তিউনিশিয়ায় আটকা বাংলাদেশিদের হুমকি মরবো তবু ফিরবো না আইওএম-এর বিরুদ্ধে জবরদস্তির অভিযোগ by মিজানুর রহমান
তিউনিশিয়ার
বিভিন্ন উপকূলে আটক এবং উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের দেশে ফেরানো নিয়ে ঢাকার
অস্বস্তি বাড়ছে। অনেকে ‘স্বেচ্ছায়’ ফিরলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি
এখনও দেশটিতে রয়ে গেছেন। তারা কোন অবস্থাতেই দেশে ফিরতে চাইছেন না বরং ফের
ইউরোপে পাড়ি দেয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। বিষয়টি ধড়া পড়ায় বিব্রত বাংলাদেশ।
তিউনিশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত
লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ সিকান্দার আলীও বাংলাদেশিদের
ফেরানো সংক্রান্ত জটিলতার কথা স্বীকার করেন। বলেন, ১১ জন বাংলাদেশি
‘স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনে’ অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। এর মধ্যে দু’জন পালিয়ে
গেছেন। তারা লিবিয়ায় ধরা পড়েছেন।
ফিরতে না চাওয়া ওই ব্যক্তিরা ‘আত্মহত্যা’র হুমকি দিচ্ছেন জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, তারা বলছেন, ‘মরবো, তবু ফিরবো না।’
ওই সব বাংলাদেশিদের দেশে ফেরানোর জন্য আইওএম জোর-দবরদস্তি করছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জেনেভাস্থ আইওএম হেডকোয়ার্টারে নালিশ দাখিল করা হয়েছে। বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিষয়ে বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম গার্ডিয়ান প্রকাশিত এক রিপোর্টে অভিযোগের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রের বরাতে সংবাদ মাধ্যমটি এ-ও জানিয়েছে- দেশে ফিরতে রাজী না হওয়া ৪ বাংলাদেশিকে গত সপ্তাহে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ‘শরণার্থী’র মর্যাদা দিয়েছে এবং তাদের গ্রহণ করেছে। যদিও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গার্ডিয়ানের রিপোর্টের ‘সবটুকু সত্য নয়’ বলে দাবি করেছেন। রাষ্ট্রদূত পাল্টা অভিযোগ করেন, কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠি যারা মানবপাচারে কোন না কোনভাবে যুক্ত তারা ‘অসত্য’ তথ্য সরবরাহ করে গার্ডিয়ানকে বিভ্রান্ত করেছে। তবে ওই রিপোর্টের বিষয়ে ঢাকা এখনও আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করেনি।
তিউনিশিয়াসহ ইউরোপ যাওয়ার পথে ট্রানজিট রুটগুলোতে আটকা এবং উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের ফেরানোর বিষয়ে গত ৫ই আগস্ট সেগুনবাগিচায় একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় তিউনিশিয়া থেকে ‘স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনে’ অস্বীকৃতি জানানো ১১ বাংলাদেশিকে সরকারি খরচে দেশে ফেরানোর সিদ্ধান্ত হয়। সভা সূত্র জানায়, ওই বাংলাদেশিদের ফেরাতে আইওএম অর্থায়ন না করার কথা জানিয়ে দিয়েছে। ফলে তাদের ফেরানো সংক্রান্ত ফান্ড জটিলতা পড়ে লিবিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস। রাষ্ট্রদূতের অনুরোধের প্রেক্ষিতে দূতবাসকে এ খাতে ১০ লাখ টাকা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে তাদের বুঝিয়ে দ্রুত বাংলাদেশে ফেরাতে দূতাবাসকে নির্দেশনা দেয়ার বিষয়ে সভা ঐকমত্যে পৌঁছায়।
রাষ্ট্রদূত শেখ সিকান্দার আলীর ভাষ্য মতে, সাগর পথে ইউরোপে পাড়ি দেয়ার সময় জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়া এবং বিকল অবস্থায় সাগরে ভাসতে থাকা একটি নৌকা থেকে ৬৪ বাংলাদেশিসহ ৭৫জন অভিবাসী উদ্ধার হয়েছিল মে মাসে। উদ্ধারকারী জাহাজেই তারা সাগরে প্রায় ৩ সপ্তাহ আটকা ছিলেন। ইউরোপের কোন দেশ তাদের গ্রহণ করছিলো না, আবার তিউনিশিয়ার সরকারও জাহাজ থেকে নামার অনুমতি দিচ্ছেলো না। রাষ্ট্রদূত ঘটনাস্থলে গিয়ে এবং তিউনিশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের গভর্ণরকে অনুরোধ করে ওই বাংলাদেশিদের ‘দেশে ফেরৎ পাঠানোর শর্তে’ উপকূলে নামিয়ে আনার অনুমতি আদায় করেছিল। কিন্তু এর মধ্যে ৫৩ জন স্বেচ্ছায় দেশে ফিরলেও ১১জন গো ধরে আছেন, তারা দেশে ফিরতে রাজী হচ্ছেন না। রাষ্ট্রদূত বলেন, ওই ১১ জনের দেশে ফেরানোর যাবতীয় ব্যয় নির্বাহে ঢাকা নির্দেশনা দিয়েছে। প্রয়োজনীয় বরাদ্দও দূতাবাসের অনুকূলে পৌঁছেছে। কিন্তু এখনও তাদের রাজী করানো যায়নি।
রাষ্ট্রদূত মানবজমিনকে বলেন, এটা আমার কমিটমেন্ট, বাংলাদেশের কমিটমেন্ট। গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের জাহাজ থেকে নামাতে পেরেছি। কিন্তু এখন তারা দেশে ফিরতে চাইছে না। রাষ্ট্রদূত বলেন, শুধু ওই ১১ জনই নয়, দেশটির বিভিন্ন উপকূলে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের বড় অংশ দেশে ফিরলেও অনেকে এখনও রয়ে গেছেন। তাদের দেশে ফেরানো না গেলে এবং দূতাবাসের কমিটমেন্ট রক্ষা না হলে পরবর্তীতে কোন দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে তিউনিস কতৃপক্ষ ভুক্তভোগীদের উপকূলেই ফেরাতে রাজী হবে না। তিনি বলেন, কোথাও কোন বাংলাদেশি বিপদে পড়েলে তাকে সর্বতোভাবে সহায়তা করতে সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুয়ায়ী রাষ্ট্রদূত এবং অন্যরা ঘটনাস্থলে যান, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করেন। কিন্তু কিছু মানুষের জন্য বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে এবং দেশগুলোর সহায়তা পাওয়ার পথও বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
কী বলেছে গার্ডিয়ান: দুনিয়া জুড়ে খ্যাতি পাওয়া বৃটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের খবর মতে, তিউনিশিয়ায় থাকা শিশুসহ বাংলাদেশি অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠাতে জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা রীতিমত চাপ দিচ্ছে। বাংলাদেশি অভিবাসীদের বরাতে সংস্থাটির বিরুদ্ধে জোর জবরদস্তির ‘গুরুতর’ ওই অভিযোগ আসার পর তিউনিশিয়াভিত্তিক এনজিও ফোরাম তিউনিশিয়েন পৌর লেস ড্রয়েটস ইকোনমিক্স এট সোসিয়াক্স (এফটিডিইএস) আগস্ট মাসে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করে। অভিবাসীরা অভিযোগ করে আসছেন, সাগর থেকে উদ্ধার হওয়ার পর থেকেই আইওএম কর্মকর্তা ও কূটনীতিকরা তাদের দেশে ফিরতে বাধ্য করছেন। তারা ফিরতে চান না, কিন্তু আইওএম তাদের ‘স্বেচ্ছায় দেশে ফেরা’ সংক্রান্ত একটি নথিতে সই নেয়ার চেষ্টা করছে। ওই সই না দিলে তাদের গ্রেপ্তারসহ নানাভাবে হয়রানি ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে তারা।
অভিবাসীরা এ-ও বলছে, বাংলাদেশ দূতাবাসের কূটনীতিকরাও তাদের সতর্ক করে বলেছেন যে, যদি তারা ‘স্বেচ্ছায়’ ফিরে যাওয়ার নথিতে স্বাক্ষর না করেন তাহলে তারা অঙ্গপাচারের শিকার হতে পারেন! অভিযোগে বলা হয়, অভিবাসীদের প্রতি আইওএম তিউনিশিয়ার আচরণের কারণে তাদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এফটিডিইএস অভিযোগটি দায়ের করেছে। অভিবাসীদের সবাই প্রায় অভিন্ন সুরে কথা বলেছেন। তাদের সাক্ষ্যে সামঞ্জস্য ছিল। সবাই আইওএমের বিরুদ্ধে অসদাচরণের কথা বলেছেন।
গত মে মাসে ম্যারিডাইব-৬০১ নামের একটি জাহাজ থেকে এই অভিবাসীদের উদ্ধার করা হয়। কোনও ইউরোপীয় দেশ তাদের গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে সাগরেই তারা প্রায় তিন সপ্তাহ আটকা ছিলেন। এফটিডিইএস’এর বরাতে গার্ডিয়ান জানায়, আইওএম কর্মীরা তাদের বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়ার বিষয়ে সাক্ষাৎকারে প্রচণ্ড মানসিক চাপ দিয়েছে। যখন তারা নথিতে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানায় তখন ওই চাপ আরও বাড়ানো হয়। তবে ওই রিপোর্টেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশি অভিবাসীদের ‘চাপ’ দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে আইওএম কতৃপক্ষ। সংস্থাটি দাবি করেছে, তারা শুধু অভিবাসীদের নথিপত্রগুলো বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিউনিশিয়ায় থাকা এবং আশ্রয় চাওয়া সংক্রান্ত অধিকারসসহ সব ধরনের বিকল্পের বিষয়ে তাদের সচেতন করেছে মাত্র।
৯ জন বাংলাদেশি দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তারা মনে করেন আইওএম সব বাংলাদেশিকে নৌকায় থাকার সময় ও পরে নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য মানসিক চাপ দিয়েছে।
এক অভিবাসী বলেন, আইওএম আমাদের একটি কাগজ দেয়। এতে বলা হয়, কেউ আমাদের ফেরত যাওয়ার জন্য জোর করতে পারবে না। তারা আমাদের বলেছে তিউনিশিয়া পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করবে এবং তারা জানে না কখন মুক্তি দেয়া হবে। বাংলাদেশ ও তিউনিশিয়া সরকার কোনও সহযোগিতা করছে না জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা এখানে থাকতে চাই। আরেক অভিবাসী বলেন, প্রতিদিন তারা আমাদের জিজ্ঞেস করে আমরা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছি? তারা জানে আমরা ফেরত যেতে চাই না। তবুও তারা আমাদের বিরক্ত করেই যাচ্ছে। গার্ডিয়ান তিউনিশিয়ার দায়িত্বে থাকা ত্রিপোলির বাংলাদেশ দূতাবাসের এক মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। তবে ওই মুখপাত্র এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।
বাংলাদেশে ফেরত যাওয়া এড়াতে তিউনিশিয়ার একটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়া এক কিশোর পুনরায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেছেন জানিয়ে গার্ডিয়ানের রিপোর্টে বলা হয়- তাকে বহনকারী নৌকা আটকে দেয়ায় তার সেই স্বপ্ন পুরণ হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে ওই কিশোর এখন লিবিয়ার কোনও আটক কেন্দ্রে রয়েছেন।
আইওএম-র মুখপাত্র লিওনার্দ ডোয়েলকে উদ্বৃত করে রিপোর্টে বলা হয়- মুখপাত্র তাদের বিরুদ্ধে জোর-জবরদস্তির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, যারা নিজ নিজ দেশে ফিরতে চেয়েছে তাদের পরামর্শ ও নথিপত্র বুঝিয়ে দিয়েছে আইওএম। তাদের আশ্রয়সহ সব ধরনের বিকল্পের বিষয়েও অবিহিত করা হয়েছে। তিউনিশিয়ায় যারা আশ্রয়ের আবেদনে আগ্রহী নয় তাদের বসবাসের অনুমতির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানানো হয়েছে। লিওনার্দ বলেন, তিউনিসিয়ায় থাকতে হলে পাসপোর্ট থাকা জরুরি। আইওএম কর্মীরা অভিবাসীদের এসব বিষয়ও বুঝিয়েছেন। তাদের সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। তিনি বলেন, অভিবাসীদের সব ধরনের তথ্য জানায় আইওএম, যাতে তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
ফিরতে না চাওয়া ওই ব্যক্তিরা ‘আত্মহত্যা’র হুমকি দিচ্ছেন জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, তারা বলছেন, ‘মরবো, তবু ফিরবো না।’
ওই সব বাংলাদেশিদের দেশে ফেরানোর জন্য আইওএম জোর-দবরদস্তি করছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জেনেভাস্থ আইওএম হেডকোয়ার্টারে নালিশ দাখিল করা হয়েছে। বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিষয়ে বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম গার্ডিয়ান প্রকাশিত এক রিপোর্টে অভিযোগের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রের বরাতে সংবাদ মাধ্যমটি এ-ও জানিয়েছে- দেশে ফিরতে রাজী না হওয়া ৪ বাংলাদেশিকে গত সপ্তাহে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ‘শরণার্থী’র মর্যাদা দিয়েছে এবং তাদের গ্রহণ করেছে। যদিও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গার্ডিয়ানের রিপোর্টের ‘সবটুকু সত্য নয়’ বলে দাবি করেছেন। রাষ্ট্রদূত পাল্টা অভিযোগ করেন, কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠি যারা মানবপাচারে কোন না কোনভাবে যুক্ত তারা ‘অসত্য’ তথ্য সরবরাহ করে গার্ডিয়ানকে বিভ্রান্ত করেছে। তবে ওই রিপোর্টের বিষয়ে ঢাকা এখনও আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করেনি।
তিউনিশিয়াসহ ইউরোপ যাওয়ার পথে ট্রানজিট রুটগুলোতে আটকা এবং উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের ফেরানোর বিষয়ে গত ৫ই আগস্ট সেগুনবাগিচায় একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় তিউনিশিয়া থেকে ‘স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনে’ অস্বীকৃতি জানানো ১১ বাংলাদেশিকে সরকারি খরচে দেশে ফেরানোর সিদ্ধান্ত হয়। সভা সূত্র জানায়, ওই বাংলাদেশিদের ফেরাতে আইওএম অর্থায়ন না করার কথা জানিয়ে দিয়েছে। ফলে তাদের ফেরানো সংক্রান্ত ফান্ড জটিলতা পড়ে লিবিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস। রাষ্ট্রদূতের অনুরোধের প্রেক্ষিতে দূতবাসকে এ খাতে ১০ লাখ টাকা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে তাদের বুঝিয়ে দ্রুত বাংলাদেশে ফেরাতে দূতাবাসকে নির্দেশনা দেয়ার বিষয়ে সভা ঐকমত্যে পৌঁছায়।
রাষ্ট্রদূত শেখ সিকান্দার আলীর ভাষ্য মতে, সাগর পথে ইউরোপে পাড়ি দেয়ার সময় জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়া এবং বিকল অবস্থায় সাগরে ভাসতে থাকা একটি নৌকা থেকে ৬৪ বাংলাদেশিসহ ৭৫জন অভিবাসী উদ্ধার হয়েছিল মে মাসে। উদ্ধারকারী জাহাজেই তারা সাগরে প্রায় ৩ সপ্তাহ আটকা ছিলেন। ইউরোপের কোন দেশ তাদের গ্রহণ করছিলো না, আবার তিউনিশিয়ার সরকারও জাহাজ থেকে নামার অনুমতি দিচ্ছেলো না। রাষ্ট্রদূত ঘটনাস্থলে গিয়ে এবং তিউনিশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের গভর্ণরকে অনুরোধ করে ওই বাংলাদেশিদের ‘দেশে ফেরৎ পাঠানোর শর্তে’ উপকূলে নামিয়ে আনার অনুমতি আদায় করেছিল। কিন্তু এর মধ্যে ৫৩ জন স্বেচ্ছায় দেশে ফিরলেও ১১জন গো ধরে আছেন, তারা দেশে ফিরতে রাজী হচ্ছেন না। রাষ্ট্রদূত বলেন, ওই ১১ জনের দেশে ফেরানোর যাবতীয় ব্যয় নির্বাহে ঢাকা নির্দেশনা দিয়েছে। প্রয়োজনীয় বরাদ্দও দূতাবাসের অনুকূলে পৌঁছেছে। কিন্তু এখনও তাদের রাজী করানো যায়নি।
রাষ্ট্রদূত মানবজমিনকে বলেন, এটা আমার কমিটমেন্ট, বাংলাদেশের কমিটমেন্ট। গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের জাহাজ থেকে নামাতে পেরেছি। কিন্তু এখন তারা দেশে ফিরতে চাইছে না। রাষ্ট্রদূত বলেন, শুধু ওই ১১ জনই নয়, দেশটির বিভিন্ন উপকূলে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের বড় অংশ দেশে ফিরলেও অনেকে এখনও রয়ে গেছেন। তাদের দেশে ফেরানো না গেলে এবং দূতাবাসের কমিটমেন্ট রক্ষা না হলে পরবর্তীতে কোন দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে তিউনিস কতৃপক্ষ ভুক্তভোগীদের উপকূলেই ফেরাতে রাজী হবে না। তিনি বলেন, কোথাও কোন বাংলাদেশি বিপদে পড়েলে তাকে সর্বতোভাবে সহায়তা করতে সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুয়ায়ী রাষ্ট্রদূত এবং অন্যরা ঘটনাস্থলে যান, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করেন। কিন্তু কিছু মানুষের জন্য বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে এবং দেশগুলোর সহায়তা পাওয়ার পথও বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
কী বলেছে গার্ডিয়ান: দুনিয়া জুড়ে খ্যাতি পাওয়া বৃটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের খবর মতে, তিউনিশিয়ায় থাকা শিশুসহ বাংলাদেশি অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠাতে জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা রীতিমত চাপ দিচ্ছে। বাংলাদেশি অভিবাসীদের বরাতে সংস্থাটির বিরুদ্ধে জোর জবরদস্তির ‘গুরুতর’ ওই অভিযোগ আসার পর তিউনিশিয়াভিত্তিক এনজিও ফোরাম তিউনিশিয়েন পৌর লেস ড্রয়েটস ইকোনমিক্স এট সোসিয়াক্স (এফটিডিইএস) আগস্ট মাসে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করে। অভিবাসীরা অভিযোগ করে আসছেন, সাগর থেকে উদ্ধার হওয়ার পর থেকেই আইওএম কর্মকর্তা ও কূটনীতিকরা তাদের দেশে ফিরতে বাধ্য করছেন। তারা ফিরতে চান না, কিন্তু আইওএম তাদের ‘স্বেচ্ছায় দেশে ফেরা’ সংক্রান্ত একটি নথিতে সই নেয়ার চেষ্টা করছে। ওই সই না দিলে তাদের গ্রেপ্তারসহ নানাভাবে হয়রানি ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে তারা।
অভিবাসীরা এ-ও বলছে, বাংলাদেশ দূতাবাসের কূটনীতিকরাও তাদের সতর্ক করে বলেছেন যে, যদি তারা ‘স্বেচ্ছায়’ ফিরে যাওয়ার নথিতে স্বাক্ষর না করেন তাহলে তারা অঙ্গপাচারের শিকার হতে পারেন! অভিযোগে বলা হয়, অভিবাসীদের প্রতি আইওএম তিউনিশিয়ার আচরণের কারণে তাদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এফটিডিইএস অভিযোগটি দায়ের করেছে। অভিবাসীদের সবাই প্রায় অভিন্ন সুরে কথা বলেছেন। তাদের সাক্ষ্যে সামঞ্জস্য ছিল। সবাই আইওএমের বিরুদ্ধে অসদাচরণের কথা বলেছেন।
গত মে মাসে ম্যারিডাইব-৬০১ নামের একটি জাহাজ থেকে এই অভিবাসীদের উদ্ধার করা হয়। কোনও ইউরোপীয় দেশ তাদের গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে সাগরেই তারা প্রায় তিন সপ্তাহ আটকা ছিলেন। এফটিডিইএস’এর বরাতে গার্ডিয়ান জানায়, আইওএম কর্মীরা তাদের বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়ার বিষয়ে সাক্ষাৎকারে প্রচণ্ড মানসিক চাপ দিয়েছে। যখন তারা নথিতে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানায় তখন ওই চাপ আরও বাড়ানো হয়। তবে ওই রিপোর্টেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশি অভিবাসীদের ‘চাপ’ দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে আইওএম কতৃপক্ষ। সংস্থাটি দাবি করেছে, তারা শুধু অভিবাসীদের নথিপত্রগুলো বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিউনিশিয়ায় থাকা এবং আশ্রয় চাওয়া সংক্রান্ত অধিকারসসহ সব ধরনের বিকল্পের বিষয়ে তাদের সচেতন করেছে মাত্র।
৯ জন বাংলাদেশি দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তারা মনে করেন আইওএম সব বাংলাদেশিকে নৌকায় থাকার সময় ও পরে নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য মানসিক চাপ দিয়েছে।
এক অভিবাসী বলেন, আইওএম আমাদের একটি কাগজ দেয়। এতে বলা হয়, কেউ আমাদের ফেরত যাওয়ার জন্য জোর করতে পারবে না। তারা আমাদের বলেছে তিউনিশিয়া পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করবে এবং তারা জানে না কখন মুক্তি দেয়া হবে। বাংলাদেশ ও তিউনিশিয়া সরকার কোনও সহযোগিতা করছে না জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা এখানে থাকতে চাই। আরেক অভিবাসী বলেন, প্রতিদিন তারা আমাদের জিজ্ঞেস করে আমরা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছি? তারা জানে আমরা ফেরত যেতে চাই না। তবুও তারা আমাদের বিরক্ত করেই যাচ্ছে। গার্ডিয়ান তিউনিশিয়ার দায়িত্বে থাকা ত্রিপোলির বাংলাদেশ দূতাবাসের এক মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। তবে ওই মুখপাত্র এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।
বাংলাদেশে ফেরত যাওয়া এড়াতে তিউনিশিয়ার একটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়া এক কিশোর পুনরায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেছেন জানিয়ে গার্ডিয়ানের রিপোর্টে বলা হয়- তাকে বহনকারী নৌকা আটকে দেয়ায় তার সেই স্বপ্ন পুরণ হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে ওই কিশোর এখন লিবিয়ার কোনও আটক কেন্দ্রে রয়েছেন।
আইওএম-র মুখপাত্র লিওনার্দ ডোয়েলকে উদ্বৃত করে রিপোর্টে বলা হয়- মুখপাত্র তাদের বিরুদ্ধে জোর-জবরদস্তির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, যারা নিজ নিজ দেশে ফিরতে চেয়েছে তাদের পরামর্শ ও নথিপত্র বুঝিয়ে দিয়েছে আইওএম। তাদের আশ্রয়সহ সব ধরনের বিকল্পের বিষয়েও অবিহিত করা হয়েছে। তিউনিশিয়ায় যারা আশ্রয়ের আবেদনে আগ্রহী নয় তাদের বসবাসের অনুমতির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানানো হয়েছে। লিওনার্দ বলেন, তিউনিসিয়ায় থাকতে হলে পাসপোর্ট থাকা জরুরি। আইওএম কর্মীরা অভিবাসীদের এসব বিষয়ও বুঝিয়েছেন। তাদের সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। তিনি বলেন, অভিবাসীদের সব ধরনের তথ্য জানায় আইওএম, যাতে তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
No comments