১৩ বছরে শিল্পকলায় লাকীর থাবা by মারুফ কিবরিয়া

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে একটানা ১৩ বছর দায়িত্ব পালন করেন বিশিষ্ট অভিনেতা ও সংগীতজ্ঞ লিয়াকত আলী লাকী। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ডিজি পদে নিয়োগ পেয়েই শিল্পকলাকে অনিয়মের কারখানায় পরিণত করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। ঘুষ লেনদেন, ভুয়া বিল-ভাউচারের নামে টাকা আত্মসাৎ, নিয়োগে অনিয়মসহ এন্তার অভিযোগ লাকীর বিরুদ্ধে। সেখানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন তিনি। দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পচর্চার জায়গাটিকে নিজের খেয়ালখুশিমতো পরিচালনা করা ও দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধানে নেমেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)ও। এরইমধ্যে দীর্ঘ আড়াই বছর অনুসন্ধান শেষে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ এনে একটি মামলা করে সংস্থাটি।

উত্তীর্ণ না হওয়া প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে ১০টি পদে নিয়োগ দিয়ে সরকারের ৮ কোটি টাকার বেশি অর্থ ক্ষতিসাধনের মামলায় লাকীকে আসামি করা হয়। মামলায় তিনি ছাড়াও আসামি করা হয়েছে আরও ২৩ জনকে। গতকাল দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থাটির উপ-পরিচালক সুমিত্রা সেন বাদী হয়ে মামলাটি করেন।  বিকালে সংস্থাটির মহাপরিচালক আক্তার হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন- পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরী, কালচারাল অফিসার আল মামুন, মো. হামিদুর রহমান, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, হাসান মাহমুদ, বেগম রুনা লায়লা মাহমুদ, সহকারী পরিচালক (বাজেট ও প্ল্যানিং) বেগম সামিরা আহমেদ, স্টেজ ম্যানেজার বেগম রহিমা খাতুন, গাইড লেকচারার মো. মাহাবুবুর রহমান, ইনস্ট্রাকটর (সংগীত ও যন্ত্র) বেগম মীন আরা পারভীন, ইনস্ট্রাকটর (নৃত্য) প্রিয়াংকা সাহা, যন্ত্রশিল্পী (গ্রেড-৩) নারায়ণ দেব লিটন, যন্ত্রশিল্পী (গ্রেড-৩) মোহাম্মদ জিয়াউল আবেদীন, নৃত্যশিল্পী (গ্রেড-৩) বেগম লায়লা ইয়াসমিন, বেগম মিফতাহল বিনতে মাসুক ও বেগম সুমাইতাহ তাবাসসুম ধানম, কণ্ঠশিল্পী বেগম রোকসানা আক্তার রূপসা, আবদুল্লাহেল রাফি তালুকদার, মো. সোহানুর রহমান, বেগম আবিদা রহমান সেতু, বেগম মোহনা খাস এবং  ক্যামেরাম্যান (জনসংযোগ) মো. রুবেল মিয়া।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, শিল্পকলা একাডেমির নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার নম্বরপত্রে অসৎ উদ্দেশ্যে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে জাল জালিয়াতি ও প্রতারণার উদ্দেশ্যে অনুত্তীর্ণ প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষার নম্বরপত্রে নম্বর বাড়িয়ে অবৈধভাবে ১০টি পদে ২৩ জন প্রার্থীকে নিয়োগ প্রদান করেছেন। পরে লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ প্রার্থীদের উত্তীর্ণ করে বিভিন্ন পদে যোগদান করে তাদের বেতনভাতা বাবদ সরকারি তহবিল থেকে ৮ কোটি ২৮ লাখ ৪৯৫ টাকা উত্তোলন করে সরকারকে আর্থিক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ৪০৯, ৪২০, ৪৬৮, ৪৭১, ১০৯ ও ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
ভুয়া বিলে শতকোটি টাকা আত্মসাৎ: লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে শুধু নিয়োগ দুর্নীতিরই অভিযোগ নয়, দুদকের টেবিলে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে বিভিন্ন বিল-ভাউচারের নামে টাকা আত্মসাতের তথ্যও। সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ৩০শে জুন ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে ৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন তিনি। ২০২০-২১ অর্থবছরের ৩০শে জুন বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখিয়ে ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। তাকে এ কাজে সহায়তা করেন তার সিন্ডিকেটের সদস্য কালচারাল অফিসার সহকারী পরিচালক (হিসাব) আল হেলাল ও উপপরিচালক (অর্থ) শফিকুল ইসলাম। ২০২১ সালে ৩০শে জুন আটজন কালচার অফিসারকে জেলায় বদলি করেছিল মন্ত্রণালয়। শিল্পকল্পার ডিজি প্রায় ৩ কোটি টাকা খরচ করে তাদের বদলির আদেশ বাতিল করান। এরপর এসব কর্মকর্তাকে নিয়ে মিটিং করে অনুষ্ঠান দেখিয়ে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। তিনি বিভিন্ন জেলার কালচার অফিসারদের ঢাকায় এনে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে টাকা আত্মসাতের পথ সুগম করেন।
সূত্র আরও জানায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী হয়নি। কিন্তু ১২-১৫ কোটি বাজেট আত্মসাতের জন্য ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠান করে কাগজপত্র বানানো হয়। যারা চারুকলার কাজ বোঝেন, তাদের এ কাজের সঙ্গে রাখা হয়নি। তিনি নিজের পছন্দের লোক দিয়ে চারুকলা প্রদর্শনীর জোট করেন। ২০২০-২১ অর্থবছরের শিল্পকলা একাডেমির ৩৫ কোটি টাকা আত্মসাতের ব্যবস্থা করেন। তিনি একাডেমির সচিবকে ২০২১ সালের জুন মাসে সরিয়ে দিয়ে অন্য একজনকে সচিবের দায়িত্ব দেন। পরে প্রতি বছর জুন মাসে ২৫-৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এসব টাকার ভাগ তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা পেয়ে থাকতেন।
সূত্র জানায়, ২০২১ সালের ৩০শে জুন শিল্পকলা একাডেমির আগের সচিব নওশাদ হোসেন বদলি হলে ওইদিনই নতুন আদেশ জারি করে একাডেমির চুক্তিভিত্তিক পরিচালক সৈয়দা মাহবুবা করিমকে সচিবের দায়িত্ব দেন লাকী। এরপর ৩০শে জুন থেকে ১৯শে জুলাই পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ২৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া লাকীর বিরুদ্ধে সংগীত বিভাগের কক্ষে ব্যবহারের জন্য পর্দা, ক্রোকারিজ ও আসবাবপত্র না কিনে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ বরাদ্দ, ডান্স অ্যাগেইনস্ট করোনা কর্মসূচির আওতায় নৃত্যদলের সম্মানী, হার্ডডিস্ক ক্রয়, ডকুমেন্টেশন, প্রপস-কস্টিউম, প্রচার ও বিবিধ খরচ দেখিয়ে শতকোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, শিল্পকলার সাবেক ডিজি লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। এগুলো অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। তিনি ডিজি থাকাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার ছিল। সে কারণে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অনুসন্ধানের গতিও থেমে থাকে। তবে ৫ই আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর এই অনুসন্ধান নিয়ে কেউ আর বাধা দেয়নি।
সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ৫ই জানুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে শিল্পকলার ঢাকা কার্যালয়ে বরাদ্দকৃত বাজেট ও ব্যয়সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র সংবলিত নথিপত্রের ফটোকপি এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে অব্যয়িত ৩৫ কোটি টাকা ২০২১ সালের ৩০ জুনে ব্যয়করণসংক্রান্ত রেকর্ডপত্র তলব করা হয়েছিল। এ ছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠান আয়োজন সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের ফটোকপি, ২০১৯-২০২০ অর্থবছর থেকে ৩১শে ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত ব্যয়সংক্রান্ত বিভিন্ন ভাউচার-ক্যাশ বই এবং শিল্পকলা একাডেমি নামীয় সোনালী ব্যাংক (সেগুনবাগিচা শাখা) অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্টের কপি চাওয়া হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতেও একইভাবে নথিপত্র তলব করা হয়। তবে ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর ধীরে ধীরে তথ্য আসা শুরু হয়েছে। ফলে একটি মামলা খুব দ্রুতই করতে পেরেছে দুদক।
অনুসন্ধান চলছে পাচারেরও: শিল্পকলার ডিজি থাকাকালীন সময়ে নানা অনিয়মের মাধ্যমে শতকোটি টাকার অবৈধভাবে মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে লাকীর বিরুদ্ধে। এসব টাকার বেশির ভাগই বিদেশে পাচার করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধান সূত্র জানিয়েছে।  সূত্র জানায়, সাবেক ডিজি লাকীর অর্থ পাচারের বিষয়ে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া দুদকও এসব নিজস্ব কৌশলে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে।
মামলা ও অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় লাকীর সঙ্গে। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
লিয়াকত আলী লাকী ২০১১ সালের ৭ই এপ্রিল শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান। ২০২৩ সালের ২৯শে মার্চ সপ্তমবারের মতো তার মেয়াদ বাড়ানো হয়। এতে টানা একযুগেরও বেশি সময় শিল্পকলার ডিজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৯ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শিল্পকলার ডিজির পদ থেকে সরে দাঁড়ান লাকী। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.