ফের অচলাবস্থায় বিশ্ব জলবায়ু রাজনীতি -কোপেনহেগেনে ব্যর্থতা by মার্কাস বেকার
কোপেনহেগেন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ব্যর্থ হয়েছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকল না। উন্নয়নশীল দেশগুলোর আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেয়নি শিল্পোন্নত দেশগুলো। ভারত ও চীনের মতো নব্য শিল্পোন্নত দেশকে তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের দিকে দৃষ্টি না দিলেও চলবে।
শুরুর আগে সারা দুনিয়ার বিজ্ঞানী, পরিবেশবাদী ও রাজনীতিকেরা এক সুরে বলেছেন, এটা ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন। কিন্তু এখন সে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এ ধরনের সম্মেলন আর আদৌ হবে কি না, তা বলা কঠিন।
কোপেনহেগেনে এই সম্মেলনে একত্র হতে সারা দুনিয়ার সরকারগুলোর সময় লেগেছে প্রায় ১৭ বছর। এত দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ-আলোচনা, আপাত নিষ্পত্তিহীন দেনদরবার, মতাদর্শিক বিতর্ক, বিলম্ব আর নানা কৌশল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে গেছে এ সময়। ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরোতে প্রথম জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলনের পর আবার একত্র হতে ১৭ বছর লেগেছে। ১৯৯২ সালের পর ধীরে ধীরে যে আশা জাগছিল, সেখানে অনেক আশাভঙ্গের বেদনায় পুড়তে হলো।
সম্মেলন শেষ হওয়ার কিছু সময় আগে মনে হচ্ছিল, এ সম্মেলন ব্যর্থ হওয়া হয়তো ঠেকানো যাবে। চূড়ান্ত ঘোষণার শেষ দিককার খসড়াগুলোতে ২০৫০ সাল নাগাদ শিল্পায়নপূর্ব স্তরের থেকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধির সীমা নির্ধারণ করার পাশাপাশি কীভাবে এ লক্ষ্য অর্জিত হবে, তার বিধানও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৮০ শতাংশ কমানো এবং ২০২০ সাল নাগাদ মধ্যমেয়াদি লক্ষ্যের সম্ভাবনার উল্লেখও এতে ছিল।
অবশেষে যে ছোট খসড়া চুক্তিতে ৩০টি শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্র সম্মত হয়, তাতে কেবল দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের বিধান রাখা হয়। আগামী দশকগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনার উল্লেখ তাতে আর থাকেনি। জলবায়ু বিপর্যয় রোধে বিজ্ঞানীরা যে হারে নিঃসরণ কমানোর কথা বলেছেন, সে বিষয়ে অঙ্গীকারে আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয়টি রাখা হয়নি। কোপেনহেগেনে যে চরম ব্যর্থতা দেখা গেছে, তাতে হয়তো দুই ডিগ্রির সীমাও মেনে চলা হবে না।
৩০টি দেশের গ্রুপ আপসের এ পরিকল্পনা মূল হলে উপস্থাপন করলে ১৯২টি দেশের বাকি দেশগুলোর অনেকে প্রায় তত্ক্ষণাত্ তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। যেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তাদের পক্ষে এটাকে কোনো সমাধান হিসেবে গ্রহণ করা কঠিন।
আমরা এখন বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতিতে অচলাবস্থার হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে। এর পরিণতিতে গরিবের মধ্যে যারা গরিব, তারাই প্রথম আক্রান্ত হবে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী ঝড় ও বন্যার মুখে তারা পড়বে। তাদের ফসল মরে যাবে। হিমবাহ গলে কোটি কোটি মানুষ তাদের পানির জোগান ও জীবিকা থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
শিল্পোন্নত দেশগুলোও রেহাই পাবে না। কিন্তু তাদের প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সম্পদের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে।
কোপেনহেগেনের ব্যর্থতা বারাক ওবামারও ব্যর্থতা। তিনি এ সম্মেলনে একটি ছাড় দিয়েছেন: তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, গরিব দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তাকারীর ভেতর তাঁর দেশও থাকবে। গরিব দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি মোকাবিলায় আরও ভালোভাবে নিজেদের প্রস্তুত করতে এবং আরও প্রতিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সচেষ্ট হতে সহায়তার জন্য এই তহবিল। এই তহবিল ২০২০ সালে শুরু করে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বড়াই করে বলেছেন, এই পরিমাণটা ‘অনেক’। কিন্তু এ তহবিলের কতটুকু যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসবে, সে বিষয়ে কোনো কথা তিনি বলেননি। এমনকি বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশগুলো ‘কোপেনহেগেন অ্যাকর্ড’ নামে যে খসড়া সমঝোতা তৈরি করেছে, তাতেও এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র কতটা উদার তার বিস্তারিত বর্ণনাও মিলবে এই সমঝোতায়। দরিদ্র দেশগুলোকে তাত্ক্ষণিক সহায়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ২০১০ ও ২০১২ সালের মধ্যে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার দিতে চায়। অন্যান্য অঞ্চল যে পরিমাণ সহায়তা দেবে, সে তুলনায় এ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কার্পণ্যের প্রমাণ মেলে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন গুণ। এমনকি জাপান দিচ্ছে ১১ বিলিয়ন ডলার। গরিব দেশের লোকজন হয়তো দ্বিধায় পড়তে পারে—তারা যুক্তরাষ্ট্রের এ সহায়তায় হাসবে না কাঁদবে।
১৭ বছর ধরে যে দেশগুলো জলবায়ু সুরক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের অন্যতম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রই ৩০ দেশের গ্রুপের সঙ্গে আলোচিত আপস পরিকল্পনার সমালোচনা করে বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবিলায় এটা যথেষ্ট নয়।
নব্য শিল্পোন্নত দেশগুলোর, বিশেষত চীনের আচরণও এর চেয়ে ভালো ছিল না। মানবজাতির দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণের চেয়ে স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক স্বার্থ চীনের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির জলবায়ু সুরক্ষাব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের অধীন করতে অস্বীকৃতি জানানোর মাধ্যমে চীন হয়তো এ সম্মেলন ব্যর্থ হতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
যারা জলবায়ু পরিবর্তনকে বিজ্ঞানী, বামপন্থী রাজনীতিক ও আতঙ্কে-ইন্ধনদাতা গণমাধ্যমের অবাস্তব ভাবনা বলে মনে করে, তাদের মতকে দৃঢ় করেছে কোপেনহেগেনের বিপর্যয়। মানবজাতি বহুপক্ষীয়, সামষ্টিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির কোনো সমাধান খুঁজে বের করতে অক্ষম—এমন মতকেও শক্তিশালী করেছে। এমন অবস্থান কোনোভাবেই শুধু বিশুদ্ধ নৈরাশ্যবাদ নয়। আসলে মানুষের স্বভাবগত কিছু বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এগুলো তৈরি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করেই মানুষ নিজের ভূমিকা নেয়। উদাহরণস্বরূপ, অনেকের পক্ষে কল্পনা করাই কঠিন যে, মহামারির ফলে বিস্তৃত এলাকার পুরো জনগোষ্ঠী ধ্বংস হতে পারে—যদিও বহু জায়গায় বহুবার এমন ঘটনা ঘটেছে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাত বা উল্কাপাতের প্রভাব বিষয়েও একই কথা খাটে। এসবের ফলে পুরো অঞ্চল, এমনকি মহাদেশ পর্যন্ত মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন আরও বেশি ভয়াবহ। কারণ, এটি অনেকাংশে আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরের বিষয়।
কোনো যুদ্ধ বা মহামারি একই সঙ্গে অল্পসংখ্যক দেশের বাইরে প্রভাব ফেলেনি। পারমাণবিক যুদ্ধের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন সারা দুনিয়ার মানুষকে প্রভাবিত করে। দ্রুত একে মোকাবিলা করতে হবে। মানবজাতির বড় অংশের জীবনযাপনের বর্তমান ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসা প্রয়োজন। তা ছাড়া বিভিন্ন সমাজকে একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ উপলব্ধি করার চেতনা না থাকার কারণে প্রায়ই মানুষ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ওপর স্থান দেয় স্বল্পমেয়াদি সাফল্যকে। সাধারণ, দৈনন্দিন কাজকর্মে স্পষ্টভাবে এর দেখা মিলবে। তাদের হয়তো জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর পরিণতি দেখার জন্য খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
স্পিগেল অনলাইন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
মার্কাস বেকার: জার্মান সাংবাদিক।
শুরুর আগে সারা দুনিয়ার বিজ্ঞানী, পরিবেশবাদী ও রাজনীতিকেরা এক সুরে বলেছেন, এটা ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন। কিন্তু এখন সে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এ ধরনের সম্মেলন আর আদৌ হবে কি না, তা বলা কঠিন।
কোপেনহেগেনে এই সম্মেলনে একত্র হতে সারা দুনিয়ার সরকারগুলোর সময় লেগেছে প্রায় ১৭ বছর। এত দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ-আলোচনা, আপাত নিষ্পত্তিহীন দেনদরবার, মতাদর্শিক বিতর্ক, বিলম্ব আর নানা কৌশল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে গেছে এ সময়। ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরোতে প্রথম জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলনের পর আবার একত্র হতে ১৭ বছর লেগেছে। ১৯৯২ সালের পর ধীরে ধীরে যে আশা জাগছিল, সেখানে অনেক আশাভঙ্গের বেদনায় পুড়তে হলো।
সম্মেলন শেষ হওয়ার কিছু সময় আগে মনে হচ্ছিল, এ সম্মেলন ব্যর্থ হওয়া হয়তো ঠেকানো যাবে। চূড়ান্ত ঘোষণার শেষ দিককার খসড়াগুলোতে ২০৫০ সাল নাগাদ শিল্পায়নপূর্ব স্তরের থেকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধির সীমা নির্ধারণ করার পাশাপাশি কীভাবে এ লক্ষ্য অর্জিত হবে, তার বিধানও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৮০ শতাংশ কমানো এবং ২০২০ সাল নাগাদ মধ্যমেয়াদি লক্ষ্যের সম্ভাবনার উল্লেখও এতে ছিল।
অবশেষে যে ছোট খসড়া চুক্তিতে ৩০টি শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্র সম্মত হয়, তাতে কেবল দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের বিধান রাখা হয়। আগামী দশকগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনার উল্লেখ তাতে আর থাকেনি। জলবায়ু বিপর্যয় রোধে বিজ্ঞানীরা যে হারে নিঃসরণ কমানোর কথা বলেছেন, সে বিষয়ে অঙ্গীকারে আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয়টি রাখা হয়নি। কোপেনহেগেনে যে চরম ব্যর্থতা দেখা গেছে, তাতে হয়তো দুই ডিগ্রির সীমাও মেনে চলা হবে না।
৩০টি দেশের গ্রুপ আপসের এ পরিকল্পনা মূল হলে উপস্থাপন করলে ১৯২টি দেশের বাকি দেশগুলোর অনেকে প্রায় তত্ক্ষণাত্ তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। যেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তাদের পক্ষে এটাকে কোনো সমাধান হিসেবে গ্রহণ করা কঠিন।
আমরা এখন বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতিতে অচলাবস্থার হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে। এর পরিণতিতে গরিবের মধ্যে যারা গরিব, তারাই প্রথম আক্রান্ত হবে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী ঝড় ও বন্যার মুখে তারা পড়বে। তাদের ফসল মরে যাবে। হিমবাহ গলে কোটি কোটি মানুষ তাদের পানির জোগান ও জীবিকা থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
শিল্পোন্নত দেশগুলোও রেহাই পাবে না। কিন্তু তাদের প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সম্পদের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে।
কোপেনহেগেনের ব্যর্থতা বারাক ওবামারও ব্যর্থতা। তিনি এ সম্মেলনে একটি ছাড় দিয়েছেন: তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, গরিব দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তাকারীর ভেতর তাঁর দেশও থাকবে। গরিব দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি মোকাবিলায় আরও ভালোভাবে নিজেদের প্রস্তুত করতে এবং আরও প্রতিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সচেষ্ট হতে সহায়তার জন্য এই তহবিল। এই তহবিল ২০২০ সালে শুরু করে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বড়াই করে বলেছেন, এই পরিমাণটা ‘অনেক’। কিন্তু এ তহবিলের কতটুকু যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসবে, সে বিষয়ে কোনো কথা তিনি বলেননি। এমনকি বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশগুলো ‘কোপেনহেগেন অ্যাকর্ড’ নামে যে খসড়া সমঝোতা তৈরি করেছে, তাতেও এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র কতটা উদার তার বিস্তারিত বর্ণনাও মিলবে এই সমঝোতায়। দরিদ্র দেশগুলোকে তাত্ক্ষণিক সহায়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ২০১০ ও ২০১২ সালের মধ্যে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার দিতে চায়। অন্যান্য অঞ্চল যে পরিমাণ সহায়তা দেবে, সে তুলনায় এ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কার্পণ্যের প্রমাণ মেলে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন গুণ। এমনকি জাপান দিচ্ছে ১১ বিলিয়ন ডলার। গরিব দেশের লোকজন হয়তো দ্বিধায় পড়তে পারে—তারা যুক্তরাষ্ট্রের এ সহায়তায় হাসবে না কাঁদবে।
১৭ বছর ধরে যে দেশগুলো জলবায়ু সুরক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের অন্যতম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রই ৩০ দেশের গ্রুপের সঙ্গে আলোচিত আপস পরিকল্পনার সমালোচনা করে বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবিলায় এটা যথেষ্ট নয়।
নব্য শিল্পোন্নত দেশগুলোর, বিশেষত চীনের আচরণও এর চেয়ে ভালো ছিল না। মানবজাতির দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণের চেয়ে স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক স্বার্থ চীনের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির জলবায়ু সুরক্ষাব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের অধীন করতে অস্বীকৃতি জানানোর মাধ্যমে চীন হয়তো এ সম্মেলন ব্যর্থ হতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
যারা জলবায়ু পরিবর্তনকে বিজ্ঞানী, বামপন্থী রাজনীতিক ও আতঙ্কে-ইন্ধনদাতা গণমাধ্যমের অবাস্তব ভাবনা বলে মনে করে, তাদের মতকে দৃঢ় করেছে কোপেনহেগেনের বিপর্যয়। মানবজাতি বহুপক্ষীয়, সামষ্টিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির কোনো সমাধান খুঁজে বের করতে অক্ষম—এমন মতকেও শক্তিশালী করেছে। এমন অবস্থান কোনোভাবেই শুধু বিশুদ্ধ নৈরাশ্যবাদ নয়। আসলে মানুষের স্বভাবগত কিছু বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এগুলো তৈরি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করেই মানুষ নিজের ভূমিকা নেয়। উদাহরণস্বরূপ, অনেকের পক্ষে কল্পনা করাই কঠিন যে, মহামারির ফলে বিস্তৃত এলাকার পুরো জনগোষ্ঠী ধ্বংস হতে পারে—যদিও বহু জায়গায় বহুবার এমন ঘটনা ঘটেছে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাত বা উল্কাপাতের প্রভাব বিষয়েও একই কথা খাটে। এসবের ফলে পুরো অঞ্চল, এমনকি মহাদেশ পর্যন্ত মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন আরও বেশি ভয়াবহ। কারণ, এটি অনেকাংশে আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরের বিষয়।
কোনো যুদ্ধ বা মহামারি একই সঙ্গে অল্পসংখ্যক দেশের বাইরে প্রভাব ফেলেনি। পারমাণবিক যুদ্ধের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন সারা দুনিয়ার মানুষকে প্রভাবিত করে। দ্রুত একে মোকাবিলা করতে হবে। মানবজাতির বড় অংশের জীবনযাপনের বর্তমান ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসা প্রয়োজন। তা ছাড়া বিভিন্ন সমাজকে একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ উপলব্ধি করার চেতনা না থাকার কারণে প্রায়ই মানুষ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ওপর স্থান দেয় স্বল্পমেয়াদি সাফল্যকে। সাধারণ, দৈনন্দিন কাজকর্মে স্পষ্টভাবে এর দেখা মিলবে। তাদের হয়তো জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর পরিণতি দেখার জন্য খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
স্পিগেল অনলাইন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
মার্কাস বেকার: জার্মান সাংবাদিক।
No comments