কাঁকন বিবিকে নিয়ে যে আফসোস রয়েই গেল by ওয়েছ খছরু
অজানা
কারণে বীরপ্রতীকের তালিকায় গেজেটভুক্ত হননি রণাঙ্গনের সাহসী নারী কাঁকন
বিবি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই ২২ বছর আগে কাঁকন বিবিকে বীরপ্রতীক
উপাধি দিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন সাময়িক সনদও। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে অনেক সময় ।
কিন্তু খেতাবের কোনো সুযোগ-সুবিধাই পাননি তিনি। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ
করেছেন মুক্তিযোদ্ধারাও। কাঁকন বিবির মৃত্যুর পর সিলেটে এ বিষয়টি সবচেয়ে
বেশি আলোচনা হচ্ছে। তবে খেতাবের প্রাপ্তি না পেলেও মহান মুক্তিযুদ্ধের এই
লড়াকু নারী পেয়েছেন অনেক কিছুই। সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন
তিনি। পাশাপাশি কয়েক বছর আগে জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কাঁকন বিবিকে ২০ লাখ
টাকা খরচ করে বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে। এত কিছুর পরও সরকারি সুযোগ-সুবিধা না
পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে চিরবিদায় নিলেন কাঁকন বিবি। মায়ের মৃত্যুর পর
অপ্রাপ্তির সব কথা হাসপাতালের করিডরে বসে বলেছেন কাঁকন বিবির একমাত্র মেয়ে
সখিনা বেগম। বুধবার রাত সোয়া ১১টার দিকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের
আইসিইউতে মারা যান কাঁকন বিবি। তার লাশ যখন আইসিইউর ভেতরে তখন বাইরে অঝোরে
কাঁদছিলেন সখিনা। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার মায়ের একটাই দুঃখ ছিল
তিনি বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন; কিন্তু উপাধির কোনো সুযোগ-সুবিধাই তার
ভাগ্যে জোটেনি। এ নিয়ে মা জীবদ্দশায় অনেকের কাছে ধর্ণা দিয়েছিলেন। কিন্তু
কোনো লাভ হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘কাঁকন বিবি যুদ্ধের ময়দানে পুরুষ
মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিলেন না। পাশাপাশি তিনি পাকিস্তানি
ক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এত ত্যাগের পরও মা
বীরপ্রতীকের কোনো সুবিধা পাননি।’ কাঁকন বিবির বাড়ি সুনামগঞ্জের
সীমান্তবর্তী এলাকা দোয়ারাবাজারের লক্ষ্মীপুর গ্রামে। চোখের দেখা পথেই
রয়েছে ভারতের বাঁশতলা সীমান্ত। তার ওপাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। সেখানেই
জন্ম কাঁকন বিবির। খাসিয়া সম্প্রদায়ের রমণী কাঁকন বিবির আদি নাম ‘কা-কেট
হান্নিওইটা’। পরবর্তীতে তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে নাম রাখেন নুরজাহান বেগম। তবে
কাঁকন বিবি নামে তিনি সবার কাছে পরিচিত। এটি ছিল তার ডাকনাম। পরবর্তীতে ওই
নামেই তিনি বহুল পরিচিতি লাভ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কাঁকন বিবি
ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে। প্রথমে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের
পক্ষে গুপ্তচরের কাজ করেন। এ কারণে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর
হাতে তিনি বন্দি হন। টানা ৭ দিন পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্পে রেখে কাঁকন
বিবির ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এমনকি তারা লোহাড় রড গরম করে কাঁকন
বিবির শরীরের বিভিন্ন অংশে ছ্যাঁকা দেয়। এতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।
পরে মৃত ভেবে তাকে ফেলে দেয়। সেখান থেকে বেঁচে কাঁকন বিবি সুস্থ হয়ে
বিভিন্ন স্থানে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। কেউ কেউ বলছেন- কাঁকন বিবি কমপক্ষে
২০টি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হলেও কাঁকন পাননি তার প্রাপ্য
মর্যাদা। সবক্ষেত্রে বঞ্চিত হন তিনি। এমনকি তাকে দোয়ারাবাজার এলাকায়
বিভিন্ন সময় নানা অপবাদ দেয়া হয়। সমাজে ভিন্ন চোখের নারী হিসেবে কাঁকন
বিবিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা কাঁকন বিবিকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর থেকে কাঁকন বিবি
বীরপ্রতীক হিসেবে সমাজে সম্মানীয় নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। কিন্তু খেতাব
ঘোষণার দীর্ঘ ২২ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো কাঁকন বিবির নাম সরকারি গেজেটে
উঠেনি। এ কারণে তিনি পাননি বীরপ্রতীক খেতাবের কোনো সুযোগ-সুবিধা। কাঁকন
বিবির মৃত্যুর পর গতকাল এ নিয়ে প্রথমেই কথা তোলেন সিলেট মহানগর
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ভবতোষ রায় বর্মন। তিনি বলেন- ‘অজানা কারণে আজ অবধি
এই বীরপ্রতীক খেতাবটি গেজেটভুক্ত হয়নি। যার ফলে কাঁকন বিবি সরকার থেকে
প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।’
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি
বড় লড়াই হয়েছে। ওই এলাকার সাহসী সন্তানরা তখন যুদ্ধ করে পাকিস্তানি
বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন। এ কারণে স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে ওই উপজেলার
তিনজনকে দেয়া হয়েছিল বীরপ্রতীক উপাধি। এর মধ্যে রয়েছেন- বর্তমান উপজেলা
চেয়ারম্যান ও থানা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক বীরপ্রতীক ইদ্রিস আলী, টেংরাটিলার
বাসিন্দা বীরপ্রতীক আবদুল মজিদ ও বীরপ্রতীক আবদুল হালিম ইঞ্জিনিয়ার। ওই
সময়ও ওই এলাকা থেকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়া হয়নি কাঁকন বিবিকে। দীর্ঘদিন
তিনি ছিলেন অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার। সমাজের মানুষও তাকে ভিন্ন চোখে দেখতো।
তার বীরত্বকে কেউ প্রাধান্য দিতো না। দোয়ারাবাজারের বীরপ্রতীক আবদুল মজিদ
জানালেন- ‘১৯৭২ সালে যে গেজেট হয়েছিল সেই গেজেটে তারা তিনজন ছিলেন
বীরপ্রতীক। তখন কাঁকন বিরি নাম ছিল না। তাকে উপাধি দেয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে।
এরপর থেকে বীর প্রতীকদের জন্য সরকার থেকে নতুনভাবে কোনো গেজেট প্রকাশিত
হয়নি। ফলে কাঁকন বিবির নাম গেজেটভুক্ত হয়নি।’ তিনি বলেন- ‘গেজেট না হলেও
কাঁকন বিবি সরকার থেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। সর্বশেষ জনতা ব্যাংক
তাকে ২০ লাখ টাকা খরচ করে বাড়িতে ঘর বানিয়ে দিয়েছে।’ সখিনা জানিয়েছেন-
‘মৃত্যুর আগেও মা বলেছিলেন- আর হয়তো ভাতা পাবো না। মৃত্যুর পর আর ভাতা দিয়ে
কী হবে।’ তিনি দাবি করেন, ‘তার মায়ের মতো যুদ্ধের মাঠে অনেক পুরুষই বীরত্ব
দেখাতে পারেনি। সুতরাং তার মায়ের নাম গেজেটভুক্ত হলে অন্তত আত্মাটা শান্তি
পাবে বলে মন্তব্য করেন সখিনা।’ সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা জানিয়েছেন,
কাঁকন বিবিকে ভাতা প্রদানের বিষয়টি ও নাম গেজেটভুক্ত করা নিয়ে স্থানীয় জেলা
প্রশাসক সাবেরুল ইসলাম নিজ থেকে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছেন।
বেশ কয়েক মাস ধরে জেলা প্রশাসক এই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
No comments