‘আমরা সঙ্কটে’: বন উজাড়ের কড়া মূল্য দিতে হচ্ছে আফগানিস্তানকে by আগনিজকা পিকুলিকা-উইলজেউস্কা
কাবুলে জ্বালানি কাঠ বিক্রির দোকান |
লাস্ট আপডেট- ১০ জুলাই ২০১৯: ভোট ছয়টার সময় স্ট্যান্ডে পৌঁছায় কাবুলের ৬০ বছর বয়সী কাঠ ব্যবসায়ী
আসেফ। কঠোর পরিশ্রম আর কড়া রোদে চামড়া কুচকে গেছে তার। চার সদস্যের
পরিবারের ভারণপোষণের জন্য বিগত ১৮ বছর ধরে সপ্তাহে সাত দিন, দিনে ১৩ ঘন্টা
করে কাজ করে আসছে সে।
মওসুমের উপর ভিত্তি করে এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ পর পর এক ট্রাক করে কাঠ
কেনে আসেফ। এরপর সেগুলোকে ছোট ছোট টুকরা করে স্থানীয় কাঠের বাজারে বিক্রি
করে।
কোন শিক্ষা না থাকায় তার আর কোন বিকল্প নেই।
এ বছর ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে তার।
আসেফ আল জাজিরাকে বললেন, “আমাদের বিক্রি কমে গেছে। একটা কারণ হলো বসন্ত।
তবে আসল কারণ হলো যারা রুটি তৈরির জন্য আগে কাঠ ব্যবহার করতো, তারা এখন
গ্যাসের ব্যবহার শুরু করেছে, কারণ গ্যাস অনেক পরিস্কার। মানুষ এখন গ্যাসের
দিকে ঝুঁকছে”।
কাছের একটা বাড়িতে একদল তরুণ ছোট একটা গ্যাস কেটল জ্বালিয়ে মাদুরে বসে
শিশা টানছে। রাশিয়ান সাহিত্যের ২৮ বছর বয়সী ছাত্র আলীশাহ আরমান এবং তার
সঙ্গীরা তাদের ঘরগুলোকে গরম রাখতে, বিশেষ করে শীতের সময় আসেফের কাছ থেকে
কাঠ কিনে থাকেন।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে আলীশাহ বললেন, “এক কেজি গ্যাসের দাম ৬০ আফগানি (৭৪
সেন্ট)। সাত কেজি কাঠ ব্যবহার করে ২৪ ঘন্টা ঘর গরম রাখতে পারি আমরা। আর এক
কেজি গ্যাস দিয়ে ঘর গরম রাখা যায় দুই থেকে তিন ঘন্টা”।
“গ্যাস ব্যয়বহুল হওয়ায় আমরা প্রায়ই কাঠ ব্যবহার করি। আমরা জানি এতে
পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। এই মুহূর্তে… ঘর ততটা গরম রাখার দরকার নেই, তাই অল্প
পরিমাণে গ্যাস ব্যবহার করছি আমরা। গ্যাস বিক্রেতাদের সরকার যদি ভর্তুকি
দেয়, তাহলে আমরা খুবই খুশি হবো”।
কিন্তু পরিস্কার জ্বালানির জন্য সরকারের সহায়তার ব্যাপারটি সুদূরের স্বপ্ন মাত্র।
দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানে জ্বালানির উৎস হিসেবে কাঠ ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বহু বছর ধরে এর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। বন উজার হওয়ার পাশাপাশি
দুষণের কারণে বছর অন্তত ৩০০০ মানুষ মারা যাচ্ছে।
কাঠ দেশটির মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে একটি। বিগত কয়েক দশকে,
এটার দুষ্প্রাপ্যতা ক্রমেই বাড়ছে। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময় মুজাহিদিন
যোদ্ধারা দেশের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে আশ্রয় নিতো। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটা
সময় বনাঞ্চলে বোমা ফেলতে শুরু করে।
বহু বছরের যুদ্ধ ও লড়াইয়ের কারণে বনাঞ্চলের উপর মারাত্মক নেতিবাচক
প্রভাব পড়েছে। বহু বন ধ্বংস হয়ে গেছে। আর যুদ্ধে লড়াইরত আফগান কর্তৃপক্ষ
কখনই বনায়ানকে অগ্রাধিকারের দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ পায়নি।
এদিকে, ২০১৩ সাল নাগাদ আফগানিস্তানের অন্তত অর্ধেক বনাঞ্চল উজার হয়ে গেছে।
কাঠের ব্যবসা লাভজনক ব্যবসা হয়ে উঠেছে।
বিক্রির জন্য কাঠ চেলাই করছে এক আফগান |
পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে স্থানীয় অধিবাসী ও সশস্ত্র গ্রুপগুলো
অবৈধভাবে কাঠ কাটছে আর এরপর সেগুলোকে প্রতিবেশী পাকিস্তানে বিক্রি করছে।
দারিদ্র, আয়ের বিকল্প উৎসের অভাব, এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারে সচেতনতার অভাবের কারণে অবৈধ ব্যবসা বেড়ে গেছে।
পুনর্বনায়ন প্রকল্প
পাকতিয়া ও পাকতিকা প্রদেশে সরকার ৮.২ মিলিয়ন পাইন গাছ লাগিয়েছে এবং
স্থানীয় প্রবীণদের সাথে নিয়ে তারা সাধারণ মানুষদের শিক্ষিত করার চেষ্টা
করছে। জনসাধারণকে বন থেকে সুবিধা নেয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। যেমন, কাঠ না
কেটে, সেগুলোর ফল ফলাদি ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হচ্ছে।
কিন্তু বন উজারের সমস্যাটি আফগানিস্তানের অনেকগুলো পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের
মধ্যে একটি মাত্র সমস্যা। তাদের অন্য বড় সমস্যাগুলো হলো খরা ও বন্যা, যেটা
পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আরও ভয়াবহ হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে পানির সঙ্কট ও দেশের
প্রাকৃতিক সম্পদের অব্যবস্থাপনা।
আফগানিস্তানে জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশানের (এফএও)
প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রাজেন্দ্র আরিয়াল। তিনি আল জাজিরাকে
বললেন, “এই সবগুলো সমস্যাই একটা আরেকটার সাথে জড়িত। পরিবেশ বিপর্যয় এবং
জমির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে জমিগুলো উষর হয়ে যাচ্ছে। আর অব্যাহত
সঙ্ঘাতের কারণে বহু উন্নয়ন সংস্থা এখানে কাজ করতে পারছে না, যার মধ্যে
জাতিসংঘও রয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য কোন প্রকল্প নিয়ে
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় তারা যেতে পারছে না, কারণ সেখানে নিরাপত্তা সঙ্কট খুবই
মারাত্মক”।
জ্বালানি সাশ্রয়ী হিটিং ও রান্নার প্রযুক্তি সরবরাহের জন্য সহায়তা
দিচ্ছে এফএও। এর মধ্যে রয়েছে তান্দুর – যেটাতে কম কাঠ লাগে, এবং সৌর-চালিত
চুলা। স্থানীয়রা যাতে তাদের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারে, সে জন্য
এগুলো সরবরাহ করা হচ্ছে। একই সাথে পেস্তা বাদামের বন তৈরির জন্য কাজ করছেন
তারা, যেটা উচ্চমূল্যের শস্য। পাশাপাশি বায়োগ্যাস ডাইজেস্টার স্থাপন করছেন
তারা, যেটা দিয়ে পশুর মলকে রান্নার গ্যাসে রূপান্তরিত করা যায়।
আরিয়াল বলেন, “আমরা সমন্বিত চিন্তা থেকে প্রকল্পগুলো ডিজাইন করছি।
শুধুমাত্র সেচের জন্য, শুধু তৃণভূমি বিস্তার, খাদ্যের মজুদ বাড়ানো বা শুধু
বিপর্যয় মোকাবেলার ব্যাপারে কোন প্রকল্প আমরা নিচ্ছি না। বরং আমরা এই
সবগুলোর বিষয় বিবেচনা করে এমন প্রকল্প ডিজাইন করছি যেটা একাধিক প্রয়োজন
পূরণ করবে”।
অস্বাভাবিক হলেও আফগানিস্তানের বনসম্পদ রক্ষায় সরকারের পদক্ষেপকে সমর্থন
দিয়েছে তালেবানরা। যদিও এমনটাও শোনা গেছে যে, এই গ্রুপটি অবৈধ কাঠের
ব্যবসার মাধ্যমে মুনাফা লুটছে।
২০১৭ সালে তালেবানরা ঘোষণা দেয়া যে, বৃক্ষরোপণ একটা ইসলামি বাধ্যবাধকতা
এবং আফগানিস্তানের জনগণের প্রতি তারা জোর আহ্বান জানান যাতে তারা একটি বা
একাধিক ফলের গাছ বা অন্যান্য গাছ লাগান, যাতে জমির সৌন্দর্য বৃদ্ধির সাথে
সাথে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সৃষ্টি থেকে উপকার পাওয়া যায়।
কিন্তু আফগানিস্তানের বনসম্পদ রক্ষায় আফগান সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টাও যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না।
পরিবেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হুসাইনি বলেন, “এক দশকেও জালালাবাদ ও অন্যান্য
এলাকাতে আমরা সুন্দর বন পাবো না। স্থানীয় অধিবাসীরা প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস
করে ফেলছে, যাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুটি নিয়ে কোন সচেতনতা নেই”।
“পরিবেশ বিপর্যয় আফগানিস্তানকে বদলে দিয়েছে এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে
মানুষের জ্ঞান খুবই সামান্য। তারা শুধু জানে যে, তারা গাছ কেটে পাকিস্তানের
কাছে বিক্রি করতে পারবে। কারণ স্থানীয় মানুষ গাছ লাগানোর জন্য সময় দিতে
রাজি নয়। আমরা একটা সঙ্কটে আছি”।
কাবুলের পুর-ই-সুরখ এলাকায় কাঠের দোকানে বসে আছেন বিক্রেতা আসেফ |
No comments