দেরাজের ভেতর কঙ্কাল -খোলা চোখে by হাসান ফেরদৌস
বলা হয়, সব মানুষেরই নাকি দেরাজের ভেতর দু-চারটে কঙ্কাল লুকানো থাকে। যতক্ষণ সে কঙ্কাল লুকিয়ে রাখা যায়, কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু একবার যদি কোনো কঙ্কালের কনে আঙুলটিও হঠাত্ বেরিয়ে পড়ে, তার বাকিটুকু টেনে না নামানো পর্যন্ত স্বস্তি নেই। ব্যাপারটি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন টাইগার উডস। কোনো এক আহাম্মকি মুহূর্তে ভদ্রলোক তাঁর দেরাজের একটা কপাট একটুমাত্র খুলেছিলেন, আর অমনি তা থেকে ঝমঝম করে একের পর এক কঙ্কাল পড়া শুরু হয়েছে। থামাথামির কোনো লক্ষণ নেই। কত বড় দেরাজ রে বাবা এই লোকের?
সত্যি বলতে কি, কঙ্কাল নয়, টাইগারের নেংটি ধরে টান পড়েছে। একদম বাজারের মধ্যখানে, ভর সন্ধ্যাবেলা, যখন চারদিকে লোকজন গমগম করছে, ঠিক তখন। তিনি এখন একজন পুরোপুরি উদোম মানুষ। যতই দুই হাত দিয়ে নিজের লজ্জা (নাকি গর্ব!) ঢাকতে চাইছেন, চারদিকে সবাই তাঁর লেংগুট ততই খামচে ধরছে। এতে কার কী লাভ হচ্ছে জানি না, কিন্তু আমার নিজের মস্ত ক্ষতি হয়ে গেছে। আমেরিকায় দীর্ঘদিন বসবাসের ফল হয়েছে এই যে গলফ নামক অতি বড়লোকি খেলার ব্যাপারে আমি অত্যুত্সাহী হয়ে পড়েছি। নিজে খেলি না, কারণ এ দেশে গলফ খেলা আর হাতি পালায় খুব তফাত নেই। অতএব, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো গলফের শখ মেটাতে টেলিভিশনের পর্দায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে এই খেলা দেখি। ১০ বছর ধরে এই একটা অভ্যাস আমার হয়েছে। ১০ বছর নয়, ঠিক ঠিক হিসাব করলে ১৩ বছর হবে। ১৯৯৫ সালে, যেবার টাইগার উডস পেশাদারি গলফার হিসেবে নাম লেখালেন এবং সে বছরই দু-দুটো চ্যাম্পিয়নশিপ জিতলেন, সেই থেকে আমি গলফ দেখছি, তা-ও মূলত যে টুর্নামেন্টে টাইগার আছেন।
আমি একা নই, টাইগার যে টুর্নামেন্ট খেলেন, তা দেখার জন্য এ দেশে লাখ লাখ লোক টিভি খুলে বসে থাকে। গলফ উপলক্ষ মাত্র নয়, টাইগারের খেলা দেখাই তাদের আগ্রহের বিষয়। যে খেলায় টাইগার নেই, তার টিভি-দর্শকের সংখ্যা কম করে হলেও গড়ে ৪০ শতাংশ পড়ে যায়। দর্শক কমে যাওয়া মানে টিভির রেটিং কমে যাওয়া, বিজ্ঞাপন কমে যাওয়া, আয় কমে যাওয়া। লোকটা যেন একাই একটা ইন্ডাস্ট্রি। তাঁর নামে সুইস ঘড়ির বিজ্ঞাপন, দামি গাড়ির বিজ্ঞাপন, এমনকি ইন্স্যুরেন্সের বিজ্ঞাপন। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে টাইগারের নামে। সিবিএস ও এনবিসি টিভি কয়েক বছরের জন্য কোটি টাকার বায়না করে রেখেছে, আগামী কয়েক বছর যত গলফ টুর্নামেন্টে টাইগার খেলবেন, কেবল তারাই পালা করে সেসবের ধারাবিবরণী প্রচার করবে। কিন্তু নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে তার মুখে এখন এমন চুনকালি পড়েছে যে টাইগার মাস দুয়েক কোনো খেলায় অংশই নেবেন না বলে জানান দিয়েছেন। আগামী কয়েক মাস কেন, এরপর আদৌ নিজ ফর্মে ফিরে এসে তাঁর পক্ষে খেলা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ফলে বুঝতেই পারছেন, এ দেশে একেবারে হায় হায় রব শুরু হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে যাঁরা টাইগারের অন্তর্বাস টেনে ধরেছেন, তাঁর ভেতর কী আছে, তা পুরোপুরি না জানা পর্যন্ত তাঁরা এই কেচ্ছা টিভির পর্দা বা পত্রিকার পাতা থেকে সরাতে রাজি নন। টাইগারের সর্বনাশ হলে কী হবে, ‘গসিপ’ বিকিয়ে যাঁরা বিরিয়ানি-পোলাও খান, তাঁদের এখন মচ্ছব চলছে।
টাইগারকে আমরা বিশ্বের একজন সেরা খেলোয়াড় বলে জেনে এসেছি। চলতি সপ্তাহেই অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস টাইগার উডসকে গত এক দশকের সেরা অ্যাথলেট বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই লোকটার ভেতর যে এমন একটা বন্য ও কুিসত মানুষ বাস করে, তা আমাদের জানা ছিল না। না, মেয়েমানুষ নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করেছে বলে এ কথা বলছি না। তাঁর বিরুদ্ধে আমার ক্রোধ এ কারণে যে আমি প্রতারিত বোধ করছি। উডস আমাদের সামনে একজন দায়িত্বশীল স্বামী ও পিতা বলে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। তাঁকে যে আমরা ‘হিরো’ বলে আলিঙ্গন করেছিলাম, এর কারণ তিনি শুধু বড় খেলোয়াড় বলেই নয়, তাঁর ভেতর একজন চমত্কার, সদাশয় ও দায়িত্ববান মানুষ রয়েছে, তাঁকে হিরো ভাবার সেটাও একটা কারণ। আমরা সবাই অসম্পন্ন মানুষ, কিন্তু একজন সম্পন্ন মানুষের খোঁজ আমাদের অহর্নিশ। টাইগারকে আমরা সে রকম একজন সম্পন্ন মানুষ ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি, তিনি একটি মুখোশ পরে ছিলেন। সেই মুখোশের আড়ালে একজন নীচ ও কদাকার মানুষ তিনি।
যে প্রশ্নের জবাব না পেয়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ মাথার চুল ছিঁড়ছি, তা হলো উডসের মতো মানুষ, যাঁর জীবনে কোনো কিছুর অভাব ছিল না, বিত্ত-যশ-প্রতিপত্তি যাঁর আঙুলের ডগায়, এমন চমত্কার সুন্দর স্ত্রী যাঁর ঘরে রয়েছে, তাঁকে কেন সস্তা দেহপসারিণীর কাছে যেতে হবে ফুর্তির খোঁজে? নানা ফ্রয়েড-বিশেষজ্ঞ নানাভাবে এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এর কোনোটাই খুব সন্তোষজনক বলে মনে হয় না। এই বিশেষজ্ঞরা অধিকাংশই পুরুষের যৌন বাসনার কথা বলেছেন। সে বাসনা এমন তীব্র ও আত্মবিধ্বংসী যে সমাজ-সংসার কোনো কিছুই তার কাছে অলঙ্ঘনীয় মনে হয় না। মেয়েদের ভেতরও যে এমন আত্মঘাতকতার উদাহরণ নেই, তা নয়। কিন্তু সংখ্যা কম। কারণ, যৌন আগ্রাসনের সঙ্গে জড়িত ক্ষমতার প্রশ্ন। এই ক্ষমতা আসে অর্থ থেকে, খ্যাতি থেকে, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি থেকে। ক্ষমতার একটি নিজস্ব মোহ ও মাদকতা আছে, যার আস্ফাালনে মানুষ—সে পুরুষ হোক বা নারী, এমন এক বোধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে সে বিশ্বাস করা শুরু করে, এই স্খলন তার জন্য স্বাভাবিক।
রাজা-বাদশাহদের বেলায় আমরা যে স্খলন দেখেছি, ইতিহাস ঘাঁটতে হবে না, বর্তমান সময়েই এর এন্তার উদাহরণ রয়েছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী বারলুসকোনির কথা ভাবুন। নাতনির বয়সী মেয়েদের বাগানবাড়িতে তুলে এনে একদঙ্গল বুড়ো কী সব কাণ্ড করছে, তার ভিডিও এখন আমাদের কাছে পৌঁছে গেছে। ধরা পড়ে যাওয়ার পরও লোকটার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। একে তো তিনি প্রধানমন্ত্রী, তাই সে দেশের সবচেয়ে ধনী লোক তিনি। তাঁর ভয় নেই, চক্ষুলজ্জাও নেই। আমাদের দেশেও একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি আছেন, যিনি একসময় বলেছিলেন, তিনি মোটেই ছোক ছোক স্বভাবের নন। মেয়েরাই তাঁর কাছে ছুটে আসে। বাহাত্তরে বুড়ো হলে কী হবে, তাঁর ব্যক্তিত্বের এমনই আকর্ষণ! হাত কচলে ভদ্রলোক এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, আগুনে পুড়তে মেয়েরা যদি আমার কাছে নিজ থেকে ছুটে আসে, তাহলে বলুন, আমার কী করার আছে?
অন্য কথায়, ক্ষমতাবান পুরুষের জন্য স্খলন অপরাধ তো নয়ই, এ যেন তার অধিকার।
অন্য আরেকটা ব্যাখ্যাও বোধ হয় আছে। অধিকাংশ মানুষ—তা সে পুরুষ বা নারী যা-ই হোক, অন্তর্গতভাবে বহুগামী। সুযোগ পেলে, ধরা পড়ব না এই নিশ্চয়তা পেলে, পা হড়কে পড়ে, এমন লোকই হয়তো বেশি। নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ সব সময়, সব ধরনের মানুষের মধ্যেই ছিল। দ্য ওয়ার্ল্ড একরডিং টু গার্প যাঁদের পড়া আছে, তাঁদের সে বিষয়টি মনে থাকার কথা। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার একসময় বলেছিলেন, সরাসরি ফষ্টিনষ্টি তিনি করেননি, কিন্তু মনে মনে অন্য রমণীকে কামনা করেছেন। কার্টার সাত্ত্বিক মানুষ ছিলেন, কিছুটা মফস্বলীয়ও বটে। পরের স্ত্রীর শরীর স্পর্শ করতে ইচ্ছা হলেও তাঁর সাহসে কুলায়নি। আরেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ঠিক তাঁর উল্টো। রমণী দেখলেই যত দ্রুত সম্ভব রমণীর শরীরে সে হাত চালান দেওয়া তাঁর প্রধান লক্ষ্য, সে কথা তিনি নিজেই কমবেশি স্বীকার করেছেন আত্মজীবনীতে। নিজের ঘরে সুন্দরী ও বিদুষী বউ থাকলে কী হবে, শুঁড়িখানার সুন্দরীদের দেখলে তাঁর মাথায় রক্ত চড়ে যায়। কিন্তু ‘রেড হ্যান্ড্রেড’ ধরা পড়বেন, এ কথা কখনোই ভাবেননি। এর পরও যখনই ধরা পড়ে গেছেন, মুখ কালো করে স্বীকার করেছেন, তিনি দেবতা নন, মানুষ মাত্র।
এই ঘরানারই একজন টাইগার উডস। আমাদের কাছে তিনি বীর ও মহানায়ক হয়ে উঠেছিলেন। অথচ রতি-পদানত একজন অতিসাধারণ মানুষ ছাড়া অন্য কিছু নন তিনি। তাঁর এই ভিন্ন চিত্রটি এখন আমাদের সামনে উন্মোচিত হওয়ায় তিনি যে সবার ঘৃণার পাত্র হলেন, তা নয়। রতি-আসক্তির কারণে ঘেন্না করলে কম্বলে আর লোম থাকবে না। সরাসরি প্রতারিত হয়েছেন তাঁর স্ত্রী, ঘৃণা করলে তিনি করতে পারেন। খেলায় ফিরে এলে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে পারলে, আমরা অধিকাংশই হয়তো তাঁর খেলা দেখব। কিন্তু তাঁকে যে নায়কোচিত সম্মান দিয়েছিলাম, তা তিনি আর কখনোই ফিরে পাবেন না।
টাইগার যে নষ্ট হয়ে গেলেন, এর পেছনে আমাদেরও কিছু অবদান আছে। ‘সেলিব্রেটি’দের প্রতি অযাচিত ও মাত্রাতিরিক্ত ভজনার অভ্যাস আমাদের। শুধু একঝলক দেখা পাওয়া যাবে ভেবে প্রিয় নায়ক বা নায়িকার জন্য আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করি। তাঁদের নামাঙ্কিত তুচ্ছাতিতুচ্ছ বাজারি জিনিস কিনে আমরা ঘর ভরে ফেলি। টিভির পর্দায়, পত্রিকার পাতায় তাঁদের খবর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। প্যারিস হিলটনের কথা ভাবুন, অথবা ভাবুন প্রিন্সেস ডায়ানার কথা। এসব সেলিব্রেটির অধিকাংশই মানুষ হিসেবে অতি ক্ষুদ্র ও ফাঁপা। তা জেনেও তাঁদের নিয়ে সত্য-মিথ্যা সব কেচ্ছা গোগ্রাসে আমরা গিলি। ব্রিটনি স্পিয়ার্স একবার অন্তর্বাস ছাড়া এক পার্টিতে এসেছিলেন। গাড়িতে উঠতে গিয়ে এক ‘পাপারাজ্জি’ ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায় তা ধরা পড়ে যায়। আর কী, এরপর পুরো এক সপ্তাহ আমেরিকার হেন পত্রপত্রিকা নেই, টিভি অনুষ্ঠান নেই, যেখানে ব্রিটনির অন্তর্বাস সংবাদ শিরোনাম হয়নি। দিনের পর দিন আমরাই সে খবর গোগ্রাসে গিলেছি।
এই সেলিব্রেটি-আগ্রাসন থেকে মুক্তির কোনো সহজ উপায় আছে বলে মনে হয় না। আধুনিক নাগরিক জীবনের এ এক অনিবার্য উপদ্রব। যেমন, অনিবার্য উপদ্রব বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ। সে দূষণ থেকে মুক্তি অসম্ভব নয়। দূষণ আমরাই করি, চাইলে সে দূষণ আমরা ঠেকাতে পারি। সে জন্য দরকার সবার আগে নিজেদের ব্যবহার বদলানো। একই কথা সেলিব্রেটি-কালচার নিয়েও। আমাদের উত্সাহ ও সমর্থনেই তাঁরা সেলিব্রেটি হয়েছেন। তাঁদের দেখে নাচবে, এমন লোকের অভাব কখনোই হবে না। কিন্তু আমি যদি তাঁদের দলে নাম না লেখাতে চাই, তাহলে অনায়াসেই নিজের মনের জানালাটা এসব সেলিব্রেটির জন্য সপাটে বন্ধ করে রাখতে পারি। সে কাজে তো কেউ নিষেধ করছে না।
অতএব, টাইগার, বিদায়!
১৮ ডিসেম্বর ২০০৯, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
সত্যি বলতে কি, কঙ্কাল নয়, টাইগারের নেংটি ধরে টান পড়েছে। একদম বাজারের মধ্যখানে, ভর সন্ধ্যাবেলা, যখন চারদিকে লোকজন গমগম করছে, ঠিক তখন। তিনি এখন একজন পুরোপুরি উদোম মানুষ। যতই দুই হাত দিয়ে নিজের লজ্জা (নাকি গর্ব!) ঢাকতে চাইছেন, চারদিকে সবাই তাঁর লেংগুট ততই খামচে ধরছে। এতে কার কী লাভ হচ্ছে জানি না, কিন্তু আমার নিজের মস্ত ক্ষতি হয়ে গেছে। আমেরিকায় দীর্ঘদিন বসবাসের ফল হয়েছে এই যে গলফ নামক অতি বড়লোকি খেলার ব্যাপারে আমি অত্যুত্সাহী হয়ে পড়েছি। নিজে খেলি না, কারণ এ দেশে গলফ খেলা আর হাতি পালায় খুব তফাত নেই। অতএব, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো গলফের শখ মেটাতে টেলিভিশনের পর্দায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে এই খেলা দেখি। ১০ বছর ধরে এই একটা অভ্যাস আমার হয়েছে। ১০ বছর নয়, ঠিক ঠিক হিসাব করলে ১৩ বছর হবে। ১৯৯৫ সালে, যেবার টাইগার উডস পেশাদারি গলফার হিসেবে নাম লেখালেন এবং সে বছরই দু-দুটো চ্যাম্পিয়নশিপ জিতলেন, সেই থেকে আমি গলফ দেখছি, তা-ও মূলত যে টুর্নামেন্টে টাইগার আছেন।
আমি একা নই, টাইগার যে টুর্নামেন্ট খেলেন, তা দেখার জন্য এ দেশে লাখ লাখ লোক টিভি খুলে বসে থাকে। গলফ উপলক্ষ মাত্র নয়, টাইগারের খেলা দেখাই তাদের আগ্রহের বিষয়। যে খেলায় টাইগার নেই, তার টিভি-দর্শকের সংখ্যা কম করে হলেও গড়ে ৪০ শতাংশ পড়ে যায়। দর্শক কমে যাওয়া মানে টিভির রেটিং কমে যাওয়া, বিজ্ঞাপন কমে যাওয়া, আয় কমে যাওয়া। লোকটা যেন একাই একটা ইন্ডাস্ট্রি। তাঁর নামে সুইস ঘড়ির বিজ্ঞাপন, দামি গাড়ির বিজ্ঞাপন, এমনকি ইন্স্যুরেন্সের বিজ্ঞাপন। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে টাইগারের নামে। সিবিএস ও এনবিসি টিভি কয়েক বছরের জন্য কোটি টাকার বায়না করে রেখেছে, আগামী কয়েক বছর যত গলফ টুর্নামেন্টে টাইগার খেলবেন, কেবল তারাই পালা করে সেসবের ধারাবিবরণী প্রচার করবে। কিন্তু নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে তার মুখে এখন এমন চুনকালি পড়েছে যে টাইগার মাস দুয়েক কোনো খেলায় অংশই নেবেন না বলে জানান দিয়েছেন। আগামী কয়েক মাস কেন, এরপর আদৌ নিজ ফর্মে ফিরে এসে তাঁর পক্ষে খেলা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ফলে বুঝতেই পারছেন, এ দেশে একেবারে হায় হায় রব শুরু হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে যাঁরা টাইগারের অন্তর্বাস টেনে ধরেছেন, তাঁর ভেতর কী আছে, তা পুরোপুরি না জানা পর্যন্ত তাঁরা এই কেচ্ছা টিভির পর্দা বা পত্রিকার পাতা থেকে সরাতে রাজি নন। টাইগারের সর্বনাশ হলে কী হবে, ‘গসিপ’ বিকিয়ে যাঁরা বিরিয়ানি-পোলাও খান, তাঁদের এখন মচ্ছব চলছে।
টাইগারকে আমরা বিশ্বের একজন সেরা খেলোয়াড় বলে জেনে এসেছি। চলতি সপ্তাহেই অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস টাইগার উডসকে গত এক দশকের সেরা অ্যাথলেট বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই লোকটার ভেতর যে এমন একটা বন্য ও কুিসত মানুষ বাস করে, তা আমাদের জানা ছিল না। না, মেয়েমানুষ নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করেছে বলে এ কথা বলছি না। তাঁর বিরুদ্ধে আমার ক্রোধ এ কারণে যে আমি প্রতারিত বোধ করছি। উডস আমাদের সামনে একজন দায়িত্বশীল স্বামী ও পিতা বলে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। তাঁকে যে আমরা ‘হিরো’ বলে আলিঙ্গন করেছিলাম, এর কারণ তিনি শুধু বড় খেলোয়াড় বলেই নয়, তাঁর ভেতর একজন চমত্কার, সদাশয় ও দায়িত্ববান মানুষ রয়েছে, তাঁকে হিরো ভাবার সেটাও একটা কারণ। আমরা সবাই অসম্পন্ন মানুষ, কিন্তু একজন সম্পন্ন মানুষের খোঁজ আমাদের অহর্নিশ। টাইগারকে আমরা সে রকম একজন সম্পন্ন মানুষ ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি, তিনি একটি মুখোশ পরে ছিলেন। সেই মুখোশের আড়ালে একজন নীচ ও কদাকার মানুষ তিনি।
যে প্রশ্নের জবাব না পেয়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ মাথার চুল ছিঁড়ছি, তা হলো উডসের মতো মানুষ, যাঁর জীবনে কোনো কিছুর অভাব ছিল না, বিত্ত-যশ-প্রতিপত্তি যাঁর আঙুলের ডগায়, এমন চমত্কার সুন্দর স্ত্রী যাঁর ঘরে রয়েছে, তাঁকে কেন সস্তা দেহপসারিণীর কাছে যেতে হবে ফুর্তির খোঁজে? নানা ফ্রয়েড-বিশেষজ্ঞ নানাভাবে এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এর কোনোটাই খুব সন্তোষজনক বলে মনে হয় না। এই বিশেষজ্ঞরা অধিকাংশই পুরুষের যৌন বাসনার কথা বলেছেন। সে বাসনা এমন তীব্র ও আত্মবিধ্বংসী যে সমাজ-সংসার কোনো কিছুই তার কাছে অলঙ্ঘনীয় মনে হয় না। মেয়েদের ভেতরও যে এমন আত্মঘাতকতার উদাহরণ নেই, তা নয়। কিন্তু সংখ্যা কম। কারণ, যৌন আগ্রাসনের সঙ্গে জড়িত ক্ষমতার প্রশ্ন। এই ক্ষমতা আসে অর্থ থেকে, খ্যাতি থেকে, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি থেকে। ক্ষমতার একটি নিজস্ব মোহ ও মাদকতা আছে, যার আস্ফাালনে মানুষ—সে পুরুষ হোক বা নারী, এমন এক বোধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে সে বিশ্বাস করা শুরু করে, এই স্খলন তার জন্য স্বাভাবিক।
রাজা-বাদশাহদের বেলায় আমরা যে স্খলন দেখেছি, ইতিহাস ঘাঁটতে হবে না, বর্তমান সময়েই এর এন্তার উদাহরণ রয়েছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী বারলুসকোনির কথা ভাবুন। নাতনির বয়সী মেয়েদের বাগানবাড়িতে তুলে এনে একদঙ্গল বুড়ো কী সব কাণ্ড করছে, তার ভিডিও এখন আমাদের কাছে পৌঁছে গেছে। ধরা পড়ে যাওয়ার পরও লোকটার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। একে তো তিনি প্রধানমন্ত্রী, তাই সে দেশের সবচেয়ে ধনী লোক তিনি। তাঁর ভয় নেই, চক্ষুলজ্জাও নেই। আমাদের দেশেও একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি আছেন, যিনি একসময় বলেছিলেন, তিনি মোটেই ছোক ছোক স্বভাবের নন। মেয়েরাই তাঁর কাছে ছুটে আসে। বাহাত্তরে বুড়ো হলে কী হবে, তাঁর ব্যক্তিত্বের এমনই আকর্ষণ! হাত কচলে ভদ্রলোক এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, আগুনে পুড়তে মেয়েরা যদি আমার কাছে নিজ থেকে ছুটে আসে, তাহলে বলুন, আমার কী করার আছে?
অন্য কথায়, ক্ষমতাবান পুরুষের জন্য স্খলন অপরাধ তো নয়ই, এ যেন তার অধিকার।
অন্য আরেকটা ব্যাখ্যাও বোধ হয় আছে। অধিকাংশ মানুষ—তা সে পুরুষ বা নারী যা-ই হোক, অন্তর্গতভাবে বহুগামী। সুযোগ পেলে, ধরা পড়ব না এই নিশ্চয়তা পেলে, পা হড়কে পড়ে, এমন লোকই হয়তো বেশি। নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ সব সময়, সব ধরনের মানুষের মধ্যেই ছিল। দ্য ওয়ার্ল্ড একরডিং টু গার্প যাঁদের পড়া আছে, তাঁদের সে বিষয়টি মনে থাকার কথা। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার একসময় বলেছিলেন, সরাসরি ফষ্টিনষ্টি তিনি করেননি, কিন্তু মনে মনে অন্য রমণীকে কামনা করেছেন। কার্টার সাত্ত্বিক মানুষ ছিলেন, কিছুটা মফস্বলীয়ও বটে। পরের স্ত্রীর শরীর স্পর্শ করতে ইচ্ছা হলেও তাঁর সাহসে কুলায়নি। আরেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ঠিক তাঁর উল্টো। রমণী দেখলেই যত দ্রুত সম্ভব রমণীর শরীরে সে হাত চালান দেওয়া তাঁর প্রধান লক্ষ্য, সে কথা তিনি নিজেই কমবেশি স্বীকার করেছেন আত্মজীবনীতে। নিজের ঘরে সুন্দরী ও বিদুষী বউ থাকলে কী হবে, শুঁড়িখানার সুন্দরীদের দেখলে তাঁর মাথায় রক্ত চড়ে যায়। কিন্তু ‘রেড হ্যান্ড্রেড’ ধরা পড়বেন, এ কথা কখনোই ভাবেননি। এর পরও যখনই ধরা পড়ে গেছেন, মুখ কালো করে স্বীকার করেছেন, তিনি দেবতা নন, মানুষ মাত্র।
এই ঘরানারই একজন টাইগার উডস। আমাদের কাছে তিনি বীর ও মহানায়ক হয়ে উঠেছিলেন। অথচ রতি-পদানত একজন অতিসাধারণ মানুষ ছাড়া অন্য কিছু নন তিনি। তাঁর এই ভিন্ন চিত্রটি এখন আমাদের সামনে উন্মোচিত হওয়ায় তিনি যে সবার ঘৃণার পাত্র হলেন, তা নয়। রতি-আসক্তির কারণে ঘেন্না করলে কম্বলে আর লোম থাকবে না। সরাসরি প্রতারিত হয়েছেন তাঁর স্ত্রী, ঘৃণা করলে তিনি করতে পারেন। খেলায় ফিরে এলে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে পারলে, আমরা অধিকাংশই হয়তো তাঁর খেলা দেখব। কিন্তু তাঁকে যে নায়কোচিত সম্মান দিয়েছিলাম, তা তিনি আর কখনোই ফিরে পাবেন না।
টাইগার যে নষ্ট হয়ে গেলেন, এর পেছনে আমাদেরও কিছু অবদান আছে। ‘সেলিব্রেটি’দের প্রতি অযাচিত ও মাত্রাতিরিক্ত ভজনার অভ্যাস আমাদের। শুধু একঝলক দেখা পাওয়া যাবে ভেবে প্রিয় নায়ক বা নায়িকার জন্য আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করি। তাঁদের নামাঙ্কিত তুচ্ছাতিতুচ্ছ বাজারি জিনিস কিনে আমরা ঘর ভরে ফেলি। টিভির পর্দায়, পত্রিকার পাতায় তাঁদের খবর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। প্যারিস হিলটনের কথা ভাবুন, অথবা ভাবুন প্রিন্সেস ডায়ানার কথা। এসব সেলিব্রেটির অধিকাংশই মানুষ হিসেবে অতি ক্ষুদ্র ও ফাঁপা। তা জেনেও তাঁদের নিয়ে সত্য-মিথ্যা সব কেচ্ছা গোগ্রাসে আমরা গিলি। ব্রিটনি স্পিয়ার্স একবার অন্তর্বাস ছাড়া এক পার্টিতে এসেছিলেন। গাড়িতে উঠতে গিয়ে এক ‘পাপারাজ্জি’ ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায় তা ধরা পড়ে যায়। আর কী, এরপর পুরো এক সপ্তাহ আমেরিকার হেন পত্রপত্রিকা নেই, টিভি অনুষ্ঠান নেই, যেখানে ব্রিটনির অন্তর্বাস সংবাদ শিরোনাম হয়নি। দিনের পর দিন আমরাই সে খবর গোগ্রাসে গিলেছি।
এই সেলিব্রেটি-আগ্রাসন থেকে মুক্তির কোনো সহজ উপায় আছে বলে মনে হয় না। আধুনিক নাগরিক জীবনের এ এক অনিবার্য উপদ্রব। যেমন, অনিবার্য উপদ্রব বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ। সে দূষণ থেকে মুক্তি অসম্ভব নয়। দূষণ আমরাই করি, চাইলে সে দূষণ আমরা ঠেকাতে পারি। সে জন্য দরকার সবার আগে নিজেদের ব্যবহার বদলানো। একই কথা সেলিব্রেটি-কালচার নিয়েও। আমাদের উত্সাহ ও সমর্থনেই তাঁরা সেলিব্রেটি হয়েছেন। তাঁদের দেখে নাচবে, এমন লোকের অভাব কখনোই হবে না। কিন্তু আমি যদি তাঁদের দলে নাম না লেখাতে চাই, তাহলে অনায়াসেই নিজের মনের জানালাটা এসব সেলিব্রেটির জন্য সপাটে বন্ধ করে রাখতে পারি। সে কাজে তো কেউ নিষেধ করছে না।
অতএব, টাইগার, বিদায়!
১৮ ডিসেম্বর ২০০৯, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments