মেধা পাচাররোধে ইউজিসি’র নতুন পরিকল্পনা by পিয়াস সরকার
টিএনই হচ্ছে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি রূপান্তরমূলক পদ্ধতি। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিদেশি কারিকুলামে দেশেই অধ্যয়ন করবেন। দেশের মেধা দেশেই থাকবে সেইসঙ্গে কাজে লাগবে উন্নত দেশের গুণগত মানের শিক্ষা। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষায় দেশের বাইরে যাওয়ার খরচ কমবে। বর্তমানে দেশে চলমান ক্রস বর্ডার হায়ার এডুকেশন (সিবিএইচই)’র মাধ্যমে দেশে-বিদেশে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, স্টাডি সেন্টার এবং ইন্সটিটিউটগুলোর সঙ্গে পার্টনারশিপে গিয়েছে। কিন্তু যথাযোগ্য সফলতা না আসায় টিএনই বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেয়ায় পরিকল্পনা চলছে।
টিএনই মূলত চারভাবে করা যেতে পারে বলে বলা হয়। প্রথমত, বিদেশের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দেশে নির্মাণ করা, বিদেশি ইন্সটিটিউশনের মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা, দেশে থেকেই বিদেশের কোর্স নিয়ে পড়ানো হবে যা পরিচালিত হবে দুই প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে, যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় এবং বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স ডেলিভারি এবং স্বীকৃতি প্রদান।
টিএনই বাস্তবায়ন হলে যেসব সুবিধা মিলবে। এরমাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সিলেবাস ও টিচিং মেথড। বিদেশে থাকার খরচ, যাতায়াত ও জীবনযাত্রার খরচ কমবে। ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যবসা প্রশাসন থেকে শুরু করে বিশেষায়িত খাত যেমন হসপিটালিটি এবং ফ্যাশন ডিজাইনের মতো বিষয়ে উচ্চমানের শিক্ষা মিলবে। দেশেই চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চশিক্ষিত ও যোগ্য লোক পাবে।
ইউজিসি প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষায় চাহিদা ও প্রাপ্তির মধ্যে বড় একটা ফারাক রয়েছে। ২০২২ সালের তথ্যানুসারে বাংলাদেশে ৫৩টি পাবলিক ও ১০৮টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এরপরও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ভালো প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ সরকার ক্রস বর্ডার হায়ার এডুকেশন (সিবিএইচই) পলিসি চালু করে ২০১৪ সালে। এই পলিসির মাধ্যমে বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দেশে ক্যাম্পাস, স্টাডি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে টিএনই পরিচালনা করছে কিন্তু তা দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থায়। উত্তীর্ণ হবার পরও বিপুল পরিমাণ শিক্ষিত বেকার তৈরি হচ্ছে। এসব কারণে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ভালো অবস্থানে যেতে পারছে না। আবার বিপুল পরিমাণ উচ্চ শিক্ষিত দেশে থাকলেও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো দেশের বাইরে থেকে লোক আনছে। এসব কারণে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১২ সালে ৫.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পায়। ২০১২ সালে দেশ থেকে ২১ হাজার ৯২৭ শিক্ষার্থী দেশের বাইরে যায়।
দেশে বর্তমানে দুটি টিএনই পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো হলো ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এবং দ্য এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওমেন। লোকাল সেন্টারগুলো এসিসিএ, সিআইএমএ এবং পিয়ারসন এডেক্সসেল পরিচালনা করছে। এই দূরবর্তী শিক্ষাকার্যক্রমগুলো মূলত ইউকে ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ইউকে, ইউএসএ, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় অধ্যয়ন করছে। বাংলাদেশে পড়তে আসছে নেপাল, মায়ানমার, ইন্ডিয়া এবং ভুটান থেকে। ২০১২ সালে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে পড়তে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১,৫৮৯ জন যা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়ায় ২৬০০ জনে।
এসব বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জের কথা বলা হচ্ছে। টিএনই প্রোগ্রামের যে খরচ অনেক শিক্ষার্থীই বহন করতে সক্ষম হবেন না। টিএনই অগ্রগতি ধরে রাখার জন্য গুণমান নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টিএনই দক্ষ আন্তর্জাতিক মানের লোক প্রস্তুতে কাজ করে। এরমাধ্যমে বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতি হয়। টিএনই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে সাউথ এশিয়ার মধ্যে একটি এডুকেশন হাব হিসেবে নাম কুঁড়াতে পারে।
কোভিড ১৯ পরবর্তী সময়ে বিদেশে শিক্ষার জন্য বাংলাদেশের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে ৫৩টি হলেও যথাযোগ্য শিক্ষাদানে ব্যহত হচ্ছে। একই সময়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে (১১০টি)। এরমধ্যে অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য কোলাবরেশন, ডুয়েল ডিগ্রির ব্যবস্থা, ফ্রাঞ্জাইজড প্রোগ্রাম চালু করেছে। তবে টিএনই দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি খরচ বহন করতে হবে। টিএনই অনেক সময় তার মূল প্রতিষ্ঠানের মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারছে না। টিএনই শিক্ষায় স্থানীয় সংস্কৃতি ধারণ করতে পারে না সেইসঙ্গে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের যোগসূত্র স্থাপনে ব্যর্থ হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে ৬০ শতাংশ জনসংখ্যার বয়স ৩০ এর নিচে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা উচ্চমানের শিক্ষার সুযোগ পাবে। চাকরির বাজারে এই শিক্ষার্থীরা ভালো সুযোগ পাবে, তারা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা দেশে বসেই অর্জন করতে পারবে। টিএনই বাস্তবায়নে ভর্তি সংক্রান্ত সময়ে গ্যাপটা পূরণ করতে হবে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিক পরিমাণ বৃত্তি ও আঞ্চলিকতা বিবেচনায় শিক্ষাব্যয় কমাতে হবে।
টিএনই নিয়ে একটি পরিকল্পনা এনেছে ইউজিসি। এটি করেন ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ, সহযোগিতায় ছিলেন ইউজিসি পরিচালক মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান ভুঁইয়া। এটি প্রস্তুত করেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মো. সাব্বির হোসাইন। তারা সম্প্রতি এই মডেলটির উল্লেখ শ্রীলঙ্কায় হয়ে যাওয়া একটি শিক্ষা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি পরিচালক মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে টিএনই গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা কমবে। যার ফলে মেধাবীদের প্রাপ্ত শিক্ষা দেশের উন্নয়নে কাজে আসবে। তিনি আরও বলেন, এর নানান ধরণের চ্যালেঞ্জ আছে। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশের উচ্চ শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন আসবে। উপকৃত হবে দেশ।
No comments