প্রত্যাবাসন নিয়ে কীভাবে এগুতে চায় বাংলাদেশ: -ব্রিফিংয়ে কূটনীতিকদের জিজ্ঞাসা
দ্বিতীয়
দফায় প্রত্যাবাসন চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে
বাংলাদেশ এখন কিভাবে এগিয়ে যেতে চায়? মোটাদাগে সেটাই জানতে চেয়েছেন ঢাকাস্থ
বিদেশি কূটনীতিকরা। গতকাল বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায়
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের ব্রিফিংয়ে তারা এটা জানতে চান।
মিয়ানমারের অস্পষ্টতা এবং বর্মী বর্বরতায় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মাঝে
আস্থা পূণঃপ্রতিষ্ঠায় নেপি’ডর ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশের পূর্ণ প্রস্তুতি
সত্ত্বেও প্রত্যাবাসান হয়নি বলে দুনিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতেই পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয় তথা সরকার ওই কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেছিল। ব্রিফিংয়ে
প্রায় অর্ধশতাধিক রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং আঞ্চলিক সংগঠনের
প্রতিনিধি আমন্ত্রিত ছিলেন। মন্ত্রী মোমেনের সঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
শাহরিয়ার আলম এমপি, মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. শহীদুল হক, সচিব
মাহবুব-উজ-জামান সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছিলেন। ঢাকাস্থ মার্কিন
রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো,
বৃটেনের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনার খানবার হোসেইন বরসহ বিভিন্ন দেশের জ্যেষ্ঠ
কূটনীতিকরা ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। তবে সেখানে মিয়ানমারের কোন প্রতিনিধি
ছিলেন না।
কূটনীতিকদের বিদায়ের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. মোমেন গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে অবহিত করেন।
দেশি-বিদেশি অন্য কূটনীতিকরাও এ বিষয়ে আনানুষ্ঠানিভাবে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সূত্র মতে, বৈঠকে মন্ত্রী বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। জবাবে কূটনীতিকরা ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যে উজ্জ্বল হয়েছে সেটি পূনরুল্লেখ করে সরকার এবং জনগনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মন্ত্রী তার বক্তব্যে প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত ছিল সেটি ব্যাখ্যা করেন, আমরা যা করেছি তা দুনিয়া দেখেছে। আমাদের সব কিছু অত্যন্ত স্বচ্ছ ছিল। মাঠ পর্যায়ে প্রত্যাবাসনের জন্য লজিস্টিক থেকে শুরু করে যেসব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল- তা চীন এবং মিয়ানমারের প্রতিনিধি সরজমিনে প্রত্যক্ষ করেছেন বলেও বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের জানান মন্ত্রী। তিনি এ-ও বলেন, প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়া ছাড়া অন্য কিছু করার নেই।
প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের রাজী করানো, রাখাইনে প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি, মিয়ানমার সরকারের কার্যক্রমে বাস্তুচ্যুতদের মাঝে যে আস্থা সঙ্কট তৈরি হয়েছে- সেটি দূর করা একান্তভাবেই মিয়ানমারের দায়িত্ব। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ কী করতে পারে? মন্ত্রী এ নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ, আলোচনা এবং পরবর্তী সংলাপ চলবে জানিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি সঙ্কট উত্তরণে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক এবং মানবিক সাপোর্ট অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে এই সঙ্কট যারা সৃষ্টি করেছে সেই মিয়ানমার যেন তার দায়বদ্ধতা এবং অঙ্গীকারের বাস্তবায়নে বাধ্য হয় অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং অধিকারের সঙ্গে তাদের স্ব-ভূমে (রাখাইনে) ফেরত নেয় সেই চাপ অব্যাহত রাখতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। সূত্র মতে, উপস্থিত কূটনীতিকরা মন্ত্রীর দীর্ঘ এবং খোলামেলা বক্তব্য অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। অন্যান্য ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন বা মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া সময় ভিন্নমত এলেও গতকাল ছিল ব্যতিক্রম। সেখানে মন্ত্রীর বক্তব্যের পর বৃটেন, ইতালী, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা কথা বলেছেন। তারা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াই দিয়েছেন। একই সঙ্গে এ ইস্যুতে বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপ আরও স্পষ্টভাবে জানার আগ্রহ ছিল তাদের। মন্ত্রী সেটি স্পষ্ট করার যথা সম্ভব চেষ্টা করেছেন বলে আনুষ্ঠানিক সংবাদ ব্রিফিংয়ে দাবি করেছেন।
মিয়ানমার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রমাণ দিক: এদিকে সংবাদ ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নতুন কিছু বলিনি। আমরা বলেছি, মিয়ানমার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে, তাদের লোকদের বুঝিয়ে ফেরত নেবে, তাদের মুক্তভাবে চলাফেরার ব্যবস্থা করবে সেটা যাতে তারা দুনিয়াকে দেখায়। মোমেনের ভাষায়- বিদেশি বন্ধুদের আমরা বলেছি, মিয়ানমার বলছে, তারা প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা সেটা বিশ্বাস করেনা। ফলে তারা যেতে রাজী না। তারা তাদের সরকারের কথায় বিশ্বাস করাতে পারছে না। আমরা মিয়ানমারকে বলছি- তোমরা নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম কিংবা জাতিসংঘের সংস্থা কিংবা অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের রাখাইন ঘুরিয়ে নিয়ে আসো। তোমরা রোহিঙ্গাদের জন্য যে ব্যবস্থা নিয়েছো, তা তারা দেখুক। রোহিঙ্গা নেতাদেরও রাখাইন থেকে ঘুরিয়ে আনার প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। কারণ, এক সময় তারা নিপীড়িত হয়েছিল, তাদের লোকদের হত্যা করা হয়েছে। এজন্য রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা চায়। সেখানে মুক্তভাবে চলাফেরার স্বাধীনতা চায়। এসব বিষয় নিশ্চিত করবে বলে মিয়ানমার বারবার আমাদের আশ্বস্ত করেছে। তাই যদি হয় তাহলে একটা দলকে নিয়ে তারা দেখায় না কেন? পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা এখনও প্রস্তুত। সব সময় ফেরত পাঠাতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, বিদেশি কূটনীতিকদের বলেছি, রোহিঙ্গাদের জন্য আমাদের যা যা করার আমরা তা করে যাব, করছি। কিন্তু বিশ্ব নেতাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। বিশ্ব সমপ্রদায়কে আমরা অনুরোধ জানিয়েছি, এই সমস্যা মোকাবিলায় তারা যেন আরও উদ্যোগী হয়। কারণ, এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, সকলের। রোহিঙ্গাদের ফেরতে নিতে মিয়ানমার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা পালন করতে যেন দেশটিকে বাধ্য করা হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের ওপর বিশ্বাস রাখছে বাংলাদেশ। কারণ, বিশ্ববাসী আমাদের সাহায্য করছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি হয়েছে। পুরো বিশ্ব আমাদের সমর্থন করছে-এটা স্বীকার করতেই হবে। আমাদের অবস্থান অত্যন্ত তুঙ্গে। বিশ্ব জনমত আমাদের প্রতি আছে বলেই মিয়ানমার সমাধানের জন্য বারবার আমাদের কাছে আসছে। ড. মোমেন আরও বলেন, প্রশ্ন থেকে যায়, দুনিয়া যদি বাংলাদেশের সঙ্গেই থাকে তাহলে একজন রোহিঙ্গাকেও দু’বছরে ফেরত পাঠানো গেলো না কেন? নিজেই ফের বলেন, সময় লাগছে। দুনিয়া কাউকে জোর করে সীমান্তের ওপরে ঠেলে দিতে পারে না। বাংলাদেশও তা করবে না। আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে যাব। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। সময় লাগছে তবে আমরা আশাবাদী। আগেও এ সমস্যার সমাধান হয়েছে। তখন স্বল্প সংখ্যা, আড়াই লাখ ছিল। এখন ১২ লাখ। তবে আমাদের বিশ্বাস, আমরা এই সমস্যার সমাধানে সফলকাম হবো। অপর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করা এনজিওরা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করলে অর্থাৎ ভিন্ন কিছু করার প্রমাণ পেলে বাংলাদেশ অবশ্যই কঠোর হবে। সে যেই হোক না কেন।
চীনের মধ্যস্থতায় আবারও বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার: এদিকে অপর প্রশ্নে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, চীন নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে। তারা ফের মধ্যস্থায় উদ্যোগী হয়েছে। চীনের প্রস্তাব হচ্ছে- তাদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ মিয়ানমার আলোচনা-বৈঠক। ড. মোমেন বলেন, বৈঠকের দিন-তারিখ এখনও ঠিক হয়নি। চীনের রাষ্ট্রদূত আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমরা রাজী। এখন চীন মিয়ানমারের সঙ্গে সঙ্গে আলাপ করে আমাদের জানাবেন। কোথায় বৈঠকটি হচ্ছে নিউইয়র্ক না ঢাকায়? মানবজমিনের এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, তা এখনও ঠিক হয়নি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষ্যে আগামী মাসে নিউইয়র্কে যাচ্ছে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সেখানে প্রস্তাবিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি হওয়ার আলোচনা রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, চীন বলেছে, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে বাংলাদেশের পাশে আছে। মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ উভয় দেশই তাদের বন্ধু। এ সমস্যা দূর করতে একযোগে কাজ করব তারা। চীনের রাষ্ট্রদূত লি দিনের শুরুতে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। উল্লেখ্য, চীনের মধ্যস্থতায় তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর উপস্থিতিতে গত দ’বছরে অন্তত ৩ দফা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
চীনের নতুন দূত যা বললেন- এদিকে কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে অংশ নেয়ার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের বৈঠক হয় চীনের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের সঙ্গে। এটি ছিল মন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের প্রথম সৌজন্য সাক্ষাৎ। মন্ত্রীর দপ্তরে বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার পথে রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের টেকসই সমাধানের পথ খোঁজাসহ ‘বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে’ তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে তারা গঠনমূলক ভূমিকা রাখবেন বলেও জানান রাষ্ট্রদূত। চীনের মধ্যস্থতায় গত ২২ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় প্রত্যবাসন চেষ্টা ভেস্তে যাওয়ার পর ফের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক প্রস্তাব করেছে চীন। উল্লেখ্য, বর্তমানে ১১ লাখেরও বেশি মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে অস্থায়ী আশ্রয়ে রয়েছেণ। শুরুতে মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিলেও অধিক জনসংখ্যার ছোট এই দেশে তাদের দীর্ঘসময় ধরে আশ্রয় দেয়া সম্ভব নয় বলে দুনিয়াকে সাফ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
কূটনীতিকদের বিদায়ের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. মোমেন গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে অবহিত করেন।
দেশি-বিদেশি অন্য কূটনীতিকরাও এ বিষয়ে আনানুষ্ঠানিভাবে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সূত্র মতে, বৈঠকে মন্ত্রী বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। জবাবে কূটনীতিকরা ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যে উজ্জ্বল হয়েছে সেটি পূনরুল্লেখ করে সরকার এবং জনগনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মন্ত্রী তার বক্তব্যে প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত ছিল সেটি ব্যাখ্যা করেন, আমরা যা করেছি তা দুনিয়া দেখেছে। আমাদের সব কিছু অত্যন্ত স্বচ্ছ ছিল। মাঠ পর্যায়ে প্রত্যাবাসনের জন্য লজিস্টিক থেকে শুরু করে যেসব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল- তা চীন এবং মিয়ানমারের প্রতিনিধি সরজমিনে প্রত্যক্ষ করেছেন বলেও বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের জানান মন্ত্রী। তিনি এ-ও বলেন, প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়া ছাড়া অন্য কিছু করার নেই।
প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের রাজী করানো, রাখাইনে প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি, মিয়ানমার সরকারের কার্যক্রমে বাস্তুচ্যুতদের মাঝে যে আস্থা সঙ্কট তৈরি হয়েছে- সেটি দূর করা একান্তভাবেই মিয়ানমারের দায়িত্ব। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ কী করতে পারে? মন্ত্রী এ নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ, আলোচনা এবং পরবর্তী সংলাপ চলবে জানিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি সঙ্কট উত্তরণে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক এবং মানবিক সাপোর্ট অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে এই সঙ্কট যারা সৃষ্টি করেছে সেই মিয়ানমার যেন তার দায়বদ্ধতা এবং অঙ্গীকারের বাস্তবায়নে বাধ্য হয় অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং অধিকারের সঙ্গে তাদের স্ব-ভূমে (রাখাইনে) ফেরত নেয় সেই চাপ অব্যাহত রাখতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। সূত্র মতে, উপস্থিত কূটনীতিকরা মন্ত্রীর দীর্ঘ এবং খোলামেলা বক্তব্য অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। অন্যান্য ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন বা মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া সময় ভিন্নমত এলেও গতকাল ছিল ব্যতিক্রম। সেখানে মন্ত্রীর বক্তব্যের পর বৃটেন, ইতালী, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা কথা বলেছেন। তারা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াই দিয়েছেন। একই সঙ্গে এ ইস্যুতে বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপ আরও স্পষ্টভাবে জানার আগ্রহ ছিল তাদের। মন্ত্রী সেটি স্পষ্ট করার যথা সম্ভব চেষ্টা করেছেন বলে আনুষ্ঠানিক সংবাদ ব্রিফিংয়ে দাবি করেছেন।
মিয়ানমার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রমাণ দিক: এদিকে সংবাদ ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নতুন কিছু বলিনি। আমরা বলেছি, মিয়ানমার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে, তাদের লোকদের বুঝিয়ে ফেরত নেবে, তাদের মুক্তভাবে চলাফেরার ব্যবস্থা করবে সেটা যাতে তারা দুনিয়াকে দেখায়। মোমেনের ভাষায়- বিদেশি বন্ধুদের আমরা বলেছি, মিয়ানমার বলছে, তারা প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা সেটা বিশ্বাস করেনা। ফলে তারা যেতে রাজী না। তারা তাদের সরকারের কথায় বিশ্বাস করাতে পারছে না। আমরা মিয়ানমারকে বলছি- তোমরা নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম কিংবা জাতিসংঘের সংস্থা কিংবা অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের রাখাইন ঘুরিয়ে নিয়ে আসো। তোমরা রোহিঙ্গাদের জন্য যে ব্যবস্থা নিয়েছো, তা তারা দেখুক। রোহিঙ্গা নেতাদেরও রাখাইন থেকে ঘুরিয়ে আনার প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। কারণ, এক সময় তারা নিপীড়িত হয়েছিল, তাদের লোকদের হত্যা করা হয়েছে। এজন্য রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা চায়। সেখানে মুক্তভাবে চলাফেরার স্বাধীনতা চায়। এসব বিষয় নিশ্চিত করবে বলে মিয়ানমার বারবার আমাদের আশ্বস্ত করেছে। তাই যদি হয় তাহলে একটা দলকে নিয়ে তারা দেখায় না কেন? পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা এখনও প্রস্তুত। সব সময় ফেরত পাঠাতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, বিদেশি কূটনীতিকদের বলেছি, রোহিঙ্গাদের জন্য আমাদের যা যা করার আমরা তা করে যাব, করছি। কিন্তু বিশ্ব নেতাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। বিশ্ব সমপ্রদায়কে আমরা অনুরোধ জানিয়েছি, এই সমস্যা মোকাবিলায় তারা যেন আরও উদ্যোগী হয়। কারণ, এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, সকলের। রোহিঙ্গাদের ফেরতে নিতে মিয়ানমার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা পালন করতে যেন দেশটিকে বাধ্য করা হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের ওপর বিশ্বাস রাখছে বাংলাদেশ। কারণ, বিশ্ববাসী আমাদের সাহায্য করছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি হয়েছে। পুরো বিশ্ব আমাদের সমর্থন করছে-এটা স্বীকার করতেই হবে। আমাদের অবস্থান অত্যন্ত তুঙ্গে। বিশ্ব জনমত আমাদের প্রতি আছে বলেই মিয়ানমার সমাধানের জন্য বারবার আমাদের কাছে আসছে। ড. মোমেন আরও বলেন, প্রশ্ন থেকে যায়, দুনিয়া যদি বাংলাদেশের সঙ্গেই থাকে তাহলে একজন রোহিঙ্গাকেও দু’বছরে ফেরত পাঠানো গেলো না কেন? নিজেই ফের বলেন, সময় লাগছে। দুনিয়া কাউকে জোর করে সীমান্তের ওপরে ঠেলে দিতে পারে না। বাংলাদেশও তা করবে না। আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে যাব। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। সময় লাগছে তবে আমরা আশাবাদী। আগেও এ সমস্যার সমাধান হয়েছে। তখন স্বল্প সংখ্যা, আড়াই লাখ ছিল। এখন ১২ লাখ। তবে আমাদের বিশ্বাস, আমরা এই সমস্যার সমাধানে সফলকাম হবো। অপর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করা এনজিওরা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করলে অর্থাৎ ভিন্ন কিছু করার প্রমাণ পেলে বাংলাদেশ অবশ্যই কঠোর হবে। সে যেই হোক না কেন।
চীনের মধ্যস্থতায় আবারও বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার: এদিকে অপর প্রশ্নে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, চীন নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে। তারা ফের মধ্যস্থায় উদ্যোগী হয়েছে। চীনের প্রস্তাব হচ্ছে- তাদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ মিয়ানমার আলোচনা-বৈঠক। ড. মোমেন বলেন, বৈঠকের দিন-তারিখ এখনও ঠিক হয়নি। চীনের রাষ্ট্রদূত আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমরা রাজী। এখন চীন মিয়ানমারের সঙ্গে সঙ্গে আলাপ করে আমাদের জানাবেন। কোথায় বৈঠকটি হচ্ছে নিউইয়র্ক না ঢাকায়? মানবজমিনের এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, তা এখনও ঠিক হয়নি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষ্যে আগামী মাসে নিউইয়র্কে যাচ্ছে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সেখানে প্রস্তাবিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি হওয়ার আলোচনা রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, চীন বলেছে, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে বাংলাদেশের পাশে আছে। মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ উভয় দেশই তাদের বন্ধু। এ সমস্যা দূর করতে একযোগে কাজ করব তারা। চীনের রাষ্ট্রদূত লি দিনের শুরুতে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। উল্লেখ্য, চীনের মধ্যস্থতায় তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর উপস্থিতিতে গত দ’বছরে অন্তত ৩ দফা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
চীনের নতুন দূত যা বললেন- এদিকে কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে অংশ নেয়ার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের বৈঠক হয় চীনের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের সঙ্গে। এটি ছিল মন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের প্রথম সৌজন্য সাক্ষাৎ। মন্ত্রীর দপ্তরে বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার পথে রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের টেকসই সমাধানের পথ খোঁজাসহ ‘বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে’ তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে তারা গঠনমূলক ভূমিকা রাখবেন বলেও জানান রাষ্ট্রদূত। চীনের মধ্যস্থতায় গত ২২ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় প্রত্যবাসন চেষ্টা ভেস্তে যাওয়ার পর ফের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক প্রস্তাব করেছে চীন। উল্লেখ্য, বর্তমানে ১১ লাখেরও বেশি মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে অস্থায়ী আশ্রয়ে রয়েছেণ। শুরুতে মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিলেও অধিক জনসংখ্যার ছোট এই দেশে তাদের দীর্ঘসময় ধরে আশ্রয় দেয়া সম্ভব নয় বলে দুনিয়াকে সাফ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
No comments