শান্তিতে নোবেল পুরস্কার এবং ওবামা, ওসামা-ওমর যুদ্ধ -গতকাল সমকাল by ফারুক চৌধুরী
মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট ওবামা, আফগানিস্তান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিলেন। প্রথমটি ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক একাডেমিতে, আফগানিস্তানে তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ ঘোষণা করে এবং দ্বিতীয়টি নরওয়ের অসলোতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার গ্রহণকালে আফগানিস্তানেরই প্রাসঙ্গিকতায়, যুদ্ধ ও শান্তি সম্বন্ধে তার ধারণাবাহী। প্রেসিডেন্ট ওবামা একজন সুবক্তা, তদুপরি আফগানিস্তানে তাঁর ভবিষ্যত্ কর্মকাণ্ড এবং পরিণতি সম্বন্ধে বিশ্বজুড়ে রয়েছে বিপুল আগ্রহ। তাই তাঁর দুটি ভাষণই এখন বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে।
এক অর্থে, তাঁর দ্বিতীয় ভাষণটিতে রয়েছে প্রথমোক্ত ভাষণে ঘোষিত আফগানিস্তানে অতিরিক্ত ৩০ হাজার সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্তেরই ব্যাখ্যা।
প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর ১০ ডিসেম্বর ২০০৯-এর অসলো বক্তৃতায় অকপটে স্বীকার করেছেন যে দুটি যুদ্ধে লিপ্ত (আফগানিস্তান আর ইরাক) একটি দেশের সামরিক সর্বাধিনায়ক হিসেবেই তিনি শান্তি পুরস্কারটি গ্রহণ করছেন এবং তাঁর শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির কারণ যতটা তাঁর ওপর প্রত্যাশার, ততটা তাঁর অর্জনের নয়। তিনি অবশ্য এও বলেছেন, নরওয়েসমেত আরও ৪২টি রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের পাশে রয়েছে আফগানিস্তানের এই যুদ্ধে। যা তিনি বলেননি, তা হলো, ভিয়েতনামের যুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রসংখ্যা কম ছিল না এবং আফগানিস্তানে অন্যান্য দেশের সেনাসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাসংখ্যার আনুপাতিক হিসাবে খুবই কম। তদুপরি তাঁদের অনেককেই আসল সমর অঙ্গন (Theatre of war) থেকে দূরেই রাখা হয়েছে। এই যুদ্ধটি ভিয়েতনামের মতোই যে সর্বোপরি ওবামার যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
তাঁর দ্বিতীয় ভাষণটিতে প্রেসিডেন্ট ওবামা শান্তি অর্জনে প্রয়োজনবোধে যুদ্ধের অনিবার্যতার কথা বলেছেন; এও বলেছেন, এমনও সময় আসতে পারে যখন একটি জাতি এককভাবে অথবা অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে, যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার নৈতিক যাথার্থ্যতা খুঁজে পাবে। প্রেসিডেন্ট ওবামা এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে ‘আলোচনার মাধ্যমে আল-কায়েদাকে অস্ত্র সমর্পণ করানো যাবে না।’ আবার এও তিনি বলেছেন, ‘আমাদের জীবদ্দশায় আমরা সশস্ত্র সংঘাতকে নির্মূল করতে পারব না।’ তাঁর মতে, শান্তি অর্জনের জন্য কখনো কখনো যুদ্ধের প্রয়োজন রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ওবামার উপরোক্ত মন্তব্যগুলোর সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন না। বস্তুত যুক্তরাষ্ট্রে ওবামার অসলো ভাষণ ব্যাপকভাবেই সমাদৃত হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু এখানে কিছু মন্তব্যের প্রয়োজন রয়েছে, প্রয়োজন রয়েছে কিছু সাবধানবাণী উচ্চারণ করার। প্রেসিডেন্ট ওবামা ভালো করেই জানেন যে তিনি যে যুদ্ধটি পরিচালনা করার দায়িত্ব নিয়েছেন, সেখানে যুদ্ধটিকে আফগানিস্তান আর পাকিস্তানে পৃথকভাবে বিবেচনা করা দুরূহ। সেই অঞ্চলটিকে মানচিত্রে ব্রিটিশ কূটনীতিক মর্টিমার ডুরান্ড ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলমের আঁচড়ে পৃথক করেছিলেন। কিন্তু সেই অঞ্চলের অধিবাসী যাঁরা, যাঁদের এক কথায় পাশ্তুন বলা হয়, তাঁদের কাছে মর্টিমার ডুরান্ড কোনো প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি নন এবং ডুরান্ড লাইন কোনো জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতিই বহন করে না। বস্তুত সেই তথাকথিত ডুরান্ড লাইনটির দুই পাশে প্রায় চার কোটি পাশ্তুন বাস করে, যাঁরা ডজন ডজন উপজাতিতে বিভক্ত, কিন্তু যাঁদের ভাষা ‘পাশ্তু’ এবং যাঁদের সামাজিক রীতিনীতি এবং রাজনৈতিক ব্যবহারবিধিকে ‘পাশ্তুন ওয়ালি’ বলে অভিহিত করা হয়। আতিথেয়তা সেই সামাজিক সংস্কৃতির একটি অংশ, যা তাঁদের রাজনৈতিক ব্যবহারবিধি থেকে অবিচ্ছেদ্য। যুক্তরাষ্ট্রের বোমার তুলনায়, পাশ্তুনরা তাঁদের রীতিনীতিকে বেশি সমীহ করেন বলেই আজ পর্যন্ত কেউ ওসামা বিন লাদেন অথবা মোল্লা ওমরের টিকিটিরও (তাঁদের আবার টিকি!) সন্ধান পায়নি।
কিন্তু আসলে অবস্থাটি তার চেয়েও বেশি জটিল। পাশ্তুনরা ডুরান্ড লাইন স্বীকার করে না সত্যি, কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান লাইনটিকে অবজ্ঞা করতে পারে না। পাকিস্তান একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (বর্তমানে) এবং ডুরান্ড লাইন প্রায় এক হাজার মাইল ধরে সে দেশের পশ্চিম সীমারেখা। পাকিস্তান এখন সোয়াত আর দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে তালেবানবিরোধী সামরিক অভিযান চালাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আফগানিস্তানে সক্রিয় তালেবান সম্বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র আর পাকিস্তানের মনোভাব কি এক? এটা কি সত্য নয় যে আফগানিস্তানের কারজাই সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের সম্পর্ক নিবিড়তর। আর এদিকে আফগানিস্তানের তালেবানদের সঙ্গে পাকিস্তানের সহমর্মিতার নজির রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। অনেকে এও মনে করেন যে আফগানিস্তানে পাকিস্তান আর ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছে, তাতে পাকিস্তান সে দেশে তালেবাননির্ভরই রইবে—বিশেষ করে ভবিষ্যতে, যখন সে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি হ্রাস পাবে।
আরেকটি কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্র বলছে আল-কায়েদার নেতৃত্বের অবস্থান হচ্ছে পাকিস্তানে। তা-ই যদি হয়, তাহলে ওবামা আফগানিস্তানে অতিরিক্ত ৩০ হাজার সেনা পাঠাচ্ছেন কেন? পাকিস্তান, অর্থাত্ মানচিত্রে চিহ্নিত পাকিস্তানের মাটি যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দুর্জয় ঘাঁটি হবে, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো জনপ্রিয়তা নেই বললেই চলে। শিক্ষিত পাকিস্তানিরাও মনে করে যে যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনবোধে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। পাইলটবিহীন যুদ্ধবিমানে, আল-কায়েদা নেতাদের হত্যা এবং তার সঙ্গে শত শত নিরস্ত্র সাধারণ পাকিস্তানির মৃত্যু সহজভাবে মেনে নিতে পারে না বিপাকে পড়া অসহায় পাকিস্তান। ইসরায়েল ও মিসর বাদ দিলে পাকিস্তান এখন যুক্তরাষ্ট্রের খয়রাতের তৃতীয় শীর্ষ প্রাপক। দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্রের লিগ টেবিলের মতো, এও তো কোনো সম্মানজনক অবস্থান নয়। ইসরায়েল অবশ্য এই লিগ টেবিলে আপনা-আপনি বিকশিত একটি বিশেষ অবস্থানে—যুক্তরাষ্ট্রের অতিদূরে থেকেও অতি কাছের। অতএব সত্যিকার অর্থে মিসরের পরেই খয়রাতি লিগ টেবিলে এখন পাকিস্তান রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে এতই নিন্দিত যে এই খয়রাতি লিগে পাকিস্তান শিরোপা লাভ করুক তা সে দেশের শিক্ষিত আধুনিকমনা মানুষ চায় না। আর আফগানিস্তানের তালেবানেরা তো আকারে-ইঙ্গিতে বলেই থাকে যে কারজাই আর জারদারি যাঁদের মিত্র তাদের শত্রুর কীই বা প্রয়োজন?
আফগানিস্তান আর পাশ্তুনদের নিয়ে যতই ভাবি, ততই মনে পড়ে আমারই মতো একজন ভেতো বাঙালি (সমতার এখানেই শেষ!) সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা। তিনি তাঁর দেশে বিদেশেতে লিখেছেন,
‘...আফগানিস্তানের ইতিহাস না লিখে ভারত-ইতিহাস লেখবার জো নেই, আফগান রাজনীতি না জেনে ভারতের সীমান্ত প্রদেশ ঠান্ডা রাখবার কোনো মধ্যমনারায়ণ নেই। গোদের ওপর আরেক বিষফোঁড়া—আফগানিস্তানের উত্তর ভাগ, অর্থাত্ বল্খ বদখশানের ইতিহাস সীমান্ত নদী আমুদরিয়ার ওপারের তুর্কিস্তানের সঙ্গে, পশ্চিম ভাগ অর্থাত্ হিরাত অঞ্চল ইরানের সঙ্গে, পূর্বভাগ অর্থাত্ কাবুল জালালাবাদ খাস ভারতবর্ষ ও কাশ্মীরের সঙ্গে মিশে গিয়ে নানা যুগে নানা রং ধরেছে।’
তাঁর সেই বর্ণনার প্রায় আট যুগ পর সৈয়দ মুজতবা আলী ফিরে এলে দেখতে পেতেন কারা এখন সেই ‘নানা রঙের’ বাহক? তিনি দেখতে পেতেন তাঁর অচেনা ওবামা বনাম ওসামা-ওমরের স্বার্থ এবং আদর্শগত সংঘাত, তিনি আঘ্রাণ লাভ করতেন, ইরান, তুরস্ক (তাঁর মারফত ন্যাটো), ভারত, পাকিস্তান আর কাশ্মীর নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির উত্তপ্ত কাবুলি পোলাওয়ের, তিনি গভীর বেদনায় অনুধাবন করতেন সেই অঞ্চল থেকে সুদূরের, তাঁর নবীন স্বদেশ বাংলাদেশে অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের সহিংস তত্পরতা।
এসবের মাঝে ওবামার ভাষণের উক্তিটি হয়তো বা তাঁর কানেও ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতো, ‘আমাদের জীবদ্দশায় আমরা সশস্ত্র সংঘাতকে নির্মূল করতে পারব না।’
ফারুক চৌধুরী: কূটনীতিবিদ। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব।
এক অর্থে, তাঁর দ্বিতীয় ভাষণটিতে রয়েছে প্রথমোক্ত ভাষণে ঘোষিত আফগানিস্তানে অতিরিক্ত ৩০ হাজার সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্তেরই ব্যাখ্যা।
প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর ১০ ডিসেম্বর ২০০৯-এর অসলো বক্তৃতায় অকপটে স্বীকার করেছেন যে দুটি যুদ্ধে লিপ্ত (আফগানিস্তান আর ইরাক) একটি দেশের সামরিক সর্বাধিনায়ক হিসেবেই তিনি শান্তি পুরস্কারটি গ্রহণ করছেন এবং তাঁর শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির কারণ যতটা তাঁর ওপর প্রত্যাশার, ততটা তাঁর অর্জনের নয়। তিনি অবশ্য এও বলেছেন, নরওয়েসমেত আরও ৪২টি রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের পাশে রয়েছে আফগানিস্তানের এই যুদ্ধে। যা তিনি বলেননি, তা হলো, ভিয়েতনামের যুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রসংখ্যা কম ছিল না এবং আফগানিস্তানে অন্যান্য দেশের সেনাসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাসংখ্যার আনুপাতিক হিসাবে খুবই কম। তদুপরি তাঁদের অনেককেই আসল সমর অঙ্গন (Theatre of war) থেকে দূরেই রাখা হয়েছে। এই যুদ্ধটি ভিয়েতনামের মতোই যে সর্বোপরি ওবামার যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
তাঁর দ্বিতীয় ভাষণটিতে প্রেসিডেন্ট ওবামা শান্তি অর্জনে প্রয়োজনবোধে যুদ্ধের অনিবার্যতার কথা বলেছেন; এও বলেছেন, এমনও সময় আসতে পারে যখন একটি জাতি এককভাবে অথবা অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে, যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার নৈতিক যাথার্থ্যতা খুঁজে পাবে। প্রেসিডেন্ট ওবামা এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে ‘আলোচনার মাধ্যমে আল-কায়েদাকে অস্ত্র সমর্পণ করানো যাবে না।’ আবার এও তিনি বলেছেন, ‘আমাদের জীবদ্দশায় আমরা সশস্ত্র সংঘাতকে নির্মূল করতে পারব না।’ তাঁর মতে, শান্তি অর্জনের জন্য কখনো কখনো যুদ্ধের প্রয়োজন রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ওবামার উপরোক্ত মন্তব্যগুলোর সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন না। বস্তুত যুক্তরাষ্ট্রে ওবামার অসলো ভাষণ ব্যাপকভাবেই সমাদৃত হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু এখানে কিছু মন্তব্যের প্রয়োজন রয়েছে, প্রয়োজন রয়েছে কিছু সাবধানবাণী উচ্চারণ করার। প্রেসিডেন্ট ওবামা ভালো করেই জানেন যে তিনি যে যুদ্ধটি পরিচালনা করার দায়িত্ব নিয়েছেন, সেখানে যুদ্ধটিকে আফগানিস্তান আর পাকিস্তানে পৃথকভাবে বিবেচনা করা দুরূহ। সেই অঞ্চলটিকে মানচিত্রে ব্রিটিশ কূটনীতিক মর্টিমার ডুরান্ড ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলমের আঁচড়ে পৃথক করেছিলেন। কিন্তু সেই অঞ্চলের অধিবাসী যাঁরা, যাঁদের এক কথায় পাশ্তুন বলা হয়, তাঁদের কাছে মর্টিমার ডুরান্ড কোনো প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি নন এবং ডুরান্ড লাইন কোনো জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতিই বহন করে না। বস্তুত সেই তথাকথিত ডুরান্ড লাইনটির দুই পাশে প্রায় চার কোটি পাশ্তুন বাস করে, যাঁরা ডজন ডজন উপজাতিতে বিভক্ত, কিন্তু যাঁদের ভাষা ‘পাশ্তু’ এবং যাঁদের সামাজিক রীতিনীতি এবং রাজনৈতিক ব্যবহারবিধিকে ‘পাশ্তুন ওয়ালি’ বলে অভিহিত করা হয়। আতিথেয়তা সেই সামাজিক সংস্কৃতির একটি অংশ, যা তাঁদের রাজনৈতিক ব্যবহারবিধি থেকে অবিচ্ছেদ্য। যুক্তরাষ্ট্রের বোমার তুলনায়, পাশ্তুনরা তাঁদের রীতিনীতিকে বেশি সমীহ করেন বলেই আজ পর্যন্ত কেউ ওসামা বিন লাদেন অথবা মোল্লা ওমরের টিকিটিরও (তাঁদের আবার টিকি!) সন্ধান পায়নি।
কিন্তু আসলে অবস্থাটি তার চেয়েও বেশি জটিল। পাশ্তুনরা ডুরান্ড লাইন স্বীকার করে না সত্যি, কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান লাইনটিকে অবজ্ঞা করতে পারে না। পাকিস্তান একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (বর্তমানে) এবং ডুরান্ড লাইন প্রায় এক হাজার মাইল ধরে সে দেশের পশ্চিম সীমারেখা। পাকিস্তান এখন সোয়াত আর দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে তালেবানবিরোধী সামরিক অভিযান চালাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আফগানিস্তানে সক্রিয় তালেবান সম্বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র আর পাকিস্তানের মনোভাব কি এক? এটা কি সত্য নয় যে আফগানিস্তানের কারজাই সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের সম্পর্ক নিবিড়তর। আর এদিকে আফগানিস্তানের তালেবানদের সঙ্গে পাকিস্তানের সহমর্মিতার নজির রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। অনেকে এও মনে করেন যে আফগানিস্তানে পাকিস্তান আর ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছে, তাতে পাকিস্তান সে দেশে তালেবাননির্ভরই রইবে—বিশেষ করে ভবিষ্যতে, যখন সে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি হ্রাস পাবে।
আরেকটি কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্র বলছে আল-কায়েদার নেতৃত্বের অবস্থান হচ্ছে পাকিস্তানে। তা-ই যদি হয়, তাহলে ওবামা আফগানিস্তানে অতিরিক্ত ৩০ হাজার সেনা পাঠাচ্ছেন কেন? পাকিস্তান, অর্থাত্ মানচিত্রে চিহ্নিত পাকিস্তানের মাটি যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দুর্জয় ঘাঁটি হবে, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো জনপ্রিয়তা নেই বললেই চলে। শিক্ষিত পাকিস্তানিরাও মনে করে যে যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনবোধে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। পাইলটবিহীন যুদ্ধবিমানে, আল-কায়েদা নেতাদের হত্যা এবং তার সঙ্গে শত শত নিরস্ত্র সাধারণ পাকিস্তানির মৃত্যু সহজভাবে মেনে নিতে পারে না বিপাকে পড়া অসহায় পাকিস্তান। ইসরায়েল ও মিসর বাদ দিলে পাকিস্তান এখন যুক্তরাষ্ট্রের খয়রাতের তৃতীয় শীর্ষ প্রাপক। দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্রের লিগ টেবিলের মতো, এও তো কোনো সম্মানজনক অবস্থান নয়। ইসরায়েল অবশ্য এই লিগ টেবিলে আপনা-আপনি বিকশিত একটি বিশেষ অবস্থানে—যুক্তরাষ্ট্রের অতিদূরে থেকেও অতি কাছের। অতএব সত্যিকার অর্থে মিসরের পরেই খয়রাতি লিগ টেবিলে এখন পাকিস্তান রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে এতই নিন্দিত যে এই খয়রাতি লিগে পাকিস্তান শিরোপা লাভ করুক তা সে দেশের শিক্ষিত আধুনিকমনা মানুষ চায় না। আর আফগানিস্তানের তালেবানেরা তো আকারে-ইঙ্গিতে বলেই থাকে যে কারজাই আর জারদারি যাঁদের মিত্র তাদের শত্রুর কীই বা প্রয়োজন?
আফগানিস্তান আর পাশ্তুনদের নিয়ে যতই ভাবি, ততই মনে পড়ে আমারই মতো একজন ভেতো বাঙালি (সমতার এখানেই শেষ!) সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা। তিনি তাঁর দেশে বিদেশেতে লিখেছেন,
‘...আফগানিস্তানের ইতিহাস না লিখে ভারত-ইতিহাস লেখবার জো নেই, আফগান রাজনীতি না জেনে ভারতের সীমান্ত প্রদেশ ঠান্ডা রাখবার কোনো মধ্যমনারায়ণ নেই। গোদের ওপর আরেক বিষফোঁড়া—আফগানিস্তানের উত্তর ভাগ, অর্থাত্ বল্খ বদখশানের ইতিহাস সীমান্ত নদী আমুদরিয়ার ওপারের তুর্কিস্তানের সঙ্গে, পশ্চিম ভাগ অর্থাত্ হিরাত অঞ্চল ইরানের সঙ্গে, পূর্বভাগ অর্থাত্ কাবুল জালালাবাদ খাস ভারতবর্ষ ও কাশ্মীরের সঙ্গে মিশে গিয়ে নানা যুগে নানা রং ধরেছে।’
তাঁর সেই বর্ণনার প্রায় আট যুগ পর সৈয়দ মুজতবা আলী ফিরে এলে দেখতে পেতেন কারা এখন সেই ‘নানা রঙের’ বাহক? তিনি দেখতে পেতেন তাঁর অচেনা ওবামা বনাম ওসামা-ওমরের স্বার্থ এবং আদর্শগত সংঘাত, তিনি আঘ্রাণ লাভ করতেন, ইরান, তুরস্ক (তাঁর মারফত ন্যাটো), ভারত, পাকিস্তান আর কাশ্মীর নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির উত্তপ্ত কাবুলি পোলাওয়ের, তিনি গভীর বেদনায় অনুধাবন করতেন সেই অঞ্চল থেকে সুদূরের, তাঁর নবীন স্বদেশ বাংলাদেশে অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের সহিংস তত্পরতা।
এসবের মাঝে ওবামার ভাষণের উক্তিটি হয়তো বা তাঁর কানেও ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতো, ‘আমাদের জীবদ্দশায় আমরা সশস্ত্র সংঘাতকে নির্মূল করতে পারব না।’
ফারুক চৌধুরী: কূটনীতিবিদ। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব।
No comments