বৃটেনে সাংবিধানিক সংকট, বিক্ষোভ

সাংবিধানিক সংকটে বৃটেন। সংকটের মূলে রয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বিচ্ছেদ বা ব্রেক্সিট। ব্রেক্সিট নিয়ে দেশটিতে নাটকীয়তার মাত্রা বেড়েই চলেছে। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দল তুমুল সমালোচনার মুখে এখন। ইতিমধ্যে দলটিতে ব্যাপক পরিসরে উত্থান-পতন দেখা গেছে। পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন দলটির সাবেক দুই প্রধান- ডেভিড ক্যামেরন ও তার উত্তরসূরি তেরেসা মে। দু’জনেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মে’র পর দলনেতা ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন।
সমপ্রতি পাঁচ সপ্তাহের জন্য পার্লামেন্ট মুলতবি রাখার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এ নিয়ে রানীর কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিলেন । রানী তার আবেদন গ্রহণ করেছেন। ব্রেক্সিট কার্যকরের সময় যখন ঘনিয়ে আসছে তখনই এমন সিদ্ধান্ত নিলেন জনসন। এ নিয়ে বিরোধীসহ নিজদলে থেকেও সমালোচিত হচ্ছেন তিনি। তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে, পদত্যাগ করেছেন তার দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী রুথ ডেভিডসন ও সরকারের হুইপ জর্জ ইয়ং। আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন বিরোধীরা।

আগামী ৩১শে অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। জনসনের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী মাসের শুরুর দিকে পার্লামেন্ট বন্ধ করে দেয়া হবে। তা খোলা হবে ১৪ই অক্টোবর। ঘোষণাটি কার্যকর হলে, ব্রেক্সিট নিয়ে বিতর্ক করার জন্য দুই সপ্তাহ সময় পাবেন সংসদ সদস্যরা। জনসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, চুক্তিহীন ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের জন্যই এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। তবে তিনি দাবি করেছেন, এই স্থগিতাবস্থা প্রয়োজনীয়। ১৪ই অক্টোবর চমৎকার একটি এজেন্ডা প্রকাশ করবে তার সরকার। তাছাড়া, এমপিরা বিতর্ক করার জন্য পর্যাপ্ত সময়ও পাবেন। তবে তার বক্তব্যে সমর্থন না দিয়ে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে পার্লামেন্ট বন্ধ করার বিরুদ্ধে।

বিক্ষোভ
দ্য টেলিগ্রাফ জানায়, বুধবার রাতে পার্লামেন্ট বন্ধের ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয় হাজার হাজার ব্রেক্সিট-বিরোধী। পাশাপাশি লন্ডনের অন্যান্য জায়গায়ও বিক্ষোভ করে শ’ শ’ মানুষ। টেমস নদীর কিনারে জড়ো হয়ে ইইউ’র পতাকা উড়িয়ে বিক্ষোভ করেন অনেকে। প্রধানমন্ত্রীকে ইঙ্গিত করে স্লোগান দেয়া হয়- আপনার ওপর লজ্জা ও এই অভ্যুত্থান বন্ধ করুন। বিক্ষোভে যোগ দেন সাংবাদিক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের ব্রেক্সিট বিরোধীরা।

বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন পার্লামেন্ট বন্ধের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেন, সরকার আমাদের গণতন্ত্রকে কেড়ে নিচ্ছে। এর উদ্দেশ্য পার্লামেন্টে আইন পাস করার জন্য এমপিদের যথেষ্ট সময় না দিয়ে একটি চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট সম্পাদন করা। তিনি এই স্থগিতাদেশ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বিবিসিকে জানান, আগামী সপ্তাহে পার্লামেন্ট খোলার পরপর বিরোধীদের প্রধান কাজ হবে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে রুখতে একটি বিল পাস করা। পাশাপাশি সরকারের বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা ভোটের প্রস্তাবও তোলা হবে বলে জানিয়েছেন এই বিরোধী নেতা।

সরকারের সমালোচনা করেছেন পার্লামেন্টের সিপকার জন বারকোও। সাধারণত রাজনৈতিক বিষয়ে মন্তব্য করে থাকেন না স্পিকার। তাই তার বক্তব্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বারকো বলেন, যেভাবেই উপস্থাপন করা হোক না কেন, এটা স্পষ্ট যে, ব্রেক্সিট নিয়ে পার্লামেন্টে বিতর্ক বন্ধ করতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছে জনসন সরকার। এটা জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন সময়গুলোর একটি। পার্লামেন্ট উন্মুক্ত থাকা আবশ্যিক।

আইনি চ্যালেঞ্জ
এদিকে, সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন বিরোধীরা। স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির মন্ত্রীদের পক্ষে স্কটল্যান্ডের একটি আদালতে পার্লামেন্ট বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে আবেদন জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তবে আবেদন নিয়ে শুনানিতে বসেনি আদালত। ২৪ ঘণ্টার জন্য আবেদনটির কার্যক্রম মুলতবি ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া, সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে একটি পিটিশন দাখিল করা হয়েছে। সেখানে স্বাক্ষর করেছেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। তাদের পক্ষে ইংল্যান্ডের এক দায়রা আদালতে সিদ্ধান্তটির বিরুদ্ধে আবেদন করেছে আইনজীবীদের একটি সংগঠন। সর্বশেষ প্রাপ্ত খবর অনুসারে, বেলফাস্টের একটি আদালতেও সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবেদন হয়েছে। সেখানে জরুরি বৈঠকে বসেছেন উচ্চ আদালতের বিচারকরা। 

পদত্যাগ
পার্লামেন্ট স্থগিত করার ঘোষণার বিরোধিতা ক্ষমতাসীনদের মধ্যেও দেখা গেছে। জনসনের সমালোচনা করেছেন কনজারভেটিভ পার্টির অনেক নেতা। ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ করেন স্কটিশ কনজারভেটিভ নেত্রী ডেভিডসন। এছাড়া আরো পদত্যাগ করেন সরকারের হুইপ জর্র্জ ইয়ং। ডেভিডসনের পদত্যাগ জনসনের জন্য প্রচণ্ড এক আঘাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। স্কাই নিউজ বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে বলেছে, এ কারণে স্কটল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচনে ডজনখানেক আসন হারাতে হতে পারে কনজারভেটিভ দলকে। ডেভিডসন তার পদত্যাগপত্রে লিখেন, ব্রেক্সিট ও পরিবার নিয়ে সবসময় দ্বিধায় ভুগেছেন তিনি। তা সত্ত্বেও নিজ দলের জন্য কাজ করে গেছেন এতদিন। সমপ্রতি প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি। তাই পরিবারকে সময় দিতে স্কটিশ কনজারভেটিভের দলপ্রধান হিসেবে পদত্যাগ করছেন তিনি। ওদিকে ইয়ং জানান, সরকারের সিদ্ধান্তের অত্যন্ত অখুশী তিনি। তাই হুইপ হিসেবে পদত্যাগ করছেন।

এদিকে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস স্বীকার করেছেন, এই অবস্থায় ব্রেক্সিট নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন তিনি। হেলসিনকিতে আয়োজিত এক সভায় তিনি বলেন, আমি জানি না এখন কী হবে। আচমকা দেখছি আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও জোট হারিয়ে ফেলেছি। এটা আমাদের ব্যবস্থার জন্য সহজ বিষয় নয়।
এদিকে, কনজারভেটিভ আইনপ্রণেতা কেন ক্লার্ক রয়টার্সকে  বলেছেন, জনসন নিশ্চিতভাবেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি একটি জনগণ বনাম বিদেশি এবং জনগণ বনাম পার্লামেন্ট নির্বাচন দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এসবের মধ্যে তিনি ডনাল্ড ট্রামেপর মতো, দেশকে বিশ্বের সবচেয়ে মহান দেশ বানানো, দেশপ্রেম ইত্যাদি বুলি ছুড়ছেন।

এমতাবস্থায়, আগামী সপ্তাহে পার্লামেন্ট খুললে জরুরি বিতর্কের আয়োজন করবে লেবার পার্টি। দলটির বাণিজ্য বিষয়ক মুখপাত্র ব্যারি গার্ডিনার রয়টার্সকে জানান, তারা চুক্তিহীন ব্রেক্সিট ঠেকাতে একটি আইন পাসের পরিকল্পনা করছেন।

No comments

Powered by Blogger.