বিজেপিতেই আস্থা ভারতীয়দের by আহমেদ বায়েজীদ
ভারতের
আরো একটি রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হলো বিজেপির শাসন। পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা
রাজ্যে ২৫ বছরের বাম শাসনের পতন ঘটিয়ে বিপুল বিজয় অর্জন করেছে নরেন্দ্র
মোদি-অমিত শাহের দল। তিন দিকে বাংলাদেশবেষ্টিত ত্রিপুরা এখন হিন্দুত্ববাদী
বিজেপির নতুন ঘাঁটি। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপির বর্তমান সরকার
ক্ষমতায় আসার পরই ভারতজুড়ে শুরু হয়েছে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান। যার
‘সুফল’ নিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ভোটের মাধ্যমে নিজেদের দখলে
নিয়েছে একের পর এক রাজ্য। ত্রিপুরার নির্বাচন তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এই
রাজ্যটিতে পাঁচ বছর আগের নির্বাচনেও যারা পাত্তা পায়নি, এবার সেই দলটিই পেল
বিপুল বিজয়। দীর্ঘ দিনের শাসনে বামদের অনিয়ম, মোদির জাদুকরী নেতৃত্ব আর
ভোটারদের বিজেপিপ্রিয়তাই এর মূল কারণ। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের
আগে এটিকে দেখা হচ্ছে মোদি সরকারের বিরাট অগ্রগতি, আর গত কয়েক বছরের দক্ষ
রাজনীতির ধারাবাহিকতা হিসেবে। তবে ভোটে জেতার পর কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসীন দলটি
রাজ্যজুড়ে যে তাণ্ডব চালিয়েছে সেটিও যে বিজেপি যুগের অস্থিতিশীল রাজনীতিরই
ধারাবাহিকতা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ত্রিপুরায় ১৯৯৩ সাল থেকে
ধারাবাহিকভাবে পাঁচটি নির্বাচনে জিতেছে বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি অব
ইন্ডিয়া-মার্কসিস্ট (সিপিআইএম)। এ রাজ্যটিতে বিজেপির ভোট ছিল খুবই কম,
সাংগঠনিক ভিত্তিও ছিল দুর্বল। সর্বশেষ ২০১৩ সালের নির্বাচনে এখানে মাত্র
দেড় শতাংশ ভোট পেয়েছিলে তারা। এবার যা দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশ। তাদের জোট সঙ্গী
উপজাতীয় দল আইপিডিএফের প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ ভোট ধরলে মোট যা হয় পঞ্চাশ
শতাংশের বেশি। মানে যে রাজ্যের মাত্র দেড় শতাংশ লোক পাঁচ বছর আগে বিজেপিকে
সমর্থন দিয়েছিল, সেখানে এবার তাদের ক্ষমতায় আনতে চেয়েছে অর্ধেকের বেশি লোক।
এবার সব কিছুই তাদের অনুকূলে গেছে। বলা ভালো যে, তারা নিতে পেরেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এর জন্য সবচেয়ে বড় দিকটি ছিল- ভোটারদের জাতীয়তাবাদী
মানসিকতা। অনেকেই বলছেন, বিজেপির সবচেয়ে বড় সফলতা এ মানসিকতা জাগ্রত করা।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি একের পর এক রাজ্যে তাদের সফলতার যে তরী
ছুটিয়ে চলছে, তার প্রধান সূত্রও এটি। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর
ভারতজুড়ে যে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা শুরু হয়েছে তা ছিল ভয়াবহ। হিন্দু
উগ্রবাদী আচরণ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের একের পর এক অঞ্চলে। সবচেয়ে বেশি
সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়েছেন মুসলিমরা। গরু রক্ষার নামে বিভিন্ন
স্থানে হামলা হয়েছে মুসলিমদের ওপর, নিহত হয়েছে বেশ কয়েকজন। একপর্যায়ে এসব
সাম্প্রদায়িকতার রেশ আন্তর্জাতিক মহল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। দেশ-বিদেশে
বিজেপির শাসনের বিরুদ্ধে সমালোচনা হয়েছে ব্যাপক। দিল্লি-মুম্বাইয়ের বিশিষ্ট
নাগরিকেরা পর্যন্ত এসব ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। ভারতজুড়েই
বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠনের উত্থান হয়েছে; কিন্তু বিজেপির তাদের অবস্থানে অনড়
রয়েছে। তারা বিশৃঙ্খলার ব্যাপারে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিলেও দলীয়
দৃষ্টিভঙ্গি সেই আগের অবস্থানেই আছে। যার ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতি একই রকম
আছে। এসব কারণে অনেকেই মনে করেছিলেন, বিজেপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমা হচ্ছে
জনমনে, কিন্তু ভোটের বেলায় দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। প্রত্যাখ্যান
করা তো দূরের কথা, উল্টো ভোটাররা বিজেপিকে বেছে নিচ্ছে একের পর এক রাজ্যে।
ব্যালটে ভরিয়ে দিচ্ছে তাদের ভোট বাক্স। অর্থাৎ গণমাধ্যম, সুশীলসমাজ বা
বিশ্বসম্প্রদায় যাই বলুক, সাধারণ ভারতীয় নাগরিকরা চাইছেন বিজেপিকে। আর এই
জায়গাটিতেই নরেন্দ্র মোদি সফল। দলের এ ব্যাপক সাফল্যেরও মূল কারিগর ভাবা
হচ্ছে তাকে। সুনীল দেওধরের মতো আরএসএস নেতাকে ত্রিপুরায় ঘাঁটি গেড়ে
নির্বাচনী কাজে রাখা হয়েছে সেই কৌশলের অংশ হিসেবে। ভারতজুড়ে আরএএসের যেসব
বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, তারওপর এ সংস্থার এক নেতা প্রচারণায় নেতৃত্ব দিয়ে সফল
হয়েছেন। গত ডিসেম্বরে গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশে বড় বিজয় পেয়েছে বিজেপি।
গুজরাট বিজেপির রাজ্য হিসেবে পরিচিত হলেও, হিমাচল তারা ছিনিয়ে নিয়েছে
কংগ্রেসের কাছ থেকে। তার আগে উত্তর প্রদেশে সফল হয়েছে যোগি আদিত্যনাথের মতো
উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রার্থী দিয়ে। কাগজে-কলমে সেকুলার রাষ্ট্র ভারতে
হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির প্রতি সমর্থন টানতে মোদি সফল হচ্ছেন ক্রমাগত।
এটিই তার সবচেয়ে বড় ম্যাজিক। আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাই বিজেপিকেই পাস
মার্ক দিয়ে রাখছেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। নরেন্দ্র মোদির ভারতের প্রধানমন্ত্রী
হওয়ার আগে ২৯টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র সাতটিতে ক্ষমতায় ছিল বিজেপি; কিন্তু
এখন প্রায় সমগ্র ভারতজুড়েই বিজেপির শাসন চলছে। সর্বশেষ ত্রিপুরা নিয়ে ২১টি
রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হলো বিজেপির শাসন। ত্রিপুরার প্রতিবেশী রাজ্য মেঘালয়েও
গঠিত হয়েছে বিজেপিসমর্থিত সরকার। আরো কিছু কারণ ছিল ত্রিপুরা নির্বাচনী
ফলাফলের নেপথ্যে। দীর্ঘ দিনে বাম একঘেয়েমি থেকে মুক্তি চেয়েছে জনগণ। তাই
তারা বিজেপির ‘চলো পাল্টাই’ স্লোগানে সাড়া দিয়েছে। বামদের অন্যায়, অনিয়ম,
বেকারত্ব বৃদ্ধি, কেন্দ্রীয় প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের দুরবস্থাও ছিল বড়
কারণ। ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক
গৌতম চাকমা বিবিসিকে বলেছেন, ‘বহু মানুষ যে বিজেপিকে ভালোবেসে ভোট দিয়েছে,
তা মনে হয় না। তারা বামফ্রন্ট সরকারকে পাল্টাতে চেয়েছে বলেই তাদের বিরুদ্ধে
ভোট দিয়েছে। আর সেটি গিয়েছে বিজেপির বাক্সে’। বিজেপির রাজনৈতিক কৌশলগুলো
অন্যদের টেক্কা দিয়েছে। উপজাতীয় ভোটব্যাংক দখলে নিতে এবার দলটি জোট গড়েছিল
উপজাতীয় দল আইপিডিএফের সাথে। রাজধানী থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত
সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করেছে দলটি। দিল্লির সাংবাদিক আশিস গুপ্ত বলেন,
‘একটা সময়ে বামরা যেভাবে ভোটে জিততে তৃণমূলে মাটি কামড়ে পড়ে থাকত, এবার
বিজেপি সেটাই করেছে।’ প্রচারণায় ছিল নতুনত্ব। মোদি নিজে প্রচারণায় গিয়ে
মানুষকে তাদের দীর্ঘ দিনের অভাবগুলো পূরণে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সব কিছু
মিলেই তাই ত্রিপুরা যোগ দিয়েছে বিজেপির সাথে। তবে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে
প্রচারণার সময় যে ভালোভালো কথা বলেছে বিজেপি তা যেন পাল্টে গেছে ফল ঘোষণার
পরই। ত্রিপুরার নির্বাচনের পর আরেকবার বিজেপির রাজনৈতিক চরিত্রটা ফুটে
উঠেছে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরই বিরোধী সমর্থকদের বাড়ি, অফিস, ব্যবসায়
প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট হয়েছে। বামপন্থীদের আদর্শ হিসেবে পরিচিত
লেলিনের ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে বুলডোজার দিয়ে। মোট কথা ত্রিপুরাবাসী
সাম্প্রতিক অতীতে যা দেখেনি তেমন কর্মকাণ্ড দিয়েই ‘বিজয় উৎসব’ করছে বিজেপি।
পশ্চিমবঙ্গ সিপিআইএম কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে লেখা চিঠিতে যে হিসাব দিয়েছে
তাতে বলা হয়েছে, গত সোমবার বিকেল পর্যন্ত ৫১৪ জন লোকের ওপর হামলা হয়েছে।
দেড় হাজারের বেশি বাড়িতে ভাঙচুর হয়েছে এবং আগুন দেয়া হয়েছে ১৯৬টি বাড়িতে।
সিপিএমের ২০৮টি দলীয় কার্যালয় দখল করে নিয়েছে বিজেপি কর্মীরা, যার মধ্যে
শতাধিক কার্যালয় ভেঙে ফেলা হয়েছে। দ্রুত নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপ না করলে
পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা সিপিআইএমের। তবে এসব
কিছুই বিজেপির উত্থান ঠেকাতে পারবে না। ভারতীয় ভোটাররা নরেন্দ্র মোদি ও তার
দলের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করেই চলছে। চলতি বছরের শেষ দিকে কর্নাটকসহ আরো
কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিজেপি সেখানেও
নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে কাজ শুরু করেছে। আর আগামী বছরের জাতীয়
নির্বাচনের দৌড়েও দলটি সবার চেয়ে এগিয়ে। বিরোধী দল কংগ্রেসের গত নির্বাচনে
যে ভরাডুবি হয়েছে তার রেশ কাটিয়ে এখনো রাজনীতিতে ভালোভাবে ফিরতে পারেনি
দলটি। এ সুযোগটিও বিজেপিকে ক্ষমতা সংহত করার সুযোগ দিয়েছে। আগামী
নির্বাচনের আগেও যে কংগ্রেস আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তারও সম্ভাবনা খুবই কম।
সে হিসেবে ভারতের বিজেপির শাসন দীর্ঘায়িত হতে পারে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
No comments