কলকাতায় মাঝরাতের আরেক রূপ by সুতীর্থ গুপ্ত
সুর্যাস্তের
সাথে সাথে কলকাতা নগরী ও এর শহরতলীর রূপ একেবারেই বদলে যায়। নগরবাসীর
শয্যা প্রস্তুতি যতই এগিয়ে বাড়তে থাকে সুনশান নিরবতা, অঞ্চলতা ঘিরে ধরে
নগরীকে। কিন্তু এরই মাঝে এক ভিন্ন জগতের স্বাদ নিতে জেগে ওঠে বিপুল সংখ্যক
তরুণ ও তরুণোতীর্ণ যুবক। রাতের গভীরতা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে নগরীর
নাইটক্লাব ও পানশালাগুলোতে ভীড় বাড়তে থাকে। মদ ও মাদকের জন্য কাড়াকাড়ি লেগে
যায়। সেখানে সবার একটাই লক্ষ্য – ফুর্তি, তখন দুনিয়ার কাউকে পরোয়া করে না
তারা।
এই কয়েক দশক আগেও কিছু তারকা হোটেলের মধ্যে নাইটক্লাবগুলো সীমাবদ্ধ ছিলো। ধনী, আর কর্পোরেট বিশ্বের হর্তাকর্তা ছাড়া আর কারো সেগুলোতে ঢু মারার সাধ্য ছিলো না। হ্যাঁ, গণিকালয়গুলোতে নিয়মিত ভীড় জমাতো আরেক দল মানুষ। নব্বইয়ের দশকে এই নগরীতে মাত্র আটটি নাইটক্লাব ছিলো। জীবনযাত্রায় নতুনত্ব এবং নিরন্তর বেড়ে চলা ভোগবাদী সংস্কৃতি নাইটক্লাব ও পানশালার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ড্যান্সবারগুলো রেকর্ড গতিতে সমাজের বুকে তাদের কার্ষিকা বিস্তার করে চলেছে।
সমাজের এই নতুন প্রবণতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ড. গৌতম ব্যানার্জি বলেন, ‘এর জন্য মূলত দায়ী উপকরণের সহজলভ্যতা, অর্থ ও সামাজিক নৈতিকতার অবক্ষয়। সামাজিক শিক্ষানীতির মধ্য দিয়েই সবাই এগুলো শিখছে।’ এসব স্বর্গের পেছনে ছোটার কারণ হিসেবে ড. ব্যানার্জি বলেন, ‘উত্তেজনা খোঁজা ও ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা। এগুলোর জন্য মাদক ও এলকোহল সেবন দায়ী। এতে পৌরুষপূর্ণ ভাবমুর্তি ফুটে ওঠে বলে মনে করা হয়।’
তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী মিনাক্ষি চৌধুরী প্রায়ই নাইটক্লাবের আড্ডায় যান। তিনি বলেন, ‘সারা দিন কঠোর পরিশ্রমের পর আমি মাথা থেকে সবকিছু ঝেড়েমুছে ফেলতে চাই। চাই নিজেকে পুরোদমে উপভোগ করতে। রাজনৈতিক নেতা ও একশ্রেণীর পুলিশের মৌনসম্মতি থাকায় এখন নগরীর আনাচে-কানাচে নাইটক্লাব গড়ে উঠেছে। এমনকি নগরীর কেন্দ্রস্থলে পুলিশ সদর দফতরের দোরগোড়াতেও নাইটক্লাব রয়েছে। নগরীর কেউ যদি বাইপার ও বিআইপি সড়ক ধরে বিমানবন্দরের দিকে এগুতে থাকে তাহলে এই ২০ কি.মি. রাস্তায় সে অন্তত একশ নাইটক্লাবের দেখা পাবে। নগরীর সল্ট লেক আইটি হাব হয়ে ওঠার পর থেকে এটা হয়েছে। নতুন শহর (রাজারহাট) এর প্রাইম লোকেশনে পরিণত হয়েছে।
বারগুলো যেন পুস্তিকার প্রতিটি আইনের প্রতি বিদ্রুপ করছে। রাত দুটোর মধ্যে ঝাপ নামিয়ে ফেলার আইনের তোয়াক্কা তারা করে না। গাড়ি ও স্যুভগুলো রাতভর ওই জায়গাগুলোতে ভীড় করে থাকে।
আলো-আধারি ঘেরা এসব বারে নারীরা উচ্চস্বরে মিউজিকের সাথে সাথে ঘুরে ঘুরে নাচছে। ডিজেরা পুরো ভলিউমে জনপ্রিয় হিন্দি গান বাজাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে সবকিছুর রং বদলে দিচ্ছে স্ট্রোবলাইটের চটকদার আলো। নগরীর জনপ্রিয় ও ভীড় লেগে থাকা ড্যান্সবারগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইট কুইন্স, জলসাঘর, দেবদাস, সানসেট, ডাউন টাউন, কিংসটন, ইত্যাদি। আসল সংখ্যাটি জানার উপায় নেই তবে পুলিশের হিসাবে নগরী ও শহরতলীতে পাঁচশ’র বেশি ড্যান্সবার রয়েছে। ছোট ছোট জেলা শহর ও হাইয়ের আশেপাশেও এগুলো ছড়িয়ে পড়ছে।
নগরীর জনপ্রিয় নাইটক্লাবগুলোর মধ্যে রয়েছে পার্ক হোটেলের ট্রিনকাস এন্ড রক্সি, হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল-এর আন্ডারগ্রাউন্ড, আইটিসি সোনার হোটেল-এ ডাবলিন, সুইসোটেল-এ মায়া, পলাশ, দি মিক্স, নকটার্নি, ইত্যাদি।
সারা দিনের ক্লান্তি মুছে ফেলতে সন্ধ্যা নামতেই এসব জায়গায় ভীড় করে নারী পুরুষের দল। এদের বেশিরভাগের বয়স ২২-৩৫ এর মধ্যে। ফাস্টফুডের সঙ্গে এলকোহল উপভোগ করে তারা। ক্লায়েন্টের কাছ থেকে কিছু টিপস পাওয়া যাবে এই আশায় একদল উত্তেজক নাচ প্রদর্শনে নেমে পড়ে। একচকিত উন্মুক্ত উরু, কিংবা এক ঝলক নাভীদেশ বা ক্লিভেজ দেখতে পেলে তাতে গুজে দেয়ার জন্য নোট হাতরাতে থাকে অনগ্রাহীর দল। এরা মূলত সিন্ডিকেট ব্যবসার সাথে জড়িত। টিপসের আসায় ওয়েটাররাও ঘরের মধ্যে চর্কির মতো ঘুরতে থাকে। যাদের সামর্থ্য আছে বলে মনে হয় তাদেরকে নাচের মাধ্যমে তাদেরকে আরো কিছুর প্রতি আকৃষ্ট করা হয়। কিছু কিছু বারে অহরহ মাদকের অপব্যবহার চলে। এমনকি বারের বাইরেও এসপ্লানেড এলাকায় গেলে আপনি শুনতে পাবেন দালালরা ফিসফিসি করে বলছে লাগবে? নাগবে নাকি? নুরজাহান, আনারকলি? কেউ আগ্রহ দেখালেই তাকে বারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হবে।
কলহ সৃষ্টি এসব বারের নিয়মিত ঘটনা। মাতালদের ঝগড়া খুনখারাবি পর্যন্ত গড়ানোর ঘটনাও বিরল নয়। অনেক দুষ্টলোকের আনাগোনা থাকায় আশপাশের অধিবাসীদের কাছে এসব বার একধরনের ভীতিকর আপদ। এসব জায়গা নিরাপদ নয় বলে সাধারণ মানুষের ধারণা। মাতালদের ঝগড়া ও উচ্চস্বরে মিউজিক এলাকাবাসীর জন্য বেশ উৎপাত সৃষ্টি করে।
এসব বার রাস্তায় যান চলাচলে বাধার সৃষ্টি করছে বলে প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়। ট্রুপ ড্যান্সিয়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মেয়েদের বারের ড্যান্সিং পেশায় টেনে আনা হয়। এসব মেয়ের বেশিরভাগ অন্য রাজ্য থেকে আসা। কড়া নজরদারির মধ্যে এদেরকে রাখা হয়। এখানে টাকার টানে সবাই আসে। এখানে সবাই লাভের ভাগিদার। ড্যান্সার থেকে তথাকথিত ব্যান্ড লিডার, বারের মালিক থেকে রাজনীতিক সবাই। তাদের অবদানে বারগুলো ফুলে ফেপে ওঠছে। ব্যান্ড লিডাররা আসল মিডলম্যান। তারা দালাল ও টাউটদের কাছ থেকে মেয়েদের সংগ্রহ করে আনে। তারা এসব মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা করে, বারের ফ্লোর ভাড়া করে।
সপ্তাহান্তের এক রাতে ১০ থেকে ১৫ লাখ রুপি পর্যন্ত আয় হয়। জনপ্রিয় বারগুলো মাসিক আয় ৮০ লাখ থেকে এক কোটি রুপি পর্যন্ত। জনপ্রিয় কোন কোন ড্যান্সার মাসিক আয় এক থেকে দু’লাখ রুপি।
এসব নাইটক্লাব ও পাব কি বৈধ? কেউ কেউ বলছেন এসব ড্যান্সবার আইন লঙ্ঘন করছে। যদিও এ ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট আইন নেই। পশ্চিমবঙ্গ শুল্ক আইনের ২৩৯ ধারায় বলা হয়েছে, কলকাতায় কোন জেলা ম্যাজিস্টেট, শুল্ক কালেক্টর বা পুলিশের বিশেষ অনুমতি না নিয়ে একজন নিবন্ধিত রিটেইল ভেন্ডর কোন রকম পেশাদার বিনোদন বা নাচ বা ভোকাল বা ইন্সট্রুমেন্টাল লাইভ মিউজিক-এর আয়োজন করতে পারবে না।
পুলিশ বিভাগ নিজস্ব ক্ষমতা বলে কথিত ‘ক্রনিং’ লাইসেন্ট দিয়ে থাকে। নাগর প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব লাইসেন্স দেয়া হয় সেগুলোর কোথাও ড্যান্সিং লাইসেন্স বলে কথা নেই। পাব মালিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে পুলিশ সুস্পষ্টভাবেই বলেছে যে বার ড্যান্স অবৈধ। এরপরও পাবগুলো চালু থাকায় ধারণা করা যায় যে এগুলোর পেছনে সুসংগঠিত কোন চক্রের হাত রয়েছে। তারা আইন উপেক্ষা করেই তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।
কংগ্রেস দলীয় একজন নেতা বলেন, রাজনীতিক ও বার মালিকদের মধ্যে সখ্যতা একটি সর্বজনবিদিত সত্য। মিউনিসিপ্যালিটি যে ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছে তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীন দলের হাতে। অর্থসহ সব ধরনের সুবিধার বিনিময়ে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায়।
এসব বারে পুলিশের একাধিক অভিযানে এখানে পতিতাবৃত্তি ও মানবপাচার চক্র জড়িত থাকার ঘটনা জানা গেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ২০-২৫টি মেয়েকে উদ্ধার করা হলেও বার মালিকদের কখনোই আইনের আওতায় আনা হয় না। বিদ্যানগর থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে মালিকদের পেছনে রাজনৈতিক মদত রয়েছে। তাই মামলা হলেও তাদেরকে গ্রেফতার করা যায় না। ড্যান্সবার নিষিদ্ধ করে আইন জারির পর এক বার মালিকের নেতৃত্বে একদল গুন্ডা থানায় পর্যন্ত হামলা চালায়। ওই মালিকের বিদেশেও বার রয়েছে। গত বছর বিদ্যানগর পুলিশ কমিশনার জাভেদ শামিম তার এলাকায় ড্যান্সবারের অনুমতি নিষিদ্ধ করে একটি মেমো জারি করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই তাকে বদলি হতে হয়। রাজ্যের সর্বত্র আবাসিক এলাকায় উন্মুক্ত বিদেশি মদের দোকানের অনুমতি দেয়ার ব্যাপারে সরকারের যে নীতি তা এই অন্ধকার জগতের ব্যবসা বিস্তারের আরেকটি কারণ।
এই কয়েক দশক আগেও কিছু তারকা হোটেলের মধ্যে নাইটক্লাবগুলো সীমাবদ্ধ ছিলো। ধনী, আর কর্পোরেট বিশ্বের হর্তাকর্তা ছাড়া আর কারো সেগুলোতে ঢু মারার সাধ্য ছিলো না। হ্যাঁ, গণিকালয়গুলোতে নিয়মিত ভীড় জমাতো আরেক দল মানুষ। নব্বইয়ের দশকে এই নগরীতে মাত্র আটটি নাইটক্লাব ছিলো। জীবনযাত্রায় নতুনত্ব এবং নিরন্তর বেড়ে চলা ভোগবাদী সংস্কৃতি নাইটক্লাব ও পানশালার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ড্যান্সবারগুলো রেকর্ড গতিতে সমাজের বুকে তাদের কার্ষিকা বিস্তার করে চলেছে।
সমাজের এই নতুন প্রবণতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ড. গৌতম ব্যানার্জি বলেন, ‘এর জন্য মূলত দায়ী উপকরণের সহজলভ্যতা, অর্থ ও সামাজিক নৈতিকতার অবক্ষয়। সামাজিক শিক্ষানীতির মধ্য দিয়েই সবাই এগুলো শিখছে।’ এসব স্বর্গের পেছনে ছোটার কারণ হিসেবে ড. ব্যানার্জি বলেন, ‘উত্তেজনা খোঁজা ও ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা। এগুলোর জন্য মাদক ও এলকোহল সেবন দায়ী। এতে পৌরুষপূর্ণ ভাবমুর্তি ফুটে ওঠে বলে মনে করা হয়।’
তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী মিনাক্ষি চৌধুরী প্রায়ই নাইটক্লাবের আড্ডায় যান। তিনি বলেন, ‘সারা দিন কঠোর পরিশ্রমের পর আমি মাথা থেকে সবকিছু ঝেড়েমুছে ফেলতে চাই। চাই নিজেকে পুরোদমে উপভোগ করতে। রাজনৈতিক নেতা ও একশ্রেণীর পুলিশের মৌনসম্মতি থাকায় এখন নগরীর আনাচে-কানাচে নাইটক্লাব গড়ে উঠেছে। এমনকি নগরীর কেন্দ্রস্থলে পুলিশ সদর দফতরের দোরগোড়াতেও নাইটক্লাব রয়েছে। নগরীর কেউ যদি বাইপার ও বিআইপি সড়ক ধরে বিমানবন্দরের দিকে এগুতে থাকে তাহলে এই ২০ কি.মি. রাস্তায় সে অন্তত একশ নাইটক্লাবের দেখা পাবে। নগরীর সল্ট লেক আইটি হাব হয়ে ওঠার পর থেকে এটা হয়েছে। নতুন শহর (রাজারহাট) এর প্রাইম লোকেশনে পরিণত হয়েছে।
বারগুলো যেন পুস্তিকার প্রতিটি আইনের প্রতি বিদ্রুপ করছে। রাত দুটোর মধ্যে ঝাপ নামিয়ে ফেলার আইনের তোয়াক্কা তারা করে না। গাড়ি ও স্যুভগুলো রাতভর ওই জায়গাগুলোতে ভীড় করে থাকে।
আলো-আধারি ঘেরা এসব বারে নারীরা উচ্চস্বরে মিউজিকের সাথে সাথে ঘুরে ঘুরে নাচছে। ডিজেরা পুরো ভলিউমে জনপ্রিয় হিন্দি গান বাজাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে সবকিছুর রং বদলে দিচ্ছে স্ট্রোবলাইটের চটকদার আলো। নগরীর জনপ্রিয় ও ভীড় লেগে থাকা ড্যান্সবারগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইট কুইন্স, জলসাঘর, দেবদাস, সানসেট, ডাউন টাউন, কিংসটন, ইত্যাদি। আসল সংখ্যাটি জানার উপায় নেই তবে পুলিশের হিসাবে নগরী ও শহরতলীতে পাঁচশ’র বেশি ড্যান্সবার রয়েছে। ছোট ছোট জেলা শহর ও হাইয়ের আশেপাশেও এগুলো ছড়িয়ে পড়ছে।
নগরীর জনপ্রিয় নাইটক্লাবগুলোর মধ্যে রয়েছে পার্ক হোটেলের ট্রিনকাস এন্ড রক্সি, হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল-এর আন্ডারগ্রাউন্ড, আইটিসি সোনার হোটেল-এ ডাবলিন, সুইসোটেল-এ মায়া, পলাশ, দি মিক্স, নকটার্নি, ইত্যাদি।
সারা দিনের ক্লান্তি মুছে ফেলতে সন্ধ্যা নামতেই এসব জায়গায় ভীড় করে নারী পুরুষের দল। এদের বেশিরভাগের বয়স ২২-৩৫ এর মধ্যে। ফাস্টফুডের সঙ্গে এলকোহল উপভোগ করে তারা। ক্লায়েন্টের কাছ থেকে কিছু টিপস পাওয়া যাবে এই আশায় একদল উত্তেজক নাচ প্রদর্শনে নেমে পড়ে। একচকিত উন্মুক্ত উরু, কিংবা এক ঝলক নাভীদেশ বা ক্লিভেজ দেখতে পেলে তাতে গুজে দেয়ার জন্য নোট হাতরাতে থাকে অনগ্রাহীর দল। এরা মূলত সিন্ডিকেট ব্যবসার সাথে জড়িত। টিপসের আসায় ওয়েটাররাও ঘরের মধ্যে চর্কির মতো ঘুরতে থাকে। যাদের সামর্থ্য আছে বলে মনে হয় তাদেরকে নাচের মাধ্যমে তাদেরকে আরো কিছুর প্রতি আকৃষ্ট করা হয়। কিছু কিছু বারে অহরহ মাদকের অপব্যবহার চলে। এমনকি বারের বাইরেও এসপ্লানেড এলাকায় গেলে আপনি শুনতে পাবেন দালালরা ফিসফিসি করে বলছে লাগবে? নাগবে নাকি? নুরজাহান, আনারকলি? কেউ আগ্রহ দেখালেই তাকে বারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হবে।
কলহ সৃষ্টি এসব বারের নিয়মিত ঘটনা। মাতালদের ঝগড়া খুনখারাবি পর্যন্ত গড়ানোর ঘটনাও বিরল নয়। অনেক দুষ্টলোকের আনাগোনা থাকায় আশপাশের অধিবাসীদের কাছে এসব বার একধরনের ভীতিকর আপদ। এসব জায়গা নিরাপদ নয় বলে সাধারণ মানুষের ধারণা। মাতালদের ঝগড়া ও উচ্চস্বরে মিউজিক এলাকাবাসীর জন্য বেশ উৎপাত সৃষ্টি করে।
এসব বার রাস্তায় যান চলাচলে বাধার সৃষ্টি করছে বলে প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়। ট্রুপ ড্যান্সিয়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মেয়েদের বারের ড্যান্সিং পেশায় টেনে আনা হয়। এসব মেয়ের বেশিরভাগ অন্য রাজ্য থেকে আসা। কড়া নজরদারির মধ্যে এদেরকে রাখা হয়। এখানে টাকার টানে সবাই আসে। এখানে সবাই লাভের ভাগিদার। ড্যান্সার থেকে তথাকথিত ব্যান্ড লিডার, বারের মালিক থেকে রাজনীতিক সবাই। তাদের অবদানে বারগুলো ফুলে ফেপে ওঠছে। ব্যান্ড লিডাররা আসল মিডলম্যান। তারা দালাল ও টাউটদের কাছ থেকে মেয়েদের সংগ্রহ করে আনে। তারা এসব মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা করে, বারের ফ্লোর ভাড়া করে।
সপ্তাহান্তের এক রাতে ১০ থেকে ১৫ লাখ রুপি পর্যন্ত আয় হয়। জনপ্রিয় বারগুলো মাসিক আয় ৮০ লাখ থেকে এক কোটি রুপি পর্যন্ত। জনপ্রিয় কোন কোন ড্যান্সার মাসিক আয় এক থেকে দু’লাখ রুপি।
এসব নাইটক্লাব ও পাব কি বৈধ? কেউ কেউ বলছেন এসব ড্যান্সবার আইন লঙ্ঘন করছে। যদিও এ ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট আইন নেই। পশ্চিমবঙ্গ শুল্ক আইনের ২৩৯ ধারায় বলা হয়েছে, কলকাতায় কোন জেলা ম্যাজিস্টেট, শুল্ক কালেক্টর বা পুলিশের বিশেষ অনুমতি না নিয়ে একজন নিবন্ধিত রিটেইল ভেন্ডর কোন রকম পেশাদার বিনোদন বা নাচ বা ভোকাল বা ইন্সট্রুমেন্টাল লাইভ মিউজিক-এর আয়োজন করতে পারবে না।
পুলিশ বিভাগ নিজস্ব ক্ষমতা বলে কথিত ‘ক্রনিং’ লাইসেন্ট দিয়ে থাকে। নাগর প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব লাইসেন্স দেয়া হয় সেগুলোর কোথাও ড্যান্সিং লাইসেন্স বলে কথা নেই। পাব মালিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে পুলিশ সুস্পষ্টভাবেই বলেছে যে বার ড্যান্স অবৈধ। এরপরও পাবগুলো চালু থাকায় ধারণা করা যায় যে এগুলোর পেছনে সুসংগঠিত কোন চক্রের হাত রয়েছে। তারা আইন উপেক্ষা করেই তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।
কংগ্রেস দলীয় একজন নেতা বলেন, রাজনীতিক ও বার মালিকদের মধ্যে সখ্যতা একটি সর্বজনবিদিত সত্য। মিউনিসিপ্যালিটি যে ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছে তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীন দলের হাতে। অর্থসহ সব ধরনের সুবিধার বিনিময়ে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায়।
এসব বারে পুলিশের একাধিক অভিযানে এখানে পতিতাবৃত্তি ও মানবপাচার চক্র জড়িত থাকার ঘটনা জানা গেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ২০-২৫টি মেয়েকে উদ্ধার করা হলেও বার মালিকদের কখনোই আইনের আওতায় আনা হয় না। বিদ্যানগর থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে মালিকদের পেছনে রাজনৈতিক মদত রয়েছে। তাই মামলা হলেও তাদেরকে গ্রেফতার করা যায় না। ড্যান্সবার নিষিদ্ধ করে আইন জারির পর এক বার মালিকের নেতৃত্বে একদল গুন্ডা থানায় পর্যন্ত হামলা চালায়। ওই মালিকের বিদেশেও বার রয়েছে। গত বছর বিদ্যানগর পুলিশ কমিশনার জাভেদ শামিম তার এলাকায় ড্যান্সবারের অনুমতি নিষিদ্ধ করে একটি মেমো জারি করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই তাকে বদলি হতে হয়। রাজ্যের সর্বত্র আবাসিক এলাকায় উন্মুক্ত বিদেশি মদের দোকানের অনুমতি দেয়ার ব্যাপারে সরকারের যে নীতি তা এই অন্ধকার জগতের ব্যবসা বিস্তারের আরেকটি কারণ।
No comments