স্মৃতিতে একাত্তর by সৈয়দ দিদার বখত
স্বাধীনতার
সুবর্ণজয়ন্তী সমাগত। নানা অধ্যায়ে বিভক্ত মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপঞ্জি।
মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে গর্জে উঠেছিল বাংলার কৃষক, শ্রমিকসহ আপামর
মুক্তিকামী জনতা। পঁচিশে মার্চের ক্র্যাকডাউন, গেরিলা যুদ্ধ, ঘটনাবহুল
একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই দিনগুলো ওঠে এসেছে সিনিয়র সাংবাদিক ও সাবেক
তথ্য প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ দীদার বখ্তের লেখায়। আজ পড়ুন প্রথম কিস্তি-
মার্চ মাস বাংলাদেশের জন্য রক্তে রঞ্জিত বিভীষিকার মাস। ৭১ এর মার্চ মাসে, অধিকার আদায়ের আন্দোলন, পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা, নৃশংস খুন, মানুষের হাহাকার, ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে গৃহহারা হয়ে যাযাবর জীবন যাপন, সশস্ত্র পাক সিপাহিদের ধাওয়া, নির্বিচারে গুলি, গণহত্যা, অত্যাচার, নির্যাতনের এক অনির্বচনীয় মাস হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
১লা মার্চ ১৯৭১, ঢাকা স্টেডিয়ামে বৃটিশ-পাকিস্তানের জমজমাট ক্রিকেট খেলা চলছে। আমরা সদলবলে খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে গেছি।
খেলার মাঝখানেই খবর এলো তদানিন্তন পাকিস্তানের চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করেছেন। জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। ৩রা মার্চ ইয়াহিয়া খান সংসদ ডেকেছেন। স্বাভাবিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হবেন প্রধানমন্ত্রী। সবকিছু ভণ্ডুল করে দিয়ে জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন ইয়াহিয়া খান।
১লা মার্চের এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা স্টেডিয়ামে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা ঘটলো। কানায় কানায় পরিপূর্ণ স্টেডিয়াম মানুষের রণহুংকারে গর্জে উঠল। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল ঢাকা স্টেডিয়াম। বাঙালির অত্যন্ত প্রিয় খেলা ক্রিকেট। সেই খেলা সঙ্গে সঙ্গেই ভণ্ডুল হয়ে গেল। হাজার হাজার মানুষ তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে রাস্তায় নেমে এলো। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক হোটেল পূর্বাণীতে নেতৃবৃন্দদের নিয়ে মিটিংয়ে বসলেন। মিটিং চলাকালে হাজার হাজার মানুষ মিছিলসহকারে সেখানে উপস্থিত হয়। এই সব মিছিলের মুখ্য স্লোগান ছিল “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। মিটিং এর পর বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন আগামী ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তিনি জনসভায় সিদ্ধান্ত জানাবেন।
ইতিমধ্যে ছাত্রদের নেতৃত্বে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশের ম্যাপ অঙ্কিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলো। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এর ঢেউ লাগলো। নতুন আঙ্গিকে স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপ নিলো।
এর পর পর মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহ্বান জানান। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছাত্র জনতার এক বিশাল জনসভায়ও স্বাধীনতার ঘোষণার সনদ সহ ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার শপথ করলো।
এদিকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো দাবি করলেন পূর্ব পাকিস্তানে যেমন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ তেমন পশ্চিম পাকিস্তানে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তিনিও প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার। বিকল্প পথ হিসেবে ক্ষমতার ভাগাভাগির প্রস্তাব করলেন তিনি। মোট কথা, রাজনৈতিক মীমাংসার সকল পথ রুদ্ধ করে দেশকে এক ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিলেন ভুট্টো সাহেব। দেশের এই টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে সমগ্র দেশবাসী উদগ্রীব হয়ে রইল ৭ই মার্চ রেসকোর্স জনসভার দিকে।
আমি রোজকার মতো সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’ অফিসে যাই। স্বনামধন্য কবি, সিকানদার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’-এ আমি কাজ করি। দেশের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক সকলেই সমকাল অফিসে কবি সিকানদার আবু জাফরের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। ৭ই মার্চের সকালে তদানিন্তন দৈনিক পাকিস্তানে কবি সিকানদার আবু জাফরের বুদ্ধিজীবী মহলের চূড়ান্ত অভিব্যক্ত “বাংলা ছাড়ো” কবিতা ছাপা হলো। সাংবাদিক, সাহিত্যিক হাসান হাফিজুর রহমান পরম সাহসিকতার পরিচয় দিলেন পত্রিকায় এই কবিতাটি ছেপে।
সকালে বঙ্গবন্ধু এই কবিতাটি পড়েছিলেন। তার অন্যতম বন্ধু সিকানদার আবু জাফরকে টেলিফোনে জানিয়েছিলেন যে তার আর কোনো সংশয় নেই যে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহল তার পাশে আছে। বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা সকল বুদ্ধিজীবী মহলে এক নতুন উদ্যম উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে ৭ই মার্চের সকালে এই কবিতাটি ছাপা হওয়ার কারণে বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হলো।
সকালে যথারীতি সমকাল অফিসে গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সুসাহিত্যিক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সমকালে আসলেন। দুজনে নানা বিষয় নিয়ে বিশেষ করে দেশের ভয়াবহ অবস্থা নিয়ে আলোচনা করলাম। তারপর একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রেসকোর্স ময়দানে এসে উপস্থিত হলাম।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহিত্যাঙ্গনে এক দিক পাল এবং “আলোকিত মানুষ” সৃষ্টির অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে আজ বাংলাদেশে বিবেচিত।
আমরা দুজন রেসকোর্স ময়দানে এসে সভাস্থলে মঞ্চের ঠিক নিচেই বসলাম। হাজার হাজার মানুষ স্লোগানে স্লোগানে উজ্জীবিত হয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে জমায়েত হতে থাকল। স্লোগানের মুখ্য বক্তব্য “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। রেসকোর্স ময়দান লক্ষ লক্ষ মানুষে কানায় কানায় পরিপূর্ণ বিস্ফোরণোন্মুখ মানুষের মাঝে একটাই আকাঙ্ক্ষা “দেশের স্বাধীনতা”।
৭ই মার্চের ভাষণ সকলেই জানেন। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে কয়েকটি বিষয় যেমন: ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর’, এটা সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক বলেই আমার কাছে মনে হয়েছিল। দ্বিতীয়: ‘অসহযোগ আন্দোলনের ডাক’। তৃতীয়: “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম”। এটা চূড়ান্ত স্বাধীনতার ডাক বলে আমার মনে আর কোনো দ্বিধা ছিল না।
এই মিটিংয়ের পর সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। একটি ক্ষমতা হস্তান্তর কর অথবা সশস্ত্র যুদ্ধ। সমস্ত মাস জুড়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর প্রতিদিন খবরের কাগজ জুড়ে প্রকাশিত হতে থাকল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙ্গে পড়তে শুরু করল। আমিও আমার স্ত্রী পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে ঢাকা থেকে খুলনায় আসলাম। সেখানেও একই অবস্থা। মিটিং মিছিল, গুম, খুন, পুলিশি হামলা, মিলিটারি নির্যাতন মিলিয়ে অশান্ত পরিবেশ।
২৫শে মার্চের কাল রাত্রি বর্বর পাক বাহিনী সশস্ত্র হামলা করলো রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। হাজার হাজার সেপাই নিহতের খবর মুখে মুখে প্রচারিত হলো। ঢাকার ইতিহাসে বর্বরোচিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর পরই খুলনা শহরের বুকে সংঘটিত হলো আরেক হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস।
রাত্রি আনুমানিক ১১টা। খুলনার সাউথ মেট্রাল রোডের বাসিন্দা মহাদেব চক্রবর্তী, আমার সহপাঠী বিমল এর বাবা ও এক ভাইসহ আরো কয়েক জনকে রাত্রে কারফিউর মধ্যে ধরে নিয়ে গেল দেখলাম। রাত্রি ১২টার সময় হাজী মহসিন রোডের চৌরাস্তায় গুলি করে ওদের মেরে রাস্তায় ফেলে রাখল। কারফিউর মধ্যে কেউ বেরুতে সাহস করল না। সকালে কারফিউ বিরতির সঙ্গে সঙ্গে লোকজন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করলো। হাজার হাজার বাসিন্দা দেখতে এসে ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে টাউন ছেড়ে গ্রাম অভিমুখে যেতে শুরু করলো।
রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে আমিও টাউনে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে স্ত্রী ছেলে এবং সদ্যোজাত মেয়েকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বহু কষ্টে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলাম। পরদিন সকালে সম্ভবত ২৯শে মার্চ তালায় গেলাম। ঐ দিন সর্বদলীয় নেতাদের নিয়ে মিটিংয়ে যোগ দিলাম।
মিটিংয়ে দেশের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হলো। মিটিংয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি করা হলো। সর্বসম্মতিতে সেদিন আমাকেই এই সংগ্রাম কমিটির অধিনায়ক করা হলো। প্রদীপ মজুমদারকে সহ-অধিনায়ক করা হলো। সৈয়দ কামেল বখতকে সশস্ত্র যুদ্ধের অধিনায়ক করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হলো। মিটিং শেষে আমরা মিছিল করে তালার ডাক বাংলোতে আসলাম। ডাক বাংলোতে তখন পাকিস্তানি ফ্লাগ উড়ছিল। ঐ ফ্লাগ নামিয়ে আমরা পুড়িয়ে ফেল্লাম। সৈয়দ ঈসা নিজ হাতে পাকিস্তানি ফ্লাগ পোড়ালো। হাজার হাজার জনগণের সামনে বর্বর পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস তুলে ধরে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিলাম আমরা। সঙ্গে সঙ্গে সদ্য নির্মিত বাংলাদেশের ম্যাপখচিত পতাকা ডাক বাংলোতে উড়ান হলো। আমি ও সহ-অধিনায়ক প্রদীপ মজুমদার অন্য সকলকে সঙ্গে নিয়ে এই পতাকা তুলে ধরলাম। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের এই নিভৃত পল্লীতেও শুরু হলো স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের সূচনা।
এই যুদ্ধের পথ ধরে দীর্ঘ নয়টি মাস কি দুরূহ দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হয়েছে এবং গ্রামাঞ্চলের মানুষ কিভাবে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে তার ইতিহাস যেমন বীরত্বব্যঞ্জক তেমনি মর্মান্তিক। এই যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হয়েছেন আমার ছোট সহোদর শহীদ কামেল বখত এবং বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনার শহীদ বেদার বখত, সহযোদ্ধা শংকর, আজীজ, সুশীল, বক্কর, আবুলসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা। গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে ধূলিসাৎ করেছে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। অবশেষে জয়ী হয়েছে মুক্তিকামী মানুষ। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জয়ী অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা তোমরা স্মরণীয় বরণীয়। তোমরা আমাদের সকল কাজের অনুপ্রেরণা, তোমরা যুগ যুগ জিয়ো। জয়গানে মুখরিত হোক মুক্তিকামী মানুষের।
>>>সৈয়দ দিদার বখত, কলাম লেখক
মার্চ মাস বাংলাদেশের জন্য রক্তে রঞ্জিত বিভীষিকার মাস। ৭১ এর মার্চ মাসে, অধিকার আদায়ের আন্দোলন, পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা, নৃশংস খুন, মানুষের হাহাকার, ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে গৃহহারা হয়ে যাযাবর জীবন যাপন, সশস্ত্র পাক সিপাহিদের ধাওয়া, নির্বিচারে গুলি, গণহত্যা, অত্যাচার, নির্যাতনের এক অনির্বচনীয় মাস হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
১লা মার্চ ১৯৭১, ঢাকা স্টেডিয়ামে বৃটিশ-পাকিস্তানের জমজমাট ক্রিকেট খেলা চলছে। আমরা সদলবলে খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে গেছি।
খেলার মাঝখানেই খবর এলো তদানিন্তন পাকিস্তানের চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করেছেন। জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। ৩রা মার্চ ইয়াহিয়া খান সংসদ ডেকেছেন। স্বাভাবিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হবেন প্রধানমন্ত্রী। সবকিছু ভণ্ডুল করে দিয়ে জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন ইয়াহিয়া খান।
১লা মার্চের এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা স্টেডিয়ামে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা ঘটলো। কানায় কানায় পরিপূর্ণ স্টেডিয়াম মানুষের রণহুংকারে গর্জে উঠল। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল ঢাকা স্টেডিয়াম। বাঙালির অত্যন্ত প্রিয় খেলা ক্রিকেট। সেই খেলা সঙ্গে সঙ্গেই ভণ্ডুল হয়ে গেল। হাজার হাজার মানুষ তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে রাস্তায় নেমে এলো। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক হোটেল পূর্বাণীতে নেতৃবৃন্দদের নিয়ে মিটিংয়ে বসলেন। মিটিং চলাকালে হাজার হাজার মানুষ মিছিলসহকারে সেখানে উপস্থিত হয়। এই সব মিছিলের মুখ্য স্লোগান ছিল “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। মিটিং এর পর বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন আগামী ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তিনি জনসভায় সিদ্ধান্ত জানাবেন।
ইতিমধ্যে ছাত্রদের নেতৃত্বে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশের ম্যাপ অঙ্কিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলো। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এর ঢেউ লাগলো। নতুন আঙ্গিকে স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপ নিলো।
এর পর পর মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহ্বান জানান। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছাত্র জনতার এক বিশাল জনসভায়ও স্বাধীনতার ঘোষণার সনদ সহ ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার শপথ করলো।
এদিকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো দাবি করলেন পূর্ব পাকিস্তানে যেমন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ তেমন পশ্চিম পাকিস্তানে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তিনিও প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার। বিকল্প পথ হিসেবে ক্ষমতার ভাগাভাগির প্রস্তাব করলেন তিনি। মোট কথা, রাজনৈতিক মীমাংসার সকল পথ রুদ্ধ করে দেশকে এক ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিলেন ভুট্টো সাহেব। দেশের এই টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে সমগ্র দেশবাসী উদগ্রীব হয়ে রইল ৭ই মার্চ রেসকোর্স জনসভার দিকে।
আমি রোজকার মতো সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’ অফিসে যাই। স্বনামধন্য কবি, সিকানদার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’-এ আমি কাজ করি। দেশের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক সকলেই সমকাল অফিসে কবি সিকানদার আবু জাফরের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। ৭ই মার্চের সকালে তদানিন্তন দৈনিক পাকিস্তানে কবি সিকানদার আবু জাফরের বুদ্ধিজীবী মহলের চূড়ান্ত অভিব্যক্ত “বাংলা ছাড়ো” কবিতা ছাপা হলো। সাংবাদিক, সাহিত্যিক হাসান হাফিজুর রহমান পরম সাহসিকতার পরিচয় দিলেন পত্রিকায় এই কবিতাটি ছেপে।
সকালে বঙ্গবন্ধু এই কবিতাটি পড়েছিলেন। তার অন্যতম বন্ধু সিকানদার আবু জাফরকে টেলিফোনে জানিয়েছিলেন যে তার আর কোনো সংশয় নেই যে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহল তার পাশে আছে। বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা সকল বুদ্ধিজীবী মহলে এক নতুন উদ্যম উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে ৭ই মার্চের সকালে এই কবিতাটি ছাপা হওয়ার কারণে বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হলো।
সকালে যথারীতি সমকাল অফিসে গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সুসাহিত্যিক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সমকালে আসলেন। দুজনে নানা বিষয় নিয়ে বিশেষ করে দেশের ভয়াবহ অবস্থা নিয়ে আলোচনা করলাম। তারপর একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রেসকোর্স ময়দানে এসে উপস্থিত হলাম।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহিত্যাঙ্গনে এক দিক পাল এবং “আলোকিত মানুষ” সৃষ্টির অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে আজ বাংলাদেশে বিবেচিত।
আমরা দুজন রেসকোর্স ময়দানে এসে সভাস্থলে মঞ্চের ঠিক নিচেই বসলাম। হাজার হাজার মানুষ স্লোগানে স্লোগানে উজ্জীবিত হয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে জমায়েত হতে থাকল। স্লোগানের মুখ্য বক্তব্য “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। রেসকোর্স ময়দান লক্ষ লক্ষ মানুষে কানায় কানায় পরিপূর্ণ বিস্ফোরণোন্মুখ মানুষের মাঝে একটাই আকাঙ্ক্ষা “দেশের স্বাধীনতা”।
৭ই মার্চের ভাষণ সকলেই জানেন। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে কয়েকটি বিষয় যেমন: ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর’, এটা সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক বলেই আমার কাছে মনে হয়েছিল। দ্বিতীয়: ‘অসহযোগ আন্দোলনের ডাক’। তৃতীয়: “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম”। এটা চূড়ান্ত স্বাধীনতার ডাক বলে আমার মনে আর কোনো দ্বিধা ছিল না।
এই মিটিংয়ের পর সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। একটি ক্ষমতা হস্তান্তর কর অথবা সশস্ত্র যুদ্ধ। সমস্ত মাস জুড়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর প্রতিদিন খবরের কাগজ জুড়ে প্রকাশিত হতে থাকল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙ্গে পড়তে শুরু করল। আমিও আমার স্ত্রী পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে ঢাকা থেকে খুলনায় আসলাম। সেখানেও একই অবস্থা। মিটিং মিছিল, গুম, খুন, পুলিশি হামলা, মিলিটারি নির্যাতন মিলিয়ে অশান্ত পরিবেশ।
২৫শে মার্চের কাল রাত্রি বর্বর পাক বাহিনী সশস্ত্র হামলা করলো রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। হাজার হাজার সেপাই নিহতের খবর মুখে মুখে প্রচারিত হলো। ঢাকার ইতিহাসে বর্বরোচিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর পরই খুলনা শহরের বুকে সংঘটিত হলো আরেক হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস।
রাত্রি আনুমানিক ১১টা। খুলনার সাউথ মেট্রাল রোডের বাসিন্দা মহাদেব চক্রবর্তী, আমার সহপাঠী বিমল এর বাবা ও এক ভাইসহ আরো কয়েক জনকে রাত্রে কারফিউর মধ্যে ধরে নিয়ে গেল দেখলাম। রাত্রি ১২টার সময় হাজী মহসিন রোডের চৌরাস্তায় গুলি করে ওদের মেরে রাস্তায় ফেলে রাখল। কারফিউর মধ্যে কেউ বেরুতে সাহস করল না। সকালে কারফিউ বিরতির সঙ্গে সঙ্গে লোকজন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করলো। হাজার হাজার বাসিন্দা দেখতে এসে ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে টাউন ছেড়ে গ্রাম অভিমুখে যেতে শুরু করলো।
রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে আমিও টাউনে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে স্ত্রী ছেলে এবং সদ্যোজাত মেয়েকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বহু কষ্টে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলাম। পরদিন সকালে সম্ভবত ২৯শে মার্চ তালায় গেলাম। ঐ দিন সর্বদলীয় নেতাদের নিয়ে মিটিংয়ে যোগ দিলাম।
মিটিংয়ে দেশের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হলো। মিটিংয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি করা হলো। সর্বসম্মতিতে সেদিন আমাকেই এই সংগ্রাম কমিটির অধিনায়ক করা হলো। প্রদীপ মজুমদারকে সহ-অধিনায়ক করা হলো। সৈয়দ কামেল বখতকে সশস্ত্র যুদ্ধের অধিনায়ক করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হলো। মিটিং শেষে আমরা মিছিল করে তালার ডাক বাংলোতে আসলাম। ডাক বাংলোতে তখন পাকিস্তানি ফ্লাগ উড়ছিল। ঐ ফ্লাগ নামিয়ে আমরা পুড়িয়ে ফেল্লাম। সৈয়দ ঈসা নিজ হাতে পাকিস্তানি ফ্লাগ পোড়ালো। হাজার হাজার জনগণের সামনে বর্বর পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস তুলে ধরে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিলাম আমরা। সঙ্গে সঙ্গে সদ্য নির্মিত বাংলাদেশের ম্যাপখচিত পতাকা ডাক বাংলোতে উড়ান হলো। আমি ও সহ-অধিনায়ক প্রদীপ মজুমদার অন্য সকলকে সঙ্গে নিয়ে এই পতাকা তুলে ধরলাম। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের এই নিভৃত পল্লীতেও শুরু হলো স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের সূচনা।
এই যুদ্ধের পথ ধরে দীর্ঘ নয়টি মাস কি দুরূহ দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হয়েছে এবং গ্রামাঞ্চলের মানুষ কিভাবে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে তার ইতিহাস যেমন বীরত্বব্যঞ্জক তেমনি মর্মান্তিক। এই যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হয়েছেন আমার ছোট সহোদর শহীদ কামেল বখত এবং বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনার শহীদ বেদার বখত, সহযোদ্ধা শংকর, আজীজ, সুশীল, বক্কর, আবুলসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা। গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে ধূলিসাৎ করেছে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। অবশেষে জয়ী হয়েছে মুক্তিকামী মানুষ। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জয়ী অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা তোমরা স্মরণীয় বরণীয়। তোমরা আমাদের সকল কাজের অনুপ্রেরণা, তোমরা যুগ যুগ জিয়ো। জয়গানে মুখরিত হোক মুক্তিকামী মানুষের।
>>>সৈয়দ দিদার বখত, কলাম লেখক
No comments