক্তির মধ্যে ক্ষমতার প্রশ্ন ছাড়া মৌলিক কোনো দ্বন্দ্ব নেই। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে দ্বন্দ্বটুকু আছে, তাও ধীরে ধীরে কমে যাবে। অর্থাত্ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শেষাবধি উপরিকাঠামোর কিছু ইস্যু বাদ দিলে মৌলিক কোনো পার্থক্য থাকবে না।’
এম এম আকাশের এই দাবি ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়। আওয়ামী লীগের আদর্শ নিয়মতান্ত্রিক উদার গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইত্যাদি প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শ। অপরদিকে বিএনপির জন্ম আওয়ামী-বিরোধী পরিকল্পনা থেকে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংগ্রাম, ভূমিকা, অর্জন, আদর্শ ও নেতৃত্বকে অস্বীকার ও পর্যুদস্ত করার জন্য। জন্ম থেকে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের ধারা গ্রহণ করে ১৯৫২ থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ও ইতিবাচক অবদানে নেতৃত্ব দিয়েছে, বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যেসব অগ্রসরমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল, তার প্রায় সব কয়টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ঘটেছিল। আর রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে জন্ম নেওয়া বিএনপি তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ওই সব জাতীয় অর্জনকে বিসর্জন দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছিল। বিএনপির দৃষ্টি ও চিন্তাধারা প্রতিক্রিয়াশীল, পাকিস্তানি ভাবধারার। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ও আদর্শগত কারণেই আন্দোলন-সংগ্রামে সব গণতান্ত্রিক শক্তির সহযোগী হয়েছে, সব বাম গণতান্ত্রিক শক্তি আওয়ামী লীগের মিত্র থেকেছে, এখনো আছে। অন্যদিকে স্বভাবতই বিএনপির মিত্র হয়েছে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, ফ্রিডম পার্টি, মৌলবাদী তথা ডানপন্থী সব দল ও অপশক্তি। আওয়ামী লীগ বাম গণতান্ত্রিক মধ্যপন্থী উদার গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে অবস্থান নিয়েছে, বিএনপি ঠিক এর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেছে। সুতরাং দ্বিদলীয় ব্যবস্থার অংশ হলেও আওয়ামী লীগ-বিএনপি আদর্শ এবং চরিত্রগতভাবে আগাগোড়াই পরস্পর বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক দল হিসেবে রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রেখেছে বা রাখছে।
এম এম আকাশ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগ দক্ষিণপন্থী হয়ে গেল বলে মন্তব্য করেছেন। আওয়ামী লীগ কি বামপন্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ডানপন্থীদের নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, দেশ শাসন করেছে বা করছে? আমরা তো বরাবরই দেখে আসছি যে আওয়ামী লীগ বাম গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গেই ছিল বা এখনো আছে। ১৯৯১ সালেও নির্বাচনে সিপিবিসহ বামপন্থীদের নিয়েই আওয়ামী লীগ ঐক্যজোট করেছিল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাই বলেছিল। এর বিপরীতে বিএনপি প্রচারণায় প্রধান যে ইস্যুটি করেছিল, তা হলো, ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন করা হলে দেশ থেকে ‘বিসমিল্লাহ’ উঠে যাবে, দেশ ভারতের গোলাম রাষ্ট্রে পরিণত হবে ইত্যাদি। কিন্তু নির্বাচনে বিএনপিই বাজিমাত করেছিল। আওয়ামী লীগসহ আটদলীয় জোট অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে গেল। অধ্যাপক আকাশ এসব বাস্তবতার কী উত্তর দেবেন?
এম এম আকাশ লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রথমে সমাজতন্ত্রে এসেছিল, সমাজতন্ত্রের সুবিধা বেশি হবে বলে, যখন অনুকূল হাওয়া তারা পেল না, তখন তারা মনে করল সমাজতন্ত্রে থাকার আর কোনো কারণ নেই।’ গত শতকের পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর রাজনৈতিক দলের সমাজতন্ত্রের প্রতি আকর্ষণে কতগুলো ঐতিহাসিক বাস্তবতা ছিল, প্রবণতাও ছিল, এমনকি ইসলাম নামধারী অনেক দলও ইসলামি সমাজতন্ত্রের কথা তখন উচ্চারণ করেছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে সমাজতন্ত্র বিদায় নেওয়ার পর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগের মতো দলগুলো বাস্তবতাবোধে পরিচালিত না হয়ে সিপিবি-বাসদের মতো সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা নিয়ে পড়ে থাকলে রাজনীতির মাঠে আর কোনো উদার গণতান্ত্রিক দল থাকতে পারত কি না, সন্দেহ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থান পুরোপুরি দক্ষিণপন্থীদের নিয়ন্ত্রণেই চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকত কি?
অধ্যাপক আকাশ আরও লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যারা বেশি লাভবান হয়েছে, তারা তৈরি করল নতুন বিএনপি।... কিছু নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এবং স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করলেন বিএনপি।’ সেনাশাসক জিয়াউর রহমান কি আওয়ামী লীগের কেউ ছিলেন? খোন্দকার মোশতাকও তো বিএনপি গঠনের উদ্যোগের সঙ্গে ছিল না। বিএনপি গঠনের নেপথ্যে সামরিক, আমলা, বণিক, উগ্র ডান ও উগ্র বামের যেসব শক্তি জড়িত ছিল; তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করা, দেশি-বিদেশি নানা শক্তির নীলনকশা বাস্তবায়ন করা, একটি পাকিস্তানি ভাবাদর্শের বাংলাদেশ সৃষ্টি করা। বিএনপির ক্ষমতা যত সংহত হয়েছে, তত বেশি দলটি আওয়ামী লীগকে এর ঐতিহাসিক ভূমিকা ও অবস্থান থেকে উচ্ছেদে তত্পর হয়েছে, সেই জায়গাগুলো নিজেরা দখল করার চেষ্টা করেছে। বিএনপির নীতিনির্ধারক মহল থেকে নির্দেশ পেয়েই পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব থেকে বঙ্গবন্ধুকে হটিয়ে বিদায় করা হয়, ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে একজন আপসকামী লোক হিসেবে দেখানো হয়, ২৫ মার্চে তাঁকে দেখানো হয় একজন আত্মসমর্পণকারী নেতা হিসেবে। আওয়ামী লীগের নেতাদের ভারতে পলায়নকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে, সেই সময় ‘ত্রাতা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন মেজর জিয়া, তিনি ১৯৭৫ সালেও ‘ত্রাতা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, একাত্তরের গোটা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন মেজর জিয়া এবং তাঁর জেড ফোর্স। বঙ্গবন্ধুকে পাঠ্যপুস্তকে একজন ব্যর্থ প্রশাসক ও স্বৈরশাসক হিসেবে উপস্থাপন করে ১৫ আগস্টকে ইতিহাসের এক প্রত্যাশিত, অনিবার্য ও অপরিহার্য হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগ এবং অসাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার উন্মত্ততায় মেতে উঠেছিল। বিএনপি সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেনি, কিন্তু যারা তা করেছে তাদের সবাইকে পুরস্কৃত করেছে, তাদের বিচার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে, এবার যখন ওই হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত রায় হয়েছে বিএনপি তখন কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। বিএনপি বিশ্বাস করে, ১৫ আগস্ট না হলে বিএনপির জন্ম হতো না, তাই ১৫ আগস্টকে নানাভাবে চিত্রায়িত করা, ওই দিনের শোকাবহ অবস্থাকে ভুলিয়ে দিতে নানা উদ্যোগ, প্রচার-প্রচারণার আশ্রয় নিয়ে থাকে বিএনপি।
অধ্যাপক আকাশ বিএনপিকে দক্ষিণপন্থী, আওয়ামী লীগকে ‘দক্ষিণপন্থী ও অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের মিশ্র প্রতীক’ বলে অভিহিত করেছেন। এ দুই দলের মধ্যে যেটুকু পার্থক্য বা দ্বন্দ্ব, তা তাঁর কথায় ‘ক্ষমতার’ দ্বন্দ্বকেন্দ্রিক। তাঁর মতে, এই দ্বন্দ্ব মেটানোর সম্ভাব্য রাস্তা হচ্ছে দুটি—একটি হচ্ছে, দেশে একটি ভদ্র দ্বিদলীয় বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা; আর দ্বিতীয় রাস্তাটি হচ্ছে, জামায়াত ও স্বৈরাচারের বিচ্ছিন্নতা এবং পরাজয়ের কারণে বিএনপির শক্তিহানি, ক্রমবিলুপ্তি ও খণ্ডায়ন। যখন দেশে একমাত্র দক্ষিণপন্থী দল হবে আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কোনো না কোনো অপেক্ষাকৃত র্যাডিকেল একটি রাজনৈতিক দল। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনানির্ভর অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-শিক্ষা-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছাড়া বাংলাদেশে ভদ্র বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা মোটেও সম্ভব নয়। সেই আদর্শ রয়েছে একমাত্র উদার ও বাম গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোরই, দক্ষিণপন্থী কোনো সংগঠনেরই তা নেই। কেননা বিএনপিসহ সব ডান ও দক্ষিণপন্থী দল এবং শক্তির দৃষ্টি পেছনের সাম্প্রদায়িকতার দিকে। সব গণতান্ত্রিক শক্তি যত বেশি পশ্চাত্পদতা কাটিয়ে মানুষকে সামনের দিকে আর্থসামাজিক ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিকভাবে এগিয়ে নিতে পারবে, তত বেশি দক্ষিণপন্থীদের স্বপ্নের বাংলাদেশ অতীত হয়ে যাবে। সেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা নির্মাণে বাম রাজনীতিবিদ ও তাত্ত্বিকেরা কবে সক্রিয় হবেন, সেটিই দেখার বিষয়।
ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।
patwari54@yahoo.com
অধ্যাপক এম এম আকাশ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শ, একটি দ্বিদলীয় পদ্ধতির রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দল দুটোর চরিত্র, সেগুলোর ভবিষ্যত্ রূপান্তর নিয়ে যেসব কথা লিখেছেন, তা বাম রাজনৈতিক মহলে বহুল আলোচিত। তিনি সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই লিখেছেন, ‘এই প্রধান দুই বুর্জোয়া শক্তির মধ্যে ক্ষমতার প্রশ্ন ছাড়া মৌলিক কোনো দ্বন্দ্ব নেই। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে দ্বন্দ্বটুকু আছে, তাও ধীরে ধীরে কমে যাবে। অর্থাত্ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শেষাবধি উপরিকাঠামোর কিছু ইস্যু বাদ দিলে মৌলিক কোনো পার্থক্য থাকবে না।’
এম এম আকাশের এই দাবি ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়। আওয়ামী লীগের আদর্শ নিয়মতান্ত্রিক উদার গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইত্যাদি প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শ। অপরদিকে বিএনপির জন্ম আওয়ামী-বিরোধী পরিকল্পনা থেকে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংগ্রাম, ভূমিকা, অর্জন, আদর্শ ও নেতৃত্বকে অস্বীকার ও পর্যুদস্ত করার জন্য। জন্ম থেকে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের ধারা গ্রহণ করে ১৯৫২ থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ও ইতিবাচক অবদানে নেতৃত্ব দিয়েছে, বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যেসব অগ্রসরমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল, তার প্রায় সব কয়টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ঘটেছিল। আর রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে জন্ম নেওয়া বিএনপি তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ওই সব জাতীয় অর্জনকে বিসর্জন দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছিল। বিএনপির দৃষ্টি ও চিন্তাধারা প্রতিক্রিয়াশীল, পাকিস্তানি ভাবধারার। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ও আদর্শগত কারণেই আন্দোলন-সংগ্রামে সব গণতান্ত্রিক শক্তির সহযোগী হয়েছে, সব বাম গণতান্ত্রিক শক্তি আওয়ামী লীগের মিত্র থেকেছে, এখনো আছে। অন্যদিকে স্বভাবতই বিএনপির মিত্র হয়েছে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, ফ্রিডম পার্টি, মৌলবাদী তথা ডানপন্থী সব দল ও অপশক্তি। আওয়ামী লীগ বাম গণতান্ত্রিক মধ্যপন্থী উদার গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে অবস্থান নিয়েছে, বিএনপি ঠিক এর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেছে। সুতরাং দ্বিদলীয় ব্যবস্থার অংশ হলেও আওয়ামী লীগ-বিএনপি আদর্শ এবং চরিত্রগতভাবে আগাগোড়াই পরস্পর বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক দল হিসেবে রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রেখেছে বা রাখছে।
এম এম আকাশ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগ দক্ষিণপন্থী হয়ে গেল বলে মন্তব্য করেছেন। আওয়ামী লীগ কি বামপন্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ডানপন্থীদের নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, দেশ শাসন করেছে বা করছে? আমরা তো বরাবরই দেখে আসছি যে আওয়ামী লীগ বাম গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গেই ছিল বা এখনো আছে। ১৯৯১ সালেও নির্বাচনে সিপিবিসহ বামপন্থীদের নিয়েই আওয়ামী লীগ ঐক্যজোট করেছিল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাই বলেছিল। এর বিপরীতে বিএনপি প্রচারণায় প্রধান যে ইস্যুটি করেছিল, তা হলো, ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন করা হলে দেশ থেকে ‘বিসমিল্লাহ’ উঠে যাবে, দেশ ভারতের গোলাম রাষ্ট্রে পরিণত হবে ইত্যাদি। কিন্তু নির্বাচনে বিএনপিই বাজিমাত করেছিল। আওয়ামী লীগসহ আটদলীয় জোট অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে গেল। অধ্যাপক আকাশ এসব বাস্তবতার কী উত্তর দেবেন?
এম এম আকাশ লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রথমে সমাজতন্ত্রে এসেছিল, সমাজতন্ত্রের সুবিধা বেশি হবে বলে, যখন অনুকূল হাওয়া তারা পেল না, তখন তারা মনে করল সমাজতন্ত্রে থাকার আর কোনো কারণ নেই।’ গত শতকের পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর রাজনৈতিক দলের সমাজতন্ত্রের প্রতি আকর্ষণে কতগুলো ঐতিহাসিক বাস্তবতা ছিল, প্রবণতাও ছিল, এমনকি ইসলাম নামধারী অনেক দলও ইসলামি সমাজতন্ত্রের কথা তখন উচ্চারণ করেছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে সমাজতন্ত্র বিদায় নেওয়ার পর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগের মতো দলগুলো বাস্তবতাবোধে পরিচালিত না হয়ে সিপিবি-বাসদের মতো সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা নিয়ে পড়ে থাকলে রাজনীতির মাঠে আর কোনো উদার গণতান্ত্রিক দল থাকতে পারত কি না, সন্দেহ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থান পুরোপুরি দক্ষিণপন্থীদের নিয়ন্ত্রণেই চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকত কি?
অধ্যাপক আকাশ আরও লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যারা বেশি লাভবান হয়েছে, তারা তৈরি করল নতুন বিএনপি।... কিছু নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এবং স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করলেন বিএনপি।’ সেনাশাসক জিয়াউর রহমান কি আওয়ামী লীগের কেউ ছিলেন? খোন্দকার মোশতাকও তো বিএনপি গঠনের উদ্যোগের সঙ্গে ছিল না। বিএনপি গঠনের নেপথ্যে সামরিক, আমলা, বণিক, উগ্র ডান ও উগ্র বামের যেসব শক্তি জড়িত ছিল; তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করা, দেশি-বিদেশি নানা শক্তির নীলনকশা বাস্তবায়ন করা, একটি পাকিস্তানি ভাবাদর্শের বাংলাদেশ সৃষ্টি করা। বিএনপির ক্ষমতা যত সংহত হয়েছে, তত বেশি দলটি আওয়ামী লীগকে এর ঐতিহাসিক ভূমিকা ও অবস্থান থেকে উচ্ছেদে তত্পর হয়েছে, সেই জায়গাগুলো নিজেরা দখল করার চেষ্টা করেছে। বিএনপির নীতিনির্ধারক মহল থেকে নির্দেশ পেয়েই পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব থেকে বঙ্গবন্ধুকে হটিয়ে বিদায় করা হয়, ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে একজন আপসকামী লোক হিসেবে দেখানো হয়, ২৫ মার্চে তাঁকে দেখানো হয় একজন আত্মসমর্পণকারী নেতা হিসেবে। আওয়ামী লীগের নেতাদের ভারতে পলায়নকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে, সেই সময় ‘ত্রাতা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন মেজর জিয়া, তিনি ১৯৭৫ সালেও ‘ত্রাতা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, একাত্তরের গোটা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন মেজর জিয়া এবং তাঁর জেড ফোর্স। বঙ্গবন্ধুকে পাঠ্যপুস্তকে একজন ব্যর্থ প্রশাসক ও স্বৈরশাসক হিসেবে উপস্থাপন করে ১৫ আগস্টকে ইতিহাসের এক প্রত্যাশিত, অনিবার্য ও অপরিহার্য হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগ এবং অসাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার উন্মত্ততায় মেতে উঠেছিল। বিএনপি সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেনি, কিন্তু যারা তা করেছে তাদের সবাইকে পুরস্কৃত করেছে, তাদের বিচার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে, এবার যখন ওই হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত রায় হয়েছে বিএনপি তখন কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। বিএনপি বিশ্বাস করে, ১৫ আগস্ট না হলে বিএনপির জন্ম হতো না, তাই ১৫ আগস্টকে নানাভাবে চিত্রায়িত করা, ওই দিনের শোকাবহ অবস্থাকে ভুলিয়ে দিতে নানা উদ্যোগ, প্রচার-প্রচারণার আশ্রয় নিয়ে থাকে বিএনপি।
অধ্যাপক আকাশ বিএনপিকে দক্ষিণপন্থী, আওয়ামী লীগকে ‘দক্ষিণপন্থী ও অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের মিশ্র প্রতীক’ বলে অভিহিত করেছেন। এ দুই দলের মধ্যে যেটুকু পার্থক্য বা দ্বন্দ্ব, তা তাঁর কথায় ‘ক্ষমতার’ দ্বন্দ্বকেন্দ্রিক। তাঁর মতে, এই দ্বন্দ্ব মেটানোর সম্ভাব্য রাস্তা হচ্ছে দুটি—একটি হচ্ছে, দেশে একটি ভদ্র দ্বিদলীয় বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা; আর দ্বিতীয় রাস্তাটি হচ্ছে, জামায়াত ও স্বৈরাচারের বিচ্ছিন্নতা এবং পরাজয়ের কারণে বিএনপির শক্তিহানি, ক্রমবিলুপ্তি ও খণ্ডায়ন। যখন দেশে একমাত্র দক্ষিণপন্থী দল হবে আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কোনো না কোনো অপেক্ষাকৃত র্যাডিকেল একটি রাজনৈতিক দল। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনানির্ভর অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-শিক্ষা-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছাড়া বাংলাদেশে ভদ্র বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা মোটেও সম্ভব নয়। সেই আদর্শ রয়েছে একমাত্র উদার ও বাম গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোরই, দক্ষিণপন্থী কোনো সংগঠনেরই তা নেই। কেননা বিএনপিসহ সব ডান ও দক্ষিণপন্থী দল এবং শক্তির দৃষ্টি পেছনের সাম্প্রদায়িকতার দিকে। সব গণতান্ত্রিক শক্তি যত বেশি পশ্চাত্পদতা কাটিয়ে মানুষকে সামনের দিকে আর্থসামাজিক ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিকভাবে এগিয়ে নিতে পারবে, তত বেশি দক্ষিণপন্থীদের স্বপ্নের বাংলাদেশ অতীত হয়ে যাবে। সেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা নির্মাণে বাম রাজনীতিবিদ ও তাত্ত্বিকেরা কবে সক্রিয় হবেন, সেটিই দেখার বিষয়।
ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।
patwari54@yahoo.com
No comments