অনেক অনেক ভালো থাকুন, স্যার by ফারজানা ব্রাউনিয়া
মমতাজউদ্দীন আহমেদ আর কখনই একেবারে তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় বলে উঠবেন না, ‘ব্রাউনিয়া,
কেমন আছো তুমি? ... তোমার মেয়েটি কেমন আছে? ...বড় ছেলেটি? ...কত বড় হয়েছে?
... ছোট ছেলেটি কি আগের মতোই শান্ত আছে?’ পরিবারের বাইরে উনিই একমাত্র
মানুষ যিনি একেবারেই পিতৃহৃদয় নিয়ে কন্যাসমতুল্য আমাকে সংসারের প্রায় সকল
খুঁটিনাটি বিষয় জিজ্ঞেস করতেন।
মানুষটির সঙ্গে প্রথম দেখা একতরফা ছিল। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছি অটোগ্রাফ শিকারীরা তাকে ঘিরে রেখেছে। আর তিনি নিজস্ব ভঙ্গিমায় উচ্চস্বরে দ্রুত কথা বলছেন আর কাগজগুলো নিয়ে দ্রুত হাতে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। তখনও জানতাম না এই মহান মানুষটি আসলে কে?
১৯৯৮ সালে চায়না থেকে ফিরে ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেপথ্য কণ্ঠ দেয়া তখন আমার শখ। এমনই একদিন রেহানা আপার ডাকে তৎকালীন শেরাটন হোটেলে একটি অনুষ্ঠান নেপথ্যে থেকে উপস্থাপন করছিলাম। সেই অনুষ্ঠানটি শেষ হতে না হতেই প্রজেক্টরের পেছনে বসেই তাঁর কণ্ঠ শুনতে পেলাম। বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তি হওয়ার কারণে তাঁর টেবিলটি ছিল একেবারে সামনের সারিতে।
‘কে? কে? কে এই মেয়েটি? ডাকো ওকে, ওকে ডাকো, ডাকো তো...’ এভাবে একটানা বলে যাচ্ছিলেন তিনি।
তাড়া পেয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজক আমাকে পেছন থেকে ডেকে সামনে নিয়ে গেলেন। কিছুটা ভয় হচ্ছিলো আমার। শিক্ষক মানুষ। হয়তো উচ্চারণের কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। তাই আমাকে খুঁজছেন। তিনি নিশ্চয়ই আমাকে সবার সামনেই বকবেন।
ভেতরে এক ধরনের উদ্বিগ্নতা নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনিও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। একই স্বরে, একই তালে, মনে হচ্ছে তিনি যেনো আমাকে বকছেন। কিন্তু না, বরং উল্টোটাই। তিনি অকপটে প্রশংসা বাক্য ছুড়ছেন আমার মতো একেবারেই অপরিচিত একজন মেয়ের দিকে। ...‘অসাধারণ, অসাধারণ ...’।
এভাবে কিছুক্ষণ অনবরত প্রশংসা বাক্য শুনতে শুনতে, একটু পর আমি আর কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমার দৃষ্টি তখন স্থির শুধু সেই মহান মানুষটির দিকে। একেই বলে জাত শিক্ষক।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের তৎকালীন মহাপরিচালক সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকি’র সঙ্গে তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং পরদিনই মহাপরিচালক মহোদয়ের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড করে আমাকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। বললেন, ‘তুমি অনেক বড় উপস্থাপক হবে।’ আমি তো অবাক। তখনকার সেই বয়স পর্যন্ত আমি কখনই এই রকম পরোপকারী কোনো মানুষ দেখিনি।
পরদিনই আমি বিটিভিতে যাই এবং সেই সময় থেকে কাজ করতে করতে আজ আমাকে বেশির ভাগ মানুষ উপস্থাপক হিসেবেই চেনেন।
তবে মমতাজ স্যারের সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হয়, তখন তিনি জানতেন না যে, তাঁর পুত্র তমাল ভাই এবং পুত্রবধূ রুমানা আপা আমার কাছেরই মানুষ। আর তাঁর কন্যা তাহিতী আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ সহপাঠী। যদিও আমি তাহিতী-এর মুখে তার বাবার নামটা বার দুয়েক শুনেছিলাম। কিন্তু তিনিই যে এই বিখ্যাত মানুষটি তা তখন আমি বুঝতে পারিনি। বিষয়টা পরবর্তীতে খোলাসা হয়।
‘মা’। এই নামেই ডাকতেন তিনি আমায়। বয়স হলে আমরা সকলেই একে একে বিদায় নেবো। কিন্তু তাঁর বিদায়কে আমার যুক্তিবাদী মন কেনো যেনো কিছুতেই মেনে নিতে চাইছে না।
মমতাজ স্যার আর আমাদের মাঝে নেই। এই খবরটা শোনার পর আমার ভেতরটা হঠাৎ ভীষণ এক শূন্যতায় হু হু করে ওঠে। চোখের কোণ নিজের অজান্তেই ভিজে যায়। চিৎকার করে কাঁদতে চাইছিলাম। কিন্তু পারিনি। মনটা তাই ভীষণ ভার হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে মুখটাও। আর সবক’টা দিনের মতো সেই দিনটিও সংসারের বিভিন্ন কাজে আমাকে সময় কাটাতে হয়েছে। আমার ভারী মুখ এবং মুড পর্যবেক্ষণ করে বড় ছেলে প্রশ্ন ছুড়েছিল, ‘মা, তোমার কী হয়েছে?’ আমি আমার ছেলের করা সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারিনি। আসলে কী উত্তর দিতাম। আমার যা হয়েছে তা কি আমি আমার ছেলেকে বুঝিয়ে বলতে পারতাম?
স্যার আপনাকে অনেক ভালোবাসি। এই তো, ক’দিন আগেই তো আপনার সঙ্গে দেখা হলো এ্যাপোলো হাসপাতালের নিচতলায়। হুইলচেয়ারে বসেছিলেন। আপনার পাশে ছিলেন আপনার সহধর্মিণী কামরুন্নেসা মমতাজ। আর আমার পাশে ছিল আমার জীবনসঙ্গী হাসান সারওয়ার্দী। মা এবং আপনাকে সালাম করে সারওয়ার্দীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েই স্বভাবসুলভভাবে আপনার পায়ের কাছে বসে পড়েছিলাম। আপনাকে পাওয়া যেনো হাতে চাঁদ পাওয়া, এ আমার সব সময়ের অনুভূতি। তখন আমার ডাক্তার দেখাবার অনেক তাড়া। কিন্তু আপনাকে দেখেই সকল পার্থিব চিন্তা উড়ে গেল।
হাতটা ধরে বাবা- মেয়ের সেটাই যে শেষ গল্প হবে তা কে জানতো?
গল্পের মাঝে আপনি জানালেন, আমার স্বামী সারওয়ার্দীর সঙ্গে আপনার আগে থেকেই পরিচয় আছে। সারওয়ার্দী যখন চাকরিসূত্রে চট্টগ্রামে ছিল তখন আপনি সেখানে শিক্ষকতা করতেন। তারপর কত শত স্মৃতিচারণ। আপনি একটা সময় বললেন, ‘দুবাই-এর কথা আমার এখনও মনে পড়ে। ঝলমলে মঞ্চ।’ সেখানে সেরা উপস্থাপক-এর অ্যাওয়ার্ডটি তুলে দিয়েছিলেন আপনি আমার হাতে। পুরস্কারটি যখন আপনি আমার হাতে তুলে দিচ্ছিলেন, তখন আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছিলো, এই প্রাপ্তিতে আমি যতটা না খুশি। তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি আপনি। খুশিতে আপ্লুত হয়ে বাবা তার কন্যার কপালে এঁকে দিয়েছিলেন স্নেহের চুম্বন।
আপনার প্রয়াণে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা সহ্য করবার শক্তি আমি খুঁজে পাই না। হরহর করে সকল বেদনা আর সুখের কথা আপনাকে বলার জন্যই যেনো সেদিন দেখা হয়েছিল।
আজ ভাবছি, জীবনে যখন এমন আরো প্রাপ্তি ঘটবে বা কষ্ট মিলবে, পিতৃহৃদয় নিয়ে তখন কে সহ্য করবে আমার বাচালতা। আপনি কেমন করে যেনো জেনেছিলেন যে, আপনার পৃথিবী ছাড়বার সময় চলে এসেছে। তাই বলেছিলেন, আর দেখা নাও হতে পারে। আমি কথাটিকে খুব সাধারণভাবে নিয়েছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি যে, সত্যিই আপনি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবেন।
পরকালে বিশ্বাস থাকলেও, আমরা আসলে কেউ-ই জানি না যে, আসলে ওখানে কী হয়। মৃত্যুর পর ঠিক কোথায় থাকি আমরা। তবে যেখানেই থাকুন না কেন স্যার, আপনি অনেক ভালো থাকবেন। এমন একজন স্বচ্ছ হৃদয়-এর শ্রেষ্ঠ মানুষকে আমি দেখেছি, ছুঁয়েছি- এ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে তাঁর লেখা নাটক, ‘কী চাহো শঙ্খচিল’ এবং ‘রাজা অনুস্বারের পালা’ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি একজন ‘ভাষাসৈনিক’। তিনি একজন ‘মুক্তিযোদ্ধা’। এর চাইতে বড় পরিচয় এদেশের মাটিতে আর কিইবা হতে পারে? একজন মহান শিক্ষক, একজন নিবেদিতপ্রাণ সংস্কৃতিকর্মী, একজন অসাধারণ লেখক, একজন নিখুঁত অভিনেতা। আরো কত কী পরিচয় এই কর্মময় মানুষটির। নাট্যকার, নির্দেশক, গবেষক এবং সর্বোপরি তিনি এদেশের নাট্য আন্দোলনের একজন অন্যতম পথিকৃৎ। এদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি তার হাতে তুলে দিলেও যেনো এদেশ এবং আমরা তাঁর কর্ম আর ভালোবাসার কাছে ঋণবদ্ধ থেকে যাবো।
এমন বীর কলমযোদ্ধা শ্রেষ্ঠ মানুষের মৃত্যু হয় না। তাঁরা বেঁচে থাকেন আমাদের শিশুবেলায়, আমাদের অস্তিত্বে, আমাদের কর্মে। স্যার, আপনার তরে শ্রদ্ধা, সালাম আর অফুরান ভালোবাসা।
মানুষটির সঙ্গে প্রথম দেখা একতরফা ছিল। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছি অটোগ্রাফ শিকারীরা তাকে ঘিরে রেখেছে। আর তিনি নিজস্ব ভঙ্গিমায় উচ্চস্বরে দ্রুত কথা বলছেন আর কাগজগুলো নিয়ে দ্রুত হাতে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। তখনও জানতাম না এই মহান মানুষটি আসলে কে?
১৯৯৮ সালে চায়না থেকে ফিরে ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেপথ্য কণ্ঠ দেয়া তখন আমার শখ। এমনই একদিন রেহানা আপার ডাকে তৎকালীন শেরাটন হোটেলে একটি অনুষ্ঠান নেপথ্যে থেকে উপস্থাপন করছিলাম। সেই অনুষ্ঠানটি শেষ হতে না হতেই প্রজেক্টরের পেছনে বসেই তাঁর কণ্ঠ শুনতে পেলাম। বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তি হওয়ার কারণে তাঁর টেবিলটি ছিল একেবারে সামনের সারিতে।
‘কে? কে? কে এই মেয়েটি? ডাকো ওকে, ওকে ডাকো, ডাকো তো...’ এভাবে একটানা বলে যাচ্ছিলেন তিনি।
তাড়া পেয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজক আমাকে পেছন থেকে ডেকে সামনে নিয়ে গেলেন। কিছুটা ভয় হচ্ছিলো আমার। শিক্ষক মানুষ। হয়তো উচ্চারণের কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। তাই আমাকে খুঁজছেন। তিনি নিশ্চয়ই আমাকে সবার সামনেই বকবেন।
ভেতরে এক ধরনের উদ্বিগ্নতা নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনিও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। একই স্বরে, একই তালে, মনে হচ্ছে তিনি যেনো আমাকে বকছেন। কিন্তু না, বরং উল্টোটাই। তিনি অকপটে প্রশংসা বাক্য ছুড়ছেন আমার মতো একেবারেই অপরিচিত একজন মেয়ের দিকে। ...‘অসাধারণ, অসাধারণ ...’।
এভাবে কিছুক্ষণ অনবরত প্রশংসা বাক্য শুনতে শুনতে, একটু পর আমি আর কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমার দৃষ্টি তখন স্থির শুধু সেই মহান মানুষটির দিকে। একেই বলে জাত শিক্ষক।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের তৎকালীন মহাপরিচালক সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকি’র সঙ্গে তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং পরদিনই মহাপরিচালক মহোদয়ের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড করে আমাকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। বললেন, ‘তুমি অনেক বড় উপস্থাপক হবে।’ আমি তো অবাক। তখনকার সেই বয়স পর্যন্ত আমি কখনই এই রকম পরোপকারী কোনো মানুষ দেখিনি।
পরদিনই আমি বিটিভিতে যাই এবং সেই সময় থেকে কাজ করতে করতে আজ আমাকে বেশির ভাগ মানুষ উপস্থাপক হিসেবেই চেনেন।
তবে মমতাজ স্যারের সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হয়, তখন তিনি জানতেন না যে, তাঁর পুত্র তমাল ভাই এবং পুত্রবধূ রুমানা আপা আমার কাছেরই মানুষ। আর তাঁর কন্যা তাহিতী আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ সহপাঠী। যদিও আমি তাহিতী-এর মুখে তার বাবার নামটা বার দুয়েক শুনেছিলাম। কিন্তু তিনিই যে এই বিখ্যাত মানুষটি তা তখন আমি বুঝতে পারিনি। বিষয়টা পরবর্তীতে খোলাসা হয়।
‘মা’। এই নামেই ডাকতেন তিনি আমায়। বয়স হলে আমরা সকলেই একে একে বিদায় নেবো। কিন্তু তাঁর বিদায়কে আমার যুক্তিবাদী মন কেনো যেনো কিছুতেই মেনে নিতে চাইছে না।
মমতাজ স্যার আর আমাদের মাঝে নেই। এই খবরটা শোনার পর আমার ভেতরটা হঠাৎ ভীষণ এক শূন্যতায় হু হু করে ওঠে। চোখের কোণ নিজের অজান্তেই ভিজে যায়। চিৎকার করে কাঁদতে চাইছিলাম। কিন্তু পারিনি। মনটা তাই ভীষণ ভার হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে মুখটাও। আর সবক’টা দিনের মতো সেই দিনটিও সংসারের বিভিন্ন কাজে আমাকে সময় কাটাতে হয়েছে। আমার ভারী মুখ এবং মুড পর্যবেক্ষণ করে বড় ছেলে প্রশ্ন ছুড়েছিল, ‘মা, তোমার কী হয়েছে?’ আমি আমার ছেলের করা সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারিনি। আসলে কী উত্তর দিতাম। আমার যা হয়েছে তা কি আমি আমার ছেলেকে বুঝিয়ে বলতে পারতাম?
স্যার আপনাকে অনেক ভালোবাসি। এই তো, ক’দিন আগেই তো আপনার সঙ্গে দেখা হলো এ্যাপোলো হাসপাতালের নিচতলায়। হুইলচেয়ারে বসেছিলেন। আপনার পাশে ছিলেন আপনার সহধর্মিণী কামরুন্নেসা মমতাজ। আর আমার পাশে ছিল আমার জীবনসঙ্গী হাসান সারওয়ার্দী। মা এবং আপনাকে সালাম করে সারওয়ার্দীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েই স্বভাবসুলভভাবে আপনার পায়ের কাছে বসে পড়েছিলাম। আপনাকে পাওয়া যেনো হাতে চাঁদ পাওয়া, এ আমার সব সময়ের অনুভূতি। তখন আমার ডাক্তার দেখাবার অনেক তাড়া। কিন্তু আপনাকে দেখেই সকল পার্থিব চিন্তা উড়ে গেল।
হাতটা ধরে বাবা- মেয়ের সেটাই যে শেষ গল্প হবে তা কে জানতো?
গল্পের মাঝে আপনি জানালেন, আমার স্বামী সারওয়ার্দীর সঙ্গে আপনার আগে থেকেই পরিচয় আছে। সারওয়ার্দী যখন চাকরিসূত্রে চট্টগ্রামে ছিল তখন আপনি সেখানে শিক্ষকতা করতেন। তারপর কত শত স্মৃতিচারণ। আপনি একটা সময় বললেন, ‘দুবাই-এর কথা আমার এখনও মনে পড়ে। ঝলমলে মঞ্চ।’ সেখানে সেরা উপস্থাপক-এর অ্যাওয়ার্ডটি তুলে দিয়েছিলেন আপনি আমার হাতে। পুরস্কারটি যখন আপনি আমার হাতে তুলে দিচ্ছিলেন, তখন আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছিলো, এই প্রাপ্তিতে আমি যতটা না খুশি। তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি আপনি। খুশিতে আপ্লুত হয়ে বাবা তার কন্যার কপালে এঁকে দিয়েছিলেন স্নেহের চুম্বন।
আপনার প্রয়াণে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা সহ্য করবার শক্তি আমি খুঁজে পাই না। হরহর করে সকল বেদনা আর সুখের কথা আপনাকে বলার জন্যই যেনো সেদিন দেখা হয়েছিল।
আজ ভাবছি, জীবনে যখন এমন আরো প্রাপ্তি ঘটবে বা কষ্ট মিলবে, পিতৃহৃদয় নিয়ে তখন কে সহ্য করবে আমার বাচালতা। আপনি কেমন করে যেনো জেনেছিলেন যে, আপনার পৃথিবী ছাড়বার সময় চলে এসেছে। তাই বলেছিলেন, আর দেখা নাও হতে পারে। আমি কথাটিকে খুব সাধারণভাবে নিয়েছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি যে, সত্যিই আপনি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবেন।
পরকালে বিশ্বাস থাকলেও, আমরা আসলে কেউ-ই জানি না যে, আসলে ওখানে কী হয়। মৃত্যুর পর ঠিক কোথায় থাকি আমরা। তবে যেখানেই থাকুন না কেন স্যার, আপনি অনেক ভালো থাকবেন। এমন একজন স্বচ্ছ হৃদয়-এর শ্রেষ্ঠ মানুষকে আমি দেখেছি, ছুঁয়েছি- এ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে তাঁর লেখা নাটক, ‘কী চাহো শঙ্খচিল’ এবং ‘রাজা অনুস্বারের পালা’ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি একজন ‘ভাষাসৈনিক’। তিনি একজন ‘মুক্তিযোদ্ধা’। এর চাইতে বড় পরিচয় এদেশের মাটিতে আর কিইবা হতে পারে? একজন মহান শিক্ষক, একজন নিবেদিতপ্রাণ সংস্কৃতিকর্মী, একজন অসাধারণ লেখক, একজন নিখুঁত অভিনেতা। আরো কত কী পরিচয় এই কর্মময় মানুষটির। নাট্যকার, নির্দেশক, গবেষক এবং সর্বোপরি তিনি এদেশের নাট্য আন্দোলনের একজন অন্যতম পথিকৃৎ। এদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি তার হাতে তুলে দিলেও যেনো এদেশ এবং আমরা তাঁর কর্ম আর ভালোবাসার কাছে ঋণবদ্ধ থেকে যাবো।
এমন বীর কলমযোদ্ধা শ্রেষ্ঠ মানুষের মৃত্যু হয় না। তাঁরা বেঁচে থাকেন আমাদের শিশুবেলায়, আমাদের অস্তিত্বে, আমাদের কর্মে। স্যার, আপনার তরে শ্রদ্ধা, সালাম আর অফুরান ভালোবাসা।
No comments