বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতা কি বাড়ছে? by জয়ন্ত ঘোষাল
ভারতের
বিভিন্ন সংবাদপত্রে ঢাকা থেকে পাঠানো সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের খবরে
প্রকাশিত হয়েছে যে নরেন্দ্র মোদি সরকারের কাশ্মীরসংক্রান্ত ৩৭০ নামের
অনুচ্ছেদটি অবলুপ্তিকে সমর্থন জানাল হাসিনা সরকার। খুব ভালো করে সংবাদটি
আবার পড়লাম। হেডিংয়ে যা-ই বলা হোক, বাংলাদেশ বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতিটি
মনোযোগ দিয়ে পড়লে দেখা যায়, ঢাকা বলছে এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
বাংলাদেশ আশা করে এই অঞ্চলটিতে শান্তি এবং সংহতি সুরক্ষিত হবে। এই বিবৃতিতে
কিন্তু কোথাও বলা হয়নি যে কাশ্মীরের এই সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশ মতাদর্শগত বা
নীতিগতভাবে সমর্থন করছে। কূটনৈতিকভাবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক
এখন সরকারি বা প্রশাসনিক স্তরে যথেষ্ট মধুর, কাজেই পাকিস্তানকে কোণঠাসা
করার জন্য বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সমর্থন ছিল বিশেষ জরুরি। এই
বিবৃতিটি ভারতও বিশেষভাবে চাইছিল।
আসলে বাংলাদেশের যুবসমাজে এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া কী, তা বেশ কিছুদিন ধরেই বুঝতে বা জানতে চাইছে ভারত। গোয়েন্দারাও বাংলাদেশের মানবজমিনের মনোভাব বুঝতে চাইছে। কিন্তু ভারত প্রশাসনের কেষ্টবিষ্টরাও জানতে পেরেছেন যে বাংলাদেশের আপামর সাধারণ মানুষের মধ্যে কিন্তু এক তীব্র ভারতবিরোধিতার আবেগ কাজ করছে। কেন এই ভারতবিরোধিতার আবেগ। দেখুন এই অনুভূতিটি খালেদার দল বিএনপি বা জামায়াতদের জন্য সৃষ্টি হয়েছে—এভাবে ব্যাখ্যা দেওয়াটা কিন্তু অতি সরলীকরণ। আসলে এই ভারতবিরোধিতার হাওয়াটার পেছনে আছে বেশ কিছু কারণ। বিগত ভোটে এবার বহু মানুষ ভোট দিতে পারেনি বলে অভিযোগ করছে, বিগত ভোট নিয়ে বহু মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের একাংশ তো বলছে, এবার নির্বাচনে ভারত সুষ্ঠু নির্বাচন হতে দেয়নি। ভারতের বিরুদ্ধে এই নালিশকে কাজে লাগাতে চাইছে জামায়াত জনসমাজ।
দ্বিতীয় কারণটি হলো, বাংলাদেশের জনসমাজে বাঙালি সত্তা বা পরিচয় যেমন আছে, তেমন আছে বাঙালি মুসলমান সমাজের পরিচয়। এই সত্তাটি হলো ইসলামিক সত্তা। এই সত্তাটি কিন্তু ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশ গঠনের পরও ছিল। এই মুসলমান সমাজ কিন্তু কাশ্মীরের এই সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্দিগ্ধচিত্ত। ইসলামের মধ্যে একধরনের পারস্পরিক সুসম্পর্কের ঐতিহ্যও আছে। ঢাকা বইমেলায় গিয়ে দেখেছি একদিকে বিক্রি হয় কোরআন শরিফ, আবার অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ এবং বাংলা সাহিত্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আজও বইয়ের বাজারে অপরিসীম আগ্রহ। বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষের মনস্তত্ত্বে এসবই আছে মিলেমিশে।
আজকের পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের কূটনৈতিক দিক থেকে বিশেষভাবে প্রয়োজন বাংলাদেশকে। এই প্রয়োজনীয়তার কারণগুলো আমি বারবার বিশ্লেষণ করি, আপনাদের জানাই; কিন্তু ভারতের রাজনেতাদের বাংলাদেশের জনমতকেও বুঝতে হবে। ঢাকা প্রেস ক্লাবে বসে আমি শুনেছি, আজ আবার ভারতবিরোধী জনমত খুব তীব্র হয়ে উঠছে। শুধু আর্থিক সাহায্য দিলেই সার্বভৌম বাংলাদেশের আপামর সাধারণ মানুষের মন পাওয়া যায় না। শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধেও জনমত ক্রমবর্ধমান। আওয়ামী লীগ একদা যেভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, আজ সেখানেও এসেছে নানা অবক্ষয়। আওয়ামী লীগের মতো দলের ভেতরও শুরু হয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। দুর্নীতি ভাঙন বেড়েছে। শেখ হাসিনারও বয়স হচ্ছে। তারপর কে আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন তা-ও আজও মীমাংসিত নয়। তাঁর ছেলে যদি রাজনীতিতে না আসেন, তবে কি তাঁর মেয়ে এসে হাল ধরবেন দলের? পরিবারের অন্য কোনো সদস্য? এসব প্রশ্ন ঢাকা থেকে দিল্লিতেও এসে আছড়ে পড়ছে। আর এসব দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে আবার সামরিক শক্তি উত্থিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে না তো?
১৯০৫ সালে ভারতের তৎকালীন বড় লাট লর্ড জর্জ নাথানিয়েল কার্জন বাংলা প্রদেশ ভাগ করেন, যা ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত। যদিও ছয় বছরের মধ্যে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ ও তার রদকে কেন্দ্র করে বাংলার প্রধান দুটি ধর্ম সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে তীব্র অনৈক্যের সূত্রপাত হয়। ১৯০৬ সালে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী পৃথক দল মুসলিম লীগ গঠন হয়। এই দল যেকোনো মূল্যে বঙ্গভঙ্গ বলবৎ রাখার পক্ষে ছিল। আবার ব্রিটিশ শাসকরা স্বীকার করে গেছেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধ্বংস করাই ছিল বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্য। বাঙালি ভদ্রলোকদের একাধিপত্য ধ্বংস করা ছিল বড় উদ্দেশ্য।
মোগল সম্রাটরা এবং বাংলার মুসলিম শাসকরাও সে সময়ে গ্রামের গরিব কৃষক ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহের জন্য বহু হিন্দু কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন। এই হিন্দু কর্মচারীরাও গরিব মুসলমান প্রজা-কৃষকদের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার চালায়। আদায় করা রাজস্বের একটা অংশ তারা নিজের কাছে রেখে অনেকেই ছোট ছোট জমিদার হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ জমানায় লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে এই জমিদার জোতদারদের আরো ক্ষমতা দিয়ে যান। এতে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরো বাড়ে। পূর্ব বাংলার কৃষকের ওপর দীর্ঘদিন ধরে কলকাতাবাসী জমিদাররা শোষণ করেন। এই জমিদার ও ব্রিটিশদের শোষণনীতি পূর্ব বাংলার মানুষদের ওপর কালোছায়া ফেলে, তাতেও বঙ্গভঙ্গের আন্দোলন আরো উদ্বুদ্ধ হয়।
নানাভাবে চিরকাল পূর্ব বাংলা নিগৃহীত হয়। পূর্ব বাংলার অর্থকরী ফসল পাট কিন্তু পূর্ব বাংলায় পাটকল তৈরি না করে বেশির ভাগ কলকাতার হুগলি নদীর তীরে গড়ে তোলা হয়। এর ফলে পাটের প্রকৃত মূল্য থেকে পূর্ব বাংলা বঞ্চিত হয়। ১৮৭১ সালের একটা হিসাবে অধ্যাপক বফিরউদ্দিন আহমেদ তাঁর গবেষণায় জানিয়েছিলেন যে বাংলার মুসলমান কর্মচারী ছিল মোট চাকরি বলয়ের ৫.৯ শতাংশ। মুসলমানদের প্রতি সরকারি অবহেলার চিত্রটিও এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আরো মজার ব্যাপার, ১৯০৫ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ হয় তখন উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তার বিরোধিতা করলেও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা বিশেষত নমঃশূদ্র যারা পূর্ব বাংলায় ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করে।
মজার ব্যাপার, ১৯০৫ সালে যে হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন, ১৯৪৭ সালে তাঁরাই আবার বাংলাদেশের বিভাগের দাবি করেন। আবার যে মুসলমান নেতারা ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গে খুশি হন, ১৯৪৭ সালে তাঁরা বাংলা বিভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন।
ভারত উপমহাদেশের বিভক্তিকরণ যখন প্রায় চূড়ান্ত, এমনকি এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন-সার্বভৌম অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎ বসুর সঙ্গে ঐকমত্যে উপনীত হয়ে ‘বসু-সোহরাওয়ার্দী’ প্রস্তাব গৃহীত হয়; কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও ব্রিটিশ সরকার কেউ সে প্রস্তাব মানেনি। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তাই শুরু হয় উর্দু ও বাংলা জাতীয়তাবাদের লড়াই। সেদিনের পাকিস্তানে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও জিন্নাহ চাপিয়ে দেন উর্দু জাতীয়তাবাদ। ১৯৪৮ সালের প্রথম থেকেই তাই শুরু হয়ে যায় ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বাংলার নতুন দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হয়।
মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক অত্যাচারের বিরুদ্ধে শুরু হয় আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক লড়াই।
আজ এত অতীত কেন ঘাঁটলাম, জানেন যখন দেখি ভারতের হিন্দু বিশ্লেষক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর পাকিস্তানবিরোধী যুদ্ধকেই তুলে ধরেন, আমার মনে হয় তাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘ ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বকে খাটো করা হয়।
আজও ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটা বড় অংশ এই ভুল করছে। বাংলাদেশের সমস্যাকে বাংলাদেশের প্রিজমে দেখুন। ভুটানের বিদেশনীতি আনুষ্ঠানিকভাবেই চুক্তি অনুসারে নেহরুর সময় থেকে ভারত নিয়ন্ত্রিত; কিন্তু সময় বদলে গেছে—ভুটানের মতো দেশও নবীন ব্রহ্ম ভারতের দাদাগিরি পছন্দ করে না, তাই ডোকলামের মতো ঘটনায় ভুটানের জমিতে চীনের আগ্রাসনের ঘটনা হচ্ছে। ভারত এখন ডোকলামের ঘটনার পর ভুটানের গুরুত্ব আরো অনেক বেশি অনুভব করছে। ঈশ্বর-আল্লাহর কাছে এই মিনতি—বাংলাদেশের মতো কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা যেন না ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশের সার্বভৌম আত্মমর্যাদাকে আন্তরিকভাবে মূল্য দেওয়া প্রয়োজন।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সমাজটাও স্থিতিশীল নয়, এটিও এক গতিশীল সমাজ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। মুজিবুর রহমানকে হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে; কিন্তু বাংলাদেশকে ইসলামীকরণ ও পাকিস্তানকরণের প্রভাব এমনভাবে জেঁকে বসেছিল যে তার অশুভ প্রভাব থেকে দেশকে মুক্ত করা আজ সহজ কাজ নয়।
সম্প্রতি নাগরিকত্ব বিল নিয়ে ভারতে নতুন করে হৈচৈ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশি চিহ্নিত করে ১০ লাখ অনাগরিককে আপাতত ডিটেনশন ক্যাম্পে রেখে ঢাকায় পাঠানোর রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হলে বাংলাদেশে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা নরেন্দ্র মোদি যে বুঝছেন না তা নয়। তিস্তা হয়নি, অতীতের গঙ্গা চুক্তিও সুষ্ঠুভাবে রূপায়ণ হয়নি। তাই অভিযোগ অনেক।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রেই পড়েছিলাম যে পদ্মা সেতু নির্মাণে চীনা ইঞ্জিনিয়ার কাজ করছেন। চীন ঋণ দিয়েছে ঢাকাকে। সেই সংবাদের ভিত্তিতে এই কলামে তা লেখায় বাংলাদেশের বহু পাঠক ক্ষুব্ধ। তাঁরা লিখেছেন, এই সেতুর কাজ বাংলাদেশ সরকার নিজের অর্থ দিয়েই করছে, চীনা সাহায্যে নয়। আমার তথ্য যদি ভুল হয়, তবে পাঠকের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
বাংলাদেশের আত্মমর্যাদাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আশা করি, নরেন্দ্র মোদির সময় এই বাঙালির ইতিহাস আজ ধারণ করে ঢাকার কূটনীতিকেও বিশেষভাবে মর্যাদা দেবেন, টেকেন ফর গ্রান্টেড কূটনীতির ফল মারাত্মক হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে।
আসলে বাংলাদেশের যুবসমাজে এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া কী, তা বেশ কিছুদিন ধরেই বুঝতে বা জানতে চাইছে ভারত। গোয়েন্দারাও বাংলাদেশের মানবজমিনের মনোভাব বুঝতে চাইছে। কিন্তু ভারত প্রশাসনের কেষ্টবিষ্টরাও জানতে পেরেছেন যে বাংলাদেশের আপামর সাধারণ মানুষের মধ্যে কিন্তু এক তীব্র ভারতবিরোধিতার আবেগ কাজ করছে। কেন এই ভারতবিরোধিতার আবেগ। দেখুন এই অনুভূতিটি খালেদার দল বিএনপি বা জামায়াতদের জন্য সৃষ্টি হয়েছে—এভাবে ব্যাখ্যা দেওয়াটা কিন্তু অতি সরলীকরণ। আসলে এই ভারতবিরোধিতার হাওয়াটার পেছনে আছে বেশ কিছু কারণ। বিগত ভোটে এবার বহু মানুষ ভোট দিতে পারেনি বলে অভিযোগ করছে, বিগত ভোট নিয়ে বহু মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের একাংশ তো বলছে, এবার নির্বাচনে ভারত সুষ্ঠু নির্বাচন হতে দেয়নি। ভারতের বিরুদ্ধে এই নালিশকে কাজে লাগাতে চাইছে জামায়াত জনসমাজ।
দ্বিতীয় কারণটি হলো, বাংলাদেশের জনসমাজে বাঙালি সত্তা বা পরিচয় যেমন আছে, তেমন আছে বাঙালি মুসলমান সমাজের পরিচয়। এই সত্তাটি হলো ইসলামিক সত্তা। এই সত্তাটি কিন্তু ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশ গঠনের পরও ছিল। এই মুসলমান সমাজ কিন্তু কাশ্মীরের এই সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্দিগ্ধচিত্ত। ইসলামের মধ্যে একধরনের পারস্পরিক সুসম্পর্কের ঐতিহ্যও আছে। ঢাকা বইমেলায় গিয়ে দেখেছি একদিকে বিক্রি হয় কোরআন শরিফ, আবার অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ এবং বাংলা সাহিত্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আজও বইয়ের বাজারে অপরিসীম আগ্রহ। বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষের মনস্তত্ত্বে এসবই আছে মিলেমিশে।
আজকের পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের কূটনৈতিক দিক থেকে বিশেষভাবে প্রয়োজন বাংলাদেশকে। এই প্রয়োজনীয়তার কারণগুলো আমি বারবার বিশ্লেষণ করি, আপনাদের জানাই; কিন্তু ভারতের রাজনেতাদের বাংলাদেশের জনমতকেও বুঝতে হবে। ঢাকা প্রেস ক্লাবে বসে আমি শুনেছি, আজ আবার ভারতবিরোধী জনমত খুব তীব্র হয়ে উঠছে। শুধু আর্থিক সাহায্য দিলেই সার্বভৌম বাংলাদেশের আপামর সাধারণ মানুষের মন পাওয়া যায় না। শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধেও জনমত ক্রমবর্ধমান। আওয়ামী লীগ একদা যেভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, আজ সেখানেও এসেছে নানা অবক্ষয়। আওয়ামী লীগের মতো দলের ভেতরও শুরু হয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। দুর্নীতি ভাঙন বেড়েছে। শেখ হাসিনারও বয়স হচ্ছে। তারপর কে আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন তা-ও আজও মীমাংসিত নয়। তাঁর ছেলে যদি রাজনীতিতে না আসেন, তবে কি তাঁর মেয়ে এসে হাল ধরবেন দলের? পরিবারের অন্য কোনো সদস্য? এসব প্রশ্ন ঢাকা থেকে দিল্লিতেও এসে আছড়ে পড়ছে। আর এসব দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে আবার সামরিক শক্তি উত্থিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে না তো?
১৯০৫ সালে ভারতের তৎকালীন বড় লাট লর্ড জর্জ নাথানিয়েল কার্জন বাংলা প্রদেশ ভাগ করেন, যা ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত। যদিও ছয় বছরের মধ্যে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ ও তার রদকে কেন্দ্র করে বাংলার প্রধান দুটি ধর্ম সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে তীব্র অনৈক্যের সূত্রপাত হয়। ১৯০৬ সালে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী পৃথক দল মুসলিম লীগ গঠন হয়। এই দল যেকোনো মূল্যে বঙ্গভঙ্গ বলবৎ রাখার পক্ষে ছিল। আবার ব্রিটিশ শাসকরা স্বীকার করে গেছেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধ্বংস করাই ছিল বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্য। বাঙালি ভদ্রলোকদের একাধিপত্য ধ্বংস করা ছিল বড় উদ্দেশ্য।
মোগল সম্রাটরা এবং বাংলার মুসলিম শাসকরাও সে সময়ে গ্রামের গরিব কৃষক ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহের জন্য বহু হিন্দু কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন। এই হিন্দু কর্মচারীরাও গরিব মুসলমান প্রজা-কৃষকদের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার চালায়। আদায় করা রাজস্বের একটা অংশ তারা নিজের কাছে রেখে অনেকেই ছোট ছোট জমিদার হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ জমানায় লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে এই জমিদার জোতদারদের আরো ক্ষমতা দিয়ে যান। এতে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরো বাড়ে। পূর্ব বাংলার কৃষকের ওপর দীর্ঘদিন ধরে কলকাতাবাসী জমিদাররা শোষণ করেন। এই জমিদার ও ব্রিটিশদের শোষণনীতি পূর্ব বাংলার মানুষদের ওপর কালোছায়া ফেলে, তাতেও বঙ্গভঙ্গের আন্দোলন আরো উদ্বুদ্ধ হয়।
নানাভাবে চিরকাল পূর্ব বাংলা নিগৃহীত হয়। পূর্ব বাংলার অর্থকরী ফসল পাট কিন্তু পূর্ব বাংলায় পাটকল তৈরি না করে বেশির ভাগ কলকাতার হুগলি নদীর তীরে গড়ে তোলা হয়। এর ফলে পাটের প্রকৃত মূল্য থেকে পূর্ব বাংলা বঞ্চিত হয়। ১৮৭১ সালের একটা হিসাবে অধ্যাপক বফিরউদ্দিন আহমেদ তাঁর গবেষণায় জানিয়েছিলেন যে বাংলার মুসলমান কর্মচারী ছিল মোট চাকরি বলয়ের ৫.৯ শতাংশ। মুসলমানদের প্রতি সরকারি অবহেলার চিত্রটিও এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আরো মজার ব্যাপার, ১৯০৫ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ হয় তখন উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তার বিরোধিতা করলেও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা বিশেষত নমঃশূদ্র যারা পূর্ব বাংলায় ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করে।
মজার ব্যাপার, ১৯০৫ সালে যে হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন, ১৯৪৭ সালে তাঁরাই আবার বাংলাদেশের বিভাগের দাবি করেন। আবার যে মুসলমান নেতারা ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গে খুশি হন, ১৯৪৭ সালে তাঁরা বাংলা বিভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন।
ভারত উপমহাদেশের বিভক্তিকরণ যখন প্রায় চূড়ান্ত, এমনকি এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন-সার্বভৌম অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎ বসুর সঙ্গে ঐকমত্যে উপনীত হয়ে ‘বসু-সোহরাওয়ার্দী’ প্রস্তাব গৃহীত হয়; কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও ব্রিটিশ সরকার কেউ সে প্রস্তাব মানেনি। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তাই শুরু হয় উর্দু ও বাংলা জাতীয়তাবাদের লড়াই। সেদিনের পাকিস্তানে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও জিন্নাহ চাপিয়ে দেন উর্দু জাতীয়তাবাদ। ১৯৪৮ সালের প্রথম থেকেই তাই শুরু হয়ে যায় ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বাংলার নতুন দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হয়।
মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক অত্যাচারের বিরুদ্ধে শুরু হয় আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক লড়াই।
আজ এত অতীত কেন ঘাঁটলাম, জানেন যখন দেখি ভারতের হিন্দু বিশ্লেষক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর পাকিস্তানবিরোধী যুদ্ধকেই তুলে ধরেন, আমার মনে হয় তাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘ ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বকে খাটো করা হয়।
আজও ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটা বড় অংশ এই ভুল করছে। বাংলাদেশের সমস্যাকে বাংলাদেশের প্রিজমে দেখুন। ভুটানের বিদেশনীতি আনুষ্ঠানিকভাবেই চুক্তি অনুসারে নেহরুর সময় থেকে ভারত নিয়ন্ত্রিত; কিন্তু সময় বদলে গেছে—ভুটানের মতো দেশও নবীন ব্রহ্ম ভারতের দাদাগিরি পছন্দ করে না, তাই ডোকলামের মতো ঘটনায় ভুটানের জমিতে চীনের আগ্রাসনের ঘটনা হচ্ছে। ভারত এখন ডোকলামের ঘটনার পর ভুটানের গুরুত্ব আরো অনেক বেশি অনুভব করছে। ঈশ্বর-আল্লাহর কাছে এই মিনতি—বাংলাদেশের মতো কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা যেন না ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশের সার্বভৌম আত্মমর্যাদাকে আন্তরিকভাবে মূল্য দেওয়া প্রয়োজন।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সমাজটাও স্থিতিশীল নয়, এটিও এক গতিশীল সমাজ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। মুজিবুর রহমানকে হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে; কিন্তু বাংলাদেশকে ইসলামীকরণ ও পাকিস্তানকরণের প্রভাব এমনভাবে জেঁকে বসেছিল যে তার অশুভ প্রভাব থেকে দেশকে মুক্ত করা আজ সহজ কাজ নয়।
সম্প্রতি নাগরিকত্ব বিল নিয়ে ভারতে নতুন করে হৈচৈ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশি চিহ্নিত করে ১০ লাখ অনাগরিককে আপাতত ডিটেনশন ক্যাম্পে রেখে ঢাকায় পাঠানোর রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হলে বাংলাদেশে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা নরেন্দ্র মোদি যে বুঝছেন না তা নয়। তিস্তা হয়নি, অতীতের গঙ্গা চুক্তিও সুষ্ঠুভাবে রূপায়ণ হয়নি। তাই অভিযোগ অনেক।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রেই পড়েছিলাম যে পদ্মা সেতু নির্মাণে চীনা ইঞ্জিনিয়ার কাজ করছেন। চীন ঋণ দিয়েছে ঢাকাকে। সেই সংবাদের ভিত্তিতে এই কলামে তা লেখায় বাংলাদেশের বহু পাঠক ক্ষুব্ধ। তাঁরা লিখেছেন, এই সেতুর কাজ বাংলাদেশ সরকার নিজের অর্থ দিয়েই করছে, চীনা সাহায্যে নয়। আমার তথ্য যদি ভুল হয়, তবে পাঠকের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
বাংলাদেশের আত্মমর্যাদাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আশা করি, নরেন্দ্র মোদির সময় এই বাঙালির ইতিহাস আজ ধারণ করে ঢাকার কূটনীতিকেও বিশেষভাবে মর্যাদা দেবেন, টেকেন ফর গ্রান্টেড কূটনীতির ফল মারাত্মক হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে।
>>>সাউথ এশিয়ান মনিটর,
No comments