যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলি লবি: কী আছে আল জাজিরার প্রতিবেদনে? by মাহমুদ ফেরদৌস
যুক্তরাষ্ট্রের
শীর্ষস্থানীয় নব্য-রক্ষণশীল থিংকট্যাংক ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব
ডেমোক্রেসিস (এফডিডি) আসলে ইসরাইলি সরকারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রে তৎপর ইসরাইল-পন্থী লবিগোষ্ঠীর ওপর আল জাজিরার প্রচারিতব্য
অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের অন্যতম মূল বক্তব্য এটি। গোপন অনুসন্ধানের ভিত্তিতে
নির্মিত এই তথ্যচিত্র দেখেছেন এমন একজনের বরাত দিয়ে এই খবর দিয়েছে
ফিলিস্তিন-ইসরাইল বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম ইলেকট্রনিক ইন্তিফাদা।
ওই সূত্র জানিয়েছে, তথ্যচিত্রে একজন ক্ষমতাধর ইসরাইলি কর্মকর্তার বক্তব্য সম্বলিত ফুটেজও রয়েছে। এতে ওই কর্মকর্তাকে বলতে দেখা যায়, ‘আমাদের আছে এফডিডি। এছাড়া এ নিয়ে অন্যরাও কাজ করছে।’ এই কর্মকর্তার নাম সিমা ভাকনিন-জিল। তিনি ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তথ্যচিত্রে তাকে বলতে দেখা যায়, এফডিডি ইসরাইলের জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্পে কাজ করছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘উপাত্ত সংগ্রহ, তথ্য বিশ্লেষণ, অ্যাকটিভিস্ট সংগঠন নিয়ে কাজ করা, অর্থের উৎস অনুসন্ধান করা। কোনো একটি দেশের পক্ষে এটিই সবচেয়ে ভালোভাবে করা সম্ভব।’
আমেরিকার ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের আওতায়, যেসব মার্কিন সংগঠন ও নাগরিক বিদেশী সরকারের পক্ষ হয়ে কাজ করেন, তাদেরকে আইন মন্ত্রণালয়ের কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স বিভাগে নিবন্ধিত হতে হয়। কিন্তু এফডিডি থিংকট্যাংক ইসরাইল সরকারের এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধিত নয়। আল জাজিরার প্রচারিতব্য তথ্যচিত্রে এই বিষয়টিই ফুটিয়ে তোলা হবে। উল্লেখ্য, বিদেশী সরকারের এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধিত হলে একটি সংগঠনের অনেক কার্যক্রমই সীমিত হয়ে পড়ে। আবার বিদেশী সরকারের এজেন্টের মতো কার্যক্রম করা সত্ত্বেও নিবন্ধিত না হলে বড় ধরণের আইনি জটিলতায় পড়তে হতে পারে।
প্রতিবেদনে দেখা যাবে যে, ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে এমন বেশ কয়েকটি লবি গ্রুপ মার্কিন নাগরিকদের ওপর নজরদারি করছে। এছাড়া ইসরাইলের সমালোচক মার্কিন নাগরিকদের হেয় করা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনে ইসরাইল-পন্থী কয়েকটি সংগঠনের গোপন তৎপরতাও এই তথ্যচিত্রে দেখানো হবে।
এর আগে বৃটেনে ইসরাইলি লবির প্রভাব ও তৎপরতা নিয়ে প্রতিবেদন নির্মান করেছিল আল জাজিরা। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর বৃটিশ রাজনীতিতে হুলস্থুল পড়ে যায়। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বৃটেনে ইসরাইলি দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা বৃটিশ একজন মন্ত্রীকে অপসারণ করার ছক কষছেন, কারণ ওই মন্ত্রী ইসরাইলের সরকারী নীতির বিরোধী। এ নিয়ে বৃটিশ পার্লামেন্টে ব্যপক হইচই পড়ে যায়। ওই কর্মকর্তাকে অপসারণেও বাধ্য হয় ইসরাইল।
ওই প্রতিবেদন নিয়ে সাড়া পাওয়ার পর আল জাজিরা এক পর্যায়ে জানায় যে, যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন লবি গ্রুপের তৎপরতা নিয়েও কাজ করেছেন চ্যানেলটির একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক। ফলে প্রতিবেদন প্রচারের আগেই এ নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম খবর প্রকাশ করেছে যে, এই তথ্যচিত্র প্রকাশ না করতে আল জাজিরার মালিক কাতার সরকারের ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করে বেশ কয়েকটি ইসরাইল-পন্থী লবি গ্রুপ। এমনকি এদের কেউ কেউ পরে দাবি করেন, কাতার সরকার তাদেরকে ওই তথ্যচিত্র প্রচার না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
কিন্তু, হারেৎস পত্রিকা জানায়, সম্প্রতি আল জাজিরা থেকে আমেরিকার বেশ কয়েকটি ইসরাইলপন্থী সংগঠন ও ব্যক্তিবিশেষের কাছে বার্তা গেছে। সেখানে বলা হয়েছে, তাদের সংগঠন কিংবা ব্যক্তিবিশেষকে আল জাজিরার একটি তথ্যচিত্রে দেখা যাবে। সেখানে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের উত্তর দিতে বলা হয়। যদিও এখন পর্যন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়নি, ইলেক্ট্রনিক ইন্তিফাদা একটি সূত্রের বরাতে ওই প্রতিবেদনে কী আছে, তা প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে সিমা ভাকনিক-জিল নামে যেই ইসরাইলি সাবেক সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে দেখা যায়, তিনি এখনও ইসরাইলি সামরিক বাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদায় কর্মরত রয়েছেন। এর চেয়েও বড় কথা তার বর্তমান কর্মস্থল হলো ইসরাইলের স্ট্রাটেজিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয়ে। এই মন্ত্রণালয়ে তিনিই সবচেয়ে উর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তা। স্ট্রাটেজিক অ্যাফেয়ার্স নামে এই মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশিদিন হয়নি। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যেই বয়কট, ডিভেস্টমেন্ট (বিনিয়োগ প্রত্যাহার) ও স্যাঙ্কশন্স (অবরোধ) অর্থাৎ বিডিএস আন্দোলনে চলছে, তার বিরুদ্ধে গোপন প্রচারণা ও নাশকতা চালানো। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হলেন গিলাদ এরদান, যিনি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ। ফলে, এই মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে ভাকনিন-জিলের মন্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
২০১৬ সালে এই মন্ত্রণালয় নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে, ভাকনিন-জিল অনলাইনে যোদ্ধাবাহিনী গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। এই যোদ্ধাবাহিনী ইসরাইলি প্রোপাগান্ডা দিয়ে ইন্টারনেট ভর্তি করে ফেলবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অপরদিকে ফিলিস্তিন-বিরোধী ইহুদী বিলিয়নিয়ার ও ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সবচেয়ে বড় দাতা শেলডন আডেলসন হলেন ফাউন্ডেশন অব ডেমোক্রেসিস (এফডিডি) থিংকট্যাংকের অন্যতম অর্থদাতা। এফডিডি সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। গত বছর ফাঁস হওয়া ইমেইল থেকে দেখা গেছে, ওয়াশিংটনে আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত কাতার থেকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি সরিয়ে নিতে এই এফডিডির সাহায্য কামনা করেন।
এই প্রতিবেদনে আরও দেখা যাবে, ইসরাইল-পন্থী একজন তরুণ লবিস্ট গর্ব করে বলছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পারস্য উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক কত ঘনিষ্ঠ! ম্যাক্স আডেলস্টেইন নামে ওই লবিস্ট কাজ করতেন হার্বর গ্রুপে। তাকে গর্ব করে বলতে দেখা যাবে, হার্বর গ্রুপ কীভাবে ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে গোপনে নিরাপত্তা সম্পর্ক স্থাপনে ভ’মিকা রেখেছে। হার্বর গ্রুপের গ্রাহকদের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি সৌদি আরবও রয়েছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে ২২ লাখ ও সৌদি আরবের কাছ থেকে ছয়মাসে ৩ লাখ ডলার পেয়েছে হার্বর গ্রুপ।
আল জাজিরার তথ্যচিত্রে দেখা যাবে, এফডিডি’র জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান জোনাথন স্ক্যাঞ্জার ব্যাখ্যা করে বলছেন কীভাবে তার সংগঠন আমেরিকায় কাজ করা ফিলিস্তিনি সংহতি গোষ্ঠীকে আক্রমণ করে। তাকে বলতে দেখা যাবে যে, বিডিএস আন্দোলনের সাফল্য সকলকে বিস্মিত করে দিয়েছে। তিনি বলেন, বিডিএস আন্দোলনের সাফল্যের বিপরীতে ইসরাইলপন্থী লবি গ্রুপের প্রতিক্রিয়া ছিল হতচ্ছাড়া ও বিশৃঙ্খল। স্ক্যাঞ্জার সেখানে হতাশামিশ্রিত কন্ঠে বলেন, স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন ও আমেরিকান মুসলিমস ফর প্যালেস্টাইন্স নামে দুইটি আমেরিকা-ভিত্তিক সংগঠনের সঙ্গে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয় এফডিডি। তিনি আরও স্বীকার করে নেন যে, ফিলিস্তিনের পক্ষে যেসব অ্যাক্টিভিস্ট কাজ করেন তারা ইহুদীদের প্রতি বিদ্বেষ থেকেই তা করছেন, এমন প্রচারণা এখন অত কাজ করছে না। তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, প্রচারণার কৌশল হিসেবে ইহুদী-বিদ্বেষী লেবেল সেঁটে দেওয়াটা আগে যেমন কাজ করতো, এখন আর তেমন কাজ করছে না।’
এর আগে ইসরাইল সরকারের একটি গোপন প্রতিবেদন, যা যুক্তরাষ্ট্রে তৎপর ইসরাইলপন্থী সংগঠনে বিলি করা হয়েছিল, সেখান থেকেও এই পরিস্থিতির ইঙ্গিত মিলে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ফিলিস্তিনি সংহতি আন্দোলনের অগ্রগতি নস্যাতে ইসরাইল যেসব প্রচেষ্টা হাতে নিয়েছে তা মোটাদাগে ব্যর্থ হয়েছে।
আল জাজিরার এই তথ্যচিত্রের সম্প্রচার ঠেকাতে ইসরাইল-পন্থী লবি গ্রুপ কাতার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা ছাড়াও অন্যান্য কৌশল হাতে নিয়েছে। যেমন, কমিটি ফর ইসরাইল নামে আরেকটি নব্য রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক নোয়াহ পোলাক বলেন, আল জাজিরার এই তৎপরতা কী ছিল, তা নিয়ে মিনমিন করে বলার কিছু নেই। এটি ছিল আমেরিকার মাটিতে কাতারের চালানো পেশাদার গুপ্ত অভিযান। শুধু তা-ই নয়, আল জাজিরা যেখানে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে আমেরিকায় যেসব সংগঠন ইসরাইল সরকারের পক্ষে কাজ করে, তারা বিদেশী এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধিত নয়, সেখানে ইসরাইল-পন্থী মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা এখন দেশটির বিচার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছেন যাতে উলটো আল জাজিরাকে কাতারের বিদেশী এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধন করা হয়! কয়েকদিন আগে, রাশিয়ার সরকারী অর্থায়নে চালিত রাশিয়া টুডে চ্যানেলকেও বিদেশী এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধিত হতে বাধ্য করেছে বিচার মন্ত্রণালয়। ঠিক সেভাবেই আল জাজিরাকে নিবন্ধিত করার কথা বলছেন ওই কংগ্রেস সদস্যরা।
ওই সূত্র জানিয়েছে, তথ্যচিত্রে একজন ক্ষমতাধর ইসরাইলি কর্মকর্তার বক্তব্য সম্বলিত ফুটেজও রয়েছে। এতে ওই কর্মকর্তাকে বলতে দেখা যায়, ‘আমাদের আছে এফডিডি। এছাড়া এ নিয়ে অন্যরাও কাজ করছে।’ এই কর্মকর্তার নাম সিমা ভাকনিন-জিল। তিনি ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তথ্যচিত্রে তাকে বলতে দেখা যায়, এফডিডি ইসরাইলের জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্পে কাজ করছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘উপাত্ত সংগ্রহ, তথ্য বিশ্লেষণ, অ্যাকটিভিস্ট সংগঠন নিয়ে কাজ করা, অর্থের উৎস অনুসন্ধান করা। কোনো একটি দেশের পক্ষে এটিই সবচেয়ে ভালোভাবে করা সম্ভব।’
আমেরিকার ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের আওতায়, যেসব মার্কিন সংগঠন ও নাগরিক বিদেশী সরকারের পক্ষ হয়ে কাজ করেন, তাদেরকে আইন মন্ত্রণালয়ের কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স বিভাগে নিবন্ধিত হতে হয়। কিন্তু এফডিডি থিংকট্যাংক ইসরাইল সরকারের এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধিত নয়। আল জাজিরার প্রচারিতব্য তথ্যচিত্রে এই বিষয়টিই ফুটিয়ে তোলা হবে। উল্লেখ্য, বিদেশী সরকারের এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধিত হলে একটি সংগঠনের অনেক কার্যক্রমই সীমিত হয়ে পড়ে। আবার বিদেশী সরকারের এজেন্টের মতো কার্যক্রম করা সত্ত্বেও নিবন্ধিত না হলে বড় ধরণের আইনি জটিলতায় পড়তে হতে পারে।
প্রতিবেদনে দেখা যাবে যে, ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে এমন বেশ কয়েকটি লবি গ্রুপ মার্কিন নাগরিকদের ওপর নজরদারি করছে। এছাড়া ইসরাইলের সমালোচক মার্কিন নাগরিকদের হেয় করা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনে ইসরাইল-পন্থী কয়েকটি সংগঠনের গোপন তৎপরতাও এই তথ্যচিত্রে দেখানো হবে।
এর আগে বৃটেনে ইসরাইলি লবির প্রভাব ও তৎপরতা নিয়ে প্রতিবেদন নির্মান করেছিল আল জাজিরা। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর বৃটিশ রাজনীতিতে হুলস্থুল পড়ে যায়। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বৃটেনে ইসরাইলি দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা বৃটিশ একজন মন্ত্রীকে অপসারণ করার ছক কষছেন, কারণ ওই মন্ত্রী ইসরাইলের সরকারী নীতির বিরোধী। এ নিয়ে বৃটিশ পার্লামেন্টে ব্যপক হইচই পড়ে যায়। ওই কর্মকর্তাকে অপসারণেও বাধ্য হয় ইসরাইল।
ওই প্রতিবেদন নিয়ে সাড়া পাওয়ার পর আল জাজিরা এক পর্যায়ে জানায় যে, যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন লবি গ্রুপের তৎপরতা নিয়েও কাজ করেছেন চ্যানেলটির একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক। ফলে প্রতিবেদন প্রচারের আগেই এ নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম খবর প্রকাশ করেছে যে, এই তথ্যচিত্র প্রকাশ না করতে আল জাজিরার মালিক কাতার সরকারের ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করে বেশ কয়েকটি ইসরাইল-পন্থী লবি গ্রুপ। এমনকি এদের কেউ কেউ পরে দাবি করেন, কাতার সরকার তাদেরকে ওই তথ্যচিত্র প্রচার না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
কিন্তু, হারেৎস পত্রিকা জানায়, সম্প্রতি আল জাজিরা থেকে আমেরিকার বেশ কয়েকটি ইসরাইলপন্থী সংগঠন ও ব্যক্তিবিশেষের কাছে বার্তা গেছে। সেখানে বলা হয়েছে, তাদের সংগঠন কিংবা ব্যক্তিবিশেষকে আল জাজিরার একটি তথ্যচিত্রে দেখা যাবে। সেখানে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের উত্তর দিতে বলা হয়। যদিও এখন পর্যন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়নি, ইলেক্ট্রনিক ইন্তিফাদা একটি সূত্রের বরাতে ওই প্রতিবেদনে কী আছে, তা প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে সিমা ভাকনিক-জিল নামে যেই ইসরাইলি সাবেক সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে দেখা যায়, তিনি এখনও ইসরাইলি সামরিক বাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদায় কর্মরত রয়েছেন। এর চেয়েও বড় কথা তার বর্তমান কর্মস্থল হলো ইসরাইলের স্ট্রাটেজিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয়ে। এই মন্ত্রণালয়ে তিনিই সবচেয়ে উর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তা। স্ট্রাটেজিক অ্যাফেয়ার্স নামে এই মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশিদিন হয়নি। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যেই বয়কট, ডিভেস্টমেন্ট (বিনিয়োগ প্রত্যাহার) ও স্যাঙ্কশন্স (অবরোধ) অর্থাৎ বিডিএস আন্দোলনে চলছে, তার বিরুদ্ধে গোপন প্রচারণা ও নাশকতা চালানো। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হলেন গিলাদ এরদান, যিনি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ। ফলে, এই মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে ভাকনিন-জিলের মন্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
২০১৬ সালে এই মন্ত্রণালয় নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে, ভাকনিন-জিল অনলাইনে যোদ্ধাবাহিনী গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। এই যোদ্ধাবাহিনী ইসরাইলি প্রোপাগান্ডা দিয়ে ইন্টারনেট ভর্তি করে ফেলবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অপরদিকে ফিলিস্তিন-বিরোধী ইহুদী বিলিয়নিয়ার ও ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সবচেয়ে বড় দাতা শেলডন আডেলসন হলেন ফাউন্ডেশন অব ডেমোক্রেসিস (এফডিডি) থিংকট্যাংকের অন্যতম অর্থদাতা। এফডিডি সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। গত বছর ফাঁস হওয়া ইমেইল থেকে দেখা গেছে, ওয়াশিংটনে আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত কাতার থেকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি সরিয়ে নিতে এই এফডিডির সাহায্য কামনা করেন।
এই প্রতিবেদনে আরও দেখা যাবে, ইসরাইল-পন্থী একজন তরুণ লবিস্ট গর্ব করে বলছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পারস্য উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক কত ঘনিষ্ঠ! ম্যাক্স আডেলস্টেইন নামে ওই লবিস্ট কাজ করতেন হার্বর গ্রুপে। তাকে গর্ব করে বলতে দেখা যাবে, হার্বর গ্রুপ কীভাবে ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে গোপনে নিরাপত্তা সম্পর্ক স্থাপনে ভ’মিকা রেখেছে। হার্বর গ্রুপের গ্রাহকদের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি সৌদি আরবও রয়েছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে ২২ লাখ ও সৌদি আরবের কাছ থেকে ছয়মাসে ৩ লাখ ডলার পেয়েছে হার্বর গ্রুপ।
আল জাজিরার তথ্যচিত্রে দেখা যাবে, এফডিডি’র জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান জোনাথন স্ক্যাঞ্জার ব্যাখ্যা করে বলছেন কীভাবে তার সংগঠন আমেরিকায় কাজ করা ফিলিস্তিনি সংহতি গোষ্ঠীকে আক্রমণ করে। তাকে বলতে দেখা যাবে যে, বিডিএস আন্দোলনের সাফল্য সকলকে বিস্মিত করে দিয়েছে। তিনি বলেন, বিডিএস আন্দোলনের সাফল্যের বিপরীতে ইসরাইলপন্থী লবি গ্রুপের প্রতিক্রিয়া ছিল হতচ্ছাড়া ও বিশৃঙ্খল। স্ক্যাঞ্জার সেখানে হতাশামিশ্রিত কন্ঠে বলেন, স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন ও আমেরিকান মুসলিমস ফর প্যালেস্টাইন্স নামে দুইটি আমেরিকা-ভিত্তিক সংগঠনের সঙ্গে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয় এফডিডি। তিনি আরও স্বীকার করে নেন যে, ফিলিস্তিনের পক্ষে যেসব অ্যাক্টিভিস্ট কাজ করেন তারা ইহুদীদের প্রতি বিদ্বেষ থেকেই তা করছেন, এমন প্রচারণা এখন অত কাজ করছে না। তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, প্রচারণার কৌশল হিসেবে ইহুদী-বিদ্বেষী লেবেল সেঁটে দেওয়াটা আগে যেমন কাজ করতো, এখন আর তেমন কাজ করছে না।’
এর আগে ইসরাইল সরকারের একটি গোপন প্রতিবেদন, যা যুক্তরাষ্ট্রে তৎপর ইসরাইলপন্থী সংগঠনে বিলি করা হয়েছিল, সেখান থেকেও এই পরিস্থিতির ইঙ্গিত মিলে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ফিলিস্তিনি সংহতি আন্দোলনের অগ্রগতি নস্যাতে ইসরাইল যেসব প্রচেষ্টা হাতে নিয়েছে তা মোটাদাগে ব্যর্থ হয়েছে।
আল জাজিরার এই তথ্যচিত্রের সম্প্রচার ঠেকাতে ইসরাইল-পন্থী লবি গ্রুপ কাতার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা ছাড়াও অন্যান্য কৌশল হাতে নিয়েছে। যেমন, কমিটি ফর ইসরাইল নামে আরেকটি নব্য রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক নোয়াহ পোলাক বলেন, আল জাজিরার এই তৎপরতা কী ছিল, তা নিয়ে মিনমিন করে বলার কিছু নেই। এটি ছিল আমেরিকার মাটিতে কাতারের চালানো পেশাদার গুপ্ত অভিযান। শুধু তা-ই নয়, আল জাজিরা যেখানে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে আমেরিকায় যেসব সংগঠন ইসরাইল সরকারের পক্ষে কাজ করে, তারা বিদেশী এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধিত নয়, সেখানে ইসরাইল-পন্থী মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা এখন দেশটির বিচার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছেন যাতে উলটো আল জাজিরাকে কাতারের বিদেশী এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধন করা হয়! কয়েকদিন আগে, রাশিয়ার সরকারী অর্থায়নে চালিত রাশিয়া টুডে চ্যানেলকেও বিদেশী এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধিত হতে বাধ্য করেছে বিচার মন্ত্রণালয়। ঠিক সেভাবেই আল জাজিরাকে নিবন্ধিত করার কথা বলছেন ওই কংগ্রেস সদস্যরা।
No comments