বাংলাদেশে নামে মাত্র সংসদীয় গণতন্ত্র আছে -_টিআইবি by কাদির কল্লোল
বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি'র এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত
১০ম সংসদে কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় ঐ সংসদ থেকে ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র
ক্ষমতার চর্চা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলেছেন, এর প্রভাবে সংসদীয় গণতন্ত্র নামেমাত্র একটা অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
২০১৪
সালের ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত গত সংসদের কর্মকাণ্ড
নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি তাদের গবেষণা
প্রতিবেদন বুধবার প্রকাশ করেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা এই বক্তব্য নাকচ করেছেন।
তারা বলেছেন, দশম সংসদ কার্যকরভাবেই সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছে।
আগের সংসদগুলো থেকে দশম সংসদকে আলাদা এবং ব্যতিক্রমী বলে অভিহিত করেছে টিআইবি।
তাদের
গবেষণায় গত সংসদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে
বিরোধীদলের পরিচয় সংকট এবং সরকারি দলের একচ্ছত্র ক্ষমতা বিস্তারের
বিষয়কে।
বাংলাদেশ সর্বশেষ দুটো সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে |
তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর আওয়ামী লীগ
সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করেছিল বিএনপি এবং
তাদের শরিকরা।
তবে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত ঐ দশম সংসদে
জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারে মন্ত্রী সভায় যোগ
দিয়েছিল। একইসাথে জাতীয় পার্টি বিরোধীদলের আসনে বসেছিল।
টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ১৯৯১ সালে সংসদীয়
গণতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিরোধীদলের সংসদ বর্জন করা একটা
সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিল।
দশম সংসদ সেই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে
এসেছে চড়া দামে বিরোধীদলের অনুপস্থিতিতে। কিন্তু ঐ সংসদ থেকে সংসদীয়
পদ্ধতিই হুমকির মুখে পড়ে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
"বিরোধীদল বলতে যা
বোঝায়, সেটারই উপস্থিতি থাকলো না। ....যার ফলে বিরোধী দল হিসেবে যাদেরকে
বলা হলো, তারা একদিকে সরকারি দলে এবং আরেকদিকে বিরোধীদলে। ফলে তাদের একটা
আত্মপরিচয় সংকট প্রথম দিন থেকেই ছিল," বলছিলেন মি: জামান।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান |
তিনি
বলেন, "এটা একটা মকারির (প্রহসন) মতো জায়গায় চলে গেছে। এটা নামে সংসদীয়
গণতন্ত্র রয়েছে।কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে আইন প্রণয়ন এবং সরকারকে
জবাবদিহিতার জায়গায় আনা, সেক্ষেত্রে কিন্তু এটা মোটেই কার্যকর হয়েছে,
সেটা বলা যাবে না।"
যদিও দশম সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। বিরোধীদল দাবিদার জাতীয় পার্টিও একইসাথে ছিল সরকারের অংশীদার।
এরপরও
অন্যান্য সংসদের মতো ঐ সংসদে একটা বড় সমস্যা ছিল কোরাম সংকট। টিআইবি
তাদের গবেষণায় বলেছে, গত সংসদে কোরাম সংকটের কারণে প্রায় ২০০ ঘণ্টা অপচয়
হয়েছে।
সংস্থাটি এর আর্থিক মূল্য দেখিয়েছে প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা।
এছাড়া
তাদের গবেষণায় আরেকটি বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিএনপি গত
সংসদে না থাকলেও তাদের বিরুদ্ধেই অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার করে সমালোচনা বেশি
করা হয়েছে।
টিআইবি'র বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন আওয়ামী লীগের
সিনিয়র নেত্রী মতিয়া চৌধুরী। তিনি বলেছেন, গত সংসদের কার্যকর ভূমিকার
কারণেই সংসদীয় গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।
মতিয়া চৌধুরী বলেন, "পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের জনক হলো গ্রেট ব্রিটেন।
তারা কমনওয়েলথভুক্ত দেশ। সেই কমনওয়েলথ পার্লামেন্ট এসোসিয়েশন
চেয়ারপার্সন হয়েছিলেন আমাদের দশম সংসদের স্পিকার এবং আইপিইউ এর
প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন আমাদের সংসদসদস্য।বিদেশীরা কেউ এটা নিয়ে প্রশ্ন
করলো না।কিন্তু টিআইবি'র কাছে এটা অপাক্তেয় হয়ে গেলো।"
"বিএনপি না আসলেই যে পার্লামেন্টে আর কেউ আসে নাই তাতো নয়।"
সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়াও টিআইবি'র বক্তব্য মানতে রাজি নন।
তিনি বলেছেন, দশম সংসদ আইন প্রণয়নসহ মৌলিক কাজগুলো জবাবদিহিতার সাথেই করেছে।
ডেপুটি
স্পিকার বলেন, "বিরোধীদল পার্লামেন্টে ছিল। এখন বিরোধীদল ওয়াক-আউট বা
হৈচৈ না করলে তাকে যদি বিরোধীদল মনে না হয়, তাহলে সেটা দু:খজনক"
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা মতিয়া চৌধুরী |
"গত
দশম সংসদে যত আইন পাশ করেছে এবং যত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার সবই
গণতান্ত্রিক-ভাবে হয়েছে। যদি ফাইল স্পিকারের দিকে ছুঁড়ে মারাটা গণতন্ত্র
হয়, তবে সেই গণতন্ত্র আমরা করি নাই," বলছিলেন ডেপুটি স্পিকার।
তবে
টিআইবি'র ইফতেখারুজ্জামানের বক্তব্য হচ্ছে, আইন প্রণয়নের মৌলিক কাজটি করার
ক্ষেত্রেও সংসদ সদস্যদের আগ্রহ কম ছিল এবং সংসদীয় কমিটিগুলোর কার্যকারিতা
সেভাবে ছিল না।
"গত সংসদে যে আইনগুলো পাশ হয়েছে তার ৭১ শতাংশ আইনই
এক থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে পাশ হয়েছে। সংসদ সদস্যরা আগ্রহ নিয়ে আইন
প্রণয়নে অংশ নেননি। তারা আলোচনায়ও সেভাবে অংশ নেননি।ফলে সংসদ কার্যকর বা
জবাবদিহি হচ্ছে বলা যায় না," বলছিলেন মি: জামান।
এদিকে বর্তমান একাদশ সংসদে কয়েকজন হলেও বিএনপিরও প্রতিনিধি রয়েছে।
সেখানে
সরকারি দলকে এখন একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত না নিয়ে সংসদে সব দলের মতামতকে
গুরুত্ব দিয়ে পরিস্থিতির পরিবর্তন করা উচিত বলে টিআইবি সুপারিশ করেছে।
No comments