বাংলাদেশকে পটাতে কেন লড়ছে ভারত ও চীন?
এ
মাসের শুরুর দিকে ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে বাংলাদেশ সফরে
এসেছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা থেকে শুরু করে পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা
করা ছিল তার সফরের উদ্দেশ্য। এছাড়া এই সফরে ৮০ মাইল দীর্ঘ একটি পাইপলাইন
নির্মাণেও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ। ওই পাইপলাইনের মাধ্যমে
বাংলাদেশে তেল রপ্তানি করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন হলো
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘প্রথমে প্রতিবেশী’ (নেইবারহুড
ফার্স্ট) শীর্ষক উচ্চাবিলাসী এক পররাষ্ট্র উদ্যোগের অংশ।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড পলিটিকস রিভিউ এ নিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছে মিশেল কুগেলম্যানের। তিনি যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক উইড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার্স ফর স্কলার্সের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ সহযোগী ও এশিয়া প্রোগ্রামের উপ-পরিচালক। কুগেলম্যান ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ সম্পর্ক কীভাবে মোদির আঞ্চলিক এজেন্ডার অন্তর্ভুক্ত এবং কেন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নে চীন বড় বাধা, তার ওপরও আলোকপাত করেছেন তিনি। তার সাক্ষাৎকার হুবহু তুলে ধরা হলো মানবজমিন থেকে পাঠকদের জন্য।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা কী?
মিশেল কুগেলম্যান: বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ভালো পর্যায়েই রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সম্পর্কে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। দুই দেশের সরকারের মধ্যে সম্পর্কে একটি বড় কেন্দ্রবিন্দু হলো সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ। দুই দেশই সন্ত্রাসবাদ নিয়ে খুবই কড়া। খুব কঠোরভাবে এই সন্ত্রাসবাদ দমন করতে তারা ভয় পায় না।
তবে উত্তেজক বিষয়-আসয়ও আছে। এর মধ্যে একটি হলো রোহিঙ্গা ইস্যু। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রচুর সংখ্যক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ সীমান্তে স্থানান্তর করা হচ্ছে। এর ফলে যে নিরাপত্তাগত জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে অস্বস্তিতে আছে নয়া দিল্লী।
এছাড়া তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়েও উত্তেজনা আছে। এই নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়। ঢাকা বেশ কয়েক বছর ধরে এই চুক্তি চূড়ান্ত করতে চাপ দিয়ে আসছে ভারতকে। নয়া দিল্লিও এতে রাজি। তবে ভারতে পানি ইস্যু হলো রাজ্য সংক্রান্ত বিষয়। এর মানে হলো, স্থানীয় রাজ্য সরকারকে অবশ্যই যে কোনো আন্তঃসীমান্ত নদী চুক্তিতে সই করতে হয়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে যে সরকার অধিষ্ঠিত আছে, তারা এই চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত নয়।
তবে এগুলোকে ছাড়িয়ে দুই দেশের সম্পর্কে সবচেয়ে বড় উত্তেজনার বিষয় হলো সম্ভবত বাংলাদেশে চীনের ঢুকে পড়াটা। কারণ, চীনকে নয়া দিল্লি নিজের মূল কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করে।
প্রশ্ন: মোদির ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি এখন পর্যন্ত কতটা সফল? আর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হলে তা ভারতের আঞ্চলিক উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হয় কীভাবে?
কুগেলম্যান: মোদির একটি বড় সমালোচনা হলো যে, তিনি তার নয়ানীতির সঙ্গে বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় স্লোগান যুক্ত করেছেন। কিন্তু এসব নীতি এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি তিনি করতে পারেননি। ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির মানে হলো প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে নয়া দিল্লির সম্পর্ক গভীর করা।
এই নীতির কিছু মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। তার সবচেয়ে বড় লক্ষণগুলোর একটি ছিল ২০১৪ সালে মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে আমন্ত্রণ জানানো। তবে এরপর থেকে ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্ক ক্রমেই অবনতি হয়েছে। বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্ক কার্যত স্থবির হয়ে আছে।
এমনকি ভারতের সঙ্গে দেশটির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কিছু প্রতিবেশীর সম্পর্কও ধাক্কা খেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নেপালের ক্ষেত্রে দুই দেশ বিচ্ছিরি এক বিতর্কে জড়িয়ে গিয়েছিল। একপর্যায়ে নেপাল অভিযোগ করে যে, ভারত দেশটির পণ্যের প্রবেশ আটকে দিচ্ছে। এছাড়া পাকিস্তান থেকে শ্রীলংকা ও মাঝের বহু এলাকায় চীনের পদচ্ছাপ পড়েছে, যা ভারত ঠেকাতে পারেনি।
তবে ‘প্রথমে প্রতিবেশী’ নীতি ব্যর্থ হওয়ার সবচেয়ে গুরুতর লক্ষণ হলো, দক্ষিণ এশিয়ার প্রধানতম আঞ্চলিক সংগঠন সার্ককে ব্যবহার করে পাকিস্তানকে খোঁচা দেয়ার যে সিদ্ধান্ত ভারত নিলো। ২০১৬ সালে ভারত বেশ কয়েকটি সার্কভুক্ত দেশকে তৎকালীন বার্ষিক সার্ক সম্মেলন বয়কট করতে রাজি করায়। ওই সম্মেলন পাকিস্তানের ইসলামাবাদে হওয়ার কথা ছিল। অগত্যা, পাকিস্তান ওই সম্মেলন বাতিল করতে বাধ্য হয়। সহযোগিতার জন্য যেই আঞ্চলিক ফোরামের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেই ফোরামকে ব্যবহার করে প্রতিবেশীদেরকে একে-অপরের বিরুদ্ধে ঠেলে দেয়ার মধ্যে ‘প্রতিবেশীসুলভ’ কিছু আসলে নেই।
তবে ‘প্রথমে প্রতিবেশী’ নীতি ব্যর্থ হলেও, বাংলাদেশই ছিল এই নীতির একমাত্র ব্যতিক্রম। এই একটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গভীরে নিতে সক্ষম হয়েছে মোদি সরকার। কেবলমাত্র সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতেই দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারা বেশ কয়েকটি চুক্তিতেও সম্মত হয়েছেন।
ভারতের দুশ্চিন্তা হলো যে, চীন তাদেরকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলছে। সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কোন্নয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অর্জন।
প্রশ্ন: সম্পর্ক গভীর করার ক্ষেত্রে কী কী সুযোগ রয়েছে? বাধাই বা কী?
কুগেলম্যান: সম্ভাব্য সহযোগিতার যেই ক্ষেত্রগুলো সবচেয়ে কম আলোচিত হয়, তার একটি হলো জ্বালানি। ভারত ও বাংলাদেশ নীরবে বেশ কয়েকটি জ্বালানি চুক্তি সই করেছে। এ থেকে দুই দেশেরই লাভ ঘরে তোলার সুযোগ রয়েছে। এসব চুক্তির একটি হলো বাংলাদেশের ট্রানজিট স্থাপনা ও বিদ্যুৎ গ্রিড ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দরিদ্র রাজ্যগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি। আরেকটি চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশকে জ্বালানি সরবরাহ করবে। বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করবে।
এর বাইরেও ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের মধ্যে জ্বালানি ভাগাভাগির কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক আলোচনা চলছে। এসব জ্বালানি চুক্তি দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা হলো চীন। বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও প্রভাব বৃদ্ধি করতে বেইজিং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আর ঢাকাও চীনকে তাড়িয়ে দেবে না। নয়া দিল্লির জন্য এটি উদ্বেগের কারণ।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক গভীর হওয়ার পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও কী ঘনিষ্ঠতর হবে? চীন ফ্যাক্টর শেষ পর্যন্ত অনতিক্রম্য কোনো প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠার প্রয়োজন নেই।
নয়া দিল্লি সেসব দেশের সঙ্গে গভীর আংশীদারিত্ব করতে অভ্যস্ত যেসবের সঙ্গে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক এক্ষেত্রে উদাহরণ। দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে যেখানে ওয়াশিংটন পাকিস্তানের সঙ্গে মোটামুটি ভালো সম্পর্ক বজায় রাখছে।
এটি বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে নয়া দিল্লি এক্ষেত্রে বাস্তবভিত্তিক হবে। নয়া দিল্লি এই বাস্তবতাও মেনে নেবে যে, চীনের কাছ থেকে পুঁজি ও বিনিয়োগ চাইবে ঢাকা। এটি মেনে নেয়ার পাশাপাশি ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্র বৃদ্ধি করবে।
অবশ্যই, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের গভীরতা ভারতের জন্য মানতে সহজ হবে যদি দেশটি এই নিশ্চয়তা পায় যে, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে। বাংলাদেশের উপকূলে কোনো নৌ স্থাপনা নির্মাণে চীনের কোনো পরিকল্পনা থাকতে পারবে না। তবে আমি মনে করি না, ভারত এ ধরনের নিশ্চয়তা খুব শিগগিরই পাবে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড পলিটিকস রিভিউ এ নিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছে মিশেল কুগেলম্যানের। তিনি যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক উইড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার্স ফর স্কলার্সের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ সহযোগী ও এশিয়া প্রোগ্রামের উপ-পরিচালক। কুগেলম্যান ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ সম্পর্ক কীভাবে মোদির আঞ্চলিক এজেন্ডার অন্তর্ভুক্ত এবং কেন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নে চীন বড় বাধা, তার ওপরও আলোকপাত করেছেন তিনি। তার সাক্ষাৎকার হুবহু তুলে ধরা হলো মানবজমিন থেকে পাঠকদের জন্য।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা কী?
মিশেল কুগেলম্যান: বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ভালো পর্যায়েই রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সম্পর্কে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। দুই দেশের সরকারের মধ্যে সম্পর্কে একটি বড় কেন্দ্রবিন্দু হলো সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ। দুই দেশই সন্ত্রাসবাদ নিয়ে খুবই কড়া। খুব কঠোরভাবে এই সন্ত্রাসবাদ দমন করতে তারা ভয় পায় না।
তবে উত্তেজক বিষয়-আসয়ও আছে। এর মধ্যে একটি হলো রোহিঙ্গা ইস্যু। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রচুর সংখ্যক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ সীমান্তে স্থানান্তর করা হচ্ছে। এর ফলে যে নিরাপত্তাগত জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে অস্বস্তিতে আছে নয়া দিল্লী।
এছাড়া তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়েও উত্তেজনা আছে। এই নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়। ঢাকা বেশ কয়েক বছর ধরে এই চুক্তি চূড়ান্ত করতে চাপ দিয়ে আসছে ভারতকে। নয়া দিল্লিও এতে রাজি। তবে ভারতে পানি ইস্যু হলো রাজ্য সংক্রান্ত বিষয়। এর মানে হলো, স্থানীয় রাজ্য সরকারকে অবশ্যই যে কোনো আন্তঃসীমান্ত নদী চুক্তিতে সই করতে হয়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে যে সরকার অধিষ্ঠিত আছে, তারা এই চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত নয়।
তবে এগুলোকে ছাড়িয়ে দুই দেশের সম্পর্কে সবচেয়ে বড় উত্তেজনার বিষয় হলো সম্ভবত বাংলাদেশে চীনের ঢুকে পড়াটা। কারণ, চীনকে নয়া দিল্লি নিজের মূল কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করে।
প্রশ্ন: মোদির ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি এখন পর্যন্ত কতটা সফল? আর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হলে তা ভারতের আঞ্চলিক উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হয় কীভাবে?
কুগেলম্যান: মোদির একটি বড় সমালোচনা হলো যে, তিনি তার নয়ানীতির সঙ্গে বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় স্লোগান যুক্ত করেছেন। কিন্তু এসব নীতি এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি তিনি করতে পারেননি। ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির মানে হলো প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে নয়া দিল্লির সম্পর্ক গভীর করা।
এই নীতির কিছু মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। তার সবচেয়ে বড় লক্ষণগুলোর একটি ছিল ২০১৪ সালে মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে আমন্ত্রণ জানানো। তবে এরপর থেকে ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্ক ক্রমেই অবনতি হয়েছে। বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্ক কার্যত স্থবির হয়ে আছে।
এমনকি ভারতের সঙ্গে দেশটির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কিছু প্রতিবেশীর সম্পর্কও ধাক্কা খেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নেপালের ক্ষেত্রে দুই দেশ বিচ্ছিরি এক বিতর্কে জড়িয়ে গিয়েছিল। একপর্যায়ে নেপাল অভিযোগ করে যে, ভারত দেশটির পণ্যের প্রবেশ আটকে দিচ্ছে। এছাড়া পাকিস্তান থেকে শ্রীলংকা ও মাঝের বহু এলাকায় চীনের পদচ্ছাপ পড়েছে, যা ভারত ঠেকাতে পারেনি।
তবে ‘প্রথমে প্রতিবেশী’ নীতি ব্যর্থ হওয়ার সবচেয়ে গুরুতর লক্ষণ হলো, দক্ষিণ এশিয়ার প্রধানতম আঞ্চলিক সংগঠন সার্ককে ব্যবহার করে পাকিস্তানকে খোঁচা দেয়ার যে সিদ্ধান্ত ভারত নিলো। ২০১৬ সালে ভারত বেশ কয়েকটি সার্কভুক্ত দেশকে তৎকালীন বার্ষিক সার্ক সম্মেলন বয়কট করতে রাজি করায়। ওই সম্মেলন পাকিস্তানের ইসলামাবাদে হওয়ার কথা ছিল। অগত্যা, পাকিস্তান ওই সম্মেলন বাতিল করতে বাধ্য হয়। সহযোগিতার জন্য যেই আঞ্চলিক ফোরামের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেই ফোরামকে ব্যবহার করে প্রতিবেশীদেরকে একে-অপরের বিরুদ্ধে ঠেলে দেয়ার মধ্যে ‘প্রতিবেশীসুলভ’ কিছু আসলে নেই।
তবে ‘প্রথমে প্রতিবেশী’ নীতি ব্যর্থ হলেও, বাংলাদেশই ছিল এই নীতির একমাত্র ব্যতিক্রম। এই একটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গভীরে নিতে সক্ষম হয়েছে মোদি সরকার। কেবলমাত্র সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতেই দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারা বেশ কয়েকটি চুক্তিতেও সম্মত হয়েছেন।
ভারতের দুশ্চিন্তা হলো যে, চীন তাদেরকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলছে। সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কোন্নয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অর্জন।
প্রশ্ন: সম্পর্ক গভীর করার ক্ষেত্রে কী কী সুযোগ রয়েছে? বাধাই বা কী?
কুগেলম্যান: সম্ভাব্য সহযোগিতার যেই ক্ষেত্রগুলো সবচেয়ে কম আলোচিত হয়, তার একটি হলো জ্বালানি। ভারত ও বাংলাদেশ নীরবে বেশ কয়েকটি জ্বালানি চুক্তি সই করেছে। এ থেকে দুই দেশেরই লাভ ঘরে তোলার সুযোগ রয়েছে। এসব চুক্তির একটি হলো বাংলাদেশের ট্রানজিট স্থাপনা ও বিদ্যুৎ গ্রিড ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দরিদ্র রাজ্যগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি। আরেকটি চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশকে জ্বালানি সরবরাহ করবে। বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করবে।
এর বাইরেও ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের মধ্যে জ্বালানি ভাগাভাগির কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক আলোচনা চলছে। এসব জ্বালানি চুক্তি দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা হলো চীন। বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও প্রভাব বৃদ্ধি করতে বেইজিং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আর ঢাকাও চীনকে তাড়িয়ে দেবে না। নয়া দিল্লির জন্য এটি উদ্বেগের কারণ।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক গভীর হওয়ার পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও কী ঘনিষ্ঠতর হবে? চীন ফ্যাক্টর শেষ পর্যন্ত অনতিক্রম্য কোনো প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠার প্রয়োজন নেই।
নয়া দিল্লি সেসব দেশের সঙ্গে গভীর আংশীদারিত্ব করতে অভ্যস্ত যেসবের সঙ্গে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক এক্ষেত্রে উদাহরণ। দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে যেখানে ওয়াশিংটন পাকিস্তানের সঙ্গে মোটামুটি ভালো সম্পর্ক বজায় রাখছে।
এটি বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে নয়া দিল্লি এক্ষেত্রে বাস্তবভিত্তিক হবে। নয়া দিল্লি এই বাস্তবতাও মেনে নেবে যে, চীনের কাছ থেকে পুঁজি ও বিনিয়োগ চাইবে ঢাকা। এটি মেনে নেয়ার পাশাপাশি ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্র বৃদ্ধি করবে।
অবশ্যই, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের গভীরতা ভারতের জন্য মানতে সহজ হবে যদি দেশটি এই নিশ্চয়তা পায় যে, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে। বাংলাদেশের উপকূলে কোনো নৌ স্থাপনা নির্মাণে চীনের কোনো পরিকল্পনা থাকতে পারবে না। তবে আমি মনে করি না, ভারত এ ধরনের নিশ্চয়তা খুব শিগগিরই পাবে।
No comments