পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ -মিডিয়া ভাবনা by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
আমাদের মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কয়েকটি প্রসঙ্গ প্রায় সময়ই ওঠে, কিন্তু কোনো পরিণতি পায় না। এর মধ্যে তিনটি বহুল আলোচিত ইস্যু হলো: ১. পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখা যায় না কেন? ২. পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের বই, পত্রপত্রিকা পাওয়া যায় না কেন? ৩. পশ্চিমবঙ্গের অডিও বাজারে বাংলাদেশের গানের সিডি পাওয়া যায় না কেন? আজকের নিবন্ধে এ তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।
পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখা যায় না কেন, তা নিয়ে বহু আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু এর কোনো সমাধান হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলেছেন, ‘এ ব্যাপারে কোনো সরকারি নিষেধাজ্ঞা নেই। এটা বেসরকারি খাতের বিষয়। তারা আগ্রহী হলে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখাতে কোনো সরকারি বাধা নেই।’ অপরদিকে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের মালিকেরা বলেছেন, ‘কলকাতার কেব্ল্ অপারেটররা এ জন্য বার্ষিক ভিত্তিতে বড় অঙ্কের টাকা দাবি করেছে। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের মালিকেরা সেই টাকা দিতে রাজি নন।’ কেনই বা রাজি হবেন? কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোনো আয় তো তাঁদের নেই।
সমস্যাটি এ জায়গায় এসে ঝুলে গেছে। কিন্তু এভাবে তো ঝুলে থাকা উচিত নয়। বিষয়টির একটা সুরাহা হওয়া দরকার। আমি প্রস্তাব করছি: বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, শিল্পী প্রতিনিধির একটি দল কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনের সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংস্কৃতিমান মুখ্যমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, কেব্ল্ অপারেটরদের সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। সমস্যাটির ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে কলকাতায় বসেই এর সমাধান দিয়ে আসার ব্যবস্থা করা দরকার। যেহেতু এটা প্রধানত বেসসকারি পর্যায়ের ইস্যু, সেহেতু এটা নিয়ে সংসদে আইন পাস বা দুই সরকারের চুক্তি স্বাক্ষরের কিছু নেই। মিয়া-বিবি রাজি হলে ওই বৈঠকেই সমাধান সম্ভব।
যদি কোনো কঠিন কারণে এ সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে কলকাতা তথা ভারতের কেব্ল্ চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে প্রদর্শন করা যুক্তিযুক্ত হবে কি না, তা কেব্ল্ অপারেটর ও আত্মসম্মানসম্পন্ন দর্শকদের বিবেচনা করতে বলব। যদি কলকাতার কেব্ল্ অপারেটররা টাকার কারণেই দেখাতে সম্মত না হন, তাহলে বাংলাদেশের কেব্ল্ অপারেটররা অনুরূপ অঙ্কের টাকার দাবি তুলতে পারেন। অন্তত এই সুযোগে বছরে একটা মোটা অঙ্কের টাকা তো আয় হবে। টাকার দাবি না মেটালে বাংলাদেশেও বন্ধ থাকুক ভারতীয় কেব্ল্ টিভি চ্যানেলগুলো। যেভাবে তারা বন্ধ রেখেছে।
এ ব্যাপারে কলকাতার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিষয়টা তুলে ধরতে হবে। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ দর্শকেরা (যাদের অনেকেই ঢাকার টিভি অনুষ্ঠানের অনুরাগী) যেন জানতে পারে, কী কারণে ও কাদের কারণে তারা ঢাকার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখতে পারছে না।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে আমাদের টিভি চ্যানেল দেখা গেলে আমাদের কী লাভ? আমি বলব, অনেক লাভ। যেমন—এত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের সমাজ, পরিবেশ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, উন্নয়ন, সাফল্য ইত্যাদি সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের অনেক শিক্ষিত মানুষও প্রায় কিছুই জানে না। তথ্যপ্রাপ্তির এক বিরাট ঘাটতি রয়েছে।
টিভি চ্যানেলগুলো দেখা গেলে বিজ্ঞাপনের বদৌলতে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও ভারতে (অন্তত প্রতিবেশী সাত রাজ্যে) সম্প্রসারিত হতো। যেমন ভারতীয় টিভি চ্যানেলে ভারতীয় নানা পণ্যসামগ্রী ও সার্ভিসের বিজ্ঞাপন দেখে বাংলাদেশের দর্শক তাতে আগ্রহী হচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী তা আমদানি করছেন। এখানে ভারতীয় পণ্যের বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। ভারতে বেড়াতে গেলেও ওই পণ্যের খোঁজ করছেন অনেকে। এভাবেই টিভি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভারতের ব্যবসা বাংলাদেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে। ভারতে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল বন্ধ করে রেখে আমাদের পণ্য সম্পর্কে ভারতবাসীকে অন্ধকারে রাখার একটা ‘ষড়যন্ত্র’ বলে অনেকে মনে করেন। যদিও সত্যের খাতিরে এটা বলতে আমার দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতীয় পণ্যের বৈচিত্র্য ও আকর্ষণ অনেক গুণ বেশি। কিন্তু আমাদের যেটুকু রয়েছে, সেটুকু নিয়েও আমরা ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে পারছি না। টিভি ছাড়া আরও কারণ রয়েছে।
কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বাজারে বাংলাদেশের বইও তেমন প্রবেশ করতে পারেনি। আমরা বইয়ের বাজারও সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের বই আমদানিকারকদের উত্সাহের অভাবও এর একটা বড় কারণ। অথচ বাংলাদেশের বইয়ের বাজারে কলকাতার বই আলো করে রয়েছে। কোনো কোনো বইয়ের দোকানে প্রধানত কলকাতার বইই বিক্রি হয়। কলকাতার পাক্ষিক পত্রিকারও বিরাট বাজার রয়েছে বাংলাদেশে। আমাদের পত্রপত্রিকার নামই কলকাতার পাঠক জানে কি না সন্দেহ। অথচ আমরা ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। এক ভাষা। সংস্কৃতির মধ্যে কত মিল। বাস্তবে কী দুঃসহ দূরত্ব সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশের সংগীত কম সমৃদ্ধ নয়। শুধু লোকগীতি নয়, আধুনিক গানেরও বাজার হতে পারত ভারতের বাংলাভাষী রাজ্যগুলোতে। কিন্তু তা হতে পারেনি। আমাদেরই উদ্যোগের অভাব এ জন্য কম দায়ী নয়। ভারতের অসহযোগিতা তো আছেই। আমরা কতটা উদ্যোগী হয়েছি, সেটাও দেখতে হবে। আমাদের কোনো সরকারই কি ভারতে (অন্তত সাত রাজ্যে) বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রসারের কোনো বড় পদক্ষেপ নিয়েছে? একটা উদাহরণ কেউ দেখাতে পারবে?
স্বাধীনতার পর থেকে এসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। কখনো কোনো সরকার এগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা মনে করেনি। যতটা মনে করেছে ফারাক্কা, তিন বিঘা করিডর বা হালের টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে। নিঃসন্দেহে এগুলো অনেক বড় সমস্যা। কিন্তু মিডিয়া, চলচ্চিত্র, প্রকাশনা, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ-ভারত অসম পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বা বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে কোনো সরকারই এগিয়ে আসেনি।
অনেকে বলতে পারে, শুধু ভারতে কেন? অন্য দেশে নয় কেন? বাজেট থাকলে পৃথিবীর সব দেশেই তা করা যেতে পারে। তবে সব দেশের লোক বাংলাদেশের বই বা গান সম্পর্কে আগ্রহী হবে, এমন দাবি করা যাবে না। পাকিস্তান, সৌদি আরব বা সুইডেনের মানুষ কি আগ্রহী হবে? কাজেই ভাষা ও সংস্কৃতির নৈকট্য বেশি বলে ভারতের সাত রাজ্যে চাহিদা হতে পারে। সে জন্যই ভারতের প্রসঙ্গ বারবার আসছে।
এই পটভূমিতে সরকারের কাছে, বিশেষ করে সংস্কৃতি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আমার প্রস্তাব: প্রতিবছর পালাক্রমে কলকাতা, শিলিগুড়ি ও আগরতলায় সপ্তাহব্যাপী ‘বাংলাদেশ উত্সবের’ আয়োজন করা হোক। এতে থাকবে বাংলাদেশের বই, পত্রপত্রিকা, আমদানিযোগ্য পণ্যসমাগ্রী, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, প্রতি সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অডিও সিডির স্টল, কলকাতার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রতি সন্ধ্যায় নির্বাচিত একটি টিভি অনুষ্ঠান, পর্যটন তথ্যকেন্দ্র ইত্যাদি। আমার আশা, সরকার উদ্যোগী হলে এ কাজে বেসরকারি উদ্যক্তাদের সহায়তা পাওয়া যাবে। তবে দেখতে হবে, সরকার যেন পেশাদারী দৃষ্টিকোণ থেকে সব আয়োজন করে। এসব ক্ষেত্রে কোনো দলীয় বা গোষ্ঠীপ্রীতি যেন সরকারকে প্রভাবিত করতে না পারে। যদি একটানা পাঁচ বছর এ রকম ‘বাংলাদেশ উত্সবের’ আয়োজন করা সম্ভব হয়, তাহলে আমাদের প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রকাশনা ও পণ্যসামগ্রীর একটা চাহিদা সৃষ্টি হতে পারে।
তবে সবকিছুর আগে দরকার পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো দেখার বাধা দূর করা। এ ব্যাপারে এক্ষুনি জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। এফবিসিসিআই এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিলে ভালো হয়। কারণ টিভি চ্যানেল দেখা গেলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। শিল্প-সংস্কৃতির প্রচার তো আছেই। ব্যবসার সম্ভাবনাও কিন্তু কম নয়। একদা ‘বিটিভির’ প্রিয় মুখ আনিসুল হক এখন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। তিনি এর গুরুত্ব যথাযথ অনুধাবন করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। কাজেই তাঁর নেতৃত্বে এই জটটা খোলার চেষ্টা করা যেতে পারে। আশা করি, কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশন এ ব্যাপারে দাপ্তরিক সহায়তা দেবে। ২০০৯ সাল শেষ হওয়ার আগেই আমরা কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখাতে চাই—এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্যোগী হতে অনুরোধ করছি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখা যায় না কেন, তা নিয়ে বহু আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু এর কোনো সমাধান হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলেছেন, ‘এ ব্যাপারে কোনো সরকারি নিষেধাজ্ঞা নেই। এটা বেসরকারি খাতের বিষয়। তারা আগ্রহী হলে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখাতে কোনো সরকারি বাধা নেই।’ অপরদিকে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের মালিকেরা বলেছেন, ‘কলকাতার কেব্ল্ অপারেটররা এ জন্য বার্ষিক ভিত্তিতে বড় অঙ্কের টাকা দাবি করেছে। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের মালিকেরা সেই টাকা দিতে রাজি নন।’ কেনই বা রাজি হবেন? কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোনো আয় তো তাঁদের নেই।
সমস্যাটি এ জায়গায় এসে ঝুলে গেছে। কিন্তু এভাবে তো ঝুলে থাকা উচিত নয়। বিষয়টির একটা সুরাহা হওয়া দরকার। আমি প্রস্তাব করছি: বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, শিল্পী প্রতিনিধির একটি দল কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনের সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংস্কৃতিমান মুখ্যমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, কেব্ল্ অপারেটরদের সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। সমস্যাটির ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে কলকাতায় বসেই এর সমাধান দিয়ে আসার ব্যবস্থা করা দরকার। যেহেতু এটা প্রধানত বেসসকারি পর্যায়ের ইস্যু, সেহেতু এটা নিয়ে সংসদে আইন পাস বা দুই সরকারের চুক্তি স্বাক্ষরের কিছু নেই। মিয়া-বিবি রাজি হলে ওই বৈঠকেই সমাধান সম্ভব।
যদি কোনো কঠিন কারণে এ সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে কলকাতা তথা ভারতের কেব্ল্ চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে প্রদর্শন করা যুক্তিযুক্ত হবে কি না, তা কেব্ল্ অপারেটর ও আত্মসম্মানসম্পন্ন দর্শকদের বিবেচনা করতে বলব। যদি কলকাতার কেব্ল্ অপারেটররা টাকার কারণেই দেখাতে সম্মত না হন, তাহলে বাংলাদেশের কেব্ল্ অপারেটররা অনুরূপ অঙ্কের টাকার দাবি তুলতে পারেন। অন্তত এই সুযোগে বছরে একটা মোটা অঙ্কের টাকা তো আয় হবে। টাকার দাবি না মেটালে বাংলাদেশেও বন্ধ থাকুক ভারতীয় কেব্ল্ টিভি চ্যানেলগুলো। যেভাবে তারা বন্ধ রেখেছে।
এ ব্যাপারে কলকাতার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিষয়টা তুলে ধরতে হবে। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ দর্শকেরা (যাদের অনেকেই ঢাকার টিভি অনুষ্ঠানের অনুরাগী) যেন জানতে পারে, কী কারণে ও কাদের কারণে তারা ঢাকার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখতে পারছে না।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে আমাদের টিভি চ্যানেল দেখা গেলে আমাদের কী লাভ? আমি বলব, অনেক লাভ। যেমন—এত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের সমাজ, পরিবেশ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, উন্নয়ন, সাফল্য ইত্যাদি সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের অনেক শিক্ষিত মানুষও প্রায় কিছুই জানে না। তথ্যপ্রাপ্তির এক বিরাট ঘাটতি রয়েছে।
টিভি চ্যানেলগুলো দেখা গেলে বিজ্ঞাপনের বদৌলতে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও ভারতে (অন্তত প্রতিবেশী সাত রাজ্যে) সম্প্রসারিত হতো। যেমন ভারতীয় টিভি চ্যানেলে ভারতীয় নানা পণ্যসামগ্রী ও সার্ভিসের বিজ্ঞাপন দেখে বাংলাদেশের দর্শক তাতে আগ্রহী হচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী তা আমদানি করছেন। এখানে ভারতীয় পণ্যের বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। ভারতে বেড়াতে গেলেও ওই পণ্যের খোঁজ করছেন অনেকে। এভাবেই টিভি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভারতের ব্যবসা বাংলাদেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে। ভারতে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল বন্ধ করে রেখে আমাদের পণ্য সম্পর্কে ভারতবাসীকে অন্ধকারে রাখার একটা ‘ষড়যন্ত্র’ বলে অনেকে মনে করেন। যদিও সত্যের খাতিরে এটা বলতে আমার দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতীয় পণ্যের বৈচিত্র্য ও আকর্ষণ অনেক গুণ বেশি। কিন্তু আমাদের যেটুকু রয়েছে, সেটুকু নিয়েও আমরা ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে পারছি না। টিভি ছাড়া আরও কারণ রয়েছে।
কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বাজারে বাংলাদেশের বইও তেমন প্রবেশ করতে পারেনি। আমরা বইয়ের বাজারও সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের বই আমদানিকারকদের উত্সাহের অভাবও এর একটা বড় কারণ। অথচ বাংলাদেশের বইয়ের বাজারে কলকাতার বই আলো করে রয়েছে। কোনো কোনো বইয়ের দোকানে প্রধানত কলকাতার বইই বিক্রি হয়। কলকাতার পাক্ষিক পত্রিকারও বিরাট বাজার রয়েছে বাংলাদেশে। আমাদের পত্রপত্রিকার নামই কলকাতার পাঠক জানে কি না সন্দেহ। অথচ আমরা ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। এক ভাষা। সংস্কৃতির মধ্যে কত মিল। বাস্তবে কী দুঃসহ দূরত্ব সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশের সংগীত কম সমৃদ্ধ নয়। শুধু লোকগীতি নয়, আধুনিক গানেরও বাজার হতে পারত ভারতের বাংলাভাষী রাজ্যগুলোতে। কিন্তু তা হতে পারেনি। আমাদেরই উদ্যোগের অভাব এ জন্য কম দায়ী নয়। ভারতের অসহযোগিতা তো আছেই। আমরা কতটা উদ্যোগী হয়েছি, সেটাও দেখতে হবে। আমাদের কোনো সরকারই কি ভারতে (অন্তত সাত রাজ্যে) বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রসারের কোনো বড় পদক্ষেপ নিয়েছে? একটা উদাহরণ কেউ দেখাতে পারবে?
স্বাধীনতার পর থেকে এসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। কখনো কোনো সরকার এগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা মনে করেনি। যতটা মনে করেছে ফারাক্কা, তিন বিঘা করিডর বা হালের টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে। নিঃসন্দেহে এগুলো অনেক বড় সমস্যা। কিন্তু মিডিয়া, চলচ্চিত্র, প্রকাশনা, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ-ভারত অসম পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বা বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে কোনো সরকারই এগিয়ে আসেনি।
অনেকে বলতে পারে, শুধু ভারতে কেন? অন্য দেশে নয় কেন? বাজেট থাকলে পৃথিবীর সব দেশেই তা করা যেতে পারে। তবে সব দেশের লোক বাংলাদেশের বই বা গান সম্পর্কে আগ্রহী হবে, এমন দাবি করা যাবে না। পাকিস্তান, সৌদি আরব বা সুইডেনের মানুষ কি আগ্রহী হবে? কাজেই ভাষা ও সংস্কৃতির নৈকট্য বেশি বলে ভারতের সাত রাজ্যে চাহিদা হতে পারে। সে জন্যই ভারতের প্রসঙ্গ বারবার আসছে।
এই পটভূমিতে সরকারের কাছে, বিশেষ করে সংস্কৃতি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আমার প্রস্তাব: প্রতিবছর পালাক্রমে কলকাতা, শিলিগুড়ি ও আগরতলায় সপ্তাহব্যাপী ‘বাংলাদেশ উত্সবের’ আয়োজন করা হোক। এতে থাকবে বাংলাদেশের বই, পত্রপত্রিকা, আমদানিযোগ্য পণ্যসমাগ্রী, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, প্রতি সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অডিও সিডির স্টল, কলকাতার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রতি সন্ধ্যায় নির্বাচিত একটি টিভি অনুষ্ঠান, পর্যটন তথ্যকেন্দ্র ইত্যাদি। আমার আশা, সরকার উদ্যোগী হলে এ কাজে বেসরকারি উদ্যক্তাদের সহায়তা পাওয়া যাবে। তবে দেখতে হবে, সরকার যেন পেশাদারী দৃষ্টিকোণ থেকে সব আয়োজন করে। এসব ক্ষেত্রে কোনো দলীয় বা গোষ্ঠীপ্রীতি যেন সরকারকে প্রভাবিত করতে না পারে। যদি একটানা পাঁচ বছর এ রকম ‘বাংলাদেশ উত্সবের’ আয়োজন করা সম্ভব হয়, তাহলে আমাদের প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রকাশনা ও পণ্যসামগ্রীর একটা চাহিদা সৃষ্টি হতে পারে।
তবে সবকিছুর আগে দরকার পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো দেখার বাধা দূর করা। এ ব্যাপারে এক্ষুনি জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। এফবিসিসিআই এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিলে ভালো হয়। কারণ টিভি চ্যানেল দেখা গেলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। শিল্প-সংস্কৃতির প্রচার তো আছেই। ব্যবসার সম্ভাবনাও কিন্তু কম নয়। একদা ‘বিটিভির’ প্রিয় মুখ আনিসুল হক এখন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। তিনি এর গুরুত্ব যথাযথ অনুধাবন করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। কাজেই তাঁর নেতৃত্বে এই জটটা খোলার চেষ্টা করা যেতে পারে। আশা করি, কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশন এ ব্যাপারে দাপ্তরিক সহায়তা দেবে। ২০০৯ সাল শেষ হওয়ার আগেই আমরা কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখাতে চাই—এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্যোগী হতে অনুরোধ করছি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
No comments