সরল গরল -নতুন প্রধান বিচারপতির ৪৭ দিন by মিজানুর রহমান খান

দেশের ১৭তম প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম শপথ নিলেন। আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি অবসরে যাবেন। মাঝখানে হাতে গোনা ৪৭টি দিন। এর মধ্যে বড় ধরনের সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন। কিন্তু পরিকল্পনা গ্রহণ করা কঠিন নয়। বিচার বিভাগ আজ এমন একটি অস্থির সময় অতিক্রম করছে যখন বিরাট কিছুর পরিকল্পনা এখনই নেওয়া দরকার।
১. ব্যতিক্রম বাদে আমাদের প্রধান বিচারপতিরা নিয়মিতভাবে এজলাসে বসেছেন। আগে আপিল বিভাগে বিচারক ছিলেন পাঁচজন। বর্তমান সরকার তা এগারোতে উন্নীত করেছে। প্রধান বিচারপতির ওপর জজিয়তির বোঝা তাই লাঘব হয়েছে। প্রধান বিচারপতি যে সমগ্র বিচার বিভাগের প্রধান নির্বাহী এবং প্রধান প্রশাসক, তা কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি। আমাদের বিনীত প্রস্তাব হলো, শুধু আইনের উল্লেখযোগ্য ব্যাখ্যার প্রশ্ন ছাড়া প্রধান বিচারপতি আদালতে বসবেন না।
২. প্রধান বিচারপতি এককভাবে হাইকোর্ট বেঞ্চগুলোকে নির্দিষ্ট এখতিয়ার দেন। সে কারণে কোনো বেঞ্চ দেওয়ানি, কেউ ফৌজদারি, কেউ মূসক ও আবগারি, কেউ রিট মামলা শোনার অধিকার পান। এই এখতিয়ার সময়ে সময়ে বদলে যায়। কোন বিচারক কোন কাজ করবেন, তা নির্ধারণ করেন প্রধান বিচারপতি। এ জন্য তাঁর ওপর আলোচনার দায় নেই। অথচ এই কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে হলে একজন প্রধান বিচারপতিকে ৯০ জন বিচারকের কাজ নজরদারি করতে হয়। বেঞ্চগুলো দৈনিক তাঁদের কাজের একটি পরিসংখ্যান জমা দেন। সবাই দেনও না। সবচেয়ে বড় উদ্বেগ, অনেক হাইকোর্ট বেঞ্চ ক্রমশ আইন দ্বারা নির্দিষ্ট এখতিয়ার-বহির্ভূত সিদ্ধান্তদানের প্রবণতা দেখাচ্ছেন। আপিল বিভাগের চূড়ান্ত ও মীমাংসিত সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। এর দুটো দিক রয়েছে—একটি বিচারিক, অপরটি পুরোপুরি প্রশাসনিক। বিচারকেরা যে যা-ই করুন, তাকে প্রশাসনিক মানদণ্ডে যাচাই করতে দেখা যায় না। এই অবস্থার অবসান প্রয়োজন। যাঁকে যে এখতিয়ার দেওয়া হয়, তাঁকে তাঁর গণ্ডির মধ্যেই থাকতে হবে। কেউ তার বাইরে গেলে তা অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক শৃঙ্খলাজনিত অবিচারিক বিষয় বলে গণ্য করতে হবে। বিচারিক এখতিয়ার বা কর্মসীমা বণ্টনের বিষয়টি একান্তভাবেই প্রশাসনিক। একটি উদাহরণ দিই: খুন, ধর্ষণ, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক মামলায় ৩০ বছর করে সাজাপ্রাপ্ত বিপুলসংখ্যক সাজা পাওয়া আসামিকে গণজামিন দেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। এই বেঞ্চটিই র্যাবের হাতে নিহত দুই সহোদরের বিষয়ে একটি সুয়োমোটো রুল জারি করেন। এ রকম রুল জারির নির্দিষ্ট এখতিয়ার ওই বেঞ্চের ছিল না। এ ধরনের রুল দেওয়ার এখতিয়ার রিট বেঞ্চের। এ ধরনের অবিচারিক অনুশীলন বন্ধে প্রধান বিচারপতিকে প্রশাসনিক মানদণ্ডে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা অনেক তর্কের পরে মেনে নিয়েছেন যে, তাঁদের ও তাঁদের পোষ্যদের সম্পদ ও দায়দেনার বিবরণ জনগণের জানার অধিকারের মধ্যে পড়ে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতি এটা সহজে মানতে চাননি। দিল্লি হাইকোর্টের রুলের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট লড়াইয়েও নেমেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির রক্ষণশীলতার সঙ্গে আমাদের দারুণ মিল রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারতের প্রধান বিচারপতিসহ সবাই তাঁদের সম্পদের বিবরণ সম্প্রতি ওয়েবসাইটে দিয়েছেন। নতুন প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ, তিনি একই ধরনের উদ্যোগ নেবেন। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদমতে, বিদ্যমান আচরণবিধি বিচারকদের কাছ থেকে সম্পদের বিবরণ চাওয়ার এখতিয়ার প্রধান বিচারপতিকেই দিয়েছে। কেউ ঘণ্টা বাঁধতে রাজি নন। তিনি তা প্রয়োগ করলে একটি মাইলফলক দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। একান্ত না পারলে এই বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে একটি প্রকাশ্য অভিমত আশা করি।
৪. বিচারকদের নিয়ে কোনো কথা উঠলেই কারণে-অকারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কথা চলে আসে। দুই সামরিক শাসকের (আইয়ুব ও জিয়া) আরামপ্রিয় এই ব্যবস্থাটির বিকলাঙ্গ দিক আমাদের আইনবিদেরা আলোচনা না করতে সংকল্পবদ্ধ। পঞ্চম সংশোধনীর রায়েও জিয়ার এই অপকীর্তিটি অক্ষত। অনেকেই লক্ষ করছেন না যে, এই কাউন্সিল শুধু অপসারণের মতো একটি চরম শাস্তিই দিতে পারে। বিচারকদের জন্য যা মৃত্যুদণ্ডতুল্য। অথচ এমন অনেক লঘু পাপ ঘটতে পারে, যার জন্য লঘুদণ্ডই প্রাপ্য। সংসদে অভিশংসনযোগ্য বিষয় ছাড়াও একজন বিচারকের কর্মজীবনে অনিয়ম ঘটতে পারে। সে জন্য হয়তো কখনো তিরস্কার প্রাপ্য। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৫ সালে ‘সি. রবিচন্দ্র আয়ার বনাম বিচারপতি এ এম ভট্টাচার্য’ মামলায় এই বিষয়টি স্বীকার করেন। আদালত এ জন্য অভ্যন্তরীণভাবে ‘মাইনর মেজারস’ বা লঘু ব্যবস্থা গ্রহণে একটি অভ্যন্তরীণ কাঠামো গঠনের সুপারিশ করেন।
বাংলাদেশের নতুন প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ, তিনি যেন এ রকম একটি ব্যবস্থা প্রবর্তনে কার্যকর উদ্যোগ নেন। এ ধরনের শৃঙ্খলা কমিটি যুক্তরাষ্ট্রের বহু রাজ্য ও অনেক দেশে রয়েছে। ভারতের বিখ্যাত আইনবিদ ভি আর কৃষ্ণা আয়ার, যিনি বাংলাদেশি আইনবিদদের কাছে খুবই শ্রদ্ধেয়, তিনি এই লক্ষ্যে একটি জুডিশিয়াল পারফরম্যান্স কমিশন গঠনে সরব রয়েছেন। অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা প্রশ্নে এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ব্রিটিশ আইনজ্ঞ লর্ড ডেভিড প্যানিক বলেন, ‘বিচারকদের এটা মানতে হবে যে, তাঁরা রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গে কর্মরত লোকদের মতোই ভুলভ্রান্তি করতে পারেন। সুতরাং তাঁদের মতোই তাঁদের আচার-আচরণও সমালোচনা ও প্রতিকারযোগ্য। বিচারকেরা এটা না মানলে তাঁরা সরকার ও সমাজের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন এক বিরাট ক্ষমতাধর পুরোহিতমণ্ডলী হয়ে থাকবেন। এর ফল দাঁড়াবে, তাঁরা কেউ কারও অসুবিধা বুঝবেন না। তাঁদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থাকবে।’ এখানে লক্ষণীয় যে, প্রস্তাবিত পারফরম্যান্স কমিশন গঠনের ধারণা ও তার বাস্তবায়ন একান্তভাবেই কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বিষয়। এ জন্য রাষ্ট্রপতি বা সরকারের কারও মুখাপেক্ষী হতে হবে না।
৫. অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও কর্মস্থল নির্ধারণে একটি নীতিমালা করতে হবে। আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সম্পর্ক বিস্তারিতভাবে ফুল কোর্টকে অনুমোদন দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে টানা ৭২ ঘণ্টা ফুল কোর্টের অধিবেশন চালানো দরকার। ফুল কোর্ট হলো সুপ্রিম কোর্টের পার্লামেন্ট। এর অবস্থা শেরেবাংলা নগরের হাউস অব দ্য নেশনের চেয়ে খুব কার্যকর বলা যায় না। আইনসচিব নিয়োগ বেআইনি ছিল। এখানে আইনের অতি নগণ্য প্রশ্ন ছিল। তদুপরি এতটা কাঠখড় পুড়ল, পোড়ানোর সুযোগ দেওয়া হলো। তবে নতুন প্রধান বিচারপতির জন্য কাকতালীয়ভাবে একটি বিশেষ দায় তৈরি হয়েছে। আইনসচিবকে বেআইনি বলে তাঁর রায় ঘোষণা এবং প্রধান বিচারপতি হিসেবে তাঁর শপথ নেওয়ার মধ্যে কয়েক প্রহরের তফাত। তিনি হাইকোর্ট বিভাগের যে রায় সমুন্নত করেছেন, সেখানে একটি তদন্তের নির্দেশনা রয়েছে। এই তদন্ত অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার দায় এখন তাঁর ওপরই বর্তেছে। যিনি বিচারিক আদেশদাতা, তিনিই এখন তা বাধ্যতামূলকভাবে পালনকারী। আর এই দায়িত্ব পালন না করা পর্যন্ত আইনসচিব নিয়োগ-নাটকের রহস্য কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে থাকবে।
৬. সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইট সম্পূর্ণ করা, প্রযুক্তিনির্ভর আদালত কক্ষ ও ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইনের আওতায় জনসংযোগ কর্মকর্তা নিয়োগের মতো প্রস্তাব নতুন প্রধান বিচারপতি তাঁর টেবিলেই পাবেন। যদি তাঁর সামনে নতুন বিচারক নিয়োগের প্রশ্ন আসে, তাহলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, প্রভু, ক্ষমা করো। গোপনীয়তার পিঞ্জর খোলো। গোপন বিচারের মতো গোপন নিয়োগও মহাপাপ।
সুপ্রিম কোর্টের সামনে একটি অসাধারণ পরিবৃত্তিকাল (ট্রানজিনশন পিরিয়ড) দেখতে পাচ্ছি। নতুন প্রধান বিচারপতির ৪৭ দিন ফুরিয়ে যাবে দ্রুত। এরপর যদি জ্যেষ্ঠতাই মাপকাঠি হয়, তাহলে আমরা প্রধান বিচারপতিদের ঘন ঘন আগমন ও বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান দেখব। ২০১১ সালের ১৮ মে অর্থাত্ আগামী ১৯ মাসের মধ্যে চার-পাঁচজন প্রধান বিচারপতির আগমন ও প্রস্থান দেখা যাবে। সুপ্রিম কোর্টের দিনবদল যেন আগমন ও প্রস্থানের ঘূর্ণাবর্তে মূর্ছা না যায়। নতুন প্রধান বিচারপতি আগামী ৪৭ দিনে উল্লিখিত কাজগুলোর সূচনা ঘটাতে পারেন। এ ছাড়া আমাদের চলতে পারে না। কে কতটা করবেন বা উদ্যোগী হবেন, তা দেখার বিষয়। তবে এসব বিষয়ের জন্য আমরা সরকার বা অন্যদের দুষতে পারব না। যত দোষ নন্দ ঘোষ বলে সরকারকে নিন্দা করতে পারব না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.