রেলপথে ‘পাথর সন্ত্রাস’ ভয়ঙ্কর ৭০ স্পট- বছরে দেড় শতাধিক ঘটনা by শুভ্র দেব
বাবা-মায়ের
সঙ্গে ঢাকা থেকে রাজশাহী যাচ্ছিল চার বছর বয়সী শিশু জিসান। ঢাকা
থেকে ছেড়ে যাওয়া পদ্মা ট্রেনটি জামতইল স্টেশনের কাছে পৌঁছালে দুর্বৃত্তরা
ট্রেনে ছুড়ে মারে পাথর। আঘাত লাগে ছোট্ট জিসানের মাথার পেছনের অংশে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জিসানকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন
চিকিৎসকরা। শুধু জিসানই নয়। প্রায়ই এমন পাথর ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটে। এ
অবস্থায় নিরাপদ রেল ভ্রমণ অনেকটা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রেন
যাত্রীদের জন্য এখন এক আতঙ্কের নাম পাথর সন্ত্রাস।
পাথর সন্ত্রাসীদের ছোড়া পাথরে যাত্রীদের প্রাণহানি থেকে শুরু করে অঙ্গহানি হচ্ছে। মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। গত বছর খোদ রেলওয়ে কর্মকর্তাও পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় নিহত হয়েছেন। রেলওয়েসূত্র বলছে, বছরে কম বেশি দেড় শতাধিক পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি এই ঘটনা বাড়ছে।
গত এক মাসে শুধুমাত্র ঢাকা-রাজশাহী রুটে ১৭টি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী ট্রেনে উত্তরাঞ্চল ভ্রমণের সময় ওই ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। তাকে বহনকারী ট্রেনে পাথরের আঘাত করায় জানালার কাচ ভেঙ্গে পড়েছিল। যদিও এঘটনায় কেউ আহত হননি। তবে বেশিরভাগ সময় পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় শুধু যাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না ট্রেনেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গত পাঁচ বছরে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় দুই হাজারের বেশি দরজা জানালা ও কাঁচ ভেঙ্গেছে। এসব মেরামতে বছরে পৌনে দুই কোটি টাকা সরকারের গচ্ছা যাচ্ছে।
ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় খোদ রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ট্রেনে ঢিল ছোড়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন রেলপথ মন্ত্রণালয়। গত কয়েক মাসে চলন্ত ট্রেনে ঢিলের আঘাতে অনেক যাত্রী আহত ও নিহত হয়েছেন। দুষ্কৃতিকারীরা নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমনের মাধ্যমকে অনিরাপদ করে তুলছে। এতে করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি বিপন্ন হচ্ছে মানুষের জীবন। তিনি বলেন, ট্রেনে ঢিল মারা একটি মারাত্বক অপরাধ। এজন্য রেললাইন এলাকার মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। ঢিল নিক্ষেপকারী কাউকে দেখলে তাকে যেন ধরিয়ে দেয়া হয়।
গত ২রা মে রাতে নোয়াখালী এক্সপ্রেস ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সরদার মাহমুদুল হাসান দূর্জয় আহত হন। তার সহপাঠিরা জানিয়েছেন, রাত ৮টার দিকে তারা নোয়াখালী স্টেশন থেকে টঙ্গির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন। ভোর চারটার দিকে ট্রেনটি নরসিংদির জিরানদি স্টেশনে পৌঁছার আগে কে বা কারা এলোপাতাড়ি পাথর ছুড়তে শুরু করে। এসময় একটি পাথর এসে দূর্জয়ের মাথায় আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়েন দূর্জয়। পাথরের আঘাতে তার প্রচুর রক্ষক্ষরণ হয়। ২৪শে এপ্রিল রাত নয়টার দিকে টঙ্গীর আউট সিগন্যালে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরে ট্রেনের গার্ড আবুল বাশার ঢালী মারাত্বকভাবে আহত হন। তিনি এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
গত বছরের ৩০শে এপ্রিল খুলনা-বেনাপোল রুটের বেনাপোল কমিউটার ট্রেনে দায়িত্ব পালন করছিলেন রেলওয়ের পরিদর্শক বায়েজিদ শিকদার। ট্রেনটি বেনাপোল থেকে খুলনা যাওয়ার পথে দৌলতপুর স্টেশন এলাকায় দুর্বৃত্তরা পাথর ছুড়ে মারে। এতে মারাত্বকভাবে আহত হন বায়েজিদ। দীর্ঘ ৪১ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর বায়েজিদ মারা যান। ওই সময় রেলওয়ের পক্ষ থেকে চারজনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়। ২০১৩ সালের ১০ই আগস্ট স্বামীর সঙ্গে বাসায় ফেরার পথে নিহত হন প্রকৌশলী প্রীতি দাশ। ওই দিন চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা তুর্ণা নিশীতা ট্রেনের জানালার পাশে বসেছিলেন প্রীতি। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ট্রেনটি ভাটিয়ারীর ভাঙ্গা ব্রিজ এলাকায় পৌঁছানোর পর জানালা বরাবর উপর্যুপরি পাথর ছোড়া হয়। এসময় একটি পাথর তার মাথায় লাগে।
রক্তাক্ত হন প্রীতি। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজশাহী থেকে খুলনাগামী সাগরদাঁড়ি ট্রেনে দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পাথরে চোখের মধ্যে মারাত্বক আঘাত পান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী। একই সময় অজ্ঞাত আরেক যুবকের মাথায় পাথরের আঘাত লাগে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরে পাথরের আঘাতে আহত হন ট্রেনের পরিচালক আবদুল কাইয়ুম। গত বছরে ২রা এপ্রিল কমলাপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি ট্রেনে পাথরের আঘাত লেগে আহত হন বোয়ালখালী পৌরসভা আওয়ামী লীগের আহবায়ক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী।
রেলওয়েসূত্র জানিয়েছে, সারাদেশে ২ হাজার ৯শ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। ২০ জেলায় পাথর নিক্ষেপেরে ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ৫টি ও পশ্চিমাঞ্চলের ১৫টি জেলা রয়েছে। ২০ জেলার মধ্যে ৭০টি স্পটকে স্ট্রোন থ্রয়িং স্পট (পাথর নিক্ষেপ স্পট) হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এসব স্পটে সবচেয়ে বেশি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রয়েছে, গাজীপুরের টঙ্গী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে গঙ্গাসাগর, কুমিল্লার ময়নামতি, চট্টগ্রামের পাহাড়তলি, সীতাকুণ্ড, নরসিংদি, পুবাইল, গফরগাঁও, গৌরিপুর, মোহনগঞ্জ, সরিষাবাড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, ঢাকার তেজগাঁও, কাওরানবাজার, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, লালমনিরহাট, পীরগঞ্জ, গাইবান্ধা, বুনারপাতা, সোনাতলা, আজিমনগর, খুলনা, পার্বতীপুর, জামতইল, কোট চাঁদপুর, নোয়াপাড়া, দৌলতপুর, রংপুর, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা, ষোলশহর ফৌজদারিহাট, সীতাকুণ্ড, চৌমুহনী, শশীদল, ইমামবাড়ি, কসবা, পাঘাচং, ভাতশালা, শায়েস্তাগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কাউনিয়া, বামনডাঙ্গা। এর বাইরে আরও অনেক স্পট আছে মাঝে মধ্যে ওই স্পট থেকে পাথর নিক্ষেপ করা হয়।
সূত্র জানিয়েছে, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বেশ কিছু কারণে ঘটে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাদক ব্যবসায়ী ও চোরা কারবারীরা এর জন্য দায়ী। কারণ রেলপথে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা অনেকটা কম। নির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য না থাকলে ট্রেনে খুব কম অভিযান চালানো হয় না। তাই এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অবৈধ ব্যবসায়ীরা গোপনে ট্রেনে করে মাদকদ্রব্য, চোরাই পণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজস থাকে। ট্রেন স্টেশনে প্রবেশের আগে অথবা স্টেশন থেকে বের হওয়ার পর ট্রেনের গতি কমিয়ে বা কখনও থামিয়ে মালামাল নামাতে সহযোগীতা করা হয়। আর আগে থেকেই এসব মাদকদ্রব্য বা চোরাই পণ্যের গ্রহীতারা নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করতে থাকে। কোন কারণে যদি ট্রেন ওই স্থানে না থামে তবে তারা পাথর নিক্ষেপ করে। রেলওয়ে পুলিশ বলছে, এ ধরনের অভিযোগ আমরা পেয়েছি। কিন্ত হাতে নাতে কোন প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে মাদকাসক্ত ও শিশুরা পাথর ছোঁড়ে মেরেছে এমন ঘটনা অনেক পাওয়া গেছে। হাতেনাতে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে বড়রা পাথর মারলে থানায় জিডি ও শিশু হলে অভিভাবকের উপস্থিতিতে মুচলেকা নেয়া হয়। আর পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় কেউ যদি মারা যায় তবে মামলা-জরিমানা করা হয়।
অপরাধ বিশ্লেষক ও সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে যাত্রীরা যেভাবে আহত-নিহত ও অঙ্গহানী হচ্ছেন এটা অমানবিক। মূলত রেলস্টেশনের আশেপাশে অপরাধীরা সক্রিয় থাকে। এসব স্থান থেকেই নানা অপরাধের জন্ম হয়। রেলপথকে অপরাধীরা নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহার করছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা না থাকায় অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। একের পর এক পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটার পর রেল কর্তৃপক্ষের লক্ষণীয় কোন উদ্যোগ নেই। অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় ঘটনায় মামলা হয় না। সাধারণ ডায়েরী করা হলেও জোরেশোরে কোন তদন্ত হয় না। রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোরশেদ আলম মানবজমিনকে বলেন, সাধারণত রেললাইনের আশেপাশে যে শিশুরা খেলাধুলা করে তারাই পাথর নিক্ষেপ করে। এছাড়া পাথর নিক্ষেপ হয় খুব নির্জন স্থানে। যেখানে সাধারণত ট্রেন থামানো হয় না।
কারণ চলন্ত ট্রেন থামাতে থামাতে কয়েক কিলোমিটার চলে যায়। ঘটনাস্থলে ফিরে আসতে ১৫/২০ মিনিটের প্রয়োজন হয়। আর ফিরে আসলে যে নিক্ষেপকারীকে পাওয়া যাবে তারও নিশ্চয়তা নাই। তাই ওইসব এলাকার স্থানীয় কমিউনিটি, প্রশাসন নিয়ে আমরা ক্যাম্পেইন করছি। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে রেলওয়ে পুলিশের কোন টহল টিম কাজ করে কিনা এমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, নির্জন স্থান থেকেই পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এসব স্থানে পুলিশের টহল টিম কাজ করে না। সবসময় এসব স্থানে লোকজনও থাকে না। এছাড়া আমাদের জনবলের স্বল্পতা রয়েছে। দেশের অর্ধেক ট্রেনে জনবল সংকট থাকায় গার্ড দেয়া সম্ভব হয় না। সারা দেশের চারশ স্টেশনের মধ্যে ২৪টিতে থানা ও ৩৩টিতে ফাঁড়ি আছে। আমরা জনবল বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।
রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। যাত্রীদের পাশাপাশি ট্রেনেরও অনেক ক্ষতি হচ্ছে। পাথর নিক্ষেপ রোধে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু উদ্যোগ ছিল। মাঝখানে এসব উদ্যেগ স্থিমিত হয়েছিল। এখন আবার নতুন করে কাজ শুরু করা হবে। এজন্য নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন ও তার লোকজনের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। আমরা তাদের বেশ কিছু সচেতনামূলক ভিডিও দেখেছি। তবে সেগুলো সড়ক পথের জন্য কার্যকরী। তাই আমরা তাদেরকে বলেছি রেলপথের জন্য যেন তারা কিছু ভিডিও বা নাটক তৈরি করেন।
প্রয়োজনে আমরা অর্থায়ন করব। সচিব আরও বলেন, এছাড়া আমরা রেলপথে পাথর নিক্ষেপের বেশ কিছু স্পট চিহ্নিত করেছি। এসব স্পট এলাকার এমপি, স্থানীয় অন্যান্য জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, স্কুল, মসজিদ, মন্দিরের প্রতিনিধি ও এলাকাবাসীকে নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করেছি। লিফলেট বিতরণ ও র্যালিও করা হয়েছে। এছাড়া মসজিদের ইমামদের চিঠি দেয়া হয়েছে নামাজের পরে যেন তারা এসব বিষয়ে আলোচনা করে। তিনি আরও বলেন, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঝুঁকিপূর্ণ স্পট আমরা চিহ্নিত করেছি। এসব স্পটেই আমাদের বেশি কাজ হয়।
পাথর সন্ত্রাসীদের ছোড়া পাথরে যাত্রীদের প্রাণহানি থেকে শুরু করে অঙ্গহানি হচ্ছে। মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। গত বছর খোদ রেলওয়ে কর্মকর্তাও পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় নিহত হয়েছেন। রেলওয়েসূত্র বলছে, বছরে কম বেশি দেড় শতাধিক পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি এই ঘটনা বাড়ছে।
গত এক মাসে শুধুমাত্র ঢাকা-রাজশাহী রুটে ১৭টি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী ট্রেনে উত্তরাঞ্চল ভ্রমণের সময় ওই ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। তাকে বহনকারী ট্রেনে পাথরের আঘাত করায় জানালার কাচ ভেঙ্গে পড়েছিল। যদিও এঘটনায় কেউ আহত হননি। তবে বেশিরভাগ সময় পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় শুধু যাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না ট্রেনেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গত পাঁচ বছরে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় দুই হাজারের বেশি দরজা জানালা ও কাঁচ ভেঙ্গেছে। এসব মেরামতে বছরে পৌনে দুই কোটি টাকা সরকারের গচ্ছা যাচ্ছে।
ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় খোদ রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ট্রেনে ঢিল ছোড়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন রেলপথ মন্ত্রণালয়। গত কয়েক মাসে চলন্ত ট্রেনে ঢিলের আঘাতে অনেক যাত্রী আহত ও নিহত হয়েছেন। দুষ্কৃতিকারীরা নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমনের মাধ্যমকে অনিরাপদ করে তুলছে। এতে করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি বিপন্ন হচ্ছে মানুষের জীবন। তিনি বলেন, ট্রেনে ঢিল মারা একটি মারাত্বক অপরাধ। এজন্য রেললাইন এলাকার মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। ঢিল নিক্ষেপকারী কাউকে দেখলে তাকে যেন ধরিয়ে দেয়া হয়।
গত ২রা মে রাতে নোয়াখালী এক্সপ্রেস ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সরদার মাহমুদুল হাসান দূর্জয় আহত হন। তার সহপাঠিরা জানিয়েছেন, রাত ৮টার দিকে তারা নোয়াখালী স্টেশন থেকে টঙ্গির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন। ভোর চারটার দিকে ট্রেনটি নরসিংদির জিরানদি স্টেশনে পৌঁছার আগে কে বা কারা এলোপাতাড়ি পাথর ছুড়তে শুরু করে। এসময় একটি পাথর এসে দূর্জয়ের মাথায় আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়েন দূর্জয়। পাথরের আঘাতে তার প্রচুর রক্ষক্ষরণ হয়। ২৪শে এপ্রিল রাত নয়টার দিকে টঙ্গীর আউট সিগন্যালে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরে ট্রেনের গার্ড আবুল বাশার ঢালী মারাত্বকভাবে আহত হন। তিনি এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
গত বছরের ৩০শে এপ্রিল খুলনা-বেনাপোল রুটের বেনাপোল কমিউটার ট্রেনে দায়িত্ব পালন করছিলেন রেলওয়ের পরিদর্শক বায়েজিদ শিকদার। ট্রেনটি বেনাপোল থেকে খুলনা যাওয়ার পথে দৌলতপুর স্টেশন এলাকায় দুর্বৃত্তরা পাথর ছুড়ে মারে। এতে মারাত্বকভাবে আহত হন বায়েজিদ। দীর্ঘ ৪১ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর বায়েজিদ মারা যান। ওই সময় রেলওয়ের পক্ষ থেকে চারজনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়। ২০১৩ সালের ১০ই আগস্ট স্বামীর সঙ্গে বাসায় ফেরার পথে নিহত হন প্রকৌশলী প্রীতি দাশ। ওই দিন চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা তুর্ণা নিশীতা ট্রেনের জানালার পাশে বসেছিলেন প্রীতি। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ট্রেনটি ভাটিয়ারীর ভাঙ্গা ব্রিজ এলাকায় পৌঁছানোর পর জানালা বরাবর উপর্যুপরি পাথর ছোড়া হয়। এসময় একটি পাথর তার মাথায় লাগে।
রক্তাক্ত হন প্রীতি। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজশাহী থেকে খুলনাগামী সাগরদাঁড়ি ট্রেনে দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পাথরে চোখের মধ্যে মারাত্বক আঘাত পান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী। একই সময় অজ্ঞাত আরেক যুবকের মাথায় পাথরের আঘাত লাগে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরে পাথরের আঘাতে আহত হন ট্রেনের পরিচালক আবদুল কাইয়ুম। গত বছরে ২রা এপ্রিল কমলাপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি ট্রেনে পাথরের আঘাত লেগে আহত হন বোয়ালখালী পৌরসভা আওয়ামী লীগের আহবায়ক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী।
রেলওয়েসূত্র জানিয়েছে, সারাদেশে ২ হাজার ৯শ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। ২০ জেলায় পাথর নিক্ষেপেরে ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ৫টি ও পশ্চিমাঞ্চলের ১৫টি জেলা রয়েছে। ২০ জেলার মধ্যে ৭০টি স্পটকে স্ট্রোন থ্রয়িং স্পট (পাথর নিক্ষেপ স্পট) হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এসব স্পটে সবচেয়ে বেশি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রয়েছে, গাজীপুরের টঙ্গী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে গঙ্গাসাগর, কুমিল্লার ময়নামতি, চট্টগ্রামের পাহাড়তলি, সীতাকুণ্ড, নরসিংদি, পুবাইল, গফরগাঁও, গৌরিপুর, মোহনগঞ্জ, সরিষাবাড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, ঢাকার তেজগাঁও, কাওরানবাজার, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, লালমনিরহাট, পীরগঞ্জ, গাইবান্ধা, বুনারপাতা, সোনাতলা, আজিমনগর, খুলনা, পার্বতীপুর, জামতইল, কোট চাঁদপুর, নোয়াপাড়া, দৌলতপুর, রংপুর, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা, ষোলশহর ফৌজদারিহাট, সীতাকুণ্ড, চৌমুহনী, শশীদল, ইমামবাড়ি, কসবা, পাঘাচং, ভাতশালা, শায়েস্তাগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কাউনিয়া, বামনডাঙ্গা। এর বাইরে আরও অনেক স্পট আছে মাঝে মধ্যে ওই স্পট থেকে পাথর নিক্ষেপ করা হয়।
সূত্র জানিয়েছে, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বেশ কিছু কারণে ঘটে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাদক ব্যবসায়ী ও চোরা কারবারীরা এর জন্য দায়ী। কারণ রেলপথে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা অনেকটা কম। নির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য না থাকলে ট্রেনে খুব কম অভিযান চালানো হয় না। তাই এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অবৈধ ব্যবসায়ীরা গোপনে ট্রেনে করে মাদকদ্রব্য, চোরাই পণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজস থাকে। ট্রেন স্টেশনে প্রবেশের আগে অথবা স্টেশন থেকে বের হওয়ার পর ট্রেনের গতি কমিয়ে বা কখনও থামিয়ে মালামাল নামাতে সহযোগীতা করা হয়। আর আগে থেকেই এসব মাদকদ্রব্য বা চোরাই পণ্যের গ্রহীতারা নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করতে থাকে। কোন কারণে যদি ট্রেন ওই স্থানে না থামে তবে তারা পাথর নিক্ষেপ করে। রেলওয়ে পুলিশ বলছে, এ ধরনের অভিযোগ আমরা পেয়েছি। কিন্ত হাতে নাতে কোন প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে মাদকাসক্ত ও শিশুরা পাথর ছোঁড়ে মেরেছে এমন ঘটনা অনেক পাওয়া গেছে। হাতেনাতে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে বড়রা পাথর মারলে থানায় জিডি ও শিশু হলে অভিভাবকের উপস্থিতিতে মুচলেকা নেয়া হয়। আর পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় কেউ যদি মারা যায় তবে মামলা-জরিমানা করা হয়।
অপরাধ বিশ্লেষক ও সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে যাত্রীরা যেভাবে আহত-নিহত ও অঙ্গহানী হচ্ছেন এটা অমানবিক। মূলত রেলস্টেশনের আশেপাশে অপরাধীরা সক্রিয় থাকে। এসব স্থান থেকেই নানা অপরাধের জন্ম হয়। রেলপথকে অপরাধীরা নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহার করছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা না থাকায় অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। একের পর এক পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটার পর রেল কর্তৃপক্ষের লক্ষণীয় কোন উদ্যোগ নেই। অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় ঘটনায় মামলা হয় না। সাধারণ ডায়েরী করা হলেও জোরেশোরে কোন তদন্ত হয় না। রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোরশেদ আলম মানবজমিনকে বলেন, সাধারণত রেললাইনের আশেপাশে যে শিশুরা খেলাধুলা করে তারাই পাথর নিক্ষেপ করে। এছাড়া পাথর নিক্ষেপ হয় খুব নির্জন স্থানে। যেখানে সাধারণত ট্রেন থামানো হয় না।
কারণ চলন্ত ট্রেন থামাতে থামাতে কয়েক কিলোমিটার চলে যায়। ঘটনাস্থলে ফিরে আসতে ১৫/২০ মিনিটের প্রয়োজন হয়। আর ফিরে আসলে যে নিক্ষেপকারীকে পাওয়া যাবে তারও নিশ্চয়তা নাই। তাই ওইসব এলাকার স্থানীয় কমিউনিটি, প্রশাসন নিয়ে আমরা ক্যাম্পেইন করছি। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে রেলওয়ে পুলিশের কোন টহল টিম কাজ করে কিনা এমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, নির্জন স্থান থেকেই পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এসব স্থানে পুলিশের টহল টিম কাজ করে না। সবসময় এসব স্থানে লোকজনও থাকে না। এছাড়া আমাদের জনবলের স্বল্পতা রয়েছে। দেশের অর্ধেক ট্রেনে জনবল সংকট থাকায় গার্ড দেয়া সম্ভব হয় না। সারা দেশের চারশ স্টেশনের মধ্যে ২৪টিতে থানা ও ৩৩টিতে ফাঁড়ি আছে। আমরা জনবল বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।
রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। যাত্রীদের পাশাপাশি ট্রেনেরও অনেক ক্ষতি হচ্ছে। পাথর নিক্ষেপ রোধে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু উদ্যোগ ছিল। মাঝখানে এসব উদ্যেগ স্থিমিত হয়েছিল। এখন আবার নতুন করে কাজ শুরু করা হবে। এজন্য নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন ও তার লোকজনের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। আমরা তাদের বেশ কিছু সচেতনামূলক ভিডিও দেখেছি। তবে সেগুলো সড়ক পথের জন্য কার্যকরী। তাই আমরা তাদেরকে বলেছি রেলপথের জন্য যেন তারা কিছু ভিডিও বা নাটক তৈরি করেন।
প্রয়োজনে আমরা অর্থায়ন করব। সচিব আরও বলেন, এছাড়া আমরা রেলপথে পাথর নিক্ষেপের বেশ কিছু স্পট চিহ্নিত করেছি। এসব স্পট এলাকার এমপি, স্থানীয় অন্যান্য জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, স্কুল, মসজিদ, মন্দিরের প্রতিনিধি ও এলাকাবাসীকে নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করেছি। লিফলেট বিতরণ ও র্যালিও করা হয়েছে। এছাড়া মসজিদের ইমামদের চিঠি দেয়া হয়েছে নামাজের পরে যেন তারা এসব বিষয়ে আলোচনা করে। তিনি আরও বলেন, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঝুঁকিপূর্ণ স্পট আমরা চিহ্নিত করেছি। এসব স্পটেই আমাদের বেশি কাজ হয়।
No comments