রায়টি হোক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দিক নির্দেশনা -সহজিয়া কড়চা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় সর্বোচ্চ আদালত থেকে ঘোষিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা কোনো স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক খুনের ঘটনা নয়। পনেরোই আগস্ট ’৭৫ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। একই সঙ্গে ঘাতকেরা বেগম ফজিলাতুন্নেসা, তাঁদের তিন ছেলে—শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল এবং তাঁদের দুই পুত্রবধূকেও হত্যা করে। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর অন্য কয়েকজন আত্মীয়কেও হত্যা করা হয়। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এমন বর্বরোচিত ও নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দ্বিতীয় কোনো দৃষ্টান্ত নেই।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তাঁর প্রিয়জনদের এই হত্যাকাণ্ড কোনো সাধারণ খুনের ঘটনা নয়। এটি বিশ শতকের অন্যতম জঘন্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। সমকালীন ইতিহাসে পৃথিবীতে আরও অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের চরিত্র ভিন্ন। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা মহাত্মা গান্ধী ঘরের ভেতর প্রার্থনাসভায় আততায়ীর হাতে নিহত হন। এর আড়াই বছর পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিহত হন জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময়। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ডব্লিউ আর ডি বন্দরনায়েক নিহত হন ১৯৫৯ সালে। পরে নিহত হন রাষ্ট্রপতি প্রেমাদাসা। আব্রাহাম লিংকন ছাড়া নিহত হন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আলেন্দে ১৯৭৩ সালে। অন্যদের মধ্যে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এবং ফিলিপাইনের বেনিনো অ্যাকুইনো আততায়ীর হাতে নিহত হন। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও নিহত হন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। যেসব দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান নিহত হন, সেসব দেশে তাঁদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁদের সরকারের পতন ঘটেনি। তা ছাড়া তাঁদের পরিবারের সব সদস্যকেও হত্যা করা হয়নি। যাঁদের নাম উল্লেখ করেছি, তাঁদের মধ্যে শুধু আলেন্দের ছাড়া সবার খুনিদের তাত্ক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা হয়। তাঁদের দেশের প্রচলিত আইনে তাঁদের হত্যার বিচার হয়েছে এবং অপরাধীরা উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করেছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বিশ শতকের একটি ব্যতিক্রমী হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডের দুটি দিক। একটি এর বর্বরতা, আরেকটি এর রাজনৈতিক নিহিতার্থ। তাঁর হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে তাঁর সরকারের পতন ঘটানো শুধু নয়, তাঁর রাজনীতির আদর্শ মুছে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। এবং যাঁরা তা করেন, তাঁরা তাতে সফল হন। তাঁরা এতটাই সফল হয়েছিলেন যে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো একটি কালো আইন পর্যন্ত তাঁরা জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। তাতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে ওই দায়মুক্তির অধ্যাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার বাতিল করে। তারপর বঙ্গবন্ধু ভবনের একজন কর্মচারী ধানমন্ডি থানায় এজাহার দায়ের করেন। ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। নানা বাধাবিঘ্নের ভেতর দিয়ে হলেও বিচারের সমাপ্তি ঘটল বৃহস্পতিবার। এখন রায় কার্যকর করার আইনি প্রক্রিয়াটি বাকি।
মামলাটির বিচার হয়েছে দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনে। প্রচলিত আইনে বিচার হওয়ায় আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগ পেয়েছেন। বিশেষ আদালতে বা সেনা আইনে বিচার হলে সাধারণ মানুষের কাছে অনেক কিছুই অজানা বা অস্পষ্ট থাকত। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের শুনানিতেও দুই পক্ষের আইনজীবীরা তাঁদের সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন এবং গত কয়েক দিনে আদালতে যে যুক্তি-তর্ক হয়েছে, তাতে আইনগত দিক যত না আলোচিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে রাজনৈতিক দিক। সেটা সংগত কারণেই হয়েছে এ জন্য যে, হত্যাকাণ্ডটি ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক শত্রুরাই তাঁকে হত্যা করেছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক শত্রুরা ক্ষমতা দখল না করলে রাষ্ট্রই উদ্যোগ নিয়ে এ মামলা পরিচালনা করতে পারত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁর শত্রুদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র মাত্র। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অপরাধের বিচার হলে সেদিনের বহু শীর্ষ সামরিক-বেসামরিক আমলা ও রাজনীতিক ফেঁসে যেতেন। ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা এবং একপর্যায়ে ঘাতকদের সঙ্গে তাঁদের সহযোগিতার কারণে ইতিহাস তাঁদের ক্ষমা করবে না। তা ছাড়া ১৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনে ষড়যন্ত্রকারী ও ঘাতকদের রাজনীতিই টিকে গেছে। উপকৃত হয়েছিলেন তাঁদের সামরিক-বেসামরিক সহযোগীরা।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সেদিনের অভ্যুত্থানে যাঁরা ভাড়াটে খুনির দায়িত্ব পালন করেছিলেন, পরবর্তী বহু বছর তাঁদের জীবন ছিল খুবই উপভোগ্য ও সুখকর। দেশ ও বিদেশে তাঁরা রাজার হালে জীবন যাপন করেছেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদ তাঁদের এমন সব বড় বড় চাকরি দিয়েছেন বিভিন্ন দূতাবাসে, যা কঠিন পরীক্ষা দিয়ে বহু বছর অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমেই শুধু পাওয়া সম্ভব। পনেরোই আগস্টের ঘাতকদের জীবনের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করাই ছিল জিয়া ও এরশাদ সরকারের অন্যতম প্রধান ব্রত।
কিন্তু কেন তাঁরা তা করেছেন? তাঁরা তা করেছেন এ জন্য যে, জিয়া-এরশাদের রাজনীতি আর ঘাতকদের রাজনীতি অভিন্ন। তাঁদের রাজনৈতিক দল গঠনেরও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সংসদেরও সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁদের প্রতি খালেদা জিয়ার সরকারের আশীর্বাদও অপ্রকাশ্য ছিল না। ফ্রিডম পার্টি, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি (প্রগশ) প্রভৃতি বিএনপি ও জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক মিত্র। জেনারেল এরশাদের ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে ফ্রিডম পার্টির এক নেতা নির্বাচিত হন। শুধু জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া নন, পনেরোই আগস্টের নষ্টদের বৈদেশিক মিত্রও ছিল খুবই বিশ্বস্ত ও ক্ষমতাবান। যে কারণে তাঁরা বহু বছর দেশের মধ্যেও দর্পভরে চলাফেরা করেছেন।
সত্তরের দশকের বিশ্ব রাজনীতি ও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির পরিস্থিতির সুযোগটি নিয়েছিলেন পনেরোই আগস্টের ষড়যন্ত্রকারীরা। পৃথিবীর কোনো মানুষই ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। মানবিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত নয় কেউই। রাজনীতিবিদ ও শাসকেরাও মানুষ। অজস্র কাজ করতে গিয়ে তাঁদের ভুল হতে পারে। রাষ্ট্রের সরকার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এক শাসক বা সরকারের ভুল পরবর্তী শাসক বা সরকারের সংশোধন করার সুযোগ থাকে। সে সুযোগ সামন্তবাদী রাজতন্ত্রেও থাকে, গণতন্ত্রে তো থাকেই।
ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে দিয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন এবং একই সঙ্গে একদলীয় শাসন প্রবর্তন ছিল একটি ভুল পদক্ষেপ। দেশের সব রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন নিষিদ্ধ করায় সেইসব দল ও সংগঠনের নেতা-কর্মীরা খুব স্বাভাবিক কারনেই বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মো) এক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতা দিয়েছে, বাকশালে যোগ দিয়েছে। যদিও এই দল দুটির কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। অন্যান্য দলগুলোর নেতারা ছিলেন খুবই বিরূপ। বঙ্গবন্ধুর সরকার ঝুঁকে পড়েছিল সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দিকে। তাতে পুঁজিবাদী বিশ্ব ও ধর্মপন্থীরা সরকারের ওপর অখুশি হয়। সরকারবিরোধী ওই সব চেতনা কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের পূর্ণ সহযোগিতায় পনেরোই আগস্টের বর্বরতা ঘটানো হয়। এবং বিভিন্ন দল ওই পটপরিবর্তনকে তাদের ভাগ্য বদলের জন্য কাজে লাগায়।
পঁচাত্তরে বিভিন্ন দলের নেতারা যে ভুলটি করেছিলেন, তা হলো, তাঁরা একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন না করে, আন্দোলন গড়ে না তুলে, সেনাবাহিনীর জেনারেলদের করুণার ওপর নির্ভর করতে থাকেন। যে কারণে সুবিধাবাদী রাজনীতির তলায় চাপা পড়ে যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার। কই, কোনো রাজনৈতিক দল তো সত্তর ও আশির দশকে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবি করে কোনো জনসভা বা মানববন্ধন করেনি? ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই দেশ ও বিদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়েছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমাদের মানবাধিকারকর্মী, সামাজিক সংগঠনের নেতা, নাগরিক সমাজের নেতা ও আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো বড় কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেননি।
তা যদি তাঁরা করতেন, তাহলে বহু আগেই এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হতো। খুব ভালো হতো এই বিচার যদি সম্পন্ন হতো জিয়া, এরশাদ বা খালেদা জিয়ার সরকারের সময়। তাঁদের জন্যও হতো শ্লাঘার বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ওই তিন শাসক চাননি, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হোক। তা চাননি এ জন্য যে, অপরাধীরা তাঁদের রাজনৈতিক মিত্র।
বাংলাদেশের রাজনীতির যে ধারা, তাতে এক সরকারের যেকোনো কাজ তার বিরোধী দলগুলো ইতিবাচকভাবে নেয় না। এই মামলার রায়ের প্রশ্নে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদ বলেছেন, এতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দেশের মানুষ ‘স্বস্তি’ পেয়েছে। তিনি একসময় আইনমন্ত্রী ছিলেন এবং দেশের একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ। তাঁর কথা আমরা মূল্য দেব। কিন্তু তাঁর দল এ রায়কে কীভাবে মূল্যায়ন করে, তা আমাদের দেখতে হবে। বিএনপিকে বুঝতে হবে, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে ঘাতকদের, তাদের নেতাদের নয়।
অতীতের অগণতান্ত্রিক শক্তির দায় দেশবাসী আর বহন করতে চায় না। আইনের শাসন আর গণতন্ত্র পরস্পর সম্পর্কিত। সাজা পাওয়া ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষক দেশ ও বিদেশে থাকা সম্ভব। তাঁদের সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। দলমতনির্বিশেষে ‘আইন’ সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য—সরকারকে প্রমাণ করতে হবে। জেলহত্যা মামলাসহ আরও যেসব মামলা এখনো নিষ্পন্ন হয়নি, তা স্বচ্ছভাবে মীমাংসিত হবে—সেটাই জনগণ প্রত্যাশা করে। মানুষ আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র চায়—অন্য কোনো কিছু নয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারে যদি কোনো রকম ত্রুটি থাকে, তার দায়দায়িত্ব আইনজীবী ও বিচারকদের, সরকারের নয়। এই রায় নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরাও গবেষণা করবেন। পুরো রায়টি এখনো আমরা পাঠ করিনি। এই রায়ে আমাদের বিচারব্যবস্থায় এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কী দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা পরে জানা যাবে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার হত্যার বিচারের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। আশা করব, এর ভেতর দিয়েই শুরু হবে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার এক নতুন অধ্যায়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তাঁর প্রিয়জনদের এই হত্যাকাণ্ড কোনো সাধারণ খুনের ঘটনা নয়। এটি বিশ শতকের অন্যতম জঘন্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। সমকালীন ইতিহাসে পৃথিবীতে আরও অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের চরিত্র ভিন্ন। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা মহাত্মা গান্ধী ঘরের ভেতর প্রার্থনাসভায় আততায়ীর হাতে নিহত হন। এর আড়াই বছর পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিহত হন জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময়। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ডব্লিউ আর ডি বন্দরনায়েক নিহত হন ১৯৫৯ সালে। পরে নিহত হন রাষ্ট্রপতি প্রেমাদাসা। আব্রাহাম লিংকন ছাড়া নিহত হন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আলেন্দে ১৯৭৩ সালে। অন্যদের মধ্যে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এবং ফিলিপাইনের বেনিনো অ্যাকুইনো আততায়ীর হাতে নিহত হন। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও নিহত হন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। যেসব দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান নিহত হন, সেসব দেশে তাঁদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁদের সরকারের পতন ঘটেনি। তা ছাড়া তাঁদের পরিবারের সব সদস্যকেও হত্যা করা হয়নি। যাঁদের নাম উল্লেখ করেছি, তাঁদের মধ্যে শুধু আলেন্দের ছাড়া সবার খুনিদের তাত্ক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা হয়। তাঁদের দেশের প্রচলিত আইনে তাঁদের হত্যার বিচার হয়েছে এবং অপরাধীরা উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করেছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বিশ শতকের একটি ব্যতিক্রমী হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডের দুটি দিক। একটি এর বর্বরতা, আরেকটি এর রাজনৈতিক নিহিতার্থ। তাঁর হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে তাঁর সরকারের পতন ঘটানো শুধু নয়, তাঁর রাজনীতির আদর্শ মুছে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। এবং যাঁরা তা করেন, তাঁরা তাতে সফল হন। তাঁরা এতটাই সফল হয়েছিলেন যে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো একটি কালো আইন পর্যন্ত তাঁরা জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। তাতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে ওই দায়মুক্তির অধ্যাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার বাতিল করে। তারপর বঙ্গবন্ধু ভবনের একজন কর্মচারী ধানমন্ডি থানায় এজাহার দায়ের করেন। ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। নানা বাধাবিঘ্নের ভেতর দিয়ে হলেও বিচারের সমাপ্তি ঘটল বৃহস্পতিবার। এখন রায় কার্যকর করার আইনি প্রক্রিয়াটি বাকি।
মামলাটির বিচার হয়েছে দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনে। প্রচলিত আইনে বিচার হওয়ায় আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগ পেয়েছেন। বিশেষ আদালতে বা সেনা আইনে বিচার হলে সাধারণ মানুষের কাছে অনেক কিছুই অজানা বা অস্পষ্ট থাকত। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের শুনানিতেও দুই পক্ষের আইনজীবীরা তাঁদের সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন এবং গত কয়েক দিনে আদালতে যে যুক্তি-তর্ক হয়েছে, তাতে আইনগত দিক যত না আলোচিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে রাজনৈতিক দিক। সেটা সংগত কারণেই হয়েছে এ জন্য যে, হত্যাকাণ্ডটি ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক শত্রুরাই তাঁকে হত্যা করেছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক শত্রুরা ক্ষমতা দখল না করলে রাষ্ট্রই উদ্যোগ নিয়ে এ মামলা পরিচালনা করতে পারত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁর শত্রুদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র মাত্র। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অপরাধের বিচার হলে সেদিনের বহু শীর্ষ সামরিক-বেসামরিক আমলা ও রাজনীতিক ফেঁসে যেতেন। ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা এবং একপর্যায়ে ঘাতকদের সঙ্গে তাঁদের সহযোগিতার কারণে ইতিহাস তাঁদের ক্ষমা করবে না। তা ছাড়া ১৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনে ষড়যন্ত্রকারী ও ঘাতকদের রাজনীতিই টিকে গেছে। উপকৃত হয়েছিলেন তাঁদের সামরিক-বেসামরিক সহযোগীরা।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সেদিনের অভ্যুত্থানে যাঁরা ভাড়াটে খুনির দায়িত্ব পালন করেছিলেন, পরবর্তী বহু বছর তাঁদের জীবন ছিল খুবই উপভোগ্য ও সুখকর। দেশ ও বিদেশে তাঁরা রাজার হালে জীবন যাপন করেছেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদ তাঁদের এমন সব বড় বড় চাকরি দিয়েছেন বিভিন্ন দূতাবাসে, যা কঠিন পরীক্ষা দিয়ে বহু বছর অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমেই শুধু পাওয়া সম্ভব। পনেরোই আগস্টের ঘাতকদের জীবনের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করাই ছিল জিয়া ও এরশাদ সরকারের অন্যতম প্রধান ব্রত।
কিন্তু কেন তাঁরা তা করেছেন? তাঁরা তা করেছেন এ জন্য যে, জিয়া-এরশাদের রাজনীতি আর ঘাতকদের রাজনীতি অভিন্ন। তাঁদের রাজনৈতিক দল গঠনেরও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সংসদেরও সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁদের প্রতি খালেদা জিয়ার সরকারের আশীর্বাদও অপ্রকাশ্য ছিল না। ফ্রিডম পার্টি, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি (প্রগশ) প্রভৃতি বিএনপি ও জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক মিত্র। জেনারেল এরশাদের ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে ফ্রিডম পার্টির এক নেতা নির্বাচিত হন। শুধু জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া নন, পনেরোই আগস্টের নষ্টদের বৈদেশিক মিত্রও ছিল খুবই বিশ্বস্ত ও ক্ষমতাবান। যে কারণে তাঁরা বহু বছর দেশের মধ্যেও দর্পভরে চলাফেরা করেছেন।
সত্তরের দশকের বিশ্ব রাজনীতি ও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির পরিস্থিতির সুযোগটি নিয়েছিলেন পনেরোই আগস্টের ষড়যন্ত্রকারীরা। পৃথিবীর কোনো মানুষই ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। মানবিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত নয় কেউই। রাজনীতিবিদ ও শাসকেরাও মানুষ। অজস্র কাজ করতে গিয়ে তাঁদের ভুল হতে পারে। রাষ্ট্রের সরকার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এক শাসক বা সরকারের ভুল পরবর্তী শাসক বা সরকারের সংশোধন করার সুযোগ থাকে। সে সুযোগ সামন্তবাদী রাজতন্ত্রেও থাকে, গণতন্ত্রে তো থাকেই।
ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে দিয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন এবং একই সঙ্গে একদলীয় শাসন প্রবর্তন ছিল একটি ভুল পদক্ষেপ। দেশের সব রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন নিষিদ্ধ করায় সেইসব দল ও সংগঠনের নেতা-কর্মীরা খুব স্বাভাবিক কারনেই বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মো) এক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতা দিয়েছে, বাকশালে যোগ দিয়েছে। যদিও এই দল দুটির কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। অন্যান্য দলগুলোর নেতারা ছিলেন খুবই বিরূপ। বঙ্গবন্ধুর সরকার ঝুঁকে পড়েছিল সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দিকে। তাতে পুঁজিবাদী বিশ্ব ও ধর্মপন্থীরা সরকারের ওপর অখুশি হয়। সরকারবিরোধী ওই সব চেতনা কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের পূর্ণ সহযোগিতায় পনেরোই আগস্টের বর্বরতা ঘটানো হয়। এবং বিভিন্ন দল ওই পটপরিবর্তনকে তাদের ভাগ্য বদলের জন্য কাজে লাগায়।
পঁচাত্তরে বিভিন্ন দলের নেতারা যে ভুলটি করেছিলেন, তা হলো, তাঁরা একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন না করে, আন্দোলন গড়ে না তুলে, সেনাবাহিনীর জেনারেলদের করুণার ওপর নির্ভর করতে থাকেন। যে কারণে সুবিধাবাদী রাজনীতির তলায় চাপা পড়ে যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার। কই, কোনো রাজনৈতিক দল তো সত্তর ও আশির দশকে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবি করে কোনো জনসভা বা মানববন্ধন করেনি? ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই দেশ ও বিদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়েছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমাদের মানবাধিকারকর্মী, সামাজিক সংগঠনের নেতা, নাগরিক সমাজের নেতা ও আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো বড় কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেননি।
তা যদি তাঁরা করতেন, তাহলে বহু আগেই এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হতো। খুব ভালো হতো এই বিচার যদি সম্পন্ন হতো জিয়া, এরশাদ বা খালেদা জিয়ার সরকারের সময়। তাঁদের জন্যও হতো শ্লাঘার বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ওই তিন শাসক চাননি, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হোক। তা চাননি এ জন্য যে, অপরাধীরা তাঁদের রাজনৈতিক মিত্র।
বাংলাদেশের রাজনীতির যে ধারা, তাতে এক সরকারের যেকোনো কাজ তার বিরোধী দলগুলো ইতিবাচকভাবে নেয় না। এই মামলার রায়ের প্রশ্নে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদ বলেছেন, এতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দেশের মানুষ ‘স্বস্তি’ পেয়েছে। তিনি একসময় আইনমন্ত্রী ছিলেন এবং দেশের একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ। তাঁর কথা আমরা মূল্য দেব। কিন্তু তাঁর দল এ রায়কে কীভাবে মূল্যায়ন করে, তা আমাদের দেখতে হবে। বিএনপিকে বুঝতে হবে, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে ঘাতকদের, তাদের নেতাদের নয়।
অতীতের অগণতান্ত্রিক শক্তির দায় দেশবাসী আর বহন করতে চায় না। আইনের শাসন আর গণতন্ত্র পরস্পর সম্পর্কিত। সাজা পাওয়া ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষক দেশ ও বিদেশে থাকা সম্ভব। তাঁদের সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। দলমতনির্বিশেষে ‘আইন’ সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য—সরকারকে প্রমাণ করতে হবে। জেলহত্যা মামলাসহ আরও যেসব মামলা এখনো নিষ্পন্ন হয়নি, তা স্বচ্ছভাবে মীমাংসিত হবে—সেটাই জনগণ প্রত্যাশা করে। মানুষ আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র চায়—অন্য কোনো কিছু নয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারে যদি কোনো রকম ত্রুটি থাকে, তার দায়দায়িত্ব আইনজীবী ও বিচারকদের, সরকারের নয়। এই রায় নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরাও গবেষণা করবেন। পুরো রায়টি এখনো আমরা পাঠ করিনি। এই রায়ে আমাদের বিচারব্যবস্থায় এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কী দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা পরে জানা যাবে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার হত্যার বিচারের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। আশা করব, এর ভেতর দিয়েই শুরু হবে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার এক নতুন অধ্যায়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments