মান-ইজ্জত সব হারিয়েছেন, পরিবারেও ঠাঁই হচ্ছে না তাদের by রুদ্র মিজান
স্বপ্ন
পূরণের পথে এগিয়ে গেছেন অনেক দূর। এবার জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট ঝেড়ে ফেলে
এগিয়ে যাবেন সামনের দিকে। পরিবারে আনবেন সচ্ছলতা। হাসি ফুটবে সবার মুখে।
সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে বিমানে উঠে আরো কত স্বপ্ন বুনছিলেন তারা। কিন্তু সব
স্বপ্নই উবে গেছে আরবের মাটিতে পা রেখে। দিন যতই যাচ্ছে ততই তাদের সামনে
পরিস্কার হচ্ছিল সব। বুঝতে পারছে ফাঁদে আটকে গেছে তারা।
আর আস্তে আস্তে স্বপ্নগুলো তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। মনে হয়েছে, এ যেন জাহান্নামের চেয়ে ভয়াবহ। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কেউ আলিঙ্গন করেছেন মৃত্যুকে। কেউবা মরতে গিয়েও বেঁচে গেছেন। কেউ দেশে ফিরেছেন শরীরে নির্যাতনের চিহৃ নিয়ে। শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা। অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে ফিরেছেন কেউ কেউ। কেউ ফিরেছেন বাচ্চা কোলে নিয়ে। বিদেশের নির্যাতনের সেল থেকে ফিরলেও মুক্তি পাননি তারা। দেশের মাটিতে এসেও শান্তি, স্বস্তি মিলছে না কিছুতেই। ‘নষ্টা, দুশ্চরিত্রা, খারাপ মেয়ে’ অপবাদ জুটছে তাদের। অপবাদ দিয়ে দুরে সরে গেছে স্বজনরা। ঠাঁই হচ্ছে না স্বামীর ঘরে। এমনকি তাড়িয়ে দিচ্ছেন মা-বাবা, ভাইয়েরাও।
সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসেব অনুসারে নির্যাতনের শিকার হয়ে গত বছর সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন ১৩৫৩ নারী। এরমধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন ১৮ জন। অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেক নারী। গত বছর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা নারীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই সহস্রাধিকে।
তাদের একজন তাহমিনা খাতুন। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যই সৌদি আরবে গিয়েছিলেন তিনি। সৌদি আরব থেকে ফিরে ঠাঁই পাচ্ছেন না কোথাও। নষ্টা অপবাদ দিয়ে দুরে চলে গেছেন স্বামী। একই অপবাদ দিচ্ছেন মা-বাবাও। তাহমিনা জানান, বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে মা-বাবা, স্বামী কেউ রাজি ছিলেন না। কিন্তু সংসারে স্বচ্ছলতার জন্য পরিচিত একজনের উৎসাহে বিদেশে যান তিনি। সেখানে দিনের পর দিন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিষয়টি দেশের সবাই জেনেছে। তাই এখন সবাই তাকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে। স্বামী তাকে ঘরে আশ্রয় দেননি। মা-বাবাও খবর নেন না। এক বান্ধবীর সঙ্গে থাকছেন করাইল বস্তিতে।
কাজ করেন একটি গার্মেন্টে। তাহমিনা জানান, গত বছর সৌদি আরব যান তিনি। রিয়াদে এক আরব ব্যবসায়ীর বাসায় ছিলেন। গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। বাসায় ওই ব্যবসায়ীর বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও তিন ছেলে সন্তান ছিলো। তাহমিনা যে কক্ষে ঘুমাতেন ওই কক্ষে কোনো দরজা ছিল না। কয়েক দিন যেতে না যেতেই শুরু হয় সমস্যা। রাতের বেলা তার কক্ষে ঢুকেন গৃহকর্তা। ঝাপটে ধরেন তাকে। শরীরের সব শক্তি দিয়ে বাধা দিয়েও ব্যর্থ হন। ধর্ষণের শিকার হন তাহমিনা। বিষয়টি পরদিন ওই ব্যক্তির স্ত্রীকে জানান। স্ত্রী উল্টো ধমক দেন। বিষয়টি কাউকে বলতে বারণ করে তা মেনে নিতে বলেন। তাহমিনা জানান, তারপর থেকে গৃহকর্তার কাছে প্রায় রাতেই ধর্ষণের শিকার হচ্ছিলেন তিনি। এরমধ্যেই এক রাতে গৃহকর্তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেজো ছেলেও পিতার মতোই তাহমিনার কক্ষে ঢুকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। তাহমিনা চিৎকার করলে গৃহকর্তার স্ত্রী এগিয়ে যান।
এসময় ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় উল্টো তাকে মারধর করা হয়। পরের রাতে আবার তাহমিনার কক্ষে যায় ওই ছেলে। বাধা দিলে তাকে মারধর করা হয়। সে রাতে ধর্ষণের শিকার হন তিনি। তাহমিনা পালাতে চেয়েও পারেন না। দেশে স্বামীর কাছে ফোনে তাকে রক্ষা করতে অনুরোধ করেন। যেভাবেই হোক দেশে যেতে চান তিনি। স্বামী অনেক চেষ্টা করেও তাকে দেশে ফেরাতে পারছিলেন না। এভাবে কাটছিলো কয়েক মাস। যৌন নির্যাতন ছাড়াও বেতন চাইতে গেলেই তাকে মারধর করা হতো। একরাতে বাসা থেকে পালিয়ে যান। রাস্তায় এক বাঙালি শ্রমিকের সহযোগিতায় পৌঁছে যান সেইফ হোমে। কথা ছিলো তিনি বিচার পাবেন। কিন্তু বছরের পর বছর সেইফ হোমে থাকা নারীরা জানিয়েছেন বিচারের নামে দীর্ঘসূত্রিতার কথা। খেয়ে না খেয়ে সেইফ হোমে থাকার চেয়ে দেশে ফিরে আসাই ভালো মনে করেছিলেন তিনি। তাই পাওনা টাকা ছাড়াই দেশে ফিরেন তাহমিনা।
নির্যাতিতাদের মধ্যে একজন ইয়াসমিন। ১৯ বছরের এই অবিবাহিতা তরুণী বিদেশে শিকার হয়েছেন যৌন নির্যাতনের। শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন একটি সন্তান নিয়ে। তারপর থেকে নিজের মা, বাবা, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন কেউ তাকে গ্রহন করেননি। অথচ এই তরুণীর কোনো অপরাধ ছিলো না। দরিদ্র পরিবারের ইয়াসমিন মা-বাবার কষ্টের ভাগ নিতে চেয়েছিলেন। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে যখন আর্থিক টানাপোড়েনে দিন কাটাচ্ছিলেন তার বাবা ঠিক তখন ইয়াসমিন সংসারের হাল ধরতে এগিয়ে যান। স্থানীয় দালাল কাশেম মিয়ার সহযোগিতায় ২০১৬ সালে জর্ডানে যান তিনি। সেখানে একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন। এরই মধ্যে জর্ডানে পরিচয় হয় মানিকগঞ্জের মেয়ে সোনিয়ার সঙ্গে। মাত্র ১৫ হাজার টাকা বেতনে গৃহকর্মীর কাজ করে জেনে সোনিয়া তাকে আরও ভালো বেতনে চাকরির প্রস্তাব দেয়। ভালো কাজ, বেশি বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে সোনিয়া তাকে নিয়ে যায় একটি বাসায়। পাঁচতলা ওই বাসায় অন্তত ২০ জন মেয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশের পুরুষদের আনাগোনা।
এটি একটি পতিতালয়। পতিতাবৃত্তিতে ইয়াসমিন রাজি না হওয়ায় মারধর করা হয়। একপর্যায়ে জোর করে তাকে সেখানে ধর্ষণ করে কয়েক পুরুষ। এভাবেই বিদেশের মাটিতে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। নির্যাতনে এক সময় অসুস্থ হয়ে যান ইয়াসমিন। অসুস্থ অবস্থায় তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া হয়। দুই মাস কারাভোগের পর গত বছরের ১৭ই এপ্রিল দেশে ফিরেন তিনি। ততদিনে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ইয়াসমিন জানান, প্রথমে নিজেও বুঝতে পারেননি তিনি অন্তঃসত্ত্বা। তবে ছয় মাস পরে জানার পর তা আর নষ্ট করতে চাননি তিনি। এই অবস্থায় কেউ তাকে আশ্রয় দিতে চায়নি। নষ্টা মেয়ে বলে তাড়িয়ে দিচ্ছিলো সবাই। চেনা-অচেনা অনেকের আশ্রয়ে থাকতে হয়েছে। তবে এখন মা-বাবার সঙ্গেই আছেন তিনি। তার মা জানান, বাবার পরিচয় নেই বাচ্চার। তাই সমাজের মানুষ নানা কথা বলে। বাচ্চার বয়স হয়ে গেছে প্রায় ১০ মাস। বাচ্চাকে নিয়ে কোথাও যেতে পারে না। দেখলেই এই বাচ্চার বাবা কে, বাবা ছাড়া বাচ্চা- এরকম নানা কটুকথা শুনতে হয় তাকে। কোনো কাজ করতে পারে না। মেয়ের বাবা মাটিকাটা শ্রমিকের কাজ করেন। তার উপরই নির্ভর পুরো পরিবার।
নির্যাতিতা আরেক তরুণী লায়লা খাতুন। বাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলায় বাড়ি। নেশাগ্রস্থ স্বামী দুই সন্তান রেখে তাকে ছেড়ে চলে যায়। সন্তানদের নিয়ে কর্মহিন লায়লার অভাব যেন পিছু ছাড়ছিলোনা কোনোভাবেই। দালালের মাধ্যমে তিনি যান বিদেশে। লায়লার বয়স জাতীয় পরিচয়পত্রে ২২ বছর। কিন্তু দালাল পাসপোর্টে দেয় ২৫ বছর। এরপর দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সি নামিরা ওবারাসীজ (আর.এল-১০১৩)-এর জোগসাজেশে কোনরকম গামকার মেডিকেল চেকাপ ছাড়াই গত বছরের ২৬শে মার্চ সৌদি আরব যান। সৌদি বিমান বন্দর থেকে তাকে একজন সৌদিয়ান সারা দিন ঘুরিয়ে রাত ১০টার দিকে নিয়ে যায় একটি বাসায়। সেখানে রাতভর লায়লাকে নির্যাতন করে ৮-১০ পুরুষ। এই অবস্থায় দেশে ফিরতে চাইলে বাংলাদেশ রিক্রুটিং এজেন্সি অফিস কোনো সহযোগিতা করেনি। একপর্যায়ে পালিয়ে রাস্তায় বের হলে পুলিশ ধরে ফের মালিকের কাছে নিয়ে যায়। পুলিশকে ঘটনা খুলে বললে পুলিশ মালিকের কাছ থেকে বিমানটিকিট নিয়ে দেয়। গত ৩রা এপ্রিল দেশে ফিরেন তিনি।
দেশে আসার পর পরিবারও তাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। অবহেলার শিকার হচ্ছেন। একইভাবে দিনাজপুরের আয়শা ফিরতে পারছেন না মা-বাবার কাছে। বাবা কথা বলেন না তার সঙ্গে। কয়েকবার বাড়িতে গেলেও বের করে দিয়েছেন তাকে। এরকম অনেক নারীর ঠাঁই হচ্ছে না ঘরে। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে নির্যাতিতাতের সহযোগিতা করা হচ্ছে। কাউন্সিলিং করা হচ্ছে তাদের অভিভাবকদের। অনেকের ঠাঁই হচ্ছে, অনেকের হচ্ছে না। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম প্রধান শরিফুল হাসান জানান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা, নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন নারীরা। মানবিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এসব নির্যাতিত নারীর পাশে দাঁড়াচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে নির্যাতিাদের স্বজনরাই তাদের আশ্রয় দিচ্ছেন না। এসব বিষয়ে তাদের কাউন্সিলিং করা হচ্ছে। পুর্নবাসনের বিষয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। তাদের চিকিৎসা ও বিমানবন্দর থেকে বাড়ি পৌঁছার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে ব্র্যাক।
প্রবাসে নির্যাতনের বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা)’র মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন সৌদিতে। সেখানকার মালিক কর্তৃক। অথচ মামলা হচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সীর বিরুদ্ধে। নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে সে দেশে অবস্থান করেই অভিযোগ করতে হবে। এজন্য সেইফ হোম, দূতাবাস রয়েছে। তাদের মাধ্যমে অভিযোগ করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে।
নারী শ্রমিকদের নির্যাতন ও সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসসংস্থান মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে যারা কাজ করেন তারা এখন দেশের বাইরে আছেন। তারা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসসংস্থান মন্ত্রনালয় এসব বিষয়ে অত্যন্ত সচেষ্ট বলে জানান তিনি।
আর আস্তে আস্তে স্বপ্নগুলো তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। মনে হয়েছে, এ যেন জাহান্নামের চেয়ে ভয়াবহ। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কেউ আলিঙ্গন করেছেন মৃত্যুকে। কেউবা মরতে গিয়েও বেঁচে গেছেন। কেউ দেশে ফিরেছেন শরীরে নির্যাতনের চিহৃ নিয়ে। শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা। অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে ফিরেছেন কেউ কেউ। কেউ ফিরেছেন বাচ্চা কোলে নিয়ে। বিদেশের নির্যাতনের সেল থেকে ফিরলেও মুক্তি পাননি তারা। দেশের মাটিতে এসেও শান্তি, স্বস্তি মিলছে না কিছুতেই। ‘নষ্টা, দুশ্চরিত্রা, খারাপ মেয়ে’ অপবাদ জুটছে তাদের। অপবাদ দিয়ে দুরে সরে গেছে স্বজনরা। ঠাঁই হচ্ছে না স্বামীর ঘরে। এমনকি তাড়িয়ে দিচ্ছেন মা-বাবা, ভাইয়েরাও।
সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসেব অনুসারে নির্যাতনের শিকার হয়ে গত বছর সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন ১৩৫৩ নারী। এরমধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন ১৮ জন। অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেক নারী। গত বছর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা নারীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই সহস্রাধিকে।
তাদের একজন তাহমিনা খাতুন। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যই সৌদি আরবে গিয়েছিলেন তিনি। সৌদি আরব থেকে ফিরে ঠাঁই পাচ্ছেন না কোথাও। নষ্টা অপবাদ দিয়ে দুরে চলে গেছেন স্বামী। একই অপবাদ দিচ্ছেন মা-বাবাও। তাহমিনা জানান, বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে মা-বাবা, স্বামী কেউ রাজি ছিলেন না। কিন্তু সংসারে স্বচ্ছলতার জন্য পরিচিত একজনের উৎসাহে বিদেশে যান তিনি। সেখানে দিনের পর দিন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিষয়টি দেশের সবাই জেনেছে। তাই এখন সবাই তাকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে। স্বামী তাকে ঘরে আশ্রয় দেননি। মা-বাবাও খবর নেন না। এক বান্ধবীর সঙ্গে থাকছেন করাইল বস্তিতে।
কাজ করেন একটি গার্মেন্টে। তাহমিনা জানান, গত বছর সৌদি আরব যান তিনি। রিয়াদে এক আরব ব্যবসায়ীর বাসায় ছিলেন। গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। বাসায় ওই ব্যবসায়ীর বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও তিন ছেলে সন্তান ছিলো। তাহমিনা যে কক্ষে ঘুমাতেন ওই কক্ষে কোনো দরজা ছিল না। কয়েক দিন যেতে না যেতেই শুরু হয় সমস্যা। রাতের বেলা তার কক্ষে ঢুকেন গৃহকর্তা। ঝাপটে ধরেন তাকে। শরীরের সব শক্তি দিয়ে বাধা দিয়েও ব্যর্থ হন। ধর্ষণের শিকার হন তাহমিনা। বিষয়টি পরদিন ওই ব্যক্তির স্ত্রীকে জানান। স্ত্রী উল্টো ধমক দেন। বিষয়টি কাউকে বলতে বারণ করে তা মেনে নিতে বলেন। তাহমিনা জানান, তারপর থেকে গৃহকর্তার কাছে প্রায় রাতেই ধর্ষণের শিকার হচ্ছিলেন তিনি। এরমধ্যেই এক রাতে গৃহকর্তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেজো ছেলেও পিতার মতোই তাহমিনার কক্ষে ঢুকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। তাহমিনা চিৎকার করলে গৃহকর্তার স্ত্রী এগিয়ে যান।
এসময় ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় উল্টো তাকে মারধর করা হয়। পরের রাতে আবার তাহমিনার কক্ষে যায় ওই ছেলে। বাধা দিলে তাকে মারধর করা হয়। সে রাতে ধর্ষণের শিকার হন তিনি। তাহমিনা পালাতে চেয়েও পারেন না। দেশে স্বামীর কাছে ফোনে তাকে রক্ষা করতে অনুরোধ করেন। যেভাবেই হোক দেশে যেতে চান তিনি। স্বামী অনেক চেষ্টা করেও তাকে দেশে ফেরাতে পারছিলেন না। এভাবে কাটছিলো কয়েক মাস। যৌন নির্যাতন ছাড়াও বেতন চাইতে গেলেই তাকে মারধর করা হতো। একরাতে বাসা থেকে পালিয়ে যান। রাস্তায় এক বাঙালি শ্রমিকের সহযোগিতায় পৌঁছে যান সেইফ হোমে। কথা ছিলো তিনি বিচার পাবেন। কিন্তু বছরের পর বছর সেইফ হোমে থাকা নারীরা জানিয়েছেন বিচারের নামে দীর্ঘসূত্রিতার কথা। খেয়ে না খেয়ে সেইফ হোমে থাকার চেয়ে দেশে ফিরে আসাই ভালো মনে করেছিলেন তিনি। তাই পাওনা টাকা ছাড়াই দেশে ফিরেন তাহমিনা।
নির্যাতিতাদের মধ্যে একজন ইয়াসমিন। ১৯ বছরের এই অবিবাহিতা তরুণী বিদেশে শিকার হয়েছেন যৌন নির্যাতনের। শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন একটি সন্তান নিয়ে। তারপর থেকে নিজের মা, বাবা, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন কেউ তাকে গ্রহন করেননি। অথচ এই তরুণীর কোনো অপরাধ ছিলো না। দরিদ্র পরিবারের ইয়াসমিন মা-বাবার কষ্টের ভাগ নিতে চেয়েছিলেন। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে যখন আর্থিক টানাপোড়েনে দিন কাটাচ্ছিলেন তার বাবা ঠিক তখন ইয়াসমিন সংসারের হাল ধরতে এগিয়ে যান। স্থানীয় দালাল কাশেম মিয়ার সহযোগিতায় ২০১৬ সালে জর্ডানে যান তিনি। সেখানে একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন। এরই মধ্যে জর্ডানে পরিচয় হয় মানিকগঞ্জের মেয়ে সোনিয়ার সঙ্গে। মাত্র ১৫ হাজার টাকা বেতনে গৃহকর্মীর কাজ করে জেনে সোনিয়া তাকে আরও ভালো বেতনে চাকরির প্রস্তাব দেয়। ভালো কাজ, বেশি বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে সোনিয়া তাকে নিয়ে যায় একটি বাসায়। পাঁচতলা ওই বাসায় অন্তত ২০ জন মেয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশের পুরুষদের আনাগোনা।
এটি একটি পতিতালয়। পতিতাবৃত্তিতে ইয়াসমিন রাজি না হওয়ায় মারধর করা হয়। একপর্যায়ে জোর করে তাকে সেখানে ধর্ষণ করে কয়েক পুরুষ। এভাবেই বিদেশের মাটিতে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। নির্যাতনে এক সময় অসুস্থ হয়ে যান ইয়াসমিন। অসুস্থ অবস্থায় তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া হয়। দুই মাস কারাভোগের পর গত বছরের ১৭ই এপ্রিল দেশে ফিরেন তিনি। ততদিনে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ইয়াসমিন জানান, প্রথমে নিজেও বুঝতে পারেননি তিনি অন্তঃসত্ত্বা। তবে ছয় মাস পরে জানার পর তা আর নষ্ট করতে চাননি তিনি। এই অবস্থায় কেউ তাকে আশ্রয় দিতে চায়নি। নষ্টা মেয়ে বলে তাড়িয়ে দিচ্ছিলো সবাই। চেনা-অচেনা অনেকের আশ্রয়ে থাকতে হয়েছে। তবে এখন মা-বাবার সঙ্গেই আছেন তিনি। তার মা জানান, বাবার পরিচয় নেই বাচ্চার। তাই সমাজের মানুষ নানা কথা বলে। বাচ্চার বয়স হয়ে গেছে প্রায় ১০ মাস। বাচ্চাকে নিয়ে কোথাও যেতে পারে না। দেখলেই এই বাচ্চার বাবা কে, বাবা ছাড়া বাচ্চা- এরকম নানা কটুকথা শুনতে হয় তাকে। কোনো কাজ করতে পারে না। মেয়ের বাবা মাটিকাটা শ্রমিকের কাজ করেন। তার উপরই নির্ভর পুরো পরিবার।
নির্যাতিতা আরেক তরুণী লায়লা খাতুন। বাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলায় বাড়ি। নেশাগ্রস্থ স্বামী দুই সন্তান রেখে তাকে ছেড়ে চলে যায়। সন্তানদের নিয়ে কর্মহিন লায়লার অভাব যেন পিছু ছাড়ছিলোনা কোনোভাবেই। দালালের মাধ্যমে তিনি যান বিদেশে। লায়লার বয়স জাতীয় পরিচয়পত্রে ২২ বছর। কিন্তু দালাল পাসপোর্টে দেয় ২৫ বছর। এরপর দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সি নামিরা ওবারাসীজ (আর.এল-১০১৩)-এর জোগসাজেশে কোনরকম গামকার মেডিকেল চেকাপ ছাড়াই গত বছরের ২৬শে মার্চ সৌদি আরব যান। সৌদি বিমান বন্দর থেকে তাকে একজন সৌদিয়ান সারা দিন ঘুরিয়ে রাত ১০টার দিকে নিয়ে যায় একটি বাসায়। সেখানে রাতভর লায়লাকে নির্যাতন করে ৮-১০ পুরুষ। এই অবস্থায় দেশে ফিরতে চাইলে বাংলাদেশ রিক্রুটিং এজেন্সি অফিস কোনো সহযোগিতা করেনি। একপর্যায়ে পালিয়ে রাস্তায় বের হলে পুলিশ ধরে ফের মালিকের কাছে নিয়ে যায়। পুলিশকে ঘটনা খুলে বললে পুলিশ মালিকের কাছ থেকে বিমানটিকিট নিয়ে দেয়। গত ৩রা এপ্রিল দেশে ফিরেন তিনি।
দেশে আসার পর পরিবারও তাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। অবহেলার শিকার হচ্ছেন। একইভাবে দিনাজপুরের আয়শা ফিরতে পারছেন না মা-বাবার কাছে। বাবা কথা বলেন না তার সঙ্গে। কয়েকবার বাড়িতে গেলেও বের করে দিয়েছেন তাকে। এরকম অনেক নারীর ঠাঁই হচ্ছে না ঘরে। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে নির্যাতিতাতের সহযোগিতা করা হচ্ছে। কাউন্সিলিং করা হচ্ছে তাদের অভিভাবকদের। অনেকের ঠাঁই হচ্ছে, অনেকের হচ্ছে না। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম প্রধান শরিফুল হাসান জানান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা, নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন নারীরা। মানবিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এসব নির্যাতিত নারীর পাশে দাঁড়াচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে নির্যাতিাদের স্বজনরাই তাদের আশ্রয় দিচ্ছেন না। এসব বিষয়ে তাদের কাউন্সিলিং করা হচ্ছে। পুর্নবাসনের বিষয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। তাদের চিকিৎসা ও বিমানবন্দর থেকে বাড়ি পৌঁছার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে ব্র্যাক।
প্রবাসে নির্যাতনের বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা)’র মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন সৌদিতে। সেখানকার মালিক কর্তৃক। অথচ মামলা হচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সীর বিরুদ্ধে। নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে সে দেশে অবস্থান করেই অভিযোগ করতে হবে। এজন্য সেইফ হোম, দূতাবাস রয়েছে। তাদের মাধ্যমে অভিযোগ করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে।
নারী শ্রমিকদের নির্যাতন ও সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসসংস্থান মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে যারা কাজ করেন তারা এখন দেশের বাইরে আছেন। তারা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসসংস্থান মন্ত্রনালয় এসব বিষয়ে অত্যন্ত সচেষ্ট বলে জানান তিনি।
No comments