ভাসছে শেরপুর
জেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলা সদরের পানি কিছুটা নেমে গেলেও সদর ও নকলা উপজেলাসহ নিম্নাঞ্চলের অন্তত ২শ’ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন আবাদ, মাছের ঘের ও সবজি আবাদ। এদিকে পাহাড়ি ঢলের পানিতে ডুবে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও নকলায় বৃদ্ধ-নারীসহ ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলাসহ জেলার অন্তত ৪৭ হাজার হেক্টর আবাদি জমির আমন ধান ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া ১ হাজার হেক্টর জমির সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর মাছের ঘের তলিয়ে গেছে ২ হাজারেরও বেশি।
অন্যদিকে নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর বাঁধ ভেঙে ও নদীর পাড় উপচে পানি যাওয়ায় রামচন্দ্রকুড়া, কাকরকান্দি, নন্নী, পোড়াগাঁও, নয়াবিল, বাঘবেড়, কলসপাড়, মরিচপুরান, যোগানিয়া, রাজনগরসহ ১০টি ইউনিয়ন ও পৌর শহরের তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
ফসলের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে শেরপুর খামারবাড়ির উপ-পরিচালক ড. সুকল্প দাস বলেন, পাহাড়ি ঢলে ৩ উপজেলার আমন ধান ও সবজি আবাদ নষ্ট হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি কমবেশি নির্ভর করবে পানি নেমে যাওয়ার উপর। পানি পুরোপুরি নেমে গেলে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনার আওতায় আনার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে তালিকা পাঠানো হবে।
জেলার বন্যাকবলিত এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছে প্রশাসন। বন্যাকবলিত বেশ কিছু এলাকায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় রাতভর পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও উদ্ধারকাজ পরিচালনা করেন।
ঝিনাইগাতীর মহারশি নদীর ভেঙে যাওয়া বাঁধ পরিদর্শন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে মেরামতের আশ্বাস দিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, মহারশি নদীর বাঁধ উঁচু করার সুযোগ নেই। তবে ভাঙনকবলিত স্থান দ্রুত মেরামত করে দেয়া হবে।
বন্যা পরিস্থিতি ও সরকারি ত্রাণ বিতরণ সম্পর্কে শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান রোববার দুপুরে বলেন, অবিরাম বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে হাজারো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। ৩টি উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করছে। আমাদের সংগ্রহে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার রয়েছে। এখন পর্যন্ত ১০ হাজার শুকনো খাবার প্যাকেট পানিবন্দি পরিবারগুলোর মাঝে সরবরাহ করা হয়েছে। আরও ২৫ হাজার প্যাকেট ত্রাণের চাহিদা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পরবর্তীতে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।
ঝিনাইগাতী (শেরপুর) প্রতিনিধি: ঝিনাইগাতী উপজেলার উজানে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ভাটি এলাকায় বন্যার পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বৃহস্পতিবার রাতে ভারী বর্ষণ ও সীমান্তের ওপার থেকে মহারশি নদী দিয়ে পাহাড়ি ঢলে উপজেলার ৭টি ইউনিয়নই বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। মহারশি নদীর কুশাইকুড়া, রামেরকুড়া, খৈলকুড়াসহ বিভিন্ন স্থানে মহারশি নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে উপজেলা সদর কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। উপজেলা পরিষদ সহ বিভিন্ন অফিসে কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। অনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। হাজার হাজার একর আমন ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। শত শত পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বহু কাঁচা-পাকা রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশরাফুল আলম জানান বন্যার্তদের মাঝে ১২শ’ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ১৫ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এদিকে গতকাল বিকালে শেরপুর-৩ আসনের বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য মাহমুদুল হক রুবেল বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন।
ফুলপুর ও তারাকান্দায় পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষ
ফুলপুর ও তারাকান্দা প্রতিনিধি জানান, ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলায়ও বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। উপজেলার ছনধরা ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামে পানিবন্দি অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ। তাদের উদ্ধারে কাজ করছে স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বন্যার পানির কারণে ফুলপুর ও তারাকান্দা উপজেলায় ৪ হাজার ২৬০ হেক্টর আমন ধানের ক্ষেত নিমজ্জিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শেরপুরের নালিতাবাড়ী এলাকা থেকে মালিঝি নদী হয়ে ফুলপুরে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে চলা বৃষ্টির কারণে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নিচু এলাকায় পানি জমতে শুরু করে। গতকাল শনিবার রাতভর বৃষ্টিতে মানুষ পানিবন্দি হতে শুরু করে।
ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবিএম আরিফুল ইসলাম জানান, শেরপুরের নালিতাবাড়ী এলাকা থেকে পানি নেমে উপজেলার ছন্দরা ইউনিয়ন পুরোটা প্লাবিত হয়েছে। উদ্ধার কার্যক্রম সকাল থেকে চলছে। স্থানীয় নৌকা ও স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকশ’ মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া হয়েছে। ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। অন্যান্য ইউনিয়নেও আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে। উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নেও জলাবদ্ধতা রয়েছে। তবে ছনধরায় সবচেয়ে বেশি। রোববার সকালের হিসাবে ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে, তবে এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
এদিকে তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা, কাকনী, তারাকান্দা, ঢাকুয়া ইউনিয়নে জলাবদ্ধতা সবচেয়ে বেশি। তারাকান্দা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অরুনিমা কাঞ্চি সুপ্রভা শাওন বলেন, জলাবদ্ধতায় ৬০০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ৫৬০ হেক্টর ধান ও ৪০ হেক্টর শীতকালীন আগাম সবজি। দু-তিন দিনের মধ্যে পানি নেমে গেলে কৃষকের তেমন ক্ষতি হবে না। তারাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজনীন সুলতানা বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত মোটামুটি ভালো রয়েছি। বৃষ্টি বাড়লে এখানকার পরিস্থিতিও খারাপের আশঙ্কা রয়েছে।
No comments