ওরা জানে না নারী দিবসের তাৎপর্য
গতকাল
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক
নারী দিবস। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, চা বাগানের নারীদের কাছে এই দিনটি বিশেষ
কোনো গুরুত্ব বহন করে না। চা শ্রমিক নারীরা জানেনও না এ দিবসের কথা। অথচ
দেশের চা শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন এই শ্রমিকরা। দেশের অন্যান্য শ্রমজীবী
নারীদের তুলনায় চা বাগানের নারী শ্রমিকদের জীবনধারা ও কাজের ধরন সম্পূর্ণ
আলাদা। চৌকিদারের ডাকে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাংসারিক সব কাজকর্ম করে ভোর
৪টার মধ্যে তাদের কাজে বেরিয়ে পড়তে হয়। স্থানভেদে ৪-৫ মাইল হেঁটে কর্মস্থলে
পৌঁছাতে হয়। সাধারণত চা পাতা তোলা ও চা গাছ ছাঁটাই করা দুটি কাজই নারী
শ্রমিকরা করে থাকেন, যা খুবই কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে বর্ষাকালে
তাদেরকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। উঁচু উঁচু টিলা (ছোট পাহাড়) বেয়ে
তাদের চা পাতা সংগ্রহ করতে হয়। এছাড়া যেহেতু চা গাছকে ঘিরে গভীর জঙ্গল বা
আগাছা থাকে, তাই সেখানে বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপ, বিচ্ছু, গজর (শুঁয়াপোকা),
হাড়ি বরল (এক ধরনের বিষাক্ত মাছি যা চা গাছের ডালে মাটির হাঁড়ি বানিয়ে বাস
করে), বিষাক্ত পিঁপড়া ইত্যাদির অবাধ বিচরণ। চা শ্রমিকরা এগুলোর কামড় খেতে
খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তাই এগুলোকে বিষাক্ত বলে মনে করেন না। যা হোক,
মাত্র ৮৫ টাকার বিনিময়ে সকাল ৪টা থেকে বিকাল ৫টা অবধি তাদের কাজ করতে হয়।
এর মধ্যে তারা দুপুর ২টায় আধঘণ্টা সময় পান খাবারের জন্য। তখন বাড়ি থেকে আনা
রুটি এবং এর সঙ্গে মরিচ, পিঁয়াজ, আলু ও কচি চা পাতা মিশিয়ে বিশেষ একধরনের
চাটনি তৈরি করে দুপুরের খাবার সেরে ফেলেন। কেউবা চাল ভাজা ও লাল চা দিয়েই
সাঙ্গ করেন দুপুরের খাবার। তারপর আবার কাজ শুরু করেন, যা চলতে থাকে বিকাল
৫টা অবধি। এরপর আবার বাড়ির কাজ করতে হয় এবং পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে
হয়।
এভাবেই শত কষ্টের মধ্যে কেটে যাচ্ছে তাদের জীবন। এ দেশের অর্থনৈতিক
উন্নতিতে এই পরিশ্রমী নারীরা এক বিরাট ভূমিকা পালন করছেন, অথচ তাদের
ভাগ্যের উন্নতির জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী
সমাজের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও নারী চা
শ্রমিকের ভাগ্য উন্নয়নে কেউ এগিয়ে আসছে না। এমনকি নারী সংশ্লিষ্ট স্থানীয়
সরকারি প্রতিষ্ঠানেও এই নারীরা কোনো সেবা পাচ্ছেন না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও
উপেক্ষিত হচ্ছেন আমাদের নারী চা শ্রমিকরা। বিশ্বব্যাপী নারী সমাজের উন্নয়নে
যেসব আইন-নীতি, উন্নয়ন-পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয় তাতে আমাদের নারী চা
শ্রমিকরা স্থান পান না। নারী চা শ্রমিকদের উন্নয়নে কয়েকটি প্রস্তাব রাখতে
চাই : ১. নারী দিবসে চা বাগানে ছুটি ঘোষণা করে এই দিনটি বিশেষভাবে পালনের
উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। ২. চা শ্রমিক নারীদের উন্নয়নে কাজ করার জন্য উপজেলা ও
জেলা মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদফতর সর্বোপরি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে
এগিয়ে আসতে হবে। ৩. জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১০সহ নারী সংশ্লিষ্ট সব
আইন-নীতিতে চা-বাগানের নারীদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ৪. নারীদের জন্য
উপযুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে। ৫.নারী চা শ্রমিকদের কাজের যথাযথ
স্বীকৃতিসহ উপযুক্ত মজুরি দিতে হবে।
মোহন রবিদাস : এমএসএস (লোক প্রশাসন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোহন রবিদাস : এমএসএস (লোক প্রশাসন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments