ঢাকায় সমকামী ক্লাব by হাফিজ মুহাম্মদ
সমকামী
ক্লাবে যোগ দিয়েই বদলে ফেলে নাম। সমকামীদের নিয়ে আড্ডা, বসবাস, বেড়ানো সবই
করে তারা। নিজ পরিবারও এ বিষয়ে থাকে অবগত। কিন্তু তারা লোক লজ্জার ভয়ে
থাকে নীরব। ইদানীং রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে সমকামীরা ক্লাব খুলে
তাদের কাজ করছে। কেউ কেউ এক সঙ্গে থাকছে।
এমন একাধিক সমকামী সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এসব সংগঠন গোপনে চালাচ্ছে কার্যক্রম। কিছু এনজিও দিচ্ছে তাদের সহায়তা। ফেসবুক, টুইটার, ইমো, হোয়াটস অ্যাপসহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে এরা এখন সরব। সাংকেতিক কোড ব্যবহার করে বাড়াচ্ছে সদস্য সংখ্যা। আসল নাম বদলে এমনই একজন সমকামী সদস্য নিজের নাম রেখেছে ড্যানি। তার বেড়ে ওঠা জয়পুরহাটে। ছোটবেলা কাটে নিজ শহরে। ঢাকার প্রেস ক্লাবের সামনে একটি চায়ের দোকানে বসে কথা হচ্ছিল ড্যানির সঙ্গে। ড্যানি বলেন, ৮ম শ্রেণিতে তখন লেখাপড়া করি। আমার টান থাকার কথা মেয়েদের প্রতি। কিন্তু না। কেন জানি ছেলেদের কাছে টানতে মন চায়। তাদের সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করে। একসময় এসএসসি পাস করে ভর্তি হই টেকনিক্যাল কলেজে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। এসময় আমি একজন পার্টনার খুঁজতে থাকি। সহসা পেয়েও যাই। এরপর আমাদের সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। তারা উভয়ে এক সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন। তাদের নিজেদের মতো শারীরিক চাহিদাও মেটান। গোপনে চারবছর তাদের সম্পর্ক চলে। একসময় তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। ভেঙে যায় দুজনের মনের লেন-দেন। ড্যানি বলেন, তখন কিছুটা হতাশায় পড়ে যাই। তবে তার সঙ্গে পরিচয় রয়েছে আরো একাধিক সমকামীর। ইতিমধ্যে ড্যানির ডিপ্লোমা কোর্স শেষ হলে স্থায়ীভাবে পড়াশুনার জন্য ঢাকায় চলে আসেন। রাজধানীতে এসে থেমে থাকেননি তিনি। নতুন পার্টনার খুঁজতে থাকেন। পাশাপাশি অস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলেন একাধিকজনের সঙ্গে। ড্যানি বলেন, এরপর নিজের মনের মতো আরেকজন সঙ্গী পাই। চলতে থাকে সম্পর্ক। দুজন বন্ধু পরিচয়ে একটি বাসা ভাড়া নেন। সাধারণ মানুষ না জানলেও তাদের মধ্যে সব সম্পর্কই তখন চলছিল। ইতিমধ্যে ড্যানির পরিবার তার আচরণে টের পান তার মধ্যে এসব অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে। কিন্তু কিসে কি হবে ততদিনে তিনি এ সম্পর্কে আসক্ত। তখন তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। একসময় ড্যানি তার পার্টনারকে নিয়ে বাড়িতে গেলে পরিবারের কাছে সত্যিকার খোলাসা হয় বিষয়টি। জেনে যায় তার অন্ধকারের কাহিনী। এদিকে একসময় ড্যানির পরিচয় হয় তার ‘গে’ কমিউনিটির আরো একাধিক সদস্যের সঙ্গে। তিনি তার কমিউনিটির কাজ ছড়িয়ে দিতে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা করেন। গড়ে তোলেন ‘ওয়ার্ক ফর মাইনরিটি (এলজিবিটি) নামের একটি সংগঠন’। এখানে সদস্য সংগ্রহ করেন ভিন্ন উপায়ে। কাজ করেন তার এবং আরো সমগোত্রীয় যে কয়টি সমকামী গোষ্ঠী রয়েছে তাদের নিয়ে। ড্যানি জানান, তার সংগঠন লিঙ্গগত বৈষম্যের শিকার হওয়া ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে ট্রেনিং দেন। সদস্য সংখ্যা কীভাবে বৃদ্ধি করবে তারও ট্রেনিং দেয়া হয় এখানে। আর তার সংগঠনকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করে বিদেশি কয়েকটি এনজিও।
আরেকজন সমকামী নয়ন। তার বেড়ে ওঠা রংপুর শহরে। তিনি পড়তেন শহরের জিলা স্কুলে। তার বয়স যখন ১৩ বছর তখন তার মনে ছেলে বন্ধুকে ভালো লাগা শুরু হতে থাকে। তার কাছের ওই বন্ধুর নাম রাহুল। এমন ভালো লাগালাগি চলতে চলতে এসএসসি পরীক্ষাও চলে আসে তাদের সামনে। নয়ন একদিন তার বন্ধুকে জানিয়ে দেন তার ভালো লাগার কথা। কিন্তু তিনি তা উড়িয়ে দেন। তাকে মানসিক ডাক্তার দেখানো হয়। কিন্তু নাছোড়বান্দা নয়ন এসএসসি পরীক্ষা শেষে রাহুলকে তার জীবনে লাগবে বলে জানিয়ে দেন। এ অবস্থায় রাহুল তার বন্ধু নয়ন থেকে চলে যান আত্মগোপনে। এদিকে নয়ন বিষ পান করেন। পরিবারের ত্বরিত পদক্ষেপে সে যাত্রায় বেঁচে যান। তবে রাহুলকে খুঁজে বেড়াতে থাকেন। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিতে গড়ে তোলেন আরেক সমকামীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক। পরে নয়ন আবারো রাহুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সামর্থ্য হন। পুনরায় সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এবার সফল নয়ন। রাহুল তার বন্ধু নয়নের মতো সমকামিতায় বিশ্বাসী কিংবা আকৃষ্ট না হলেও মেনে নেন ওর আবদার। এদিকে নয়ন হঠাৎ একদিন তার মাকে আরেকটি বাচ্চা নিতে বলেন। তার চিন্তা বাদ দিয়ে দিতে বলেন। নয়নের একটি ছোট বোন থাকার পরও কেন আরেকটি সন্তান নিতে বলে তারা চিন্তায় পড়ে যান। নয়নের মা তার এমন অস্বাভাবিক কথাবার্তা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়েন। তার বাবাকেও বিষয়টি জানানো হয়। তারা কেউ মেনে নিতে পারেন না ছেলের এমন আচরণ। ধীরে ধীরে তাদের বুঝিয়ে ফেলেন নয়ন। এদিকে নয়ন এবং রাহুলের এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলে তারা ভিন্ন কলেজে ভর্তি হন। এইচএসসিতে পড়া অবস্থায় রাহুলের চাকরি হয়ে যায়। এ জন্য তাকে চলে যেতে হয় খুলনায়। রাহুলের অনিচ্ছা সত্ত্বেও নয়নের জন্য সম্পর্ক রাখতে হয়। একসময় রাহুলের পরিবারও জেনে যায় তাদের মধ্যকার সম্পর্ক। কিন্তু রাহুলের পরিবার নয়ন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে বলা হয়। কিন্তু ততদিনে রাহুলও নয়নের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। এদিকে নয়নের পরিবার লোক-লজ্জায় কি করবেন তা ভেবে পান না। একসময় তাদের একমাত্র ছেলের জন্য মেনে নেন। তবে শর্ত থাকে সমাজে যেন তাদের সম্পর্ক জানাজানি না হয়। কিছুদিন পর রাহুলের পোস্টিং হয় ঢাকায়। সঙ্গীর জন্য নয়নও চলে আসেন ঢাকায়। তারা নিয়মিত এক সঙ্গে না থাকতে পারলেও সপ্তাহে মিলিত হতেন। এভাবে কেটে যেতে থাকে আরো কিছুদিন। নয়ন ভর্তি হন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। থাকেন ফার্মগেটের একটি মেসে এক রুম নিয়ে। এদিকে নয়নের পার্টনার রাহুলের বদলি হয় চট্টগ্রামে। কিন্তু তাতে কি! নয়নের জন্য রাহুল প্রতিমাসে অন্তত ১/২ বার ঢাকায় আসেন। থাকেন এক সঙ্গে। শুধু নয়ন কিংবা ড্যানি নয়। এমন হাজারো সমকামী রয়েছে সারা দেশে। যেমন রয়েছে পুরুষ সমকামী তেমনি রয়েছে নারী সমকামী। ধর্ম এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং আইন এমন সম লিঙ্গের যৌন সম্পর্ককে বিকৃত রুচি বলে অবহিত করলেও তারা থেমে নেই। তারা বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে তাদের সবকিছুই চলে অতি গোপনে। মাঝে-মধ্যে তারা জনসম্মুখে জানান দিতে চাইলেও পড়তে হয় তোপের মুখে। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সমকামীদের রয়েছে সরব উপস্থিতি। একাধিক গ্রুপ এবং ফ্যান পেইজ খুলে চলছে সব ধরনের কার্যক্রম। ফোনে কথা বলাকে রিস্কি মনে করার কারণে তারা মূলত এসব মাধ্যম থেকেই যোগাযোগ করেন। যাদের স্থায়ী পার্টনার নেই তারা এখান থেকে পার্ট-টাইম সম্পর্ক গড়ে তুলেন। আর স্থায়ীয়রা তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি করেন নানাভাবে। এমন কয়েকটি গ্রুপ-পেইজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে তাদের গভীরতা অনেক ভেতরে। এখানে পুরুষ সমকামীরা দুটি সাংকেতিক নাম ব্যবহার করে। একটি হচ্ছে ‘টপ’ অন্য আরেকটি ‘বটম’। তারা নিজেদের ভেতর একজন আরেকজনকে মেইল-ফিমেইল হিসেবে এ নামে জানেন।
এদিকে পুরুষ সমকামীর পাশাপাশি একইভাবে নারী সমকামীরাও তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করছে। তবে পুরুষ সমকামীদের থেকে তাদের কার্যক্রম চলে অনেক বেশি গোপনে। তারা সমাজে তো দূরে থাক পরিবারের কাছে প্রকাশ করেন না। তবে ছেলেদের তুলনায় তারা পরস্পরে সহজে মিলিত হতে পারেন। এক্ষেত্রে তাদের পরিবার জানতে পারেন না। তারা একে অন্যের সঙ্গে এ সম্পর্ক গোপনভাবেই রক্ষা করে চলেন। সমাজে তারা খুব একটা পরিচিতি পেতেও চান না। ছেলে সমকামীদের ভেতর দ্রুত বিয়ের একটা প্রবণতা কাজ করলেও মেয়েদের মধ্যে বিয়ের আগ্রহটা থাকে অনেক কম। এদের প্রচারণার বেশিরভাগই চলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর সম্পর্ক হয়ে গেলে মুঠোফোনে। ফেসবুকে তাদের পদচারণা দেখা যায় তুলনামূলক বেশি। গ্রুপ পেজ এবং ম্যাসেঞ্জারে তাদের রয়েছে উপস্থিতি। এক নারী সমকামী এঞ্জেল ফারিয়া। তার নির্দিষ্ট পার্টনার ছাড়া বাইরে কেউ জানেন না যে, তিনি সমকামী। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় কীভাবে তিনি এ সম্পর্কে পা বাড়ালেন। ফারিয়া জানান, তার কখনো ছেলেদের প্রতি কোনো ধরনের অনুভূতি কাজ করে না। বরং মেয়েদের প্রতি তাকে বেশি টানে। বয়োসন্ধি পার হওয়ার পরে তিনি মনে করেন ছেলেকে নয় মেয়েকেই সঙ্গী হিসেবে নেবেন। প্রথমে প্রথমে এমন সঙ্গী খুঁজে না পেলেও একসময় এমন একজন পেয়ে যান। একে অন্যের পরিবারের কাছে বান্ধবী পরিচয়ে জানলেও তারা আসলে উভয়ে পার্টনার। তারা যখন সময় পেতেন তখনই নিজেদের বাসায় মিলিত হতেন। উভয়ে পারিবারিকভাবে পরিচিত হয়ে গেলে তাদেরকেও সন্দেহের চোখে দেখতো না। তবে একসময় তাদের এ সম্পর্ক ভেঙে যায়। ফারিয়া মানসিকভাবে বিষণ্ন হন। তবে তা দ্রুত কাটিয়েও উঠেন। পরে নিজেকে একজন ওপেন লেসবিয়ান হিসেবে প্রকাশ করান। তবে তাও তো গোপনে। যখন তার পরিবারের সদস্যরা বাসায় অনুপস্থিত থাকেন তখন তার পার্টনারদের ডেকে এ সম্পর্কে মিলিত হন। ফারিয়াকে পরিবার বিয়ে দিতে চাইলেও তিনি রাজি হননি। তার উচ্চতর ডিগ্রি শেষ হলে বিয়ে করবেন বলে জানিয়ে দেন। আসলে ফারিয়া চান তারমতো একজন সমকামী মেয়েকে বিয়ে করতে।
২০১৪ সালের ১৮ই জানুয়ারি দেশে সমকামীদের পত্রিকা ‘রূপবান’ প্রকাশিত হলে তুলকালাম সৃষ্টি হয়। চারদিকে এগুলোকে নির্মূল করার আহ্বান জানানো হয়। পরবর্তীতে সমকামীদের পত্রিকা রূপবান এবং বয়েজ অফ বাংলাদেশ (বিওবি) নামে একটি সংগঠন দেশে সমকামীদের প্রকৃত সংখ্যা নিরুপণ করতে জরিপ চালায়। জরিপের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সেখানে তারা বলছে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ সমকামী জনগোষ্ঠী রয়েছে। জরিপে তৃতীয় লিঙ্গকে আওতায় নেয়া হয়নি। এছাড়াও পরবর্তীতে ৬০০ সমকামী এবং উভয়কামী নারী-পুরুষের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখেছে তারা পরিবারের কাছেই তাদের সম্পর্কের কথা গোপন রাখেন।
২০১৫ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর বৃটিশ কাউন্সিলে একটি সমকামী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেদিন ২০০-এর বেশি সমকামী তরুণ-তরুণী জড়ো হয়েছিল। যেখানে ‘ধী’ নামে একটি সমকামী কমিক উপস্থাপন করা হয়েছিল। আর এর চরিত্র ধারণ করেছিলেন দেশের খ্যাতনামা এক সাংস্কৃতিক দম্পতির মেয়ে। সেদিনকার সমাবেশে সমকামীদের অধিকারের পক্ষে ‘নিজেরা করি’ এনজিওর সমন্বয়কারী নানা কথা বলেছিলেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। বৃটিশ কাউন্সিলের সমকামীদের সে সমাবেশের খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশে নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। এর আগে ২০১৩ সালের ২৯শে এপ্রিল জেনেভায় অনুষ্ঠিত ‘ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউতে’ তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সমকামীদের অধিকারের পক্ষে কথা বলায় দেশে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। ২০১৭ সালের আগস্টে কেরানীগঞ্জ থেকে এক গোপন বৈঠক চলাকালে ২৮ সমকামীকে পুলিশ আটক করে। এ ঘটনা নিয়েও দেশজুড়ে তোলপাড় হয়।
এমন একাধিক সমকামী সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এসব সংগঠন গোপনে চালাচ্ছে কার্যক্রম। কিছু এনজিও দিচ্ছে তাদের সহায়তা। ফেসবুক, টুইটার, ইমো, হোয়াটস অ্যাপসহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে এরা এখন সরব। সাংকেতিক কোড ব্যবহার করে বাড়াচ্ছে সদস্য সংখ্যা। আসল নাম বদলে এমনই একজন সমকামী সদস্য নিজের নাম রেখেছে ড্যানি। তার বেড়ে ওঠা জয়পুরহাটে। ছোটবেলা কাটে নিজ শহরে। ঢাকার প্রেস ক্লাবের সামনে একটি চায়ের দোকানে বসে কথা হচ্ছিল ড্যানির সঙ্গে। ড্যানি বলেন, ৮ম শ্রেণিতে তখন লেখাপড়া করি। আমার টান থাকার কথা মেয়েদের প্রতি। কিন্তু না। কেন জানি ছেলেদের কাছে টানতে মন চায়। তাদের সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করে। একসময় এসএসসি পাস করে ভর্তি হই টেকনিক্যাল কলেজে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। এসময় আমি একজন পার্টনার খুঁজতে থাকি। সহসা পেয়েও যাই। এরপর আমাদের সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। তারা উভয়ে এক সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন। তাদের নিজেদের মতো শারীরিক চাহিদাও মেটান। গোপনে চারবছর তাদের সম্পর্ক চলে। একসময় তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। ভেঙে যায় দুজনের মনের লেন-দেন। ড্যানি বলেন, তখন কিছুটা হতাশায় পড়ে যাই। তবে তার সঙ্গে পরিচয় রয়েছে আরো একাধিক সমকামীর। ইতিমধ্যে ড্যানির ডিপ্লোমা কোর্স শেষ হলে স্থায়ীভাবে পড়াশুনার জন্য ঢাকায় চলে আসেন। রাজধানীতে এসে থেমে থাকেননি তিনি। নতুন পার্টনার খুঁজতে থাকেন। পাশাপাশি অস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলেন একাধিকজনের সঙ্গে। ড্যানি বলেন, এরপর নিজের মনের মতো আরেকজন সঙ্গী পাই। চলতে থাকে সম্পর্ক। দুজন বন্ধু পরিচয়ে একটি বাসা ভাড়া নেন। সাধারণ মানুষ না জানলেও তাদের মধ্যে সব সম্পর্কই তখন চলছিল। ইতিমধ্যে ড্যানির পরিবার তার আচরণে টের পান তার মধ্যে এসব অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে। কিন্তু কিসে কি হবে ততদিনে তিনি এ সম্পর্কে আসক্ত। তখন তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। একসময় ড্যানি তার পার্টনারকে নিয়ে বাড়িতে গেলে পরিবারের কাছে সত্যিকার খোলাসা হয় বিষয়টি। জেনে যায় তার অন্ধকারের কাহিনী। এদিকে একসময় ড্যানির পরিচয় হয় তার ‘গে’ কমিউনিটির আরো একাধিক সদস্যের সঙ্গে। তিনি তার কমিউনিটির কাজ ছড়িয়ে দিতে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা করেন। গড়ে তোলেন ‘ওয়ার্ক ফর মাইনরিটি (এলজিবিটি) নামের একটি সংগঠন’। এখানে সদস্য সংগ্রহ করেন ভিন্ন উপায়ে। কাজ করেন তার এবং আরো সমগোত্রীয় যে কয়টি সমকামী গোষ্ঠী রয়েছে তাদের নিয়ে। ড্যানি জানান, তার সংগঠন লিঙ্গগত বৈষম্যের শিকার হওয়া ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে ট্রেনিং দেন। সদস্য সংখ্যা কীভাবে বৃদ্ধি করবে তারও ট্রেনিং দেয়া হয় এখানে। আর তার সংগঠনকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করে বিদেশি কয়েকটি এনজিও।
আরেকজন সমকামী নয়ন। তার বেড়ে ওঠা রংপুর শহরে। তিনি পড়তেন শহরের জিলা স্কুলে। তার বয়স যখন ১৩ বছর তখন তার মনে ছেলে বন্ধুকে ভালো লাগা শুরু হতে থাকে। তার কাছের ওই বন্ধুর নাম রাহুল। এমন ভালো লাগালাগি চলতে চলতে এসএসসি পরীক্ষাও চলে আসে তাদের সামনে। নয়ন একদিন তার বন্ধুকে জানিয়ে দেন তার ভালো লাগার কথা। কিন্তু তিনি তা উড়িয়ে দেন। তাকে মানসিক ডাক্তার দেখানো হয়। কিন্তু নাছোড়বান্দা নয়ন এসএসসি পরীক্ষা শেষে রাহুলকে তার জীবনে লাগবে বলে জানিয়ে দেন। এ অবস্থায় রাহুল তার বন্ধু নয়ন থেকে চলে যান আত্মগোপনে। এদিকে নয়ন বিষ পান করেন। পরিবারের ত্বরিত পদক্ষেপে সে যাত্রায় বেঁচে যান। তবে রাহুলকে খুঁজে বেড়াতে থাকেন। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিতে গড়ে তোলেন আরেক সমকামীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক। পরে নয়ন আবারো রাহুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সামর্থ্য হন। পুনরায় সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এবার সফল নয়ন। রাহুল তার বন্ধু নয়নের মতো সমকামিতায় বিশ্বাসী কিংবা আকৃষ্ট না হলেও মেনে নেন ওর আবদার। এদিকে নয়ন হঠাৎ একদিন তার মাকে আরেকটি বাচ্চা নিতে বলেন। তার চিন্তা বাদ দিয়ে দিতে বলেন। নয়নের একটি ছোট বোন থাকার পরও কেন আরেকটি সন্তান নিতে বলে তারা চিন্তায় পড়ে যান। নয়নের মা তার এমন অস্বাভাবিক কথাবার্তা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়েন। তার বাবাকেও বিষয়টি জানানো হয়। তারা কেউ মেনে নিতে পারেন না ছেলের এমন আচরণ। ধীরে ধীরে তাদের বুঝিয়ে ফেলেন নয়ন। এদিকে নয়ন এবং রাহুলের এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলে তারা ভিন্ন কলেজে ভর্তি হন। এইচএসসিতে পড়া অবস্থায় রাহুলের চাকরি হয়ে যায়। এ জন্য তাকে চলে যেতে হয় খুলনায়। রাহুলের অনিচ্ছা সত্ত্বেও নয়নের জন্য সম্পর্ক রাখতে হয়। একসময় রাহুলের পরিবারও জেনে যায় তাদের মধ্যকার সম্পর্ক। কিন্তু রাহুলের পরিবার নয়ন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে বলা হয়। কিন্তু ততদিনে রাহুলও নয়নের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। এদিকে নয়নের পরিবার লোক-লজ্জায় কি করবেন তা ভেবে পান না। একসময় তাদের একমাত্র ছেলের জন্য মেনে নেন। তবে শর্ত থাকে সমাজে যেন তাদের সম্পর্ক জানাজানি না হয়। কিছুদিন পর রাহুলের পোস্টিং হয় ঢাকায়। সঙ্গীর জন্য নয়নও চলে আসেন ঢাকায়। তারা নিয়মিত এক সঙ্গে না থাকতে পারলেও সপ্তাহে মিলিত হতেন। এভাবে কেটে যেতে থাকে আরো কিছুদিন। নয়ন ভর্তি হন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। থাকেন ফার্মগেটের একটি মেসে এক রুম নিয়ে। এদিকে নয়নের পার্টনার রাহুলের বদলি হয় চট্টগ্রামে। কিন্তু তাতে কি! নয়নের জন্য রাহুল প্রতিমাসে অন্তত ১/২ বার ঢাকায় আসেন। থাকেন এক সঙ্গে। শুধু নয়ন কিংবা ড্যানি নয়। এমন হাজারো সমকামী রয়েছে সারা দেশে। যেমন রয়েছে পুরুষ সমকামী তেমনি রয়েছে নারী সমকামী। ধর্ম এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং আইন এমন সম লিঙ্গের যৌন সম্পর্ককে বিকৃত রুচি বলে অবহিত করলেও তারা থেমে নেই। তারা বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে তাদের সবকিছুই চলে অতি গোপনে। মাঝে-মধ্যে তারা জনসম্মুখে জানান দিতে চাইলেও পড়তে হয় তোপের মুখে। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সমকামীদের রয়েছে সরব উপস্থিতি। একাধিক গ্রুপ এবং ফ্যান পেইজ খুলে চলছে সব ধরনের কার্যক্রম। ফোনে কথা বলাকে রিস্কি মনে করার কারণে তারা মূলত এসব মাধ্যম থেকেই যোগাযোগ করেন। যাদের স্থায়ী পার্টনার নেই তারা এখান থেকে পার্ট-টাইম সম্পর্ক গড়ে তুলেন। আর স্থায়ীয়রা তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি করেন নানাভাবে। এমন কয়েকটি গ্রুপ-পেইজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে তাদের গভীরতা অনেক ভেতরে। এখানে পুরুষ সমকামীরা দুটি সাংকেতিক নাম ব্যবহার করে। একটি হচ্ছে ‘টপ’ অন্য আরেকটি ‘বটম’। তারা নিজেদের ভেতর একজন আরেকজনকে মেইল-ফিমেইল হিসেবে এ নামে জানেন।
এদিকে পুরুষ সমকামীর পাশাপাশি একইভাবে নারী সমকামীরাও তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করছে। তবে পুরুষ সমকামীদের থেকে তাদের কার্যক্রম চলে অনেক বেশি গোপনে। তারা সমাজে তো দূরে থাক পরিবারের কাছে প্রকাশ করেন না। তবে ছেলেদের তুলনায় তারা পরস্পরে সহজে মিলিত হতে পারেন। এক্ষেত্রে তাদের পরিবার জানতে পারেন না। তারা একে অন্যের সঙ্গে এ সম্পর্ক গোপনভাবেই রক্ষা করে চলেন। সমাজে তারা খুব একটা পরিচিতি পেতেও চান না। ছেলে সমকামীদের ভেতর দ্রুত বিয়ের একটা প্রবণতা কাজ করলেও মেয়েদের মধ্যে বিয়ের আগ্রহটা থাকে অনেক কম। এদের প্রচারণার বেশিরভাগই চলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর সম্পর্ক হয়ে গেলে মুঠোফোনে। ফেসবুকে তাদের পদচারণা দেখা যায় তুলনামূলক বেশি। গ্রুপ পেজ এবং ম্যাসেঞ্জারে তাদের রয়েছে উপস্থিতি। এক নারী সমকামী এঞ্জেল ফারিয়া। তার নির্দিষ্ট পার্টনার ছাড়া বাইরে কেউ জানেন না যে, তিনি সমকামী। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় কীভাবে তিনি এ সম্পর্কে পা বাড়ালেন। ফারিয়া জানান, তার কখনো ছেলেদের প্রতি কোনো ধরনের অনুভূতি কাজ করে না। বরং মেয়েদের প্রতি তাকে বেশি টানে। বয়োসন্ধি পার হওয়ার পরে তিনি মনে করেন ছেলেকে নয় মেয়েকেই সঙ্গী হিসেবে নেবেন। প্রথমে প্রথমে এমন সঙ্গী খুঁজে না পেলেও একসময় এমন একজন পেয়ে যান। একে অন্যের পরিবারের কাছে বান্ধবী পরিচয়ে জানলেও তারা আসলে উভয়ে পার্টনার। তারা যখন সময় পেতেন তখনই নিজেদের বাসায় মিলিত হতেন। উভয়ে পারিবারিকভাবে পরিচিত হয়ে গেলে তাদেরকেও সন্দেহের চোখে দেখতো না। তবে একসময় তাদের এ সম্পর্ক ভেঙে যায়। ফারিয়া মানসিকভাবে বিষণ্ন হন। তবে তা দ্রুত কাটিয়েও উঠেন। পরে নিজেকে একজন ওপেন লেসবিয়ান হিসেবে প্রকাশ করান। তবে তাও তো গোপনে। যখন তার পরিবারের সদস্যরা বাসায় অনুপস্থিত থাকেন তখন তার পার্টনারদের ডেকে এ সম্পর্কে মিলিত হন। ফারিয়াকে পরিবার বিয়ে দিতে চাইলেও তিনি রাজি হননি। তার উচ্চতর ডিগ্রি শেষ হলে বিয়ে করবেন বলে জানিয়ে দেন। আসলে ফারিয়া চান তারমতো একজন সমকামী মেয়েকে বিয়ে করতে।
২০১৪ সালের ১৮ই জানুয়ারি দেশে সমকামীদের পত্রিকা ‘রূপবান’ প্রকাশিত হলে তুলকালাম সৃষ্টি হয়। চারদিকে এগুলোকে নির্মূল করার আহ্বান জানানো হয়। পরবর্তীতে সমকামীদের পত্রিকা রূপবান এবং বয়েজ অফ বাংলাদেশ (বিওবি) নামে একটি সংগঠন দেশে সমকামীদের প্রকৃত সংখ্যা নিরুপণ করতে জরিপ চালায়। জরিপের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সেখানে তারা বলছে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ সমকামী জনগোষ্ঠী রয়েছে। জরিপে তৃতীয় লিঙ্গকে আওতায় নেয়া হয়নি। এছাড়াও পরবর্তীতে ৬০০ সমকামী এবং উভয়কামী নারী-পুরুষের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখেছে তারা পরিবারের কাছেই তাদের সম্পর্কের কথা গোপন রাখেন।
২০১৫ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর বৃটিশ কাউন্সিলে একটি সমকামী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেদিন ২০০-এর বেশি সমকামী তরুণ-তরুণী জড়ো হয়েছিল। যেখানে ‘ধী’ নামে একটি সমকামী কমিক উপস্থাপন করা হয়েছিল। আর এর চরিত্র ধারণ করেছিলেন দেশের খ্যাতনামা এক সাংস্কৃতিক দম্পতির মেয়ে। সেদিনকার সমাবেশে সমকামীদের অধিকারের পক্ষে ‘নিজেরা করি’ এনজিওর সমন্বয়কারী নানা কথা বলেছিলেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। বৃটিশ কাউন্সিলের সমকামীদের সে সমাবেশের খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশে নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। এর আগে ২০১৩ সালের ২৯শে এপ্রিল জেনেভায় অনুষ্ঠিত ‘ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউতে’ তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সমকামীদের অধিকারের পক্ষে কথা বলায় দেশে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। ২০১৭ সালের আগস্টে কেরানীগঞ্জ থেকে এক গোপন বৈঠক চলাকালে ২৮ সমকামীকে পুলিশ আটক করে। এ ঘটনা নিয়েও দেশজুড়ে তোলপাড় হয়।
No comments