অর্থনীতি-মধ্যবিত্তের নিকাশ এবং আর্থিক আচরণ by আবু আহমেদ
আমাকে এক সাংবাদিক ঈদের আগে জিজ্ঞাসা করেছিল, মধ্যবিত্ত কারা। আমি বলেছিলাম, যারা নিজের ছোট্ট বাড়িতে থাকে অথবা দু-তিন বেডের ভাড়াবাড়িতে থাকে, নিজের একটা ছোট্ট গাড়ি আছে, ছেলেমেয়েদের মোটামুটি ভালো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যমের স্কুলেই পড়ায় বা পড়িয়েছে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে দু-একজন বড় হয়ে মা-বাবার সংসারে সাহায্য করা শুরু করেছে। বিদেশে বেড়াতে যেতে পারে না। তবে স্বদেশে বেড়ায়, আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেয় এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে দমন করে রাখতে শিখেছে।
এবার সাংবাদিক প্রশ্ন করল, তাহলে আপনার দৃষ্টিতে উচ্চমধ্যবিত্ত কারা। আমি বললাম, ওরা—যারা পারিবারিক খরচের ক্ষেত্রে পরোয়া করে না, একাধিক গাড়ি ব্যবহার করে, ছেলেমেয়েদের উচ্চমূল্যের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ায়, স্কুলের গণ্ডি পার হলে তাদের পুরো খরচায় বিদেশে পাঠিয়ে দেয়, নিজেকে নিরাপদ করার জন্য নানাবিধ স্কিমের আশ্রয় নেয়, রাজনীতি না করলেও রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্ট থাকে, দান-খয়রাতও করে এবং সুযোগ পেলে সম্পদের একটা অংশ বাইরেও নিয়ে যায়।
এবার সে বলল, উচ্চমধ্যবিত্ত ও ধনীদের মধ্যে পার্থক্য কী। আমি বললাম, পার্থক্য নেই, থাকলেও সামান্য, যে শতকোটি টাকার মালিক তাঁকে তুমি ধনী বলতে পার, আর যে এর অর্ধেকের মালিক তাঁকেও তুমি ধনী বলতে পার, আর যে এদের কাতারে শামিল হওয়ার জন্য সদা পেরেশান, তাঁকে তুমি উচ্চ-মধ্যবিত্ত বলতে পার। এবার তার প্রশ্ন, এরা কি কেউ গ্রামে থাকে? আমি বললাম, এদের কেউ কেউ গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, তবে থাকে না। এদের সন্তানদের সেই সম্পর্কও একদিন টুটে যাবে। তখন তারা হবে গ্লোবাল সিটিজেন বা বিশ্বনাগরিক। সেটা আবার কী? সেটা হলো আয়-রোজগার করবে এরা বাংলাদেশে কিন্তু ব্যয় এবং গচ্ছিত রাখবে বিদেশে, বিশেষ করে যেখানে তাদের সন্তানেরা লেখাপড়া করেছে বা চাকরি করছে। তাদের পাসপোর্ট থাকবে একাধিক, এদের জন্য ভিসার দরকার হবে না, অর্থ এদের বিশ্বনাগরিক বানিয়ে দিয়েছে।
এবার তার প্রশ্ন, বাংলাদেশ থেকে তো আয়কে বাইরে নেওয়া যায় না, তাহলে আপনি যে বলছেন ওরা অর্থ বানায় বাংলাদেশে, আর জমা করছে অন্য দেশে, এটা কী করে সম্ভব। আমি বললাম, এখনো তুমি অনেক জুনিয়র, বাঁকা পথে চিন্তা করতে শেখোনি, তাই এই প্রশ্ন করছ। ধানমন্ডি-গুলশানের আদি মালিকদের হাতে কি তাঁদের প্লটগুলো আছে? নেই, তাঁরা অতি উচ্চমূল্যে ডেভেলপার বা অন্যদের কাছে বেচে দিয়েছেন। আসল মালিকদের অনেকে এখন প্রয়াত। দু-চারজন এখনো বেঁচে থাকলে অর্থকড়ি বিদেশে রেখে শুধু নিজেই বাংলাদেশে পড়ে আছেন। অন্যদের অনেকে আবার যাওয়া-আসার মধ্যে আছেন। জিজ্ঞেস করলে বলবে, দেশের কাজে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন দুই মাস। এঁদের ছেলেমেয়ে বা স্ত্রীও যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। তাহলে এঁদের অর্থকড়ি কীভাবে বাংলাদেশে থাকবে! এঁদের সম্পত্তি বিক্রির অর্থ কি বিদেশে নিতে কোনো অসুবিধা হয়েছে? বিদেশি মুদ্রায় যত খুশি অর্থকে বিদেশে নিতে বাধা আছে, তবে যাঁদের অর্থ আছে, তাঁরা ঠিকই নিতে সক্ষম হচ্ছেন। বাংলাদেশে এখন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দ্রুত বিকাশ ঘটছে, তাদের কেউ কেউ গত এক দশকে উচ্চবিত্তে পা দিয়েছে। আর তাদের অনেকে পুরো পরিবারকে বিদেশে রেখে তাদের ভাষায় মানসম্পন্ন লেখাপড়া এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। এবার সে প্রশ্ন করল, তাহলে উচ্চবিত্তের লোকেরা কি দেশের ক্ষতি করছে? আমি বললাম, না, তুমি তাদের স্বাধীনতা দিয়েছ আর তারা ভোগের সেই অধিকারকে ব্যবহার করে তাদের আয়কে নিজেদের মতো করে ব্যয় করছে, সে ব্যয় আবার তোমার-আমার কাছে খারাপ লাগবে।
উচ্চমধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণীর এই আচরণ শুধু বাংলাদেশে নয়, অন্য দেশেও এমনটা ঘটছে। নাইজেরিয়ার দরিদ্র লোকেরা দেশপ্রেমিক। নাইজেরিয়ার তেলের অর্থ কোথায় যাচ্ছে, এই নিয়ে তারা প্রতিবাদ করে। কিন্তু ওদের ধনিক শ্রেণীরা কালো ইংলিশম্যান। লন্ডনের রাস্তায় যে কালো শৌখিন লোকদের পাইপ টানতে দেখবে, ওদের মধ্যে অনেক নাইজেরীয় আছে। ওদের ধনী করছে তেলের পাচার করা অর্থ। এখন ওরা নিজেদের গ্লোবাল সিটিজেন ভাবে। অনেক পাকিস্তানিরও একই অবস্থা। তাদের মধ্যে যারা বিদেশে আছে, তারা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। এক. বিদেশি ধনী পাকিস্তানি, দুই. বিদেশি খেটে খাওয়া পাকিস্তানি। স্বদেশি ধনিক শ্রেণীর পাকিস্তানিরা স্বদেশে ব্যবসা ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বটে। তবে অবস্থা খারাপ দেখলে বিদেশে নিরাপদ স্বর্গগুলোতে আবার আশ্রয় নেয়। অনেক বাংলাদেশিও দেখবে, মাসের পর মাস যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়বহুল শহরে আছে, তারা কোনো কাজ করে না, তাদের আয়ের উত্স কী? এই প্রশ্নের জবাব যুক্তরাষ্ট্রের সরকারও কোনো দিন তাদের জিজ্ঞেস করেনি, বাংলাদেশ সরকারও করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার জিজ্ঞেস করেনি, কারণ বিদেশিরা অবাধে অর্থ ব্যয় করলে লাভ তাদেরই। আর বাংলাদেশ জিজ্ঞেস করেনি, কারণ বাংলাদেশ অক্ষম।
বিশ্বে যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাচ্ছে প্রতিবছর, এর পুরোটা বিনিয়োগ নয়। একটা বিরাট অংশ হলো কথিত অর্থ পাচার। এই তো সেদিন পর্যন্ত সুইস ব্যাংকগুলো ছিল বিশ্ব চোরদের জন্য নিরাপদ প্রতিষ্ঠান। শুধু যুক্তরাষ্ট্র তাদের কতিপয় লোকের ট্যাক্স ফাঁকি দেখার জন্য সুইস ব্যাংককে বলেছে তোমরা তোমাদের গোপনীয়তা উন্মুক্ত করো, তখন তারা রাজি হয়েছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান-নাইজেরিয়া এমন একটা অনুরোধ করলে বলত, এটা করতে গেলে সুইজারল্যান্ডের কোর্টের আদেশ লাগবে। সুতরাং চোর ধরা অতো সহজ নয়। কোনো কোনো দেশ বিদেশে ঘুষ দেওয়ার বিপক্ষে আইন করেছে। কিন্তু তাতে কি বিদেশি কোম্পানিগুলোর ঘুষ দেওয়া বন্ধ হয়েছে? ছোট ঘুষখোরেরা ঘুষের টাকায় ঈদে কেনাকাটা করে বটে, কিন্তু বড় ঘুষখোরেরা ওই ব্যয়কে ব্যয়ই মনে করে না, তারা ঘুষের অর্থ বিদেশে পাচার করে। কী পরিমাণ অর্থ দরিদ্র দেশগুলো থেকে শুধু সন্তানদের লেখাপড়ার নামে পাচার হয়েছে, সেটা বোঝা যেত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সরকারগুলো যদি গত দুই দশকের ওই সব বিদেশি ছাত্রের ব্যাংক হিসাবগুলো পরীক্ষা করতে দিত।
এবার সে প্রশ্ন করল, তাহলে উচ্চমধ্যবিত্তের উত্থান কি অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয়। আমি বললাম, অবশ্যই প্রয়োজনীয়। ওদের উত্থান না ঘটলে উদ্যোক্তা শ্রেণীর বিকাশ ঘটবে না, আর উদ্যোক্তা শ্রেণী উদ্যোগ না নিলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসবে না। অর্থনীতিতে গতি না এলে তুমি যে অপেক্ষাকৃত গরিব লোকদের জন্য হা-হুতাশ করছ; ওদেরও কোনো উপকার করা যাবে না। আর সরকারের মাধ্যমে উদ্যোগের কথা বলছ? সেই অর্থ কে দেবে? নিশ্চয়ই ট্যাক্সদাতারা। তোমার অর্থনীতিতে উচ্চমধ্যবিত্ত আর ধনিক শ্রেণীর যদি বিকাশ না ঘটে তাহলে ট্যাক্স দেবে কারা? আরেকটি কথা মনে রেখো, সরকার দিয়ে সব কাজ করাতে নেই, সব কাজ করাতে গেলে ব্যয়টা অনেক বেশি হবে। এই যে ঘুষের কথা বলছ, ওরই উত্স তো সেই সরকারি কেনাকাটা। ঘুষ-দুর্নীতি—এগুলোকে কমিয়ে রাখার জন্য প্রায় সব দেশেই প্রতিরোধ কমিশন আছে। তোমার দেশেও আছে, তবে কাজে করছে কি না, তা নিয়েও একটা রিপোর্ট করতে পারো।
এবার তার প্রশ্ন, তাহলে দেশের অর্থ দেশে রাখার উপায় কী? বললাম, পূর্ণ প্রতিরোধক কোনো উপায় নেই। রাখা না-রাখাকে মানুষের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিতে হবে। অর্থনীতিশাস্ত্র বলে, যে অর্থনীতিতে মুনাফা বেশি, সেই অর্থনীতিতে পুঁজি ও বিনিয়োগ প্রবাহিত হয়; সেই অর্থে বাংলাদেশের পুঁজি বাংলাদেশেই থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে না। ঘটবে না যদি অন্যান্য উপাদান পক্ষে না থাকে। সেই সব উপাদান হলো—আয়কে বাইরে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধগুলো আরও উদারীকরণ করা, দেশের মধ্যে একটা নিরাপত্তার আবহ তৈরি করা, বিচারব্যবস্থা নিরপেক্ষকরণ ইত্যাদি। তোমার-আমার জাতি যদি নিত্য যুদ্ধে লিপ্ত থাকে, তাহলে ধনিক শ্রেণী অন্যভাবে তাদের নিরাপত্তা খুঁজবে। এই যে দেখছ না, যেসব দেশ বিভিন্ন কারণে বিরূপ অবস্থার মধ্যে আছে, ওই সব দেশে কি ব্যাপক বিনিয়োগ হচ্ছে? যুদ্ধের মধ্যে যে দু-একটা বিনিয়োগ হচ্ছে, কিন্তু সেই বিনিয়োগের মূল্য কত? সেই জন্য বলছিলাম, একটা শান্তিময় পরিবেশ তোমার দেশের অর্থকে তোমার দেশে রাখার জন্য একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। অর্থনীতি খারাপ হলে দরিদ্র লোকদের সংখ্যা আরও বাড়বে। সে অবস্থায় হতাশাও বাড়বে।
আর সেই বাংলাদেশের কথা একবার চিন্তা করে দেখো। এমনিতেই এই দেশ এত লোক নিয়ে ভালো চলার কথা নয়। আর তুমি তো ঈদ উপলক্ষে ভোক্তাদের আচরণ নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য আমাকে প্রশ্নগুলো করেছ। ভোক্তা বেশি ভোগ করলে অর্থনীতি ভালো যাবে বলে তত্ত্ব বলে। দেখছ না, ওবামা আমেরিকান লোকদের আবার ভোক্তা বানানোর জন্য কত প্রণোদনা প্যাকেজ দিচ্ছেন! আর ভোক্তারাও আসবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত থেকে। এক দশক আগে ঢাকার জুতার বাজারে উচ্চমূল্যের জুতা পাওয়া যেত না। দোকানিরা মনে করত, লোকদের কেনার সামর্থ্য নেই। আর এখন মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দামি পণ্য কেনার জন্য। তবে এগুলো অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments