ভারত বা বাংলাদেশ নয়, মিয়ানমারের গ্যাস পাবে চীন by বদরূল ইমাম
সম্প্রতি বাংলাদেশ মিয়ানমারের সাগরবক্ষে অবস্থিত গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস পরিবহনের জন্য মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত ত্রিদেশীয় পাইপলাইন প্রকল্প প্রস্তাবটি পুনর্জীবিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ মনে করছে, মিয়ানমার থেকে ত্রিদেশীয় এই পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প দুভাবে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হতে পারে। প্রথমত, এই পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সঞ্চালন চার্জ বাবদ বাংলাদেশ প্রতিবছর অর্থ অর্জনের সুবিধা লাভ করবে, যা কিনা ডলারে বা সমমানের গ্যাস পাওয়ার মাধ্যমে হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ওই পাইপলাইন কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে মিয়ানমার থেকে গ্যাস আমদানি করতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এর আগে প্রথমত প্রকল্পটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘসূত্রতা এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় কিছু বিষয়ে মতৈক্য না হওয়ার কারণে তা আর বাস্তবায়নের পথে এগোয়নি। ইতিমধ্যে মিয়ানমার ভারতের পরিবর্তে চীনের কাছে গ্যাস বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে চীনের ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। এ বিষয়ে এক পশ্চিমা পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেন, বাংলাদেশ যে ট্রেনটি ধরতে চাইছে, তা ইতিমধ্যেই স্টেশন ছেড়ে চলে গেছে।
বাংলাদেশে কোনো কোনো মহল মনে করে, ত্রিদেশীয় পাইপলাইন বাংলাদেশের জন্য তেমন সুবিধা বয়ে আনবে না; বরং ভারতের সঙ্গে গ্যাস পাইপলাইন যোগসূত্র স্থাপন করলে তা ভবিষ্যতে সময় ও ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বিরোধমূলক সংকট সৃষ্টির আশঙ্কাকে বাড়াতে পারে। আবার অন্য মহল মনে করে, আন্তদেশীয় গ্যাস পাইপলাইন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে যে রকম পারস্পরিক অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে এনেছে, মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত ত্রিদেশীয় পাইপলাইনও দেশ তিনটির মধ্যে সেভাবে লাভ বয়ে নিয়ে আসবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো স্বল্প জ্বালানি সম্পদের দেশে বর্তমানের গ্যাসের ঘাটতি ও আসন্ন ভবিষ্যত্ জ্বালানিসংকটের প্রেক্ষাপটে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জ্বালানি মজুদ ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করতে ত্রিদেশীয় গ্যাস পাইপলাইন মোক্ষম ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই এ প্রশ্ন এসে পড়ে যে বাংলাদেশ কি একটি সুযোগ হাতছাড়া করছে?
মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরবক্ষে আবিষ্কৃত হয় বিরাট আকারের গ্যাসক্ষেত্র সুউ, সুউফু এবং মিয়া। কোরিয়ার তেল কোম্পানি দেওউ ইন্টারন্যাশনাল আবিষ্কৃত এই গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে ভারতীয় কোম্পানিরও অংশীদারি রয়েছে (দেওউ ৫১%, ভারতের ওএনজিসি ১৮.৫%, ভারতের গেইল ৮.৫%)। আবিষ্কারের পর থেকেই ভারত এই গ্যাস আমদানি করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। বাংলাদেশের একটি প্রাইভেট কোম্পানি মোহনা হোল্ডিং লিমিটেড মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারত পর্যন্ত একটি পাইপলাইন স্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে তিন দেশের সরকারের কাছে পেশ করে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন এ প্রস্তাবে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে। পরবর্তী সময়ে তিন দেশের সরকারই এ প্রস্তাব গ্রহণে নীতিগতভাবে সম্মত হয়। বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত্ গ্যাসসংকটের প্রেক্ষাপট এবং মিয়ানমার থেকে গ্যাস আমদানির সম্ভাবনা বাংলাদেশকে ওই পাইপলাইন প্রকল্পে আগ্রহী করে।
পাইপলাইন প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার মন্ত্রী পর্যায়ে সমঝোতামূলক সভার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, একটি ত্রিদেশীয় কারিগরি কমিটি বিষয়টির বিস্তারিত রূপরেখা প্রণয়ন করবে। ২০০৫ সালে মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুনে কারিগরি কমিটি সভায় মিলিত হয়। বাংলাদেশ প্রস্তাব করে যে ১. পাইপলাইনটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে নয়, টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে তা চট্টগ্রাম হয়ে ভারতের দিকে এগোবে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভবিষ্যতে গ্যাস সরবরাহের সুযোগ বাড়ানো ছিল এ প্রস্তাবের লক্ষ্য, ২. চুক্তি সাপেক্ষে বাংলাদেশ পাইপলাইনে নির্ধারিত পয়েন্ট থেকে গ্যাস নেওয়ার অধিকার রাখবে, ৩. ভারতের তত্ত্বাবধানে নয়, বরং পাইপলাইনটি নির্মাণ করবে একটি আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম এবং ৪. বাংলাদেশের ভেতর পাইপলাইন অপারেটর হিসেবে বাংলাদেশি সংস্থা নিয়োজিত থাকবে, যার জন্য বাংলাদেশকে চার্জ দিতে হবে। এসব প্রস্তাবে ভারত ও মিয়ানমার উভয়েই আরও আলোচনা সাপেক্ষে সম্মতিসূচক প্রতিক্রয়া ব্যক্ত করে।
বাংলাদেশ ভারতের প্রতি আরও দুটি শর্ত দেয় যে, নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুত্ আমদানির জন্য ভারত করিডর-সুবিধা দেবে এবং উপরিউক্ত দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে বাণিজ্য-পণ্য বিনিময়ের জন্য ভারত করিডর দিয়ে যাতায়াত করার অধিকার দেবে। ভারত এই শেষোক্ত শর্ত দুটি মানতে রাজি না হলে বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা সভা ব্যর্থ হয়। এভাবে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ প্রস্তাবিত ত্রিদেশীয় পাইপলাইন প্রকল্প কার্যক্রম থেকে সরে আসে ।
এদিকে বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে ভারত নতুন পাইপলাইন পথ খুঁজতে সচেষ্ট হয়। নতুন পথ হিসেবে মিয়ানমার থেকে মিজোরাম, ত্রিপুরা, আসাম হয়ে পশ্চিমে শিলিগুড়ি; অতঃপর দক্ষিণে ঘুরে কলকাতার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু যেখানে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পাইপলাইন গেলে তা ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে ও চার হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নির্মাণ করা যাবে, অন্য পথটি বেছে নিলে পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য আরও ৫০০ কিলোমিটার বেশি হবে ও তাতে খরচ হবে আরও দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তা ছাড়া ত্রিপুরা-আসাম এলাকার বিদ্রোহীদের কাছ থেকে পাইপলাইনটির নিরাপত্তা বিশেষ উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখা দেয়। এসব কারণে ভারত পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়নে আর অগ্রসর হতে পারেনি।
ইতিমধ্যে মিয়ানমার তার গ্যাস বিক্রি-বাণিজ্যে স্থগিত অবস্থার অবসান ঘটিয়ে চীনের কাছে গ্যাস বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে দেওউ কোম্পানি মিয়ানমার সরকারের সম্মতিক্রমে চীনের সরকারি তেল কোম্পানি চায়না পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কাছে গ্যাস বিক্রি করার চুক্তি করে। দেওউ ও তার কনসোর্টিয়াম এই গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন প্রকল্পে ৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করবে। চুক্তি অনুযায়ী এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে চীনকে ৩০ বছর গ্যাস সরবরাহ করা হবে। ২০১৩ সালে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে ও প্রতিদিন ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাইপলাইনে সরবরাহ করা হবে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে কিছু দূরত্বে অবস্থিত মিয়ানমারের সাগরবক্ষে নব-আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো প্রমাণ করেছে, এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলোর বিরাট গ্যাস-চাহিদা মেটাতে তাদের নিজস্ব গ্যাস ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে গ্যাস জোগাড় করতে কতটা তত্পর। এ ক্ষেত্র থেকে গ্যাস আমদানি করার প্রতিযোগিতায় ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশ পরস্পর প্রতিযোগী। বর্তমান প্রতিযোগিতায় ভারত যেমন জয়ী হতে পারেনি, তেমনি বাংলাদেশের গ্যাস আমদানির প্রস্তাবও মিয়ানমার সরকার নাকচ করেছে। তবে মিয়ানমার জানিয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আবিষ্কৃত নতুন ক্ষেত্র থেকে গ্যাস আমদানি করতে পারবে। ভারতের বর্তমান গ্যাসের চাহিদা বিশাল, আর ভবিষ্যতের চাহিদা ততোধিক এবং তা মেটাতে গ্যাস আমদানি আবশ্যক হবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই গ্যাস-ঘাটতির দেশ হয়ে পড়েছে আর ভবিষ্যতের গ্যাস-চাহিদার তুলনায় নিজস্ব সম্ভাব্য সরবরাহ অপ্রতুল। সে কারণে বাংলাদেশকে এখন থেকে ভবিষ্যত্ চাহিদা মেটানোর পন্থা ও পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।
বাংলাদেশকে বিশেষ করে ভবিষ্যত্ জালানিসংকট মেটানোর জন্য গ্যাস আমদানির প্রয়োজনীয় ছক বা পথ মানচিত্র আকারে নির্ধারণ করতে হবে। যেহেতু ভারত কখনোই গ্যাস রপ্তানি করবে না, বাংলাদেশের গ্যাস আমদানির একমাত্র উত্স হবে মিয়ানমারের আরাকান উপকূলে সমুদ্রবক্ষে আগামী দিনে আবিষ্কৃত নতুন গ্যাস, যা বাংলাদেশ থেকে সুবিধাজনক দূরত্বে অবস্থিত হবে এবং বাংলাদেশে রপ্তানি করতে মিয়ানমার রাজি হবে বলে জানিয়েছে। বাংলাদেশ হয় ভারত-বাংলাদেশ-মিয়ানমার ত্রিদেশীয় পাইপলাইন দিয়ে অথবা মিয়ানমার-বাংলাদেশ দ্বিদেশীয় পাইপলাইন কাজে লাগিয়ে গ্যাস আমদানির পরিকল্পনা করতে পারে।
ত্রিদেশীয় পাইপলাইনের সুবিধা হবে যে, তা আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম কর্তৃক নির্মাণ করতে বাংলাদেশকে অর্থ জোগান দিতে হবে না; বরং তা রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকি বাবদ বাংলাদেশ অর্থ অর্জন করতে পারে এবং পাইপলাইন দিয়ে ভারতে গ্যাস সঞ্চালন বাবদ প্রতিবছর নির্দিষ্ট হারে অর্থ পাবে, যা নগদের পরিবর্তে গ্যাস হিসেবে নিতে পারে। একটি ত্রিদেশীয় পাইপলাইন স্থাপনে বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য ও চুক্তির প্রাথমিক শর্ত হওয়া উচিত মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে গ্যাস আমদানি। অন্য বিকল্প পন্থা হলো, বাংলাদেশ নিজস্ব উদ্যোগে ও অর্থায়নে মিয়ানমার-বাংলাদেশ দ্বিদেশীয় পাইপলাইন নির্মাণ করে গ্যাস আমদানি করা, যে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিনামূল্যে কোনো গ্যাস পাবে না; বরং সব গ্যাসই বাংলাদেশকে ক্রয় করতে হবে। ত্রিদেশীয় বা দ্বিদেশীয় উভয় ক্ষেত্রেই গ্যাস পাইপলাইন মিয়ানমার থেকে টেকনাফ পথে বাংলাদেশে ঢুকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম হয়ে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশের বেশি লাভ হবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ জ্বালানিসংকটের রূপ কতটা ব্যাপক হতে পারে তা অনেকে যথার্থ অনুধাবন করেন না। কিন্তু দেশের পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বাস্তবায়ন করতে হলে তা যে পাহাড়সম, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে স্বল্প আয়তনের ও বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশকে জ্বালানি সম্পদের ভবিষ্যত্ রূপরেখা তৈরি করতে অভ্যন্তরীণ সম্পদের অতিরিক্ত বাইরের জ্বালানি সম্পদ কাজে লাগানোর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা আবশ্যক।
বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, রেজাইনা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।
বাংলাদেশে কোনো কোনো মহল মনে করে, ত্রিদেশীয় পাইপলাইন বাংলাদেশের জন্য তেমন সুবিধা বয়ে আনবে না; বরং ভারতের সঙ্গে গ্যাস পাইপলাইন যোগসূত্র স্থাপন করলে তা ভবিষ্যতে সময় ও ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বিরোধমূলক সংকট সৃষ্টির আশঙ্কাকে বাড়াতে পারে। আবার অন্য মহল মনে করে, আন্তদেশীয় গ্যাস পাইপলাইন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে যে রকম পারস্পরিক অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে এনেছে, মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত ত্রিদেশীয় পাইপলাইনও দেশ তিনটির মধ্যে সেভাবে লাভ বয়ে নিয়ে আসবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো স্বল্প জ্বালানি সম্পদের দেশে বর্তমানের গ্যাসের ঘাটতি ও আসন্ন ভবিষ্যত্ জ্বালানিসংকটের প্রেক্ষাপটে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জ্বালানি মজুদ ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করতে ত্রিদেশীয় গ্যাস পাইপলাইন মোক্ষম ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই এ প্রশ্ন এসে পড়ে যে বাংলাদেশ কি একটি সুযোগ হাতছাড়া করছে?
মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরবক্ষে আবিষ্কৃত হয় বিরাট আকারের গ্যাসক্ষেত্র সুউ, সুউফু এবং মিয়া। কোরিয়ার তেল কোম্পানি দেওউ ইন্টারন্যাশনাল আবিষ্কৃত এই গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে ভারতীয় কোম্পানিরও অংশীদারি রয়েছে (দেওউ ৫১%, ভারতের ওএনজিসি ১৮.৫%, ভারতের গেইল ৮.৫%)। আবিষ্কারের পর থেকেই ভারত এই গ্যাস আমদানি করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। বাংলাদেশের একটি প্রাইভেট কোম্পানি মোহনা হোল্ডিং লিমিটেড মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারত পর্যন্ত একটি পাইপলাইন স্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে তিন দেশের সরকারের কাছে পেশ করে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন এ প্রস্তাবে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে। পরবর্তী সময়ে তিন দেশের সরকারই এ প্রস্তাব গ্রহণে নীতিগতভাবে সম্মত হয়। বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত্ গ্যাসসংকটের প্রেক্ষাপট এবং মিয়ানমার থেকে গ্যাস আমদানির সম্ভাবনা বাংলাদেশকে ওই পাইপলাইন প্রকল্পে আগ্রহী করে।
পাইপলাইন প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার মন্ত্রী পর্যায়ে সমঝোতামূলক সভার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, একটি ত্রিদেশীয় কারিগরি কমিটি বিষয়টির বিস্তারিত রূপরেখা প্রণয়ন করবে। ২০০৫ সালে মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুনে কারিগরি কমিটি সভায় মিলিত হয়। বাংলাদেশ প্রস্তাব করে যে ১. পাইপলাইনটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে নয়, টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে তা চট্টগ্রাম হয়ে ভারতের দিকে এগোবে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভবিষ্যতে গ্যাস সরবরাহের সুযোগ বাড়ানো ছিল এ প্রস্তাবের লক্ষ্য, ২. চুক্তি সাপেক্ষে বাংলাদেশ পাইপলাইনে নির্ধারিত পয়েন্ট থেকে গ্যাস নেওয়ার অধিকার রাখবে, ৩. ভারতের তত্ত্বাবধানে নয়, বরং পাইপলাইনটি নির্মাণ করবে একটি আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম এবং ৪. বাংলাদেশের ভেতর পাইপলাইন অপারেটর হিসেবে বাংলাদেশি সংস্থা নিয়োজিত থাকবে, যার জন্য বাংলাদেশকে চার্জ দিতে হবে। এসব প্রস্তাবে ভারত ও মিয়ানমার উভয়েই আরও আলোচনা সাপেক্ষে সম্মতিসূচক প্রতিক্রয়া ব্যক্ত করে।
বাংলাদেশ ভারতের প্রতি আরও দুটি শর্ত দেয় যে, নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুত্ আমদানির জন্য ভারত করিডর-সুবিধা দেবে এবং উপরিউক্ত দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে বাণিজ্য-পণ্য বিনিময়ের জন্য ভারত করিডর দিয়ে যাতায়াত করার অধিকার দেবে। ভারত এই শেষোক্ত শর্ত দুটি মানতে রাজি না হলে বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা সভা ব্যর্থ হয়। এভাবে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ প্রস্তাবিত ত্রিদেশীয় পাইপলাইন প্রকল্প কার্যক্রম থেকে সরে আসে ।
এদিকে বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে ভারত নতুন পাইপলাইন পথ খুঁজতে সচেষ্ট হয়। নতুন পথ হিসেবে মিয়ানমার থেকে মিজোরাম, ত্রিপুরা, আসাম হয়ে পশ্চিমে শিলিগুড়ি; অতঃপর দক্ষিণে ঘুরে কলকাতার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু যেখানে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পাইপলাইন গেলে তা ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে ও চার হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নির্মাণ করা যাবে, অন্য পথটি বেছে নিলে পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য আরও ৫০০ কিলোমিটার বেশি হবে ও তাতে খরচ হবে আরও দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তা ছাড়া ত্রিপুরা-আসাম এলাকার বিদ্রোহীদের কাছ থেকে পাইপলাইনটির নিরাপত্তা বিশেষ উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখা দেয়। এসব কারণে ভারত পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়নে আর অগ্রসর হতে পারেনি।
ইতিমধ্যে মিয়ানমার তার গ্যাস বিক্রি-বাণিজ্যে স্থগিত অবস্থার অবসান ঘটিয়ে চীনের কাছে গ্যাস বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে দেওউ কোম্পানি মিয়ানমার সরকারের সম্মতিক্রমে চীনের সরকারি তেল কোম্পানি চায়না পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কাছে গ্যাস বিক্রি করার চুক্তি করে। দেওউ ও তার কনসোর্টিয়াম এই গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন প্রকল্পে ৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করবে। চুক্তি অনুযায়ী এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে চীনকে ৩০ বছর গ্যাস সরবরাহ করা হবে। ২০১৩ সালে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে ও প্রতিদিন ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাইপলাইনে সরবরাহ করা হবে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে কিছু দূরত্বে অবস্থিত মিয়ানমারের সাগরবক্ষে নব-আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো প্রমাণ করেছে, এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলোর বিরাট গ্যাস-চাহিদা মেটাতে তাদের নিজস্ব গ্যাস ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে গ্যাস জোগাড় করতে কতটা তত্পর। এ ক্ষেত্র থেকে গ্যাস আমদানি করার প্রতিযোগিতায় ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশ পরস্পর প্রতিযোগী। বর্তমান প্রতিযোগিতায় ভারত যেমন জয়ী হতে পারেনি, তেমনি বাংলাদেশের গ্যাস আমদানির প্রস্তাবও মিয়ানমার সরকার নাকচ করেছে। তবে মিয়ানমার জানিয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আবিষ্কৃত নতুন ক্ষেত্র থেকে গ্যাস আমদানি করতে পারবে। ভারতের বর্তমান গ্যাসের চাহিদা বিশাল, আর ভবিষ্যতের চাহিদা ততোধিক এবং তা মেটাতে গ্যাস আমদানি আবশ্যক হবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই গ্যাস-ঘাটতির দেশ হয়ে পড়েছে আর ভবিষ্যতের গ্যাস-চাহিদার তুলনায় নিজস্ব সম্ভাব্য সরবরাহ অপ্রতুল। সে কারণে বাংলাদেশকে এখন থেকে ভবিষ্যত্ চাহিদা মেটানোর পন্থা ও পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।
বাংলাদেশকে বিশেষ করে ভবিষ্যত্ জালানিসংকট মেটানোর জন্য গ্যাস আমদানির প্রয়োজনীয় ছক বা পথ মানচিত্র আকারে নির্ধারণ করতে হবে। যেহেতু ভারত কখনোই গ্যাস রপ্তানি করবে না, বাংলাদেশের গ্যাস আমদানির একমাত্র উত্স হবে মিয়ানমারের আরাকান উপকূলে সমুদ্রবক্ষে আগামী দিনে আবিষ্কৃত নতুন গ্যাস, যা বাংলাদেশ থেকে সুবিধাজনক দূরত্বে অবস্থিত হবে এবং বাংলাদেশে রপ্তানি করতে মিয়ানমার রাজি হবে বলে জানিয়েছে। বাংলাদেশ হয় ভারত-বাংলাদেশ-মিয়ানমার ত্রিদেশীয় পাইপলাইন দিয়ে অথবা মিয়ানমার-বাংলাদেশ দ্বিদেশীয় পাইপলাইন কাজে লাগিয়ে গ্যাস আমদানির পরিকল্পনা করতে পারে।
ত্রিদেশীয় পাইপলাইনের সুবিধা হবে যে, তা আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম কর্তৃক নির্মাণ করতে বাংলাদেশকে অর্থ জোগান দিতে হবে না; বরং তা রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকি বাবদ বাংলাদেশ অর্থ অর্জন করতে পারে এবং পাইপলাইন দিয়ে ভারতে গ্যাস সঞ্চালন বাবদ প্রতিবছর নির্দিষ্ট হারে অর্থ পাবে, যা নগদের পরিবর্তে গ্যাস হিসেবে নিতে পারে। একটি ত্রিদেশীয় পাইপলাইন স্থাপনে বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য ও চুক্তির প্রাথমিক শর্ত হওয়া উচিত মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে গ্যাস আমদানি। অন্য বিকল্প পন্থা হলো, বাংলাদেশ নিজস্ব উদ্যোগে ও অর্থায়নে মিয়ানমার-বাংলাদেশ দ্বিদেশীয় পাইপলাইন নির্মাণ করে গ্যাস আমদানি করা, যে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিনামূল্যে কোনো গ্যাস পাবে না; বরং সব গ্যাসই বাংলাদেশকে ক্রয় করতে হবে। ত্রিদেশীয় বা দ্বিদেশীয় উভয় ক্ষেত্রেই গ্যাস পাইপলাইন মিয়ানমার থেকে টেকনাফ পথে বাংলাদেশে ঢুকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম হয়ে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশের বেশি লাভ হবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ জ্বালানিসংকটের রূপ কতটা ব্যাপক হতে পারে তা অনেকে যথার্থ অনুধাবন করেন না। কিন্তু দেশের পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বাস্তবায়ন করতে হলে তা যে পাহাড়সম, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে স্বল্প আয়তনের ও বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশকে জ্বালানি সম্পদের ভবিষ্যত্ রূপরেখা তৈরি করতে অভ্যন্তরীণ সম্পদের অতিরিক্ত বাইরের জ্বালানি সম্পদ কাজে লাগানোর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা আবশ্যক।
বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, রেজাইনা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।
No comments