অপার রহস্যের মিথ মহানায়িকা সুচিত্রা সেন by পীর হাবিবুর রহমান
বাংলা
চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ষাট ও সত্তর দশকে অসাধারণ, অসামান্য সম্মোহনী শক্তির
রূপবতী রোমান্টিক নায়িকা সুচিত্রা সেন সম্রাজ্ঞীর মতো বিচরণ করে মহানায়িকার
খেতাব নিয়ে, এক অপার রহস্যময়ী মিথে পরিণত হয়ে ৮৩ বছর বয়সে চিরবিদায়
নিয়েছেন। জীবন্ত কিংবদন্তি এই নায়িকা একটু হাসলেই দর্শক মুগ্ধ হয়ে যেতেন।
ঘাড় বাঁকানো তাঁর দীর্ঘায়িত চোখাচাহনি দর্শকের হৃদয় দুলিয়ে দিত।
উপমহাদেশে যেখানে গায়ক-গায়িকারা অসুস্থ হয়ে শয্যা না নেওয়া পর্যন্ত গান গাইতে থাকেন, অবসরের কথা ভাবেন না, এমনকি ক্রিকেটাররা পর্যন্ত ফর্ম শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঠ থেকে বিদায় নেন না। আর রাজনীতিতে তো শয্যাশায়ী না হওয়া পর্যন্ত অবসরের কথা ভাবেনই না, সেখানে সুচিত্রা সেনই একমাত্র হলিউড কাঁপানো ‘গ্রেটা গার্বো’র মতো অপরূপ সৌন্দর্য, বিস্ময়কর অভিনয় প্রতিভা ও কোটি দর্শকের হৃদয়-মনে নায়িকার ইমেজ রেখে মৃত্যুর আগে ’৭৮ সাল থেকে সাড়ে তিন দশক লোকচক্ষুর অন্তরালে গিয়ে, নিজেকে মিথে পরিণত করতে পেরেছিলেন। তিনিও মা-মাসি, ঠাকুমা-দিদিমার চলচ্চিত্র থেকে মেঘা সিরিয়ালে এককথায় বড় পর্দা থেকে ছোট ছোট বাক্সে রোজ হাজিরা দিয়ে জীবনের ইতি টানতে পারতেন। কিন্তু তাতে আর দশজন সাধারণের মতোই তাঁকে বিদায় নিতে হতো। মানুষের এত কৌতূহল আকর্ষণ ও রহস্যের মনোজগতের মহানায়িকা হয়ে এত আলোচনার ঝড় তুলে বিদায় নিতে পারতেন না।
এখানে সুচিত্রা তাঁর কঠোর সাধনা বা যথাসময়ে যৌবনের জোয়ার থাকতে থাকতেই সবার সামনে দরজায় খিল তুলে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে গিয়ে নিজেকে বন্দী করে মিথের জন্ম দিতে পেরেছেন। সেলুলয়েডের জগতে সবাইকে নয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানব জগতকেও যথাসময়ে অবসর নিয়ে এবং স্বেচ্ছায় নির্বাসনের দরজার আড়ালে থেকে হারিয়ে গিয়েছেন। চলচ্চিত্রে থাকতে মহানায়িকা হয়ে যেমন সবার হৃদয়ের আকুলতা নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রভূমিতে ছিলেন, তেমনি সাড়ে তিন দশক লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে লাখো লাখো কৌতূহল প্রিয় মানুষের মনোজগতে ঝড় তুলেই গেছেন। অনন্ত কৌতূহল, অন্তহীন তৃষ্ণা, নানাবিধ বাস্তব-অবাস্তব-পরাবাস্তব, জল্পনা-কল্পনা তাঁকে ঘিরে একটি দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। মৃত্যুর পর মানুষের এই কৌতূহল বা রহস্যভেদ করার তৃষ্ণা নিবারণ দূরে থাক, তা আরও তীব্র করেছে। সবার উৎসুক মনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে আরও বেশি আড়াল রাখার জেদে জয়ী হয়েছেন মহানায়িকা সুচিত্রা।
লোকে যত তাঁকে একনজর দেখতে চেয়েছে, তিনি তত বেশি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। মৃত্যুর আগে যতবার নার্সিংহোমে গেছেন ফটোসাংবাদিকরা অষ্টপ্রহর জেগে থেকেও একটি ছবি আনতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত নিজের শর্ত মেনে কালো কাচে ঢাকা ভ্যানে কফিন বন্দী হয়ে শশ্মানে চিতা পর্যন্ত পৌঁছেছে তাঁর দেহ। তবুও তাঁর একটি ছবি তুলে রাখা বা একনজর দেখার সুযোগ হয়নি কারও।
১৯৯৫ সালে দক্ষিণ কলকাতার ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ছবি তুলতে গিয়েছিলেন সুচিত্রা। সেই ছবির পর দুই দশক বহির্বিশ্বকে আর কোনো ছবি দেখতে দেননি তিনি। ’৭৮ সালে চলচ্চিত্রকে বিদায় জানানোর ৩৪ বছর পরেও এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর প্রতি তুমুল আকর্ষণ, আবেগ ও কৌতূহলে ভাসিয়েছে পঞ্চাশোর্ধ বাঙালিদের।
সুচিত্রার বক্সঅফিস হিট করা সিনেমার স্মৃতি সিঁড়ি বেয়ে দর্শকরা ডুবেছেন অপ্রতিরোধ্য নস্টালজিয়ায়, তাদের তারুণ্যে তীব্র ভালো লাগাবোধ ভেজা ফুলের গন্ধে ভিজিয়ে দিয়েছে তাদের মন। সুচিত্রা জেনেছিলেন কোথায় থামতে হয়। তাই তিনি নায়িকা হিসেবে পর্দায় দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে, এই চরম সত্যটি উপলব্ধি করেই সচেতনভাবে বাইরের দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে নির্জনতায় ডুবেছিলেন। এতে তাঁর ভরা যৌবনের পরমাসুন্দরীর ইমেজের প্রেমে নিজেই যে জড়িয়ে পড়েছিলেন, সেটিই সত্য নয়, তাঁর লাখো কোটি ভক্তকেও সেই মায়াজালে আটকে দিয়েছিলেন। তিনি পর্দার বাইরে বাকি জীবন কাটিয়ে দিলে তার সেই চিরচেনা চিরসুন্দর রূপের মূর্তি ভেঙে যেমন খান খান হয়ে যেত, তেমনি এভাবে মিথেও পরিণত হতেন না।
স্বপ্নের রাজকন্যা মায়াবী ইন্দ্রজালে চিরবিদায় নিয়েছেন। জনতার স্রোতে এসে মিশে গিয়ে সাধারণের তালিকায় ঠাঁই হতে দেননি। এটিই তাঁর শক্তি। বিশ্লেষকদের মতে, তাঁর এই নিভৃতচারী জীবন বা একান্ত নির্জনতায় কাটানো একাকিত্বের শক্তির উৎস ছিল নিজের ব্যাংক-ব্যালেন্স। এককথায় তাঁর অভিনয়কালে শিল্পীর পারিশ্রমিক তেমন না থাকলেও মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের আর্থিক টানাপড়েন বা দৈন্য ছিল না। আর ছিল না বলেই তাঁকে অভিনয় করে খেতে হয়নি। তিনি তাঁর পুরনো বাড়ির জমিতে বহুতল নির্মাণ করে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন বলেই তাঁর দৃঢ় সংকল্পে জয়ী হয়ে ইতিহাসের চাকাকে পাল্টে দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনিই সুচিত্রা সেন। ভারতীয়দের সব রীতিনীতি ভেঙে দিয়ে, সব লোভ-মোহকে জয় করে মহাসংযমী আচরণে পর্দা থেকে বিদায় নিয়ে সবার জন্য কপাট বন্ধ করে মিথ হয়ে থেকে গেলেন।
বাংলা চলচ্চিত্রে চিরকালের জন্য যেন এক অবিস্মরণীয় বিস্ময়কর মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ আর ষাট দশকে বাংলা রোমান্টিক সিনেমাযুগকে স্বর্ণযুগে পৌঁছে দিয়েছিলেন উত্তম কুমারের সঙ্গে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের চিরসবুজ জুটি। বাংলা ভাষাভাষি সিনেমা দর্শকদের কাছে মহানায়ক উত্তম কুমার ও মহানায়িকা সুচিত্রা সেন যে ইমেজ দাঁড় করিয়ে গেছেন, যে গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা রেখে গেছেন তা আর কেউ যেমন ভাঙতে পারেননি, তেমনি আগামী শত বছরে ভাঙতে পারবেন বলে কেউ বিশ্বাস করেন না। লাখো কোটি দর্শকের হৃদয় জয় করা এমন চলচ্চিত্র জুুটি এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন যে, হাজার হাজার রমণী নানা বয়সের মহানায়ক উত্তম কুমারের প্রেমে পড়েছিলেন। ঠিক তেমনি লাখো লাখো পুরুষের হৃদয় জয় করে প্রেমে পাগল করেছিলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। একদল পুরুষ যেমন আইডল মনে করে, উত্তম কুমারের মতো পোশাক-আশাক এবং ধূমপান আয়ত্ত করেছিলেন, তেমনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অজ¯্র রমণী মহানায়িকা সুচিত্রাকে আইডল করে তার মতো শাড়ি পরেছেন। হাতাকাটা ব্লাউজ পরেছেন। চোখে কাজল টেনেছেন। চুলে কখনো বেণী বেঁধেছেন। কখনোবা খোঁপা বেঁধেছেন। ঘাড় বাঁকিয়ে রোমান্টিক চাহনি দিয়েছেন। এমন আবেদনময় শহুরে ভদ্র পুরুষের অবয়ব নিয়ে হৃদয় জয় করা উত্তমের মতো তারকা যেমন রুপালি পর্দায় আর আসেননি, তেমনি অন্যরকম সুন্দরী, স্মার্ট, জীবন্ত রোমান্টিক সুচিত্রা সেনেরও জন্ম হয়নি।
উত্তম-সুচিত্রা মানেই সিনেমা ছিল সুপারহিট। উত্তম সুচিত্রার রোমান্টিক যুগলকে রুপালি পর্দায়ই দর্শকরা লালন করেননি, পর্দার বাইরেও তাঁদের হৃদয়ঘটিত প্রণয় বা রসায়ন নিয়ে বিস্তর আলোচনা যুগের পর যুগ চলেছে। মৃত্যুর পরও উত্তম সুচিত্রা সম্পর্ক মিথ হয়ে এখনো সিনেমা দর্শকদের মাঝে আলোচনার জন্ম দেয় চায়ের টেবিলে।
সুপার স্টারদের কখনো কখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকতেই সময়কে টানতে হয়। সুচিত্রা সেনই জনপ্রিয়তার চূড়ায় যাওয়া সেই কিংবদন্তি নায়িকা, যিনি নিজের লাগাম টেনেই ধরেননি, অনন্ত যৌবনা ও তুমুল সম্মোহনী রূপের সৌন্দর্য দর্শক হৃদয়-মনের গভীরে গেঁথে দিয়ে নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে যত না আলোচনা, যত না প্রশংসা, যত না বিশ্লেষণ, তার চেয়ে বেশি মিথ হয়ে ঘুরে ফিরে আসছে যেন অনন্তকালের চিরযৌবনা রূপবতী সুচিত্রা সেনের মৃত্যু নেই।
মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে জনপ্রিয়তার স্বর্ণশিখরে যাওয়া মহানায়ক উত্তম কুমারেরও মৃত্যু নেই। তবে তাঁদের জীবন ঘিরে রয়েছে মানুষের মধ্যে, দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল, অন্তহীন তৃষ্ণা আর হাজারো প্রশ্ন। যেসব প্রশ্নের উত্তর কখনো মিলবে না। কেবল প্রশ্ন চলতেই থাকবে। কৌতূহলপ্রিয় মানুষের অজানাকে জানার আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠবে। এক জীবনে সুচিত্রা সেন সেই রহস্যের জন্ম দিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। তবুও বাংলা চলচ্চিত্রের কথা এলেই মহানায়ক উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেন। যেন তাঁদের আগে বা পরে কেউ নেই। তাঁরাই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম ও শেষ জনপ্রিয় রোমান্টিক জুটি।
উত্তম সুচিত্রা জুটির জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে একের পর এক বক্স অফিস হিট করছে, তখন দর্শকদের মাঝেও তুমুল আলোচনার ঝড়। দুই মহানায়ক-মহানায়িকার রসায়ন নিয়ে বিস্তর আলোচনা তুঙ্গে। প্রণয়ের পাঠ থেকে কেউ বলতে শুরু করেন যে, গোপনে তারা বিয়েও করে ফেলেছেন। দুজনের সংসারেও দাম্পত্যের ঝড়োহাওয়া উঠেছিল। আর বাইরে সুচিত্রা সেনকে উত্তম কুমার ছাড়া চলচ্চিত্র দর্শকরা ভাবতেই পারছিলেন না। তখন উত্তম-সুচিত্রাকে অনুকরণ করতে চায়নি, এমন প্রেমিক যুগল খুঁজে পাওয়া যায় না। যৌবনে কতজন হয়তো রিনা ব্রাউনের মতো প্রেমিকের বাইকে বসে চলে যেতে চেয়েছে ‘স্বপ্নপুরীর’ দেশে। রুপালি পর্দার মতো ব্যক্তিজীবনেও তাঁরা বিবাহিত। এমন ভাবনা যখন তুঙ্গে তখন আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছিল, একটি পোস্টার। সেটি ছিল অগ্নিপরীক্ষা চলচ্চিত্রের পোস্টার। যেখানে লেখা ছিল, ‘আমাদের প্রণয়ের সাক্ষী হলো অগ্নিপরীক্ষা’ তলায় সুচিত্রা সেনের স্বাক্ষর। ’৫৪ সালের সেই পোস্টার দেখে দর্শকরা চায়ের টেবিলে তুলেছিলেন তুমুল আলোচনার ঝড়। আর সেই পোস্টার দেখে সারা দিন কেঁদে ভাসিয়েছিলেন, উত্তম কুমারের স্ত্রী গৌরী দেবী। সেই আগুনের তাপ সুচিত্রা সেনের দাম্পত্য জীবনেও পড়েছিল। সুচিত্রা সেনের স্বামী দিবানাথ সেন সন্দেহ শুরু করতে করেন তাঁর স্ত্রীকে। এক পর্যায়ে অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন। বক্স অফিস তখন গরম উত্তম-সুচিত্রা সেনের জুটিতে। তখন তাদের ছয়টি ছবি সুপারহিট। আর দশটি ছবিতে তাঁরা চুক্তিবদ্ধ। ব্যক্তিত্বের দ্যুতি ছড়িয়ে যেদিন সুচিত্রা সেন তাঁর স্বামী দিবানাথ সেনকে বললেন, অভিনয় ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। এতে বাড়তে থাকে ঝগড়াঝাটি। দিবানাথের সন্দেহ তাঁকে পুড়িয়ে শেষ করতে থাকে। বেড়ে যায় তাঁর মদ্যপান। সুচিত্রাকে সিনেমা জগতের সবাই মিসেস সেন বলে ডাকলেও একমাত্র মহানায়ক উত্তম কুমার ডাকতেন রমা বলে। আর উত্তম কুমারকে মহানায়িকা সুচিত্রা ডাকতেন, ‘উতু’ বলে। সাংসারিক গোলমাল বাড়তে থাকায় মেয়ে মুনমুনকে সুচিত্রা পাঠিয়ে দেন দার্জিলিংয়ে কনভেন্টে পড়তে। সে সময় উত্তম কিংবা সুচিত্রার বাড়িতে উইকেন্ডে পার্টি চলত নিয়মিত। সেখানে সবার পরিবারের লোকজন ছাড়াও যোগ দিতেন ঘনিষ্ঠ পরিচালক রতœা চ্যাটার্জী ও অন্য বন্ধুরা।
১৯৫৭ সালে উত্তম কুমার হারানো সুর ছবিটি পরিচালনা করলেন। নায়িকা হতে বললেন, সুচিত্রা সেনকে। উত্তম যেখানে প্রযোজক সুচিত্রা সেখানে বললেন, ‘তোমার জন্য সব ছবির ডেট ক্যান্সেল করব। হলোও তাই। ব্যাপারটা পছন্দ হলো না দিবানাথ সেনের। এর মধ্যে একদিন সুচিত্রা সেনের বালিগঞ্জের বাসায় পার্টি ছিল। উত্তম কুমার ‘কালো কুর্তা বা ব্ল্যাক ডগ’ হুইসকি খুব ভালোবাসতেন। পার্টিতে তাই মদের আয়োজন বিশাল। সেই আসরে সুচিত্রার স্বামী দিবানাথই ছিলেন না, উত্তমের স্ত্রী গৌরী দেবীও ছিলেন। মধ্যরাতে মদের আসর যখন জমে উঠেছে, তখন কেউ বলে উঠলেন, এবার একটু নাচ হয়ে যাক। ব্যস! উঠে পড়লেন উত্তম-সুচিত্রা। হলো টুইস ডুয়েল নাচ। সিনেমার মতো করে উত্তম কুমার সুচিত্রার কোমরে হাত দিয়ে নাচছেন অন্তরঙ্গ হয়ে। কয়েক প্যাক পান করা দিবানাথ সেন আর মাথা ঠিক রাখতে পারলেন না। কোথায় থেকে একটা চুরি জোগাড় করে তাড়া করলেন উত্তম কুমারকে। পার্টি তখন প্রায় ল-ভ । সুচিত্রার বাড়ি অলিন্দে ছুটছেন উত্তম কুমার। পেছনে চুরি হাতে সুচিত্রার স্বামী! এক সময় উত্তম কুমারকে ধরে ফেললেন দিবানাথ সেন। হাতজোড় করে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কাতর প্রার্থনা করছেন উত্তম কুমার। আর রাগে ক্ষোভে জ্বলে দিবানাথ বলছেন, ‘উত্তম আই উইল কিল ইউ, আই উইল কিল ইউ।’ দুজনের মাঝখানে গিয়ে গৌরী দেবীই থামালেন। কোনো মতে দিবানাথ সেনকে নিরস্ত্র করলেন! আর উত্তম কুমার জানে রক্ষা পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে দ্রুত ছুটতে থাকলেন। থামলেন দুই কিলোমিটার দূরে হরিস মুখার্জী রোডে নিজের বাড়িতে গিয়ে। এই ঘটনায় দিবানাথের সঙ্গে সুচিত্রার দূরত্ব আরও যোজন যোজন বেড়ে গেল। দিবানাথ এবার বললেন, সুচিত্রা ছবি করতে পারবেন। তবে উত্তমের সঙ্গে নয়। সুচিত্রা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। দিবানাথের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছলে, চরম সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বামী, বালিগঞ্জের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন দক্ষিণ কলকাতার নিউ আলিপুরে। আলাদা থাকতে শুরু করলেন। এর কিছু দূরেই উত্তম কুমারের নতুন বাড়ি। সপরিবারে থাকবেন বলে বাড়িটি মনের মতো করে তৈরি করেছিলেন উত্তম। দুজনকে নিয়ে তখন গুজব ফ্লিম জগৎ ছেড়ে বাইরে এলো চরমে। বলাবলি শুরু হলো, এবার তাহলে উত্তম সুচিত্রাকে বিয়ে করবেন। আর দিবানাথকে ডিভোর্স সুচিত্রার জন্য সময়ের ব্যাপারমাত্র। গুজবের তাপ গৌরী দেবীর মনকেও অশান্ত অস্থির করে তুলল। উত্তম কুমার শুটিং থেকে গভীর রাতে ফিরলেই স্ত্রী গৌরী দেবী মনে করতেন, সুচিত্রার সঙ্গে সময় কাটিয়েই ফিরেছেন। বাবা-মায়ের দাম্পত্য এতকিছু বুঝত না উত্তম কুমারে ছেলে গৌতম। সুযোগ পেলেই সে চলে যেত রমা আন্টির কাছে। গৌতমকে নিজের সন্তানের মতো আদর করতেন সুচিত্রা। অনেক সময় এমন হয়েছে, মায়ের কাছে কিছু না পেয়ে গৌতম সোজা চলে যেত টালিগঞ্জে শুটিং স্পটে। আর সুচিত্রা হাসিমুখে তার আবদার মেটাতেন। ছুটিতে মুনমুন কলকাতায় এলে গৌতমসহ সুচিত্রা যেমন বেড়াতে যেতেন, তেমনি উত্তম কুমারও সময় পেলে মুনমুনকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। এতে গুঞ্জন-গুজব যেন সত্যে পরিণত হয়ে উঠল। সবাই বলাবলি করতে থাকলেন, উত্তম-সুচিত্রা গোপনে বিয়ে করেছেন। সুচিত্রার ডিভোর্স হলেই ঘটা করেই তা ঘোষণা করা হবে।
এদিকে গৌরী দেবীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে উত্তম কুমারের। উত্তম কুমারও তখন মদপানের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর গৌরীকে ছেড়ে সুখপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে জীবন কাটাতে শুরু করেছেন। এই অবস্থায় ’৮০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়ে কলকাতার ভ্যালভিউ ক্লিনিকে মারা যান উত্তম কুমার। আর তার আগেই আকস্মিকভাবে চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিয়ে নির্জনে চলে যান সুচিত্রা সেন। উত্তমের মৃত্যুতে শোকার্ত দর্শকহৃদয় যখন ভেঙে গেছে, তাঁর শবদেহ ঘিরে অশ্রু স্বজল স্বজনের ঘিরে ভিড় তখন সবার অপেক্ষা কখন আসবেন মহানায়িকা সুচিত্রা? অবশেষে মহানায়িকা সুচিত্রা যখন শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এলেন, তখন একের পর এক ক্যামেরার শার্টার ক্লিক হতে থাকল। কাকতালীয় হোক আর অন্য রহস্যজনক কারণেই হোক দুজনের ইতি ঘটেছে, কলকাতার ভ্যালভিউ হাসপাতালে। যার শুধু সময়ের ব্যবধানমাত্র ৩৪ বছরের।
সুচিত্রা সেনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনা, নানাবাড়িতে। আসল নাম রমাদাস গুপ্ত। পাবনা শহরের দিলালপুরে কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। ছিলেন পাবনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের মুহূর্তে কলকাতাতে চলে যান পরিবারের সঙ্গে। হয়ে যান সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। বিখ্যাত শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র ছাপাখানার মালিক দিবানাথ সেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের একমাত্র কন্যা মুনমুন সেন তৃণমূলের হয়ে লোকসভায় গেলেও চলচ্চিত্রে মায়ের ইমেজ ভাঙা দূরে থাক জনপ্রিয়তায় কাছাকাছিও যেতে পারেননি। সুচিত্রা সেনের চলচ্চিত্রে অভিষেক ’৫২ সালে। তাঁর প্রথম ছবির নামা ছিল ‘শেষ কোথায়’। কিন্তু সেটি মুক্তি পায়নি। মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবির নাম ‘সাত নম্বর’ কয়েদি। সেটি তাঁকে জনপ্রিয়তা দিতে পারেনি। কিন্তু ’৫৪ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির মধ্যে দিয়ে জনপ্রিয়তায় উঠে আসেন সুচিত্রা সেন। তাঁর অভিনীত বাংলা ছবির সংখ্যা অর্ধশতাধিক। উত্তম কুমার ছাড়াও সুচিত্রা বিকাশ রায়, বসন্ত চৌধুরী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং হিন্দিতে দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, ধর্মেন্দ্র ও সঞ্জীব কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। কিন্তু কালের যাত্রাপথে বাংলা চলচ্চিত্রে সুচিত্রা-উত্তম জুটিই ছিল সবচেয়ে রোমান্টিক ও জনপ্রিয়। একসাথে ৩০ ছবি করা রুপালি পর্দার এই জুটির আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা আর কেউ ভাঙতে পারেননি। সুচিত্রা হয়ে উঠেছিলেন কোটি কোটি তরুণের স্বপ্নের নারী। আর নারীদের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।
সুচিত্রা-উত্তম অভিনীত ছবির মধ্যে ‘অগ্নিপরীক্ষা, সবার উপরে, সাপমোচন, শিল্পী, পথে হলো দেরি, হারানো সুর, গৃহদাহ ও সাগরিকা’ অন্যতম। এসব ছবি দেখে দর্শকদের হৃদয় মনজুড়ে প্রেমের আগুনই জ্বলে ওঠেনি, সৌন্দর্যের পিপাসাও তীব্র হয়ে উঠেছিল। ‘সাগরিকা’ ছবিতে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে উত্তমের সিগারেট টানার দৃশ্য আপনা আপনি ধূমপায়ী পুরুষেরা অনুসরণ করেছিলেন। আর সুচিত্রা সেনের ‘দ্বীপ জ্বেলে যায়’ ছবি দেখতে দেখতে আপন মনে কাঁদেননি, এমন নারীদর্শক কমই ছিলেন।
উত্তম সুচিত্রার ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন, অভিনয় প্রতিভা, সংলাপ এবং ঠোঁট মেলানো গান সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। উত্তমের বিপরীতে সুপ্রিয়া দেবীর মতো সুন্দরী নায়িকারাও অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু দর্শক বাংলা ছবি বলতেই উত্তমের সঙ্গে নায়িকা হিসেবে যেমন সুচিত্রাকে চেয়েছিলেন, তেমনি সুচিত্রার সঙ্গে নায়কের আসনে উত্তম ছাড়া বিকল্প ভাবেননি। সুচিত্রা সেনের সর্বশেষ ছবির নাম প্রণয় পাশা। ’৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে তাঁর নায়ক ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর তিনি আর কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি। এক সময় অভিনয় ছেড়ে পর্দা ও লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান সুচিত্রা সেন। দীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি পর্দার অন্তরালে বাস করেন কন্যা মুনমুন সেন, নাতনি রায়মা ও রিয়া এবং নিকটাত্মীয় ছাড়া তাঁর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের নিজস্ব ফ্ল্যাটে আর কেউ দেখা করতে পারেননি। আকর্ষণীয় সৌন্দর্য কাহিনীর সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ার অসাধারণ নৈপুণ্য তাঁকে খ্যাতির শিখরে নিয়েছিল। তাঁর রূপ, ছাল-চলন পোশাক ও সাজসজ্জা বাঙালি নারীর ফ্যাশনেই পরিণত হয়নি, তিনিও হয়ে উঠেছিলেন শাশ্বত বাঙালি নারীর প্রতীকী রূপ। ২০১৪ সালে ১৭ জানুয়ারি তিনি অসংখ্য ভক্তকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান।
১৯৬৩ সালে ‘সাতপাকে বাঁধা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন ‘সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস’ জয় করেন। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান প্রদান করে। শোনা যায়, ২০০৫ সালে তাঁকে ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু জনসম্মুখে আসতে চান না বলে এ পুরস্কার গ্রহণ করতে চাননি। ২০১২ সালে তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘বঙ্গবিভূষণ’ প্রদান করা হয়। ২৫ বছরের অভিনয়জগতে নিজের রূপ-সৌন্দর্য ও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে রেখে এভাবে নিজেকে পর্দার আড়ালে গুটিয়ে নেওয়ায় তাঁকে নিয়ে যত মিথ চালু হয়। বলা হয়, সুচিত্রা সেনের কোনো বিকল্প নেই। তিনিই তাঁর বিকল্প। এমন মহানায়িকার বিকল্প হয় না। তাঁর হিন্দি ‘আন্দি’ গুজরাটে মুক্তির পর ২০ সপ্তাহ নিষিদ্ধ ছিল। কারণ তিনি যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাতে তৎকালীন ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছায়া থাকার কারণে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। ’৭৭ সালে ক্ষমতা থেকে ইন্দিরা গান্ধীর বিদায় ঘটলে গুজরাটের টেলিভিশন চ্যানেলে ছবিটি প্রচার করা হয়। স্বেচ্ছানির্বাসিত জীবনে রামকৃষ্ণ মন্দির ঘিরে বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন তিনি। নির্জন ও নিভৃত জীবন-যাপন করায় হলিউড কিংবদন্তি গ্রেটা গার্বোর সঙ্গে অনেকে তাঁর মিল খুঁজেছেন। সময় শিডিউল না থাকার কারণে কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘চৌধুরাণী’ ছবিতে কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন সুচিত্রা সেন। এ কারণে অস্কারজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ ছবিটিই আর বানাননি। উত্তর ফালগুনী যৌনকর্মী পান্না ভাই ও তাঁর কন্যা আইনজীবী সুপর্ণার দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকমন জয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন। দীর্ঘ ২৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হৃদরোগে আক্রান্ত সুচিত্রা সেন কলকাতার বেসরকারি হাসপাতাল বেলভিউতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৮২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন পাবনার একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মা-বাবার পঞ্চম সন্তান ছিলেন সুচিত্রা সেন। মায়ের নাম ইন্দিরা দেবী। মা কন্যার মতো অনিন্দ্যসুন্দরী না হলেও লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে যখন কপালে সিঁদুরের বড় টিপ দিয়ে প্রতিবেশীদের বাড়িতে যেতেন তখন মুগ্ধ হতেন। সুচিত্রা সেনের ভাই অশোক, যেমন ছিল তাঁর সুন্দর মার্জিত চেহারা তেমন প্রখর ব্যক্তিত্ব। অনেকে বলতেন অশোক যদি সিনেমায় নামতেন তাহলে চলচ্চিত্র আরেক অশোক কুমারকে পেত।
শৈশব থেকেই সুচিত্রা সেন ছিলেন গৃহমুখী। প্রতিবেশী কেউ বাড়িতে এলে তিনি খুব একটা গল্পে যেতেন না। একা একা নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকতেন বলে একটা ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়ে যায় ছোটবেলা থেকেই। অন্য বোনেরা মিশুক হলেও প্রতিবেশী বালিকাদের সঙ্গে গলায় গলায় ভাব করে হাঁটলে সুচিত্রা মানে রমা ছিলেন আলাদা। সুচিত্রার বোন হেমালিনা প্রতিবেশী ফাহমিদার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বে জড়িয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে ফাহমিদা লেখক হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, একবার ভাই ফোঁটার সময় সুচিত্রার ভাই গৌতম ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ফাহমিদার মা ও দিদিকে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন। আর ফাহমিদার তখন মনে হয়েছিল, তিনি যেন ছোট্ট কৃষ্ণ ঠাকুরকে দেখছেন। তাদের দুই বাড়িতে যাতায়াত, আড্ডা, খেলাধুলায় সবাই যুক্ত হলেও সুচিত্রা বা রমা একটু দূরে থাকতেন। কখনো সবাই চেপে ধরলে তাঁর প্রিয় একটা গান গাইতেন, ‘হিমেল রাতের ওই গগনের দ্বীপগুলিরে হেমন্তিকা’। তাঁর গানের গলাটি ছিল ভারি মিষ্টি। রমার বোন রুনাও ভালো গাইতেন। পরবর্তী জীবনে তিনি শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবনে গান শিখেছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। রূপে-গুণে ছোটবেলা থেকেই রমা ছিলেন আলাদা। বিশেষ করে তাঁর রূপে মুগ্ধ হতেন সবাই। তা জানতেন বলেই নিজেকে বাঁচিয়ে চলতেন তিনি। তবে রূপসী বলে অহংকার ছিল না। কিন্তু আত্মমগ্নতায় ডুবে থাকতেই বেশি ভালোবাসতেন। স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান মাতিয়ে রাখতেন। ফাংশনে লাল পাড় গরদের শাড়ি পরে শ্যাম্পু করা দীর্ঘ ঘনকালো চুল, কোমর লুটিয়ে ঢেউ তুলে সবার দৃষ্টি কেড়ে নিতেন কিশোরী রমা। বান্ধবীরাও গুঞ্জন তুলতেন, রূপের ঔদ্ধত্য রমার মতো পরমাসুন্দরীকেই বুঝি মানাত। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সফলের নেপথ্য ভূমিকার জন্য শিক্ষকরা রমার গুণকীর্তন করতেন। সেদিন সাধারণ মানুষ রমা বা সুচিত্রার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা না করলেও তাঁর মামাবাড়ি আসা এক নাগা সন্ন্যাসী ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন। সন্ন্যাসী রমাকে দেখে বলেছিলেন, ‘বড় হলে এ বেটির নাম সবার মুখে মুখে ফিরবে।’ বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা হয়ে সেই সন্ন্যাসীর কথাকেই সত্যে পরিণত করেছিলেন সুচিত্রা সেন।
দেশভাগের পর তাঁর বেশির ভাগ সময় কেটেছে পাটনায় মামাবাড়িতে। থাকতে হয়েছে শান্তিনিকেতনেও। মামারা তাঁকে আদর করে ডাকতেন কৃষ্ণা বলে। শান্তিনিকেতনে থাকতে থাকতেই ফ্রক ছেড়ে সবে শাড়ি ধরা পরমা সুন্দরী সুচিত্রার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এলে বাবা করুণাময় প্রস্তুতির জন্য সময় চাইলেন। কিন্তু পাত্র দিবানাথের বিলম্ব সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না। দিবানাথ তাঁর বাবা আদিনাথ সেনকে পরিষ্কার বলে দেন, রমাকেই তাঁর চাই। নইলে আর কাউকেই বিয়ে নয়। ধনুক ভাঙা পণ আর তাতেই বিয়ের মধ্য দিয়ে রমা দাশগুপ্ত হলেন মিসেস সেন। দিবানাথ ছিলেন সংস্কৃতিমনা। স্ত্রীর রূপগুণে মুগ্ধ। চেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী রমা হয় গায়িকা নয় হবেন নায়িকা। তাঁর পরিবারের সঙ্গে মুম্বাইয়ের বিখ্যাত পরিচালক বিমল রায়ের সম্পর্ক ছিল। আদিনাথের প্রথম স্ত্রী ছিলেন বিমল রায়ের বোন। কিন্তু অকালে বোনটি মারা গেলেও ভগ্নিপতির সঙ্গে সম্পর্কটি টিকে যায়। অভিনয় নয়, রমার প্রথম সুযোগ আসে গানে। পার্ক স্ট্রিটে গানের রেকর্ডিং করতে গিয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পান তিনি। সেটা অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘সংকেত’ না বীরেশ্বর বসুর ‘শেষ কোথায়’ ছবির? এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পরিচালক পিনাকী মুখোপাধ্যায় এক লেখায় লিখেছেন, ‘আমি তখন পরিচালক অর্ধেন্দু মুখার্জির সহকারী। এক সন্ধ্যায় এক ভদ্রমহিলা এলেন আমাদের অফিসে। এক নজরে চোখে পড়বার মতো তাঁর চেহারা। অসম্ভব শার্প ভঙ্গিমাটা বিনম্র। কিন্তু ঋজু। শুনলাম তাঁর নাম রমা সেন। আমাদের “সংকেত” ছবিতে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করতে ইচ্ছুক। অর্ধেন্দু দায়ের সঙ্গে বেশ কিছু সময় তাঁর কথাবার্তা হলো। কিছুক্ষণ পর অর্ধেন্দু দা আমায় ডেকে বললেন, পানু, রমার একটা স্ক্রিন টেস্ট নিতে হবে।
রমা সেন আমার সঙ্গে ফ্লোরে চলে এলেন। আমি প্রয়োজনীয় টেস্ট নিলাম। মুভি ক্যামেরায় ওঁর ছবির পর ছবি উঠল, শব্দযন্ত্রে ধরা পড়ল কণ্ঠস্বর। সেদিন টেস্ট দিয়ে রমা সেন চলে গেলেন। সেই টেস্টের প্রিন্ট বের হলো রসায়নাগার থেকে। প্রজেকশন দেখে অর্ধেন্দু দা আমাদের মতামত জানতে চাইলেন। সবাই যখন একবাক্যে বলল, আমাদের সবার ভালো লেগেছে, তখন তিনিও মৃদু হেসে বললেন, এটা আমি জানতাম। তুমি ফোনে রমাকে খবর দিয়ে বল, আমরা তাঁকে সিলেক্ট করেছি। পরদিন ফোন করলে রমাই টেলিফোনটা ধরলেন। কিন্তু খবরটা পেয়ে উনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমি বললাম, কই কিছু বলছেন না যে? শোনা গেল কেমন যেন এক নিষ্প্রাণ কণ্ঠস্বর, “পিনাকী বাবু! অর্ধেন্দু দাকে বলবেন, তিনি যেন আমায় মার্জনা করেন।” এটা অপ্রত্যাশিত। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, কেন? কেন? রমা সেন বললেন, “ইচ্ছা থাকলেও আপাতত আর কোনো ছবিতে অভিনয় করতে পারছি না। শ্বশুরবাড়িতে অনুমতি পাওয়া গেল না। আপনি অর্ধেন্দু দাকে আমার হয়ে বুঝিয়ে বলবেন, যেন আমায় ভুল না বোঝেন।” কথাটা বলে রমা সেন ফোনটা ছেড়ে দিলেন। পরবর্তী সময়ে রমা সেনের বদলে দীপ্তি রায়কে নায়িকা করে “বিজলী সংকেত” ছবি মুক্তি পায় ১৯৮১ সালের ৪ মে।’
সংকেতের পর ১৯৫২ সালে বীরেশ্বর বসুর ‘শেষ কোথায়’ আবার অভিনয় করার বিশেষ সুযোগ আসে মিসেস সেনের। এবার তিনি শ্বশুর মশাইয়ের অনুমতি নিতে গেলে আদিনাথ সেন তাঁকে বললেন, ‘তোমার মধ্যে যদি ট্যালেন্ট থাকে, তাকে নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। তোমার যদি ইচ্ছা থাকে আমি আর বাধা দেব না।’ শেষ কোথায় ছবিটাও মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। শেষে ’৭৪ সালের ২৫ জানুয়ারি ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’ নামে মুক্তি পায় ছবিটি। সবচেয়ে মজার ঘটনা, ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’ সুচিত্রা সেনকে দুই বয়সের ব্যবধানে দুই রকম দেখতে লেগেছে। ২২ বছর আগে শেষ কোথায় এক রকম, আর পরের শ্রাবণ সন্ধ্যায় এক রকম। যৌবনে তাঁর চিপচিপে গড়ন আর পরিণত বয়সের বিরাট চেহারার মধ্যে কি ভীষণ অমিল! সুচিত্রা সেনের ভাগ্য ভালো সুপার ফ্লপ ছবিটি দুয়েক সপ্তাহ বিভিন্ন হলে চলে বিদায় নেয়। এত বছর পর অসমাপ্ত ছবিতে কাজ করা ঠিক হয়নি জেনেও সুচিত্রা সেন হয়তো করেছিলেন প্রথম ছবির কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করতে।
‘শেষ কোথায়’ প্রসঙ্গে সুচিত্রা সেনের একান্ত ফটোগ্রাফার দীরেন দেব স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘কাজের ফাঁকে ক্যামেরা নিয়ে একদিন পৌঁছে গেলাম ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে। কাজ হচ্ছিল, “শেষ কোথাও”-এর। ফ্লোরে ঢুকেই শুনলাম, ছবির জন্য নতুন নায়িকা আনা হয়েছে। সেটের ভিতরে আলোর নিচে আবিষ্কার করলাম, সেই নতুন নায়িকাটিকে। হালকা চিপচিপে চেহারা। টিকলো নাক। চোখ দুটি বেশ। ঠোঁটে সলজ্জ হাসি। মন্দ লাগল না। দাঁড় করিয়ে ক্যামেরার শাটার টিপলাম। নতুন নায়িকার কেউ ফটো তুলতে পারে ভাবেননি তিনি। সেটের বাইরে এসে দেখলাম এক ভদ্রলোক পুরুষালী চেহারা, চোখে চশমা, সরু গোঁফ একটা মরিচ মাইনর গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। শুনলাম তিনিই নায়িকার স্বামী দিবানাথ সেন।’ সুচিত্রা সেনের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’। সুকুমার দাশগুপ্তের পরিচালনায় ১৯৫৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায়। বিপরীতে নায়ক ছিলেন সমর রায়। সেই ছবিতেই রমা হলেন সুচিত্রা সেন। পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্তের ভাষায়, ‘সেটি ’৫২ সালের ঘটনা। আমার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান এস এম প্রডাকশনের প্রথম ছবি “সাত নম্বর কয়েদি”র প্রস্তুতি পর্ব চলছে। সাত নম্বর বাড়িখানি ছবি হিট হওয়ায় সাত নম্বর আমার লাকি নম্বর বলে এই ছবির নাম হয়ে গেল সাত নম্বর কয়েদি। সাত নম্বর কয়েদির জন্য তখন দেখতে সুশ্রী আর শুনতে মিষ্টি একটি অল্পবয়সী নায়িকা খুঁজছি। একদিন দিবানাথ সেনের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে অভিনয়ের ইচ্ছা নিয়ে। দেখলাম নায়িকাদের কাছে আমারই নয়, সব পরিচালকের যে তিনটি চাহিদা রয়েছে তা মেটাবার পুঁজি রমা সেনের কাছে আছে। বয়স কতই বা হবে, টিনেজ সবে পার হয়েছে। দেখতে শুধু সুশ্রী নয়, যাকে বলে ডাকসাইটে সুন্দরী। তৃতীয় চাহিদায় আটকে গেল বিষয়টি। মেয়েটি দেখতে যেমন সুন্দরী, শুনতে তেমন মিষ্টি নয়। অর্থাৎ তাঁর কথায় পূর্ব বাংলার টিপিক্যাল টান। তবু হাল ছাড়লাম না। বললাম, তোমাকে কিছুদিন ডায়ালগ রিহার্সেল করাব। কিন্তু মজা হচ্ছে, এই রিহার্সেলের জন্য রমাকে আমি সাত নম্বর কয়েদির ডায়ালগ দিইনি। দিয়েছিলাম, শরৎ বাবুর “বিন্দুর ছেলে”র নাটকখানার। কারণ আমার বিশ্বাস, শরৎচন্দ্রের চেয়ে ভালো সংলাপ লিখিয়ে আজো বাংলা সাহিত্যে কেউ নেই। আশ্চর্য একাগ্রতা দেখলাম তাঁর। কয়েকদিনের মধ্যে সে পশ্চিম বাংলার কথা বলার ধরন অনেকটা আয়ত্ত করে নিল। উচ্চারণ হলো অনেক পরিচ্ছন্ন। এই মেয়ে যে পারবে এবং সফল হবে এ নিয়ে কোনো সংশয় রইল না। বিনা দ্বিধায় নায়িকার ভূমিকাটি তাঁকে দিয়ে দিলাম। তারপর আমার আরও দুটি ছবিতে সে নায়িকা হিসেবে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে এগিয়ে গেল।’ রমা থেকে সুচিত্রা হওয়া প্রসঙ্গে তাঁর ভাষায়, ‘রুপালি পর্দায় দুই অক্ষরের নামটা বদলাতে বললেন পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত। সে সময় তাঁর সহকারী ছিলেন নীতিশ রায়। তিনিই রমাকে রমার নতুন নামকরণ সুচিত্রা সেন করলেন।’ সাত নম্বর কয়েদির সংগীত পরিচালক কালিপদ সেন সুচিত্রা সেন সম্পর্কে বলেন, ‘অরোরা স্টুডিওতে পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেন। সুকুমার দাশ বললেন, “এই মেয়েটি আমার ছবির নায়িকা এবং সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে।” পরিচয় যেভাবে দিলেন তাতে মনে হলো, বিশেষ প্রয়োজনবশত উনি ছবিতে নামছেন। কথাবার্তা বলে জানতে পারলাম, ওর জেঠাতো ভাসুর ঢাকায় আমার সঙ্গে কলেজে পড়ত। এদের বাড়ি ছিল ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। সাত নম্বর কয়েদির শুটিং মাঝে মাঝে দেখতে যেতাম। অভিনয় সমন্ধে ওর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। সুকুমার বাবুকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছিল তাকে দিয়ে শো অভিনয় করানোর। প্রথম প্রথম ছবিতে নায়িকা হিসেবে যেটুকু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে, সেটা অবশ্যই ছিল। এরপর তিনি তিনটি ছবিতে নায়িকা হিসেবে কাজ করেন। আমি যার সংগীত পরিচালক ছিলাম। একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি, অভিনয়ের দিক থেকে পরপর তিনটি ছবিতেই সুচিত্রা সেন গভীর অনুশীলনে কৃতকার্জ হয়েছেন।’ ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর পর পরিষ্কার হয়ে গেল, সুচিত্রা সেন সত্যিকারের অভিনয়জগতে শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন। তাঁর একাগ্রতা ও ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, অভিনয়জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে অনেক দুঃসহ যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছে। এমন দিনও তার জীবনে গেছে সারারাত ধরে শুটিং গেছে, সুচিত্রা সেন একা মেকআপ রুমে বসে আছেন। অথচ কেউ খোঁজ নিচ্ছে না। পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় সুচিত্রা সেন সম্পর্কে বলেছেন, ‘তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা ও অভিনয়শৈলী নিয়ে যে গভীর সাধনা ছিল তা অন্য শিল্পীদের অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দেবে। কাজের সময় সুচিত্রা সেন ভুলে যান তাঁর ভূমিকা ছাড়া তার আর কোনো সত্তা আছে। সেই আপনভোলা শিল্পী সুচিত্রা সেন নিজের দোষত্রুটি সংশোধন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। এবং কখনো পরিচালকের কাজে বাধা দেননি। কোনো তর্কও করতেন না। হয়তো বলতেন, এ কথাগুলো বলতে আমার অসুবিধা হচ্ছে, কিছু বদলে দিতে পারেন না তাৎপর্য ঠিক রেখে? খাওয়ার সময় ঠিক নেই দেখে বলত, যাও এবার খাবারের ছুটি। কিন্তু ঠিক সেই মহূর্তে সুচিত্রা সেন হয়তো তার আবেগ এমনভাবে তাকে উত্তেজিত করছে যে, তিনি খাওয়া ভুলে বলতেন, আরেকটু পরে। এই শর্টটা হয়ে যাক। পরে হয়তো এটা ঠিক আসবে না।’ ইনডোর শুটিং করার মধ্যে হঠাৎ তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আউটডোর শুটিংয়ে তাতে তিনি বেজার হতেন না। আউটডোর শেষ করে আবার ইনডোরে কাজ শুরু করতেন। কোনো দিন বলেননি, আমি ক্লান্ত, আর পারছি না। শর্ট থেকে বেরিয়ে সুচিত্রা সেন সব ভুলে সহজভাবে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে করতে বাড়ি ফিরতেন। আমি তখন থেকেই জানতাম, এই সাধনার একাগ্রতার আর প্রতিভার স্বীকৃতি একদিন তাঁর জীবনে আসবেই। অভিনয়জীবনের শুরু থেকেই সুচিত্রা সেন তাঁর মনপ্রাণ ঢেলে শুধু অভিনয় নিয়েই ডুবে থেকেছেন। নিজের অভিনয়প্রতিভা ছাড়াও গোটা ছবিটা নিয়ে এমনভাবে ভাবতেন মনে করতেন এটা তাঁর নিজের ছবি। নিজেকে এমনভাবে জড়িয়ে নেওয়ার ঘটনা শিল্পীদের মধ্যে দেখা যায় না।
রোমান্টিক নায়ক-নায়িকা হিসেবে উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সেই ছবির সংগীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সুচিত্রা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘অগ্নিপরীক্ষা থেকে শ্রাবণ সন্ধ্যার এই আঠারো বছরে আঠারো বারের বেশি আমাদের দেখা হয়নি। অথচ আমার গাওয়া গান সুচিত্রা সেনের দুটি ঠোঁটে, দীর্ঘায়িত দুটি চোখে প্রাণ খুঁজে পায়। আমি কাঠামোর অন্য মাটির প্রতিমায় রং চড়াই আর সুচিত্রা সেন আঁকেন তাঁর দুটি চোখ। এত নিখুঁত সেই প্রাণপ্রতিষ্ঠা, যেই হাউসে বসে যখন নিজেই গান শুনি সুচিত্রা লিপ মুভমেন্ট, মনেই হয় না সুচিত্রা ছাড়া আর কেউ গাইছেন সেই গান। প্রাণে সেই মুহূর্তে যেন বিদ্যুৎ চমকে যায়। নিজের অজান্তেই তাঁর প্রেমে পড়ে যাই, সেই অগ্নিপরীক্ষা থেকে আজ পর্যন্ত। উত্তমের চোখের ভাষা আর সুচিত্রা সেনের হাসির ভাষা অগ্নিপরীক্ষায় নয়, অভিনয়জীবনেই তাদের রোমান্টিক জনপ্রিয়তার স্বর্ণশিখরে নিয়ে জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত করেছিল।’
লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার কারণে চলচ্চিত্রজগতের দেশি-বিদেশি শিল্পীরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও তিনি রাজি হননি। তিনি যে হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, সেই হাসপাতালেই মহানায়ক উত্তম কুমার ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। উত্তম কুমারের জন্ম হয়েছিল কলকাতার আহেরি টোলায় ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬ সালে। তাঁর আসল নাম ছিল অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। পরিবারের তিন সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর বাবার নাম ছিল সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়। তিনি গৌরী দেবীকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের একমাত্র সন্তান গৌতম চট্টোপাধ্যায় মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা যান। তাঁর নাতি গৌরব চট্টোপাধ্যায়ও চলচ্চিত্রের ব্যস্ত অভিনেতা। ১৯৬৩ সালে স্ত্রী গৌরী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে। প্রণয়ের টানে অভিনেত্রী সুখপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে জীবনের বাকি ১৭ বছর কাটান। সাড়ে চুয়াত্তর ছবি দিয়ে উত্তম-সুচিত্রার জুটির যে ইনিংস শুরু হয়েছিল, তা পরবর্তীতে তাদের মহানায়ক-মহানায়িকাতেই পরিণত করেনি, রুপালি পর্দার জগতে তৈরি হয়েছিল রঙিন ইতিহাস, গৌরবের ইতিহাস।
বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে অনেকে আসা-যাওয়া করলেও কেউ যেমন উত্তম কুমার হতেন পারেননি, পারবেনও না, তেমনি অনেক নায়িকা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আগমন ঘটলেও কেউ যেমন সুচিত্রা হতে পারেননি, তেমনি কেউ হতে পারবেনও না। এ যেন বাংলা চলচ্চিত্রে সুচিত্রাই প্রথম সুচিত্রাই শেষ। সব দর্শকের হৃদয়ে সম্রাজ্ঞীর আসন নেওয়া সুচিত্রা সেনকে ঘিরে হাজারো প্রশ্ন আর কৌতূহলের শেষ নেই। অপার রহস্যের যে মিথ তৈরি করেছেন, অনুসন্ধিৎসু মন সেখানে অবিরাম ডুবসাঁতার কাটলেও রহস্য কেউ ভেদ করতে পারেননি। একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, উত্তমের সঙ্গে সুচিত্রার সম্পর্ক বা রসায়ন ব্যক্তিগত হিসেবের খাতায় কতটা লেখা হয়েছিল, সেটি আরও বিস্ময়কর রহস্যময়তায় ঘেরা। উত্তম চলচ্চিত্রজগতে সফল ও সুখী হলেও ব্যক্তিজীবনে কি সুখী হয়েছিলেন? কিংবা একা নির্জনতায় নিমগ্ন হয়ে যাওয়া রামকৃষ্ণ মন্দির কি সুচিত্রা সেনের অন্তহীন বেদনায় কোনো শান্তির সন্ধান দিতে পেরেছিল? সুচিত্রা কি নির্জন জীবনে সুখী ছিলেন, নাকি দুঃখভারাক্রান্ত বিষাদগ্রস্ত ছিল তাঁর মন? এমন প্রশ্ন তাঁর দর্শকদের মনে বা চলচ্চিত্রজগতে অনন্তকাল প্রশ্ন হয়ে ঘুরে ফিরবে।
উপমহাদেশে যেখানে গায়ক-গায়িকারা অসুস্থ হয়ে শয্যা না নেওয়া পর্যন্ত গান গাইতে থাকেন, অবসরের কথা ভাবেন না, এমনকি ক্রিকেটাররা পর্যন্ত ফর্ম শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঠ থেকে বিদায় নেন না। আর রাজনীতিতে তো শয্যাশায়ী না হওয়া পর্যন্ত অবসরের কথা ভাবেনই না, সেখানে সুচিত্রা সেনই একমাত্র হলিউড কাঁপানো ‘গ্রেটা গার্বো’র মতো অপরূপ সৌন্দর্য, বিস্ময়কর অভিনয় প্রতিভা ও কোটি দর্শকের হৃদয়-মনে নায়িকার ইমেজ রেখে মৃত্যুর আগে ’৭৮ সাল থেকে সাড়ে তিন দশক লোকচক্ষুর অন্তরালে গিয়ে, নিজেকে মিথে পরিণত করতে পেরেছিলেন। তিনিও মা-মাসি, ঠাকুমা-দিদিমার চলচ্চিত্র থেকে মেঘা সিরিয়ালে এককথায় বড় পর্দা থেকে ছোট ছোট বাক্সে রোজ হাজিরা দিয়ে জীবনের ইতি টানতে পারতেন। কিন্তু তাতে আর দশজন সাধারণের মতোই তাঁকে বিদায় নিতে হতো। মানুষের এত কৌতূহল আকর্ষণ ও রহস্যের মনোজগতের মহানায়িকা হয়ে এত আলোচনার ঝড় তুলে বিদায় নিতে পারতেন না।
এখানে সুচিত্রা তাঁর কঠোর সাধনা বা যথাসময়ে যৌবনের জোয়ার থাকতে থাকতেই সবার সামনে দরজায় খিল তুলে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে গিয়ে নিজেকে বন্দী করে মিথের জন্ম দিতে পেরেছেন। সেলুলয়েডের জগতে সবাইকে নয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানব জগতকেও যথাসময়ে অবসর নিয়ে এবং স্বেচ্ছায় নির্বাসনের দরজার আড়ালে থেকে হারিয়ে গিয়েছেন। চলচ্চিত্রে থাকতে মহানায়িকা হয়ে যেমন সবার হৃদয়ের আকুলতা নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রভূমিতে ছিলেন, তেমনি সাড়ে তিন দশক লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে লাখো লাখো কৌতূহল প্রিয় মানুষের মনোজগতে ঝড় তুলেই গেছেন। অনন্ত কৌতূহল, অন্তহীন তৃষ্ণা, নানাবিধ বাস্তব-অবাস্তব-পরাবাস্তব, জল্পনা-কল্পনা তাঁকে ঘিরে একটি দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। মৃত্যুর পর মানুষের এই কৌতূহল বা রহস্যভেদ করার তৃষ্ণা নিবারণ দূরে থাক, তা আরও তীব্র করেছে। সবার উৎসুক মনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে আরও বেশি আড়াল রাখার জেদে জয়ী হয়েছেন মহানায়িকা সুচিত্রা।
লোকে যত তাঁকে একনজর দেখতে চেয়েছে, তিনি তত বেশি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। মৃত্যুর আগে যতবার নার্সিংহোমে গেছেন ফটোসাংবাদিকরা অষ্টপ্রহর জেগে থেকেও একটি ছবি আনতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত নিজের শর্ত মেনে কালো কাচে ঢাকা ভ্যানে কফিন বন্দী হয়ে শশ্মানে চিতা পর্যন্ত পৌঁছেছে তাঁর দেহ। তবুও তাঁর একটি ছবি তুলে রাখা বা একনজর দেখার সুযোগ হয়নি কারও।
১৯৯৫ সালে দক্ষিণ কলকাতার ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ছবি তুলতে গিয়েছিলেন সুচিত্রা। সেই ছবির পর দুই দশক বহির্বিশ্বকে আর কোনো ছবি দেখতে দেননি তিনি। ’৭৮ সালে চলচ্চিত্রকে বিদায় জানানোর ৩৪ বছর পরেও এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর প্রতি তুমুল আকর্ষণ, আবেগ ও কৌতূহলে ভাসিয়েছে পঞ্চাশোর্ধ বাঙালিদের।
সুচিত্রার বক্সঅফিস হিট করা সিনেমার স্মৃতি সিঁড়ি বেয়ে দর্শকরা ডুবেছেন অপ্রতিরোধ্য নস্টালজিয়ায়, তাদের তারুণ্যে তীব্র ভালো লাগাবোধ ভেজা ফুলের গন্ধে ভিজিয়ে দিয়েছে তাদের মন। সুচিত্রা জেনেছিলেন কোথায় থামতে হয়। তাই তিনি নায়িকা হিসেবে পর্দায় দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে, এই চরম সত্যটি উপলব্ধি করেই সচেতনভাবে বাইরের দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে নির্জনতায় ডুবেছিলেন। এতে তাঁর ভরা যৌবনের পরমাসুন্দরীর ইমেজের প্রেমে নিজেই যে জড়িয়ে পড়েছিলেন, সেটিই সত্য নয়, তাঁর লাখো কোটি ভক্তকেও সেই মায়াজালে আটকে দিয়েছিলেন। তিনি পর্দার বাইরে বাকি জীবন কাটিয়ে দিলে তার সেই চিরচেনা চিরসুন্দর রূপের মূর্তি ভেঙে যেমন খান খান হয়ে যেত, তেমনি এভাবে মিথেও পরিণত হতেন না।
স্বপ্নের রাজকন্যা মায়াবী ইন্দ্রজালে চিরবিদায় নিয়েছেন। জনতার স্রোতে এসে মিশে গিয়ে সাধারণের তালিকায় ঠাঁই হতে দেননি। এটিই তাঁর শক্তি। বিশ্লেষকদের মতে, তাঁর এই নিভৃতচারী জীবন বা একান্ত নির্জনতায় কাটানো একাকিত্বের শক্তির উৎস ছিল নিজের ব্যাংক-ব্যালেন্স। এককথায় তাঁর অভিনয়কালে শিল্পীর পারিশ্রমিক তেমন না থাকলেও মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের আর্থিক টানাপড়েন বা দৈন্য ছিল না। আর ছিল না বলেই তাঁকে অভিনয় করে খেতে হয়নি। তিনি তাঁর পুরনো বাড়ির জমিতে বহুতল নির্মাণ করে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন বলেই তাঁর দৃঢ় সংকল্পে জয়ী হয়ে ইতিহাসের চাকাকে পাল্টে দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনিই সুচিত্রা সেন। ভারতীয়দের সব রীতিনীতি ভেঙে দিয়ে, সব লোভ-মোহকে জয় করে মহাসংযমী আচরণে পর্দা থেকে বিদায় নিয়ে সবার জন্য কপাট বন্ধ করে মিথ হয়ে থেকে গেলেন।
বাংলা চলচ্চিত্রে চিরকালের জন্য যেন এক অবিস্মরণীয় বিস্ময়কর মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ আর ষাট দশকে বাংলা রোমান্টিক সিনেমাযুগকে স্বর্ণযুগে পৌঁছে দিয়েছিলেন উত্তম কুমারের সঙ্গে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের চিরসবুজ জুটি। বাংলা ভাষাভাষি সিনেমা দর্শকদের কাছে মহানায়ক উত্তম কুমার ও মহানায়িকা সুচিত্রা সেন যে ইমেজ দাঁড় করিয়ে গেছেন, যে গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা রেখে গেছেন তা আর কেউ যেমন ভাঙতে পারেননি, তেমনি আগামী শত বছরে ভাঙতে পারবেন বলে কেউ বিশ্বাস করেন না। লাখো কোটি দর্শকের হৃদয় জয় করা এমন চলচ্চিত্র জুুটি এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন যে, হাজার হাজার রমণী নানা বয়সের মহানায়ক উত্তম কুমারের প্রেমে পড়েছিলেন। ঠিক তেমনি লাখো লাখো পুরুষের হৃদয় জয় করে প্রেমে পাগল করেছিলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। একদল পুরুষ যেমন আইডল মনে করে, উত্তম কুমারের মতো পোশাক-আশাক এবং ধূমপান আয়ত্ত করেছিলেন, তেমনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অজ¯্র রমণী মহানায়িকা সুচিত্রাকে আইডল করে তার মতো শাড়ি পরেছেন। হাতাকাটা ব্লাউজ পরেছেন। চোখে কাজল টেনেছেন। চুলে কখনো বেণী বেঁধেছেন। কখনোবা খোঁপা বেঁধেছেন। ঘাড় বাঁকিয়ে রোমান্টিক চাহনি দিয়েছেন। এমন আবেদনময় শহুরে ভদ্র পুরুষের অবয়ব নিয়ে হৃদয় জয় করা উত্তমের মতো তারকা যেমন রুপালি পর্দায় আর আসেননি, তেমনি অন্যরকম সুন্দরী, স্মার্ট, জীবন্ত রোমান্টিক সুচিত্রা সেনেরও জন্ম হয়নি।
উত্তম-সুচিত্রা মানেই সিনেমা ছিল সুপারহিট। উত্তম সুচিত্রার রোমান্টিক যুগলকে রুপালি পর্দায়ই দর্শকরা লালন করেননি, পর্দার বাইরেও তাঁদের হৃদয়ঘটিত প্রণয় বা রসায়ন নিয়ে বিস্তর আলোচনা যুগের পর যুগ চলেছে। মৃত্যুর পরও উত্তম সুচিত্রা সম্পর্ক মিথ হয়ে এখনো সিনেমা দর্শকদের মাঝে আলোচনার জন্ম দেয় চায়ের টেবিলে।
সুপার স্টারদের কখনো কখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকতেই সময়কে টানতে হয়। সুচিত্রা সেনই জনপ্রিয়তার চূড়ায় যাওয়া সেই কিংবদন্তি নায়িকা, যিনি নিজের লাগাম টেনেই ধরেননি, অনন্ত যৌবনা ও তুমুল সম্মোহনী রূপের সৌন্দর্য দর্শক হৃদয়-মনের গভীরে গেঁথে দিয়ে নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে যত না আলোচনা, যত না প্রশংসা, যত না বিশ্লেষণ, তার চেয়ে বেশি মিথ হয়ে ঘুরে ফিরে আসছে যেন অনন্তকালের চিরযৌবনা রূপবতী সুচিত্রা সেনের মৃত্যু নেই।
মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে জনপ্রিয়তার স্বর্ণশিখরে যাওয়া মহানায়ক উত্তম কুমারেরও মৃত্যু নেই। তবে তাঁদের জীবন ঘিরে রয়েছে মানুষের মধ্যে, দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল, অন্তহীন তৃষ্ণা আর হাজারো প্রশ্ন। যেসব প্রশ্নের উত্তর কখনো মিলবে না। কেবল প্রশ্ন চলতেই থাকবে। কৌতূহলপ্রিয় মানুষের অজানাকে জানার আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠবে। এক জীবনে সুচিত্রা সেন সেই রহস্যের জন্ম দিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। তবুও বাংলা চলচ্চিত্রের কথা এলেই মহানায়ক উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেন। যেন তাঁদের আগে বা পরে কেউ নেই। তাঁরাই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম ও শেষ জনপ্রিয় রোমান্টিক জুটি।
উত্তম সুচিত্রা জুটির জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে একের পর এক বক্স অফিস হিট করছে, তখন দর্শকদের মাঝেও তুমুল আলোচনার ঝড়। দুই মহানায়ক-মহানায়িকার রসায়ন নিয়ে বিস্তর আলোচনা তুঙ্গে। প্রণয়ের পাঠ থেকে কেউ বলতে শুরু করেন যে, গোপনে তারা বিয়েও করে ফেলেছেন। দুজনের সংসারেও দাম্পত্যের ঝড়োহাওয়া উঠেছিল। আর বাইরে সুচিত্রা সেনকে উত্তম কুমার ছাড়া চলচ্চিত্র দর্শকরা ভাবতেই পারছিলেন না। তখন উত্তম-সুচিত্রাকে অনুকরণ করতে চায়নি, এমন প্রেমিক যুগল খুঁজে পাওয়া যায় না। যৌবনে কতজন হয়তো রিনা ব্রাউনের মতো প্রেমিকের বাইকে বসে চলে যেতে চেয়েছে ‘স্বপ্নপুরীর’ দেশে। রুপালি পর্দার মতো ব্যক্তিজীবনেও তাঁরা বিবাহিত। এমন ভাবনা যখন তুঙ্গে তখন আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছিল, একটি পোস্টার। সেটি ছিল অগ্নিপরীক্ষা চলচ্চিত্রের পোস্টার। যেখানে লেখা ছিল, ‘আমাদের প্রণয়ের সাক্ষী হলো অগ্নিপরীক্ষা’ তলায় সুচিত্রা সেনের স্বাক্ষর। ’৫৪ সালের সেই পোস্টার দেখে দর্শকরা চায়ের টেবিলে তুলেছিলেন তুমুল আলোচনার ঝড়। আর সেই পোস্টার দেখে সারা দিন কেঁদে ভাসিয়েছিলেন, উত্তম কুমারের স্ত্রী গৌরী দেবী। সেই আগুনের তাপ সুচিত্রা সেনের দাম্পত্য জীবনেও পড়েছিল। সুচিত্রা সেনের স্বামী দিবানাথ সেন সন্দেহ শুরু করতে করেন তাঁর স্ত্রীকে। এক পর্যায়ে অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন। বক্স অফিস তখন গরম উত্তম-সুচিত্রা সেনের জুটিতে। তখন তাদের ছয়টি ছবি সুপারহিট। আর দশটি ছবিতে তাঁরা চুক্তিবদ্ধ। ব্যক্তিত্বের দ্যুতি ছড়িয়ে যেদিন সুচিত্রা সেন তাঁর স্বামী দিবানাথ সেনকে বললেন, অভিনয় ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। এতে বাড়তে থাকে ঝগড়াঝাটি। দিবানাথের সন্দেহ তাঁকে পুড়িয়ে শেষ করতে থাকে। বেড়ে যায় তাঁর মদ্যপান। সুচিত্রাকে সিনেমা জগতের সবাই মিসেস সেন বলে ডাকলেও একমাত্র মহানায়ক উত্তম কুমার ডাকতেন রমা বলে। আর উত্তম কুমারকে মহানায়িকা সুচিত্রা ডাকতেন, ‘উতু’ বলে। সাংসারিক গোলমাল বাড়তে থাকায় মেয়ে মুনমুনকে সুচিত্রা পাঠিয়ে দেন দার্জিলিংয়ে কনভেন্টে পড়তে। সে সময় উত্তম কিংবা সুচিত্রার বাড়িতে উইকেন্ডে পার্টি চলত নিয়মিত। সেখানে সবার পরিবারের লোকজন ছাড়াও যোগ দিতেন ঘনিষ্ঠ পরিচালক রতœা চ্যাটার্জী ও অন্য বন্ধুরা।
১৯৫৭ সালে উত্তম কুমার হারানো সুর ছবিটি পরিচালনা করলেন। নায়িকা হতে বললেন, সুচিত্রা সেনকে। উত্তম যেখানে প্রযোজক সুচিত্রা সেখানে বললেন, ‘তোমার জন্য সব ছবির ডেট ক্যান্সেল করব। হলোও তাই। ব্যাপারটা পছন্দ হলো না দিবানাথ সেনের। এর মধ্যে একদিন সুচিত্রা সেনের বালিগঞ্জের বাসায় পার্টি ছিল। উত্তম কুমার ‘কালো কুর্তা বা ব্ল্যাক ডগ’ হুইসকি খুব ভালোবাসতেন। পার্টিতে তাই মদের আয়োজন বিশাল। সেই আসরে সুচিত্রার স্বামী দিবানাথই ছিলেন না, উত্তমের স্ত্রী গৌরী দেবীও ছিলেন। মধ্যরাতে মদের আসর যখন জমে উঠেছে, তখন কেউ বলে উঠলেন, এবার একটু নাচ হয়ে যাক। ব্যস! উঠে পড়লেন উত্তম-সুচিত্রা। হলো টুইস ডুয়েল নাচ। সিনেমার মতো করে উত্তম কুমার সুচিত্রার কোমরে হাত দিয়ে নাচছেন অন্তরঙ্গ হয়ে। কয়েক প্যাক পান করা দিবানাথ সেন আর মাথা ঠিক রাখতে পারলেন না। কোথায় থেকে একটা চুরি জোগাড় করে তাড়া করলেন উত্তম কুমারকে। পার্টি তখন প্রায় ল-ভ । সুচিত্রার বাড়ি অলিন্দে ছুটছেন উত্তম কুমার। পেছনে চুরি হাতে সুচিত্রার স্বামী! এক সময় উত্তম কুমারকে ধরে ফেললেন দিবানাথ সেন। হাতজোড় করে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কাতর প্রার্থনা করছেন উত্তম কুমার। আর রাগে ক্ষোভে জ্বলে দিবানাথ বলছেন, ‘উত্তম আই উইল কিল ইউ, আই উইল কিল ইউ।’ দুজনের মাঝখানে গিয়ে গৌরী দেবীই থামালেন। কোনো মতে দিবানাথ সেনকে নিরস্ত্র করলেন! আর উত্তম কুমার জানে রক্ষা পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে দ্রুত ছুটতে থাকলেন। থামলেন দুই কিলোমিটার দূরে হরিস মুখার্জী রোডে নিজের বাড়িতে গিয়ে। এই ঘটনায় দিবানাথের সঙ্গে সুচিত্রার দূরত্ব আরও যোজন যোজন বেড়ে গেল। দিবানাথ এবার বললেন, সুচিত্রা ছবি করতে পারবেন। তবে উত্তমের সঙ্গে নয়। সুচিত্রা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। দিবানাথের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছলে, চরম সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বামী, বালিগঞ্জের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন দক্ষিণ কলকাতার নিউ আলিপুরে। আলাদা থাকতে শুরু করলেন। এর কিছু দূরেই উত্তম কুমারের নতুন বাড়ি। সপরিবারে থাকবেন বলে বাড়িটি মনের মতো করে তৈরি করেছিলেন উত্তম। দুজনকে নিয়ে তখন গুজব ফ্লিম জগৎ ছেড়ে বাইরে এলো চরমে। বলাবলি শুরু হলো, এবার তাহলে উত্তম সুচিত্রাকে বিয়ে করবেন। আর দিবানাথকে ডিভোর্স সুচিত্রার জন্য সময়ের ব্যাপারমাত্র। গুজবের তাপ গৌরী দেবীর মনকেও অশান্ত অস্থির করে তুলল। উত্তম কুমার শুটিং থেকে গভীর রাতে ফিরলেই স্ত্রী গৌরী দেবী মনে করতেন, সুচিত্রার সঙ্গে সময় কাটিয়েই ফিরেছেন। বাবা-মায়ের দাম্পত্য এতকিছু বুঝত না উত্তম কুমারে ছেলে গৌতম। সুযোগ পেলেই সে চলে যেত রমা আন্টির কাছে। গৌতমকে নিজের সন্তানের মতো আদর করতেন সুচিত্রা। অনেক সময় এমন হয়েছে, মায়ের কাছে কিছু না পেয়ে গৌতম সোজা চলে যেত টালিগঞ্জে শুটিং স্পটে। আর সুচিত্রা হাসিমুখে তার আবদার মেটাতেন। ছুটিতে মুনমুন কলকাতায় এলে গৌতমসহ সুচিত্রা যেমন বেড়াতে যেতেন, তেমনি উত্তম কুমারও সময় পেলে মুনমুনকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। এতে গুঞ্জন-গুজব যেন সত্যে পরিণত হয়ে উঠল। সবাই বলাবলি করতে থাকলেন, উত্তম-সুচিত্রা গোপনে বিয়ে করেছেন। সুচিত্রার ডিভোর্স হলেই ঘটা করেই তা ঘোষণা করা হবে।
এদিকে গৌরী দেবীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে উত্তম কুমারের। উত্তম কুমারও তখন মদপানের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর গৌরীকে ছেড়ে সুখপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে জীবন কাটাতে শুরু করেছেন। এই অবস্থায় ’৮০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়ে কলকাতার ভ্যালভিউ ক্লিনিকে মারা যান উত্তম কুমার। আর তার আগেই আকস্মিকভাবে চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিয়ে নির্জনে চলে যান সুচিত্রা সেন। উত্তমের মৃত্যুতে শোকার্ত দর্শকহৃদয় যখন ভেঙে গেছে, তাঁর শবদেহ ঘিরে অশ্রু স্বজল স্বজনের ঘিরে ভিড় তখন সবার অপেক্ষা কখন আসবেন মহানায়িকা সুচিত্রা? অবশেষে মহানায়িকা সুচিত্রা যখন শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এলেন, তখন একের পর এক ক্যামেরার শার্টার ক্লিক হতে থাকল। কাকতালীয় হোক আর অন্য রহস্যজনক কারণেই হোক দুজনের ইতি ঘটেছে, কলকাতার ভ্যালভিউ হাসপাতালে। যার শুধু সময়ের ব্যবধানমাত্র ৩৪ বছরের।
সুচিত্রা সেনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনা, নানাবাড়িতে। আসল নাম রমাদাস গুপ্ত। পাবনা শহরের দিলালপুরে কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। ছিলেন পাবনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের মুহূর্তে কলকাতাতে চলে যান পরিবারের সঙ্গে। হয়ে যান সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। বিখ্যাত শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র ছাপাখানার মালিক দিবানাথ সেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের একমাত্র কন্যা মুনমুন সেন তৃণমূলের হয়ে লোকসভায় গেলেও চলচ্চিত্রে মায়ের ইমেজ ভাঙা দূরে থাক জনপ্রিয়তায় কাছাকাছিও যেতে পারেননি। সুচিত্রা সেনের চলচ্চিত্রে অভিষেক ’৫২ সালে। তাঁর প্রথম ছবির নামা ছিল ‘শেষ কোথায়’। কিন্তু সেটি মুক্তি পায়নি। মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবির নাম ‘সাত নম্বর’ কয়েদি। সেটি তাঁকে জনপ্রিয়তা দিতে পারেনি। কিন্তু ’৫৪ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির মধ্যে দিয়ে জনপ্রিয়তায় উঠে আসেন সুচিত্রা সেন। তাঁর অভিনীত বাংলা ছবির সংখ্যা অর্ধশতাধিক। উত্তম কুমার ছাড়াও সুচিত্রা বিকাশ রায়, বসন্ত চৌধুরী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং হিন্দিতে দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, ধর্মেন্দ্র ও সঞ্জীব কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। কিন্তু কালের যাত্রাপথে বাংলা চলচ্চিত্রে সুচিত্রা-উত্তম জুটিই ছিল সবচেয়ে রোমান্টিক ও জনপ্রিয়। একসাথে ৩০ ছবি করা রুপালি পর্দার এই জুটির আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা আর কেউ ভাঙতে পারেননি। সুচিত্রা হয়ে উঠেছিলেন কোটি কোটি তরুণের স্বপ্নের নারী। আর নারীদের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।
সুচিত্রা-উত্তম অভিনীত ছবির মধ্যে ‘অগ্নিপরীক্ষা, সবার উপরে, সাপমোচন, শিল্পী, পথে হলো দেরি, হারানো সুর, গৃহদাহ ও সাগরিকা’ অন্যতম। এসব ছবি দেখে দর্শকদের হৃদয় মনজুড়ে প্রেমের আগুনই জ্বলে ওঠেনি, সৌন্দর্যের পিপাসাও তীব্র হয়ে উঠেছিল। ‘সাগরিকা’ ছবিতে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে উত্তমের সিগারেট টানার দৃশ্য আপনা আপনি ধূমপায়ী পুরুষেরা অনুসরণ করেছিলেন। আর সুচিত্রা সেনের ‘দ্বীপ জ্বেলে যায়’ ছবি দেখতে দেখতে আপন মনে কাঁদেননি, এমন নারীদর্শক কমই ছিলেন।
উত্তম সুচিত্রার ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন, অভিনয় প্রতিভা, সংলাপ এবং ঠোঁট মেলানো গান সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। উত্তমের বিপরীতে সুপ্রিয়া দেবীর মতো সুন্দরী নায়িকারাও অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু দর্শক বাংলা ছবি বলতেই উত্তমের সঙ্গে নায়িকা হিসেবে যেমন সুচিত্রাকে চেয়েছিলেন, তেমনি সুচিত্রার সঙ্গে নায়কের আসনে উত্তম ছাড়া বিকল্প ভাবেননি। সুচিত্রা সেনের সর্বশেষ ছবির নাম প্রণয় পাশা। ’৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে তাঁর নায়ক ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর তিনি আর কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি। এক সময় অভিনয় ছেড়ে পর্দা ও লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান সুচিত্রা সেন। দীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি পর্দার অন্তরালে বাস করেন কন্যা মুনমুন সেন, নাতনি রায়মা ও রিয়া এবং নিকটাত্মীয় ছাড়া তাঁর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের নিজস্ব ফ্ল্যাটে আর কেউ দেখা করতে পারেননি। আকর্ষণীয় সৌন্দর্য কাহিনীর সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ার অসাধারণ নৈপুণ্য তাঁকে খ্যাতির শিখরে নিয়েছিল। তাঁর রূপ, ছাল-চলন পোশাক ও সাজসজ্জা বাঙালি নারীর ফ্যাশনেই পরিণত হয়নি, তিনিও হয়ে উঠেছিলেন শাশ্বত বাঙালি নারীর প্রতীকী রূপ। ২০১৪ সালে ১৭ জানুয়ারি তিনি অসংখ্য ভক্তকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান।
১৯৬৩ সালে ‘সাতপাকে বাঁধা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন ‘সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস’ জয় করেন। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান প্রদান করে। শোনা যায়, ২০০৫ সালে তাঁকে ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু জনসম্মুখে আসতে চান না বলে এ পুরস্কার গ্রহণ করতে চাননি। ২০১২ সালে তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘বঙ্গবিভূষণ’ প্রদান করা হয়। ২৫ বছরের অভিনয়জগতে নিজের রূপ-সৌন্দর্য ও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে রেখে এভাবে নিজেকে পর্দার আড়ালে গুটিয়ে নেওয়ায় তাঁকে নিয়ে যত মিথ চালু হয়। বলা হয়, সুচিত্রা সেনের কোনো বিকল্প নেই। তিনিই তাঁর বিকল্প। এমন মহানায়িকার বিকল্প হয় না। তাঁর হিন্দি ‘আন্দি’ গুজরাটে মুক্তির পর ২০ সপ্তাহ নিষিদ্ধ ছিল। কারণ তিনি যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাতে তৎকালীন ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছায়া থাকার কারণে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। ’৭৭ সালে ক্ষমতা থেকে ইন্দিরা গান্ধীর বিদায় ঘটলে গুজরাটের টেলিভিশন চ্যানেলে ছবিটি প্রচার করা হয়। স্বেচ্ছানির্বাসিত জীবনে রামকৃষ্ণ মন্দির ঘিরে বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন তিনি। নির্জন ও নিভৃত জীবন-যাপন করায় হলিউড কিংবদন্তি গ্রেটা গার্বোর সঙ্গে অনেকে তাঁর মিল খুঁজেছেন। সময় শিডিউল না থাকার কারণে কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘চৌধুরাণী’ ছবিতে কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন সুচিত্রা সেন। এ কারণে অস্কারজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ ছবিটিই আর বানাননি। উত্তর ফালগুনী যৌনকর্মী পান্না ভাই ও তাঁর কন্যা আইনজীবী সুপর্ণার দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকমন জয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন। দীর্ঘ ২৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হৃদরোগে আক্রান্ত সুচিত্রা সেন কলকাতার বেসরকারি হাসপাতাল বেলভিউতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৮২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন পাবনার একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মা-বাবার পঞ্চম সন্তান ছিলেন সুচিত্রা সেন। মায়ের নাম ইন্দিরা দেবী। মা কন্যার মতো অনিন্দ্যসুন্দরী না হলেও লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে যখন কপালে সিঁদুরের বড় টিপ দিয়ে প্রতিবেশীদের বাড়িতে যেতেন তখন মুগ্ধ হতেন। সুচিত্রা সেনের ভাই অশোক, যেমন ছিল তাঁর সুন্দর মার্জিত চেহারা তেমন প্রখর ব্যক্তিত্ব। অনেকে বলতেন অশোক যদি সিনেমায় নামতেন তাহলে চলচ্চিত্র আরেক অশোক কুমারকে পেত।
শৈশব থেকেই সুচিত্রা সেন ছিলেন গৃহমুখী। প্রতিবেশী কেউ বাড়িতে এলে তিনি খুব একটা গল্পে যেতেন না। একা একা নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকতেন বলে একটা ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়ে যায় ছোটবেলা থেকেই। অন্য বোনেরা মিশুক হলেও প্রতিবেশী বালিকাদের সঙ্গে গলায় গলায় ভাব করে হাঁটলে সুচিত্রা মানে রমা ছিলেন আলাদা। সুচিত্রার বোন হেমালিনা প্রতিবেশী ফাহমিদার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বে জড়িয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে ফাহমিদা লেখক হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, একবার ভাই ফোঁটার সময় সুচিত্রার ভাই গৌতম ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ফাহমিদার মা ও দিদিকে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন। আর ফাহমিদার তখন মনে হয়েছিল, তিনি যেন ছোট্ট কৃষ্ণ ঠাকুরকে দেখছেন। তাদের দুই বাড়িতে যাতায়াত, আড্ডা, খেলাধুলায় সবাই যুক্ত হলেও সুচিত্রা বা রমা একটু দূরে থাকতেন। কখনো সবাই চেপে ধরলে তাঁর প্রিয় একটা গান গাইতেন, ‘হিমেল রাতের ওই গগনের দ্বীপগুলিরে হেমন্তিকা’। তাঁর গানের গলাটি ছিল ভারি মিষ্টি। রমার বোন রুনাও ভালো গাইতেন। পরবর্তী জীবনে তিনি শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবনে গান শিখেছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। রূপে-গুণে ছোটবেলা থেকেই রমা ছিলেন আলাদা। বিশেষ করে তাঁর রূপে মুগ্ধ হতেন সবাই। তা জানতেন বলেই নিজেকে বাঁচিয়ে চলতেন তিনি। তবে রূপসী বলে অহংকার ছিল না। কিন্তু আত্মমগ্নতায় ডুবে থাকতেই বেশি ভালোবাসতেন। স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান মাতিয়ে রাখতেন। ফাংশনে লাল পাড় গরদের শাড়ি পরে শ্যাম্পু করা দীর্ঘ ঘনকালো চুল, কোমর লুটিয়ে ঢেউ তুলে সবার দৃষ্টি কেড়ে নিতেন কিশোরী রমা। বান্ধবীরাও গুঞ্জন তুলতেন, রূপের ঔদ্ধত্য রমার মতো পরমাসুন্দরীকেই বুঝি মানাত। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সফলের নেপথ্য ভূমিকার জন্য শিক্ষকরা রমার গুণকীর্তন করতেন। সেদিন সাধারণ মানুষ রমা বা সুচিত্রার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা না করলেও তাঁর মামাবাড়ি আসা এক নাগা সন্ন্যাসী ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন। সন্ন্যাসী রমাকে দেখে বলেছিলেন, ‘বড় হলে এ বেটির নাম সবার মুখে মুখে ফিরবে।’ বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা হয়ে সেই সন্ন্যাসীর কথাকেই সত্যে পরিণত করেছিলেন সুচিত্রা সেন।
দেশভাগের পর তাঁর বেশির ভাগ সময় কেটেছে পাটনায় মামাবাড়িতে। থাকতে হয়েছে শান্তিনিকেতনেও। মামারা তাঁকে আদর করে ডাকতেন কৃষ্ণা বলে। শান্তিনিকেতনে থাকতে থাকতেই ফ্রক ছেড়ে সবে শাড়ি ধরা পরমা সুন্দরী সুচিত্রার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এলে বাবা করুণাময় প্রস্তুতির জন্য সময় চাইলেন। কিন্তু পাত্র দিবানাথের বিলম্ব সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না। দিবানাথ তাঁর বাবা আদিনাথ সেনকে পরিষ্কার বলে দেন, রমাকেই তাঁর চাই। নইলে আর কাউকেই বিয়ে নয়। ধনুক ভাঙা পণ আর তাতেই বিয়ের মধ্য দিয়ে রমা দাশগুপ্ত হলেন মিসেস সেন। দিবানাথ ছিলেন সংস্কৃতিমনা। স্ত্রীর রূপগুণে মুগ্ধ। চেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী রমা হয় গায়িকা নয় হবেন নায়িকা। তাঁর পরিবারের সঙ্গে মুম্বাইয়ের বিখ্যাত পরিচালক বিমল রায়ের সম্পর্ক ছিল। আদিনাথের প্রথম স্ত্রী ছিলেন বিমল রায়ের বোন। কিন্তু অকালে বোনটি মারা গেলেও ভগ্নিপতির সঙ্গে সম্পর্কটি টিকে যায়। অভিনয় নয়, রমার প্রথম সুযোগ আসে গানে। পার্ক স্ট্রিটে গানের রেকর্ডিং করতে গিয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পান তিনি। সেটা অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘সংকেত’ না বীরেশ্বর বসুর ‘শেষ কোথায়’ ছবির? এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পরিচালক পিনাকী মুখোপাধ্যায় এক লেখায় লিখেছেন, ‘আমি তখন পরিচালক অর্ধেন্দু মুখার্জির সহকারী। এক সন্ধ্যায় এক ভদ্রমহিলা এলেন আমাদের অফিসে। এক নজরে চোখে পড়বার মতো তাঁর চেহারা। অসম্ভব শার্প ভঙ্গিমাটা বিনম্র। কিন্তু ঋজু। শুনলাম তাঁর নাম রমা সেন। আমাদের “সংকেত” ছবিতে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করতে ইচ্ছুক। অর্ধেন্দু দায়ের সঙ্গে বেশ কিছু সময় তাঁর কথাবার্তা হলো। কিছুক্ষণ পর অর্ধেন্দু দা আমায় ডেকে বললেন, পানু, রমার একটা স্ক্রিন টেস্ট নিতে হবে।
রমা সেন আমার সঙ্গে ফ্লোরে চলে এলেন। আমি প্রয়োজনীয় টেস্ট নিলাম। মুভি ক্যামেরায় ওঁর ছবির পর ছবি উঠল, শব্দযন্ত্রে ধরা পড়ল কণ্ঠস্বর। সেদিন টেস্ট দিয়ে রমা সেন চলে গেলেন। সেই টেস্টের প্রিন্ট বের হলো রসায়নাগার থেকে। প্রজেকশন দেখে অর্ধেন্দু দা আমাদের মতামত জানতে চাইলেন। সবাই যখন একবাক্যে বলল, আমাদের সবার ভালো লেগেছে, তখন তিনিও মৃদু হেসে বললেন, এটা আমি জানতাম। তুমি ফোনে রমাকে খবর দিয়ে বল, আমরা তাঁকে সিলেক্ট করেছি। পরদিন ফোন করলে রমাই টেলিফোনটা ধরলেন। কিন্তু খবরটা পেয়ে উনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমি বললাম, কই কিছু বলছেন না যে? শোনা গেল কেমন যেন এক নিষ্প্রাণ কণ্ঠস্বর, “পিনাকী বাবু! অর্ধেন্দু দাকে বলবেন, তিনি যেন আমায় মার্জনা করেন।” এটা অপ্রত্যাশিত। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, কেন? কেন? রমা সেন বললেন, “ইচ্ছা থাকলেও আপাতত আর কোনো ছবিতে অভিনয় করতে পারছি না। শ্বশুরবাড়িতে অনুমতি পাওয়া গেল না। আপনি অর্ধেন্দু দাকে আমার হয়ে বুঝিয়ে বলবেন, যেন আমায় ভুল না বোঝেন।” কথাটা বলে রমা সেন ফোনটা ছেড়ে দিলেন। পরবর্তী সময়ে রমা সেনের বদলে দীপ্তি রায়কে নায়িকা করে “বিজলী সংকেত” ছবি মুক্তি পায় ১৯৮১ সালের ৪ মে।’
সংকেতের পর ১৯৫২ সালে বীরেশ্বর বসুর ‘শেষ কোথায়’ আবার অভিনয় করার বিশেষ সুযোগ আসে মিসেস সেনের। এবার তিনি শ্বশুর মশাইয়ের অনুমতি নিতে গেলে আদিনাথ সেন তাঁকে বললেন, ‘তোমার মধ্যে যদি ট্যালেন্ট থাকে, তাকে নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। তোমার যদি ইচ্ছা থাকে আমি আর বাধা দেব না।’ শেষ কোথায় ছবিটাও মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। শেষে ’৭৪ সালের ২৫ জানুয়ারি ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’ নামে মুক্তি পায় ছবিটি। সবচেয়ে মজার ঘটনা, ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’ সুচিত্রা সেনকে দুই বয়সের ব্যবধানে দুই রকম দেখতে লেগেছে। ২২ বছর আগে শেষ কোথায় এক রকম, আর পরের শ্রাবণ সন্ধ্যায় এক রকম। যৌবনে তাঁর চিপচিপে গড়ন আর পরিণত বয়সের বিরাট চেহারার মধ্যে কি ভীষণ অমিল! সুচিত্রা সেনের ভাগ্য ভালো সুপার ফ্লপ ছবিটি দুয়েক সপ্তাহ বিভিন্ন হলে চলে বিদায় নেয়। এত বছর পর অসমাপ্ত ছবিতে কাজ করা ঠিক হয়নি জেনেও সুচিত্রা সেন হয়তো করেছিলেন প্রথম ছবির কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করতে।
‘শেষ কোথায়’ প্রসঙ্গে সুচিত্রা সেনের একান্ত ফটোগ্রাফার দীরেন দেব স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘কাজের ফাঁকে ক্যামেরা নিয়ে একদিন পৌঁছে গেলাম ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে। কাজ হচ্ছিল, “শেষ কোথাও”-এর। ফ্লোরে ঢুকেই শুনলাম, ছবির জন্য নতুন নায়িকা আনা হয়েছে। সেটের ভিতরে আলোর নিচে আবিষ্কার করলাম, সেই নতুন নায়িকাটিকে। হালকা চিপচিপে চেহারা। টিকলো নাক। চোখ দুটি বেশ। ঠোঁটে সলজ্জ হাসি। মন্দ লাগল না। দাঁড় করিয়ে ক্যামেরার শাটার টিপলাম। নতুন নায়িকার কেউ ফটো তুলতে পারে ভাবেননি তিনি। সেটের বাইরে এসে দেখলাম এক ভদ্রলোক পুরুষালী চেহারা, চোখে চশমা, সরু গোঁফ একটা মরিচ মাইনর গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। শুনলাম তিনিই নায়িকার স্বামী দিবানাথ সেন।’ সুচিত্রা সেনের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’। সুকুমার দাশগুপ্তের পরিচালনায় ১৯৫৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায়। বিপরীতে নায়ক ছিলেন সমর রায়। সেই ছবিতেই রমা হলেন সুচিত্রা সেন। পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্তের ভাষায়, ‘সেটি ’৫২ সালের ঘটনা। আমার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান এস এম প্রডাকশনের প্রথম ছবি “সাত নম্বর কয়েদি”র প্রস্তুতি পর্ব চলছে। সাত নম্বর বাড়িখানি ছবি হিট হওয়ায় সাত নম্বর আমার লাকি নম্বর বলে এই ছবির নাম হয়ে গেল সাত নম্বর কয়েদি। সাত নম্বর কয়েদির জন্য তখন দেখতে সুশ্রী আর শুনতে মিষ্টি একটি অল্পবয়সী নায়িকা খুঁজছি। একদিন দিবানাথ সেনের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে অভিনয়ের ইচ্ছা নিয়ে। দেখলাম নায়িকাদের কাছে আমারই নয়, সব পরিচালকের যে তিনটি চাহিদা রয়েছে তা মেটাবার পুঁজি রমা সেনের কাছে আছে। বয়স কতই বা হবে, টিনেজ সবে পার হয়েছে। দেখতে শুধু সুশ্রী নয়, যাকে বলে ডাকসাইটে সুন্দরী। তৃতীয় চাহিদায় আটকে গেল বিষয়টি। মেয়েটি দেখতে যেমন সুন্দরী, শুনতে তেমন মিষ্টি নয়। অর্থাৎ তাঁর কথায় পূর্ব বাংলার টিপিক্যাল টান। তবু হাল ছাড়লাম না। বললাম, তোমাকে কিছুদিন ডায়ালগ রিহার্সেল করাব। কিন্তু মজা হচ্ছে, এই রিহার্সেলের জন্য রমাকে আমি সাত নম্বর কয়েদির ডায়ালগ দিইনি। দিয়েছিলাম, শরৎ বাবুর “বিন্দুর ছেলে”র নাটকখানার। কারণ আমার বিশ্বাস, শরৎচন্দ্রের চেয়ে ভালো সংলাপ লিখিয়ে আজো বাংলা সাহিত্যে কেউ নেই। আশ্চর্য একাগ্রতা দেখলাম তাঁর। কয়েকদিনের মধ্যে সে পশ্চিম বাংলার কথা বলার ধরন অনেকটা আয়ত্ত করে নিল। উচ্চারণ হলো অনেক পরিচ্ছন্ন। এই মেয়ে যে পারবে এবং সফল হবে এ নিয়ে কোনো সংশয় রইল না। বিনা দ্বিধায় নায়িকার ভূমিকাটি তাঁকে দিয়ে দিলাম। তারপর আমার আরও দুটি ছবিতে সে নায়িকা হিসেবে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে এগিয়ে গেল।’ রমা থেকে সুচিত্রা হওয়া প্রসঙ্গে তাঁর ভাষায়, ‘রুপালি পর্দায় দুই অক্ষরের নামটা বদলাতে বললেন পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত। সে সময় তাঁর সহকারী ছিলেন নীতিশ রায়। তিনিই রমাকে রমার নতুন নামকরণ সুচিত্রা সেন করলেন।’ সাত নম্বর কয়েদির সংগীত পরিচালক কালিপদ সেন সুচিত্রা সেন সম্পর্কে বলেন, ‘অরোরা স্টুডিওতে পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেন। সুকুমার দাশ বললেন, “এই মেয়েটি আমার ছবির নায়িকা এবং সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে।” পরিচয় যেভাবে দিলেন তাতে মনে হলো, বিশেষ প্রয়োজনবশত উনি ছবিতে নামছেন। কথাবার্তা বলে জানতে পারলাম, ওর জেঠাতো ভাসুর ঢাকায় আমার সঙ্গে কলেজে পড়ত। এদের বাড়ি ছিল ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। সাত নম্বর কয়েদির শুটিং মাঝে মাঝে দেখতে যেতাম। অভিনয় সমন্ধে ওর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। সুকুমার বাবুকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছিল তাকে দিয়ে শো অভিনয় করানোর। প্রথম প্রথম ছবিতে নায়িকা হিসেবে যেটুকু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে, সেটা অবশ্যই ছিল। এরপর তিনি তিনটি ছবিতে নায়িকা হিসেবে কাজ করেন। আমি যার সংগীত পরিচালক ছিলাম। একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি, অভিনয়ের দিক থেকে পরপর তিনটি ছবিতেই সুচিত্রা সেন গভীর অনুশীলনে কৃতকার্জ হয়েছেন।’ ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর পর পরিষ্কার হয়ে গেল, সুচিত্রা সেন সত্যিকারের অভিনয়জগতে শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন। তাঁর একাগ্রতা ও ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, অভিনয়জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে অনেক দুঃসহ যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছে। এমন দিনও তার জীবনে গেছে সারারাত ধরে শুটিং গেছে, সুচিত্রা সেন একা মেকআপ রুমে বসে আছেন। অথচ কেউ খোঁজ নিচ্ছে না। পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় সুচিত্রা সেন সম্পর্কে বলেছেন, ‘তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা ও অভিনয়শৈলী নিয়ে যে গভীর সাধনা ছিল তা অন্য শিল্পীদের অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দেবে। কাজের সময় সুচিত্রা সেন ভুলে যান তাঁর ভূমিকা ছাড়া তার আর কোনো সত্তা আছে। সেই আপনভোলা শিল্পী সুচিত্রা সেন নিজের দোষত্রুটি সংশোধন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। এবং কখনো পরিচালকের কাজে বাধা দেননি। কোনো তর্কও করতেন না। হয়তো বলতেন, এ কথাগুলো বলতে আমার অসুবিধা হচ্ছে, কিছু বদলে দিতে পারেন না তাৎপর্য ঠিক রেখে? খাওয়ার সময় ঠিক নেই দেখে বলত, যাও এবার খাবারের ছুটি। কিন্তু ঠিক সেই মহূর্তে সুচিত্রা সেন হয়তো তার আবেগ এমনভাবে তাকে উত্তেজিত করছে যে, তিনি খাওয়া ভুলে বলতেন, আরেকটু পরে। এই শর্টটা হয়ে যাক। পরে হয়তো এটা ঠিক আসবে না।’ ইনডোর শুটিং করার মধ্যে হঠাৎ তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আউটডোর শুটিংয়ে তাতে তিনি বেজার হতেন না। আউটডোর শেষ করে আবার ইনডোরে কাজ শুরু করতেন। কোনো দিন বলেননি, আমি ক্লান্ত, আর পারছি না। শর্ট থেকে বেরিয়ে সুচিত্রা সেন সব ভুলে সহজভাবে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে করতে বাড়ি ফিরতেন। আমি তখন থেকেই জানতাম, এই সাধনার একাগ্রতার আর প্রতিভার স্বীকৃতি একদিন তাঁর জীবনে আসবেই। অভিনয়জীবনের শুরু থেকেই সুচিত্রা সেন তাঁর মনপ্রাণ ঢেলে শুধু অভিনয় নিয়েই ডুবে থেকেছেন। নিজের অভিনয়প্রতিভা ছাড়াও গোটা ছবিটা নিয়ে এমনভাবে ভাবতেন মনে করতেন এটা তাঁর নিজের ছবি। নিজেকে এমনভাবে জড়িয়ে নেওয়ার ঘটনা শিল্পীদের মধ্যে দেখা যায় না।
রোমান্টিক নায়ক-নায়িকা হিসেবে উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সেই ছবির সংগীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সুচিত্রা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘অগ্নিপরীক্ষা থেকে শ্রাবণ সন্ধ্যার এই আঠারো বছরে আঠারো বারের বেশি আমাদের দেখা হয়নি। অথচ আমার গাওয়া গান সুচিত্রা সেনের দুটি ঠোঁটে, দীর্ঘায়িত দুটি চোখে প্রাণ খুঁজে পায়। আমি কাঠামোর অন্য মাটির প্রতিমায় রং চড়াই আর সুচিত্রা সেন আঁকেন তাঁর দুটি চোখ। এত নিখুঁত সেই প্রাণপ্রতিষ্ঠা, যেই হাউসে বসে যখন নিজেই গান শুনি সুচিত্রা লিপ মুভমেন্ট, মনেই হয় না সুচিত্রা ছাড়া আর কেউ গাইছেন সেই গান। প্রাণে সেই মুহূর্তে যেন বিদ্যুৎ চমকে যায়। নিজের অজান্তেই তাঁর প্রেমে পড়ে যাই, সেই অগ্নিপরীক্ষা থেকে আজ পর্যন্ত। উত্তমের চোখের ভাষা আর সুচিত্রা সেনের হাসির ভাষা অগ্নিপরীক্ষায় নয়, অভিনয়জীবনেই তাদের রোমান্টিক জনপ্রিয়তার স্বর্ণশিখরে নিয়ে জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত করেছিল।’
লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার কারণে চলচ্চিত্রজগতের দেশি-বিদেশি শিল্পীরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও তিনি রাজি হননি। তিনি যে হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, সেই হাসপাতালেই মহানায়ক উত্তম কুমার ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। উত্তম কুমারের জন্ম হয়েছিল কলকাতার আহেরি টোলায় ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬ সালে। তাঁর আসল নাম ছিল অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। পরিবারের তিন সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর বাবার নাম ছিল সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়। তিনি গৌরী দেবীকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের একমাত্র সন্তান গৌতম চট্টোপাধ্যায় মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা যান। তাঁর নাতি গৌরব চট্টোপাধ্যায়ও চলচ্চিত্রের ব্যস্ত অভিনেতা। ১৯৬৩ সালে স্ত্রী গৌরী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে। প্রণয়ের টানে অভিনেত্রী সুখপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে জীবনের বাকি ১৭ বছর কাটান। সাড়ে চুয়াত্তর ছবি দিয়ে উত্তম-সুচিত্রার জুটির যে ইনিংস শুরু হয়েছিল, তা পরবর্তীতে তাদের মহানায়ক-মহানায়িকাতেই পরিণত করেনি, রুপালি পর্দার জগতে তৈরি হয়েছিল রঙিন ইতিহাস, গৌরবের ইতিহাস।
বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে অনেকে আসা-যাওয়া করলেও কেউ যেমন উত্তম কুমার হতেন পারেননি, পারবেনও না, তেমনি অনেক নায়িকা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আগমন ঘটলেও কেউ যেমন সুচিত্রা হতে পারেননি, তেমনি কেউ হতে পারবেনও না। এ যেন বাংলা চলচ্চিত্রে সুচিত্রাই প্রথম সুচিত্রাই শেষ। সব দর্শকের হৃদয়ে সম্রাজ্ঞীর আসন নেওয়া সুচিত্রা সেনকে ঘিরে হাজারো প্রশ্ন আর কৌতূহলের শেষ নেই। অপার রহস্যের যে মিথ তৈরি করেছেন, অনুসন্ধিৎসু মন সেখানে অবিরাম ডুবসাঁতার কাটলেও রহস্য কেউ ভেদ করতে পারেননি। একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, উত্তমের সঙ্গে সুচিত্রার সম্পর্ক বা রসায়ন ব্যক্তিগত হিসেবের খাতায় কতটা লেখা হয়েছিল, সেটি আরও বিস্ময়কর রহস্যময়তায় ঘেরা। উত্তম চলচ্চিত্রজগতে সফল ও সুখী হলেও ব্যক্তিজীবনে কি সুখী হয়েছিলেন? কিংবা একা নির্জনতায় নিমগ্ন হয়ে যাওয়া রামকৃষ্ণ মন্দির কি সুচিত্রা সেনের অন্তহীন বেদনায় কোনো শান্তির সন্ধান দিতে পেরেছিল? সুচিত্রা কি নির্জন জীবনে সুখী ছিলেন, নাকি দুঃখভারাক্রান্ত বিষাদগ্রস্ত ছিল তাঁর মন? এমন প্রশ্ন তাঁর দর্শকদের মনে বা চলচ্চিত্রজগতে অনন্তকাল প্রশ্ন হয়ে ঘুরে ফিরবে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
No comments