ট্রাম্প গণতন্ত্রের অপূরণীয় ক্ষতি করে যাবেন by ইয়ান বুরুমা
আরেকটি ব্যাপার হলো, ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের দিক থেকে যা-ই হোন না কেন, জনপরিসরে তাঁরা সব সময়ই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মানুষ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানকেও অনেকটা পবিত্র গ্রন্থের মতো মর্যাদা দেওয়া হয়। এমনকি যারা ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারপন্থী, তাঁরাও সংবিধানকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে। ১৮৩০-এর দশকের শুরুর দিকে ফরাসি চিন্তাবিদ আলেক্সিস দ্য তোকভিল যুক্তরাষ্ট্র সফর করে দেখেছিলেন, খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধ দেশটির গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তিনি মনে করেছিলেন, এই ‘নাগরিক ধর্ম’ আমেরিকার অতিরিক্ত ভোগবাদী জীবনযাত্রার ভারসাম্য রক্ষা করে। আইন ও স্বাধীনতাকে ভিত্তি ধরে তৈরি রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি এই আস্থাই বিভিন্ন জাতির অভিবাসীদের একত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলেছিল।
আমেরিকার গণতন্ত্র বা রাজনৈতিক বিশ্বাস সব সময় সবার জন্য সমান ছিল না। ১৯৬০-এর দশকের আগে কৃষ্ণাঙ্গরা পুরোপুরি এর অংশ হতে পারেনি। এখনো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব আমেরিকার রাজনীতিতে শক্তিশালী। গৃহযুদ্ধে দক্ষিণের পরাজয় হলেও এই সমস্যার সমাধান হয়নি। ধর্মীয় কট্টরপন্থীরা কখনোই বিশ্বাস করেনি, ধর্ম ও রাষ্ট্র আলাদা থাকা উচিত। আর দরিদ্র মানুষের জন্য আইনের শাসন কেবল কাগজে-কলমেই আছে; কারণ তারা পর্যাপ্ত পয়সা খরচ করে ভালো আইনজীবী নিতে পারে না।
তবুও আমেরিকার গণতন্ত্র অনেক দিন ধরে এমনভাবে টিকে আছে যেন এটি এক ধরনের বিশ্বাসের (ধর্মের মতো) অংশ। খ্রিষ্টধর্মের অনেক ধারণা আমেরিকার রাজনীতিতে ঢুকে গেছে। যেমন, আমেরিকা মনে করে তাদের মূল্যবোধ (স্বাধীনতা, গণতন্ত্র) সব মানুষের জন্য এবং তারা সেসব মূল্যবোধ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চায়। পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সও একই কাজ করেছে, কারণ ফ্রান্স ও আমেরিকার গণতন্ত্র দুই বিপ্লব (ফরাসি বিপ্লব ও আমেরিকান বিপ্লব) থেকে এসেছে। আর এই বিপ্লব আলোকিত যুগের (এনলাইটমেন্ট) ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়াটা আমেরিকার গণতন্ত্রের ওপর মানুষের আস্থাকে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলবে। এটি হয়তো মার্কিন গণতন্ত্রকে ধ্বংসও করতে পারে।
অনেকে ট্রাম্পকে ফ্যাসিবাদী (স্বৈরাচারী শাসকের মতো) বলে থাকেন। তবে ফ্যাসিবাদ সাধারণত একটি সুস্পষ্ট মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে চলে; যা ট্রাম্পের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। তাঁর আশপাশের লোকজন (যাঁরা তাঁর উগ্র সমর্থক, যাঁরা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ান এবং সুযোগসন্ধানী) তাঁরা আদর্শগত দিক থেকে ঐক্যবদ্ধ নয়।
মুসোলিনি বা অন্যান্য ফ্যাসিবাদী শাসকের মতো তাঁরা শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থা চান না। বরং তাঁরা অনেক সরকারি কাঠামো ভেঙে ফেলতে চান।
ট্রাম্পই প্রথম আমেরিকান রাজনীতিবিদ নন যিনি শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের মনের অভিবাসনভীতি ও ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে অভিবাসী, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ এবং উদারপন্থী (লিবারেল) নেতাদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করেছেন। তবে অন্যদের চেয়ে তাঁর সবচেয়ে ব্যতিক্রমী দিক হলো—তিনি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকাশ্যেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্র বিচার ব্যবস্থা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং আইনের শাসন—এসব গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলেও ট্রাম্প এগুলোকে পাত্তা দেন না।
দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে প্রথম সপ্তাহেই তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করেছেন। কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই ফেডারেল বাজেট আটকে দিয়েছেন। জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার বাতিলের ঘোষণা দেন।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধান বিশেষজ্ঞ লরেন্স ট্রাইব একে ‘আইন ও সংবিধানের ওপর সরাসরি আক্রমণ’ বলে বর্ণনা করেছেন।
ট্রাম্প এমন কাজ করছেন যা আমেরিকার দীর্ঘদিনের শাসনব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করছে। এই শাসনব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হলেও এত দিন তা দেশকে এক সঙ্গে ধরে রেখেছিল। কিন্তু ট্রাম্প সেটি ধ্বংস করে এক নতুন বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন যেখানে একজন নেতার প্রতি অন্ধ আনুগত্য থাকতে হবে। জার্মানিতে একসময় একে ‘ফ্যুরারপ্রিন্সিপ’ বলা হতো, যার অর্থ হলো, শাসকই চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী এবং তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারবে না।
ট্রাম্পের কিছু সমর্থক মনে করেন, তিনি ঈশ্বরের মনোনীত একজন নেতা। এই ধরনের অন্ধ ভক্তি সাধারণত কঠোর একনায়কতন্ত্রে দেখা যায়, কিন্তু এর আগে কখনোই এটি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়নি।
১৯৩০-এর দশকে ‘নিউ ডিল’ কার্যকর করার সময় ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট প্রেসিডেন্ট পদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করেছিলেন। এটি তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীদের ক্ষুব্ধ করেছিল। তবুও তার অনেক সমর্থকের মতে এটি দেশের সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ছিল। সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান তখন বলেছিলেন, ‘একটা হালকা ধরনের একনায়কত্ব আমাদের কঠিন সময় পার হতে সাহায্য করবে।’
কিন্তু রুজভেল্ট তখনো আইন অমান্য করেননি। তিনি সংবিধানকে আঘাত করেননি বা বিদ্রোহ উসকে দেননি। তিনি তাঁর দলকে অন্ধ সমর্থনের ভিত্তিতে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মতো গড়ে তোলেননি।
কিন্তু ট্রাম্প এসব করছেন। হুমকি দিয়ে, চাপে রেখে এবং ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে তিনি রিপাবলিকান দলটিকে নিজের হাতের মুঠোয় এনেছেন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ এবং বিশ্ব রাজনীতিতে এর প্রভাব কী হবে, তা এখনই বলা কঠিন।
কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী বা মতবাদ তাদের প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পরও টিকে থাকে। কিন্তু ‘ট্রাম্পবাদ’ খুব বেশি দিন টিকে নাও থাকতে পারে। এর কারণ হলো, ট্রাম্পের রাগী ও আত্মকেন্দ্রিক আচরণ কোনো শক্তিশালী আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি যা দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক প্রভাব রাখতে পারে।
ট্রাম্পের অনেক সমর্থকই হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হতাশ হবে, কারণ তাঁর অনেক প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপ নেয়নি।
যদি শেয়ারবাজারে বড় ধস নামে, ডেমোক্রেটিক পার্টি শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে বা আদালত তাঁর স্বেচ্ছাচারিতার ওপর লাগাম দেয়, তাহলে তাঁর প্রভাব অনেকটাই কমে যেতে পারে।
তবে ট্রাম্পের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী না হলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে এমনভাবে ধ্বংস করে যেতে পারেন, যা হয়তো আর ঠিক করা যাবে না। যদি তা ঘটে, তাহলে তাঁর শাসনের ক্ষতিকর প্রভাব অনেক দিন ধরে রয়ে যাবে। ট্রাম্প নিজে হয়তো একসময় রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সরে যাবেন। কিন্তু তার রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ হয়তো বহু বছর পর্যন্ত দৃশ্যমান থেকে যাবে।
● ইয়ান বুরুমা প্রখ্যাত লেখক, সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
![]() |
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প |
No comments