২৩শে মার্চ পতাকা দিবস by নূরে আলম সিদ্দিকী
২৩শে
মার্চ ওরা পাকিস্তান দিবস হিসেবে পালন করতো। পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব
পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতি থাকলে তিনি, না থাকলে তার প্রতিনিধিত্ব যিনি করতেন,
সেই গভর্নর সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজের অভিবাদন নিতেন। সারা দেশে
পাকিস্তানের পতাকা উড়ত। কিন্তু একাত্তরে আমরা স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয়
ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইশতেহারের মাধ্যমে
জানিয়ে দিলাম যে, এবার ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন
বাংলার পতাকা উড়বে।
যে কথাটা সংসদীয় রাজনীতির কারণে বঙ্গবন্ধু বলতে পারতেন না, বাধা-নিষেধ ছিল, সেটি ছাত্রলীগের নেতৃচতুষ্টয়ের বক্তৃতা অথবা বিবৃতির মাধ্যমে প্রকাশ হতো। আমরা তার কাছ থেকে পরামর্শ, এমনকি অনুমতিও নিতাম বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে। ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের পতাকা উঠবে, না স্বাধীন বাংলার পতাকা উঠবে- শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতার জন্য এই কথাটিও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ালে তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায়িত করতে পারে- এ আশঙ্কা তো ছিলই। তারা কর্নওয়ালিসকে এনেছিল বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ানোর জন্য। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হতেন না। কিন্তু একটি মুহূর্তের জন্যও আওয়ামী লীগের তরফ থেকে কর্নওয়ালিসকে ফেরত যেতে বলা হয়নি। কারণ আমরা জানতাম, ২৫শে মার্চ হোক, ২৬ বা ২৭শে মার্চ হোক- আমাদের উপর তারা আক্রমণ করবেই। তারা সর্বপ্রকার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র আনছিল। জাহাজ বোঝাই করে সৈন্য আনছিল। আমরা সবকিছু অবহিত ছিলাম। তারা এটাকে তাদের শক্তির বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা বিশ্বাস করতো যে এই নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করলেই আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে। আমরা বিশ্বাস করতাম, জনগণকে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ করতে পারি, একটি চেতনার মোহনায় এনে দাঁড় করাতে পারি, তাহলে ওদের ওই অস্ত্রের শক্তিকে এই নিরস্ত্র মানুষই মোকাবিলা করবে। তাই ২৩শে মার্চ পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্তটি স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আসে এবং আমি বহু অনুষ্ঠানে বলেছি, বহুবার বলেছি এবং এটা আমি বলতেই থাকবো যে, স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ শুধু একটি আন্দোলন পরিচালনা করার সংগঠন ছিল না; ছিল বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের প্রতিধ্বনি।
২৩শে মার্চে ঘোষণা দেয়ার পরে আমরা ওদেরকে, ওদের শক্তিকে পুরোপুরি চ্যালেঞ্জ করার জন্য কর্মসূচি দিলাম : পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উঠবে, ব্যান্ড বাজবে, কুচকাওয়াজ হবে; জয় বাংলা বাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ৩২ নন্বর ধানমন্ডি পর্যন্ত যাবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে প্রদান করা হবে। সেদিন মঞ্চে আমরা ৪ জন দাঁড়ালাম। আমাদের খসরু, মন্টু, সেলিম জয় বাংলা বাহিনীর জেনারেলের বেশে ব্যান্ডের তালে তালে পতাকাটা নিয়ে মার্চপাস্ট করে গেল। আমরা অভিবাদন গ্রহণ করলাম। তখন পল্টন আর ওই কুচকাওয়াজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না, এক বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হলো।
ওখান থেকে আমরা ৩২নং-এ রওয়ানা হলাম। রাস্তা যত বাড়ছে জনতার ঢল তত নামছে, স্রোত বাড়ছে। বঙ্গবন্ধু নিচে গেটের কাছে নেমে এলেন। ছোট্ট পরিসরে লাখ লাখ লোক। ওর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের সেই সামরিক ভাব বজায় রেখে পতাকাটা তুলে দিলাম। হাইকোর্ট থেকে শুরু করে প্রধান বিচারপতির বাসভবন, সচিবালয়সহ বাঙালিদের ৯৯ ভাগ গৃহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ৫৪ হাজার বর্গমাইলের মানচিত্র আঁকা পতাকাটি উড়লো। কিন্তু অবাঙালি অধ্যুষিত মিরপুর আর মোহাম্মদপুরে উড়লো পাকিস্তানের পতাকা। আমরা বেদনাহত চিত্তে তা লক্ষ্য করলাম। তার পরপরই ইশ্তেহারে বলে দিলাম, যারা ২৩শে মার্চকে সম্মান করেনি, পতাকা দিবসকে সম্মান করেনি, এখনো পাকিস্তানের সঙ্গে যারা একাত্মতা ঘোষণা করছে, তাদের গ্যাস, পানি এবং বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দাও। এ কথাটা নিশ্চয়ই সেদিন কোনো সংসদীয় দলের নেতার পক্ষে বলা সম্ভব ছিল না। যা হোক, সঙ্গে সঙ্গে তাদের সব বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
আমার মনে আছে, মাখন, শহীদ, রশীদ, কাজী ফিরোজ, মহসীন, মাসুদ, এস এম হলের জিএস- আমরা তিনটা জিপ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। বিশেষ করে ক্র্যাক ডাউন হওয়ার ডেফিনিট ইনফরমেশনটা দেয়াও আমাদের লক্ষ্য ছিল। গিয়ে দেখি, বঙ্গবন্ধু বারান্দায় পায়চারি করছেন। আমাদের দেখার পরে বললেন- শোনো, আমার কাছে এসেছে অবাঙালিরা। তারা কিন্তু আত্মসমর্পণ করেছে। তারাও এদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে চায়, সংহতি ঘোষণা করতে চায়। মাখন, আলম, তোমরা গিয়ে ওদের কাছ থেকে এভিডেন্সটা নিয়ে নাও, ওদের আনুগত্যটা নিয়ে নাও।
মোহাম্মদপুরে বর্তমানের গায়ক ও নৃত্যশিল্পী সাদী মোহাম্মদ, শিবলী মোহাম্মদের বাবা সলিমুল্লাহ সাহেবের বাসায় আমরা গেলাম। গিয়ে দেখি কেমন যেন একটা গুমোট পরিবেশ। উপস্থিত বিহারি নেতাদের কেউ কেউ আমাদের উদ্দেশ করে বলছেন, ‘চৌধুরী সাবকো থোরা আনা হ্যায়, ওতো রাহা মে হ্যায়, আতাই হ্যায়, থোরা খানা খাকে যানা’- এইসব। সে রাতেই ক্র্যাক ডাউন হবে, সে খবরটা তো তাদের কাছেও আছে। ঐখানেই আমাদেরকে শেষ করে দেয়ার একটা পরিকল্পনা তাদের ছিল। ২৩শে মার্চে যারা পতাকা ওড়ায়নি, যারা আনুগত্য প্রকাশ করার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ২ খলিফাকে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের একটা নীলনকশা ছিল অঘটন ঘটানোর। আল্লাহ হায়াৎ রেখেছিলেন বলে সে রাতে সেখান থেকে আমরা তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। পরবর্তীতে সেখানে কি নৃশংসভাবে শিশু, নারীসহ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সলিমুল্লাহ সাহেবের বাসায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে, তিনি শহীদ হয়েছেন, তার দৌহিত্রও মারা গেছে- এসব কাহিনী অনেকেই শুনেছেন।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের উন্মেষ, তার বিকাশ, ব্যাপ্তি, সফলতা, সব বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে। এই দেশকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতাম। এই সংস্কৃতি, ভাষাকে লালন করতাম সমস্ত সত্তায়। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে তিন ধরনের রাজনীতি প্রচলিত ছিল। একটা ছিল বাম রাজনীতি, যারা সমাজতন্ত্র চাইতেন। একটা ছিল পরিষ্কার ডান রাজনীতি, যারা আমাদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অবস্থান যত করুণই হোক, পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। আরেক দল আমরা।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা প্রদানের পরে আমরা বুঝে গেলাম যে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় আমাদের উত্তরণ করতে হবে। এটা তারাও বুঝেছিল। বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিয়ে গেল। শেখ ফজলুল হক মনি, সাইফুদ্দিন, এম এ রেজা, জগন্নাথ কলেজ থেকে আল মুজাহিদীসহ ৯ জনকে কারাগারে নিল। আমরা কারাগারে গেলাম। এই কারাগারে যাওয়ার আগেও ছাত্রলীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করতো। যখন বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিলেন, তখন তাকে সিআইএর দালাল বলা হলো। কেউ কেউ বললেন, তিনি ভারতের দালাল। কেউ কেউ বললেন, তার ফাঁসি হওয়া উচিত, বাংলাদেশে। যেটা পশ্চিম পাকিস্তানিরাও বলতে সাহস পায়নি, বাম রাজনীতির একটা অংশ এইসব কথা বললো। এই প্রেক্ষাপটে ৬৬-র ৭ই জুন হরতাল অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে আমরা কারারুদ্ধ হয়ে গেলাম। কারাগার থেকে মুক্তির পর এসে আমরা লক্ষ্য করলাম যে, আমাদের সংগঠনের মধ্যে একটি চেতনার জন্ম হয়েছে- যেটা তদানীন্তন ছাত্র ইউনিয়ন পিকিং এবং মস্কোর চাইতেও বৈপ্লবিক অভিব্যক্তিতে আরো প্রকট, আরো বীভৎস। তারা সংগ্রাম, আন্দোলন- এসব কিছু ছাড়িয়ে, এমনকি মাও সেতুং, ফিদেল ক্যাস্ট্রোকেও ছাড়িয়ে ব্রেজিস দেব্রের কন্টিনিউয়াস রেভ্যুলেশনে বিশ্বাস করে। তখন বাংলাদেশে কেন, সারা পৃথিবীতেই গণতন্ত্রের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। ভিয়েতনামে আমেরিকা মার খাচ্ছে। সমাজতন্ত্র মানে হচ্ছে আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা। সমাজতন্ত্র মানেই হচ্ছে প্রগতিশীলের বহিঃপ্রকাশ। যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলে, তাদেরকে এরা সংকীর্ণবাদী, আঞ্চলিকতাবাদী বলে অভিহিত করতো। বেলুচিস্তানের সাধারণ মানুষও শোষিত, সীমান্ত প্রদেশের সাধারণ মানুষও শোষিত। ওরা অভিযোগ করতো, আমরা ওই শোষিত মানুষের কথা বলি না; অর্থাৎ ওদের ভাষায় আমরা সংকীর্ণ। তার উত্তরে আমি পাগলের মতো বাঙালি জাতীয়তাবাদের গান গেয়ে বেড়াতাম। বলতাম, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বটিকে প্রতিষ্ঠা করবো। এবং আমরা লক্ষ্য করলাম যে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব বাংলার মাটিতে শিকড়-গ্রোথিত হয়ে গেছে। কিন্তু একটা ম্যান্ডেট দরকার। দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন শুধু আমার বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন না, উনি আমার আদর্শের গুরু। সিরাজুদ্দিন হোসেনই আমাকে তফাজ্জল হোসেন মানিক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করান। তিনিই আমাদেরকে বুঝিয়ে দিলেন, তোমরা যতই দাবি করো না কেন- শেখ মুজিব সমস্ত বাংলার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন- তা ধোপে টিকবে না, যতক্ষণ না একটি নির্বাচনের মাধ্যমে তার নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
সৈয়দ মোযাহারুল হক বাকীসহ আমাদের নিজেদের মধ্যে একটা নেটওয়ার্ক ছিল। আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতাম যে, গণতন্ত্রই হচ্ছে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের শক্তির মূল উৎস এবং নির্বাচন হওয়া দরকার। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের থেকে এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা অসম্ভব ছিল। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের মধ্যে বিভাজন দেখা দেয়। তথাকথিত বিপ্লবী অংশ নির্বাচন বর্জনের জন্য সংকল্পবদ্ধ, আর আমরা নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিলাম। এক্ষেত্রে নির্বাচনের যথার্থতা ও অপরিহার্যতা বিষয়ে সিরাজুদ্দিন হোসেন বলতে গেলে প্রতিদিন ইত্তেফাকে প্রতিবেদন লিখেছেন। আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করলেও ছাত্রলীগের মধ্যে নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিভাজন থাকায় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদে এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা অসম্ভব ছিল। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আজকে স্মরণ করবো সিরাজুল আলম খান এবং কাজী আরিফের কথা। তাদেরকে বলা হতো বিপ্লবী অংশের এক এবং দুই নন্বরের নেতা। আবার বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্য নিয়েও তাদের কোনো প্রশ্ন ছিল না। স্বাধীন করার পরে এটা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হবে, না জন-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ- এই প্রশ্নও কেউ তোলেননি। মতবিরোধ ছিল; কিন্তু স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতীয়তাবাদ- এখানে কোনো বিরোধ ছিল না।
ছাত্রলীগ স্বাধীনতার পরে যখন বিভক্ত হয়ে গেল, তখন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর একই অবয়বের প্রতিকৃতি ৭২-এর অক্টোবরে, রেসকোর্সে এবং ছাত্রলীগের অপর অংশের সম্মেলনে, অর্থাৎ ওই পল্টনেও ছিল। তিনি গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক, না কমরেড- বিভাজনটা শুরু হলো সেখান থেকে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে পর্যন্ত আমরা এই যে অবিভাজ্য ছিলাম, এটার একটি কারণ, স্বাধীনতা আমরা সকলেই চাইতাম। কিন্তু তারা মনে করতেন, বন্দুকের নলই একমাত্র ক্ষমতার উৎস, সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া স্বাধীনতা আসবে না। সেদিনও এক ভদ্রলোক আমাকে বললেন, শেষ পর্যন্ত তো আপনাদের ওই অস্ত্র ধরতেই হলো। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, তারা সঠিক ছিলেন, আপনিই ভুল ছিলেন। আমি বললাম, নির্বাচনের ম্যান্ডেটটা পাওয়ার আগে যদি এই ঘোষণাটা দিতেন, তাহলে বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলনটি সিংহলের তামিলদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মতো হয়ে যেত। তখন বুঝতে পারতেন ম্যান্ডেট ছাড়া সশস্ত্র সংগ্রামের কি জ্বালা!
যা হোক, ৭২-এ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স বা পল্টন, কোনো জায়গায় যদি না যেতেন, তাহলে জোড়াতালি দিয়ে আমার মনে হয় ছাত্রলীগ থাকতো, কিন্তু পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিলে তাদের তাত্ত্বিক নেতা জনাব সিরাজুল আলম খান কী সিদ্ধান্ত নিতেন, সেটা বলা মুশকিল। কারণ সিরাজ ভাইয়ের সাংগঠনিক শক্তি, তার বৈপ্লবিক চেতনা- কোনো কিছুর প্রতি কটাক্ষ না করে আমি বলতে চাই, আমার কাছে আদর্শের প্রশ্নে তাকে সবসময়ই একটু কনফিউস্ড মনে হয়েছে। যা-ই হোক, যদি বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে না যেতেন, তাহলে ছাত্রলীগ ভাঙত না- এমন কথা বলাও দুষ্কর, কারণ বিপ্লব এমন ধরনের প্রেরণা এবং তা এত ফাস্ট হয়ে গিয়েছিল, তখন ওটার রাশ টেনে ধরে রাখা সিরাজ ভাইয়ের পক্ষেও সম্ভব হতো কি-না, আমি সন্দিহান। কারণ একটা স্পিড যখন ড্রাইভারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন গাড়ির দুর্ঘটনা আটকানো যায় না। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা যেভাবে আমাদের উজ্জীবিত করেছে, তা বিস্ময়কর!
এই বাঙালি জাতীয় চেতনার সোপান বেয়েই আমরা স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে উপনীত হই। ৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট লাভ করেন এবং এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, ওই ম্যান্ডেট আমাদের শুধু মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলো সৃষ্টি করতেই উজ্জীবিত করেনি, বাংলার মানুষকে উদ্বেলিত, উচ্ছ্বসিত করে ২৫শে মার্চের আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। এবং ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালি তাদের পরাজিত করতে পেরেছে। সারা বিশ্বে একটি নতুন সত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে : অস্ত্রের ধার যত তীক্ষ্ণই হোক না কেন, ঐক্যবদ্ধ ও জাগ্রত জনশক্তির কাছে তা পরাজিত হতে বাধ্য। ৭০-এর নির্বাচন ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয়ের উৎস। অবিস্মরণীয় এই নির্বাচনের ফলাফল বঙ্গবন্ধুকে কেবল অফুরন্ত শক্তি ও ভিন্নমাত্রার উচ্চতায়ই প্রতিস্থাপিত করেনি, ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে শুরু করে স্বাধীনতার ডাক দেয়ার শক্তিরও জোগান দিয়েছে। ৯ মাসের যুদ্ধে জয় প্রান্তিক জনতার ঐক্যেরই ফলশ্রুতি।
২৩শে মার্চের পতাকা উত্তোলন দিবসে জীবনসায়াহ্নে এসে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বলতে চাই, ৭০-এর নির্বাচনে অভূতপূর্ব ম্যান্ডেটই ছিল আমাদের শক্তির উৎস। জয়তু বাংলার প্রান্তিক জনতা।
যে কথাটা সংসদীয় রাজনীতির কারণে বঙ্গবন্ধু বলতে পারতেন না, বাধা-নিষেধ ছিল, সেটি ছাত্রলীগের নেতৃচতুষ্টয়ের বক্তৃতা অথবা বিবৃতির মাধ্যমে প্রকাশ হতো। আমরা তার কাছ থেকে পরামর্শ, এমনকি অনুমতিও নিতাম বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে। ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের পতাকা উঠবে, না স্বাধীন বাংলার পতাকা উঠবে- শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতার জন্য এই কথাটিও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ালে তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায়িত করতে পারে- এ আশঙ্কা তো ছিলই। তারা কর্নওয়ালিসকে এনেছিল বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ানোর জন্য। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হতেন না। কিন্তু একটি মুহূর্তের জন্যও আওয়ামী লীগের তরফ থেকে কর্নওয়ালিসকে ফেরত যেতে বলা হয়নি। কারণ আমরা জানতাম, ২৫শে মার্চ হোক, ২৬ বা ২৭শে মার্চ হোক- আমাদের উপর তারা আক্রমণ করবেই। তারা সর্বপ্রকার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র আনছিল। জাহাজ বোঝাই করে সৈন্য আনছিল। আমরা সবকিছু অবহিত ছিলাম। তারা এটাকে তাদের শক্তির বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা বিশ্বাস করতো যে এই নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করলেই আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে। আমরা বিশ্বাস করতাম, জনগণকে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ করতে পারি, একটি চেতনার মোহনায় এনে দাঁড় করাতে পারি, তাহলে ওদের ওই অস্ত্রের শক্তিকে এই নিরস্ত্র মানুষই মোকাবিলা করবে। তাই ২৩শে মার্চ পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্তটি স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আসে এবং আমি বহু অনুষ্ঠানে বলেছি, বহুবার বলেছি এবং এটা আমি বলতেই থাকবো যে, স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ শুধু একটি আন্দোলন পরিচালনা করার সংগঠন ছিল না; ছিল বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের প্রতিধ্বনি।
২৩শে মার্চে ঘোষণা দেয়ার পরে আমরা ওদেরকে, ওদের শক্তিকে পুরোপুরি চ্যালেঞ্জ করার জন্য কর্মসূচি দিলাম : পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উঠবে, ব্যান্ড বাজবে, কুচকাওয়াজ হবে; জয় বাংলা বাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ৩২ নন্বর ধানমন্ডি পর্যন্ত যাবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে প্রদান করা হবে। সেদিন মঞ্চে আমরা ৪ জন দাঁড়ালাম। আমাদের খসরু, মন্টু, সেলিম জয় বাংলা বাহিনীর জেনারেলের বেশে ব্যান্ডের তালে তালে পতাকাটা নিয়ে মার্চপাস্ট করে গেল। আমরা অভিবাদন গ্রহণ করলাম। তখন পল্টন আর ওই কুচকাওয়াজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না, এক বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হলো।
ওখান থেকে আমরা ৩২নং-এ রওয়ানা হলাম। রাস্তা যত বাড়ছে জনতার ঢল তত নামছে, স্রোত বাড়ছে। বঙ্গবন্ধু নিচে গেটের কাছে নেমে এলেন। ছোট্ট পরিসরে লাখ লাখ লোক। ওর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের সেই সামরিক ভাব বজায় রেখে পতাকাটা তুলে দিলাম। হাইকোর্ট থেকে শুরু করে প্রধান বিচারপতির বাসভবন, সচিবালয়সহ বাঙালিদের ৯৯ ভাগ গৃহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ৫৪ হাজার বর্গমাইলের মানচিত্র আঁকা পতাকাটি উড়লো। কিন্তু অবাঙালি অধ্যুষিত মিরপুর আর মোহাম্মদপুরে উড়লো পাকিস্তানের পতাকা। আমরা বেদনাহত চিত্তে তা লক্ষ্য করলাম। তার পরপরই ইশ্তেহারে বলে দিলাম, যারা ২৩শে মার্চকে সম্মান করেনি, পতাকা দিবসকে সম্মান করেনি, এখনো পাকিস্তানের সঙ্গে যারা একাত্মতা ঘোষণা করছে, তাদের গ্যাস, পানি এবং বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দাও। এ কথাটা নিশ্চয়ই সেদিন কোনো সংসদীয় দলের নেতার পক্ষে বলা সম্ভব ছিল না। যা হোক, সঙ্গে সঙ্গে তাদের সব বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
আমার মনে আছে, মাখন, শহীদ, রশীদ, কাজী ফিরোজ, মহসীন, মাসুদ, এস এম হলের জিএস- আমরা তিনটা জিপ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। বিশেষ করে ক্র্যাক ডাউন হওয়ার ডেফিনিট ইনফরমেশনটা দেয়াও আমাদের লক্ষ্য ছিল। গিয়ে দেখি, বঙ্গবন্ধু বারান্দায় পায়চারি করছেন। আমাদের দেখার পরে বললেন- শোনো, আমার কাছে এসেছে অবাঙালিরা। তারা কিন্তু আত্মসমর্পণ করেছে। তারাও এদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে চায়, সংহতি ঘোষণা করতে চায়। মাখন, আলম, তোমরা গিয়ে ওদের কাছ থেকে এভিডেন্সটা নিয়ে নাও, ওদের আনুগত্যটা নিয়ে নাও।
মোহাম্মদপুরে বর্তমানের গায়ক ও নৃত্যশিল্পী সাদী মোহাম্মদ, শিবলী মোহাম্মদের বাবা সলিমুল্লাহ সাহেবের বাসায় আমরা গেলাম। গিয়ে দেখি কেমন যেন একটা গুমোট পরিবেশ। উপস্থিত বিহারি নেতাদের কেউ কেউ আমাদের উদ্দেশ করে বলছেন, ‘চৌধুরী সাবকো থোরা আনা হ্যায়, ওতো রাহা মে হ্যায়, আতাই হ্যায়, থোরা খানা খাকে যানা’- এইসব। সে রাতেই ক্র্যাক ডাউন হবে, সে খবরটা তো তাদের কাছেও আছে। ঐখানেই আমাদেরকে শেষ করে দেয়ার একটা পরিকল্পনা তাদের ছিল। ২৩শে মার্চে যারা পতাকা ওড়ায়নি, যারা আনুগত্য প্রকাশ করার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ২ খলিফাকে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের একটা নীলনকশা ছিল অঘটন ঘটানোর। আল্লাহ হায়াৎ রেখেছিলেন বলে সে রাতে সেখান থেকে আমরা তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। পরবর্তীতে সেখানে কি নৃশংসভাবে শিশু, নারীসহ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সলিমুল্লাহ সাহেবের বাসায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে, তিনি শহীদ হয়েছেন, তার দৌহিত্রও মারা গেছে- এসব কাহিনী অনেকেই শুনেছেন।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের উন্মেষ, তার বিকাশ, ব্যাপ্তি, সফলতা, সব বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে। এই দেশকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতাম। এই সংস্কৃতি, ভাষাকে লালন করতাম সমস্ত সত্তায়। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে তিন ধরনের রাজনীতি প্রচলিত ছিল। একটা ছিল বাম রাজনীতি, যারা সমাজতন্ত্র চাইতেন। একটা ছিল পরিষ্কার ডান রাজনীতি, যারা আমাদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অবস্থান যত করুণই হোক, পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। আরেক দল আমরা।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা প্রদানের পরে আমরা বুঝে গেলাম যে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় আমাদের উত্তরণ করতে হবে। এটা তারাও বুঝেছিল। বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিয়ে গেল। শেখ ফজলুল হক মনি, সাইফুদ্দিন, এম এ রেজা, জগন্নাথ কলেজ থেকে আল মুজাহিদীসহ ৯ জনকে কারাগারে নিল। আমরা কারাগারে গেলাম। এই কারাগারে যাওয়ার আগেও ছাত্রলীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করতো। যখন বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিলেন, তখন তাকে সিআইএর দালাল বলা হলো। কেউ কেউ বললেন, তিনি ভারতের দালাল। কেউ কেউ বললেন, তার ফাঁসি হওয়া উচিত, বাংলাদেশে। যেটা পশ্চিম পাকিস্তানিরাও বলতে সাহস পায়নি, বাম রাজনীতির একটা অংশ এইসব কথা বললো। এই প্রেক্ষাপটে ৬৬-র ৭ই জুন হরতাল অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে আমরা কারারুদ্ধ হয়ে গেলাম। কারাগার থেকে মুক্তির পর এসে আমরা লক্ষ্য করলাম যে, আমাদের সংগঠনের মধ্যে একটি চেতনার জন্ম হয়েছে- যেটা তদানীন্তন ছাত্র ইউনিয়ন পিকিং এবং মস্কোর চাইতেও বৈপ্লবিক অভিব্যক্তিতে আরো প্রকট, আরো বীভৎস। তারা সংগ্রাম, আন্দোলন- এসব কিছু ছাড়িয়ে, এমনকি মাও সেতুং, ফিদেল ক্যাস্ট্রোকেও ছাড়িয়ে ব্রেজিস দেব্রের কন্টিনিউয়াস রেভ্যুলেশনে বিশ্বাস করে। তখন বাংলাদেশে কেন, সারা পৃথিবীতেই গণতন্ত্রের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। ভিয়েতনামে আমেরিকা মার খাচ্ছে। সমাজতন্ত্র মানে হচ্ছে আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা। সমাজতন্ত্র মানেই হচ্ছে প্রগতিশীলের বহিঃপ্রকাশ। যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলে, তাদেরকে এরা সংকীর্ণবাদী, আঞ্চলিকতাবাদী বলে অভিহিত করতো। বেলুচিস্তানের সাধারণ মানুষও শোষিত, সীমান্ত প্রদেশের সাধারণ মানুষও শোষিত। ওরা অভিযোগ করতো, আমরা ওই শোষিত মানুষের কথা বলি না; অর্থাৎ ওদের ভাষায় আমরা সংকীর্ণ। তার উত্তরে আমি পাগলের মতো বাঙালি জাতীয়তাবাদের গান গেয়ে বেড়াতাম। বলতাম, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বটিকে প্রতিষ্ঠা করবো। এবং আমরা লক্ষ্য করলাম যে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব বাংলার মাটিতে শিকড়-গ্রোথিত হয়ে গেছে। কিন্তু একটা ম্যান্ডেট দরকার। দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন শুধু আমার বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন না, উনি আমার আদর্শের গুরু। সিরাজুদ্দিন হোসেনই আমাকে তফাজ্জল হোসেন মানিক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করান। তিনিই আমাদেরকে বুঝিয়ে দিলেন, তোমরা যতই দাবি করো না কেন- শেখ মুজিব সমস্ত বাংলার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন- তা ধোপে টিকবে না, যতক্ষণ না একটি নির্বাচনের মাধ্যমে তার নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
সৈয়দ মোযাহারুল হক বাকীসহ আমাদের নিজেদের মধ্যে একটা নেটওয়ার্ক ছিল। আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতাম যে, গণতন্ত্রই হচ্ছে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের শক্তির মূল উৎস এবং নির্বাচন হওয়া দরকার। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের থেকে এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা অসম্ভব ছিল। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের মধ্যে বিভাজন দেখা দেয়। তথাকথিত বিপ্লবী অংশ নির্বাচন বর্জনের জন্য সংকল্পবদ্ধ, আর আমরা নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিলাম। এক্ষেত্রে নির্বাচনের যথার্থতা ও অপরিহার্যতা বিষয়ে সিরাজুদ্দিন হোসেন বলতে গেলে প্রতিদিন ইত্তেফাকে প্রতিবেদন লিখেছেন। আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করলেও ছাত্রলীগের মধ্যে নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিভাজন থাকায় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদে এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা অসম্ভব ছিল। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আজকে স্মরণ করবো সিরাজুল আলম খান এবং কাজী আরিফের কথা। তাদেরকে বলা হতো বিপ্লবী অংশের এক এবং দুই নন্বরের নেতা। আবার বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্য নিয়েও তাদের কোনো প্রশ্ন ছিল না। স্বাধীন করার পরে এটা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হবে, না জন-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ- এই প্রশ্নও কেউ তোলেননি। মতবিরোধ ছিল; কিন্তু স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতীয়তাবাদ- এখানে কোনো বিরোধ ছিল না।
ছাত্রলীগ স্বাধীনতার পরে যখন বিভক্ত হয়ে গেল, তখন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর একই অবয়বের প্রতিকৃতি ৭২-এর অক্টোবরে, রেসকোর্সে এবং ছাত্রলীগের অপর অংশের সম্মেলনে, অর্থাৎ ওই পল্টনেও ছিল। তিনি গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক, না কমরেড- বিভাজনটা শুরু হলো সেখান থেকে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে পর্যন্ত আমরা এই যে অবিভাজ্য ছিলাম, এটার একটি কারণ, স্বাধীনতা আমরা সকলেই চাইতাম। কিন্তু তারা মনে করতেন, বন্দুকের নলই একমাত্র ক্ষমতার উৎস, সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া স্বাধীনতা আসবে না। সেদিনও এক ভদ্রলোক আমাকে বললেন, শেষ পর্যন্ত তো আপনাদের ওই অস্ত্র ধরতেই হলো। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, তারা সঠিক ছিলেন, আপনিই ভুল ছিলেন। আমি বললাম, নির্বাচনের ম্যান্ডেটটা পাওয়ার আগে যদি এই ঘোষণাটা দিতেন, তাহলে বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলনটি সিংহলের তামিলদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মতো হয়ে যেত। তখন বুঝতে পারতেন ম্যান্ডেট ছাড়া সশস্ত্র সংগ্রামের কি জ্বালা!
যা হোক, ৭২-এ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স বা পল্টন, কোনো জায়গায় যদি না যেতেন, তাহলে জোড়াতালি দিয়ে আমার মনে হয় ছাত্রলীগ থাকতো, কিন্তু পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিলে তাদের তাত্ত্বিক নেতা জনাব সিরাজুল আলম খান কী সিদ্ধান্ত নিতেন, সেটা বলা মুশকিল। কারণ সিরাজ ভাইয়ের সাংগঠনিক শক্তি, তার বৈপ্লবিক চেতনা- কোনো কিছুর প্রতি কটাক্ষ না করে আমি বলতে চাই, আমার কাছে আদর্শের প্রশ্নে তাকে সবসময়ই একটু কনফিউস্ড মনে হয়েছে। যা-ই হোক, যদি বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে না যেতেন, তাহলে ছাত্রলীগ ভাঙত না- এমন কথা বলাও দুষ্কর, কারণ বিপ্লব এমন ধরনের প্রেরণা এবং তা এত ফাস্ট হয়ে গিয়েছিল, তখন ওটার রাশ টেনে ধরে রাখা সিরাজ ভাইয়ের পক্ষেও সম্ভব হতো কি-না, আমি সন্দিহান। কারণ একটা স্পিড যখন ড্রাইভারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন গাড়ির দুর্ঘটনা আটকানো যায় না। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা যেভাবে আমাদের উজ্জীবিত করেছে, তা বিস্ময়কর!
এই বাঙালি জাতীয় চেতনার সোপান বেয়েই আমরা স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে উপনীত হই। ৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট লাভ করেন এবং এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, ওই ম্যান্ডেট আমাদের শুধু মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলো সৃষ্টি করতেই উজ্জীবিত করেনি, বাংলার মানুষকে উদ্বেলিত, উচ্ছ্বসিত করে ২৫শে মার্চের আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। এবং ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালি তাদের পরাজিত করতে পেরেছে। সারা বিশ্বে একটি নতুন সত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে : অস্ত্রের ধার যত তীক্ষ্ণই হোক না কেন, ঐক্যবদ্ধ ও জাগ্রত জনশক্তির কাছে তা পরাজিত হতে বাধ্য। ৭০-এর নির্বাচন ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয়ের উৎস। অবিস্মরণীয় এই নির্বাচনের ফলাফল বঙ্গবন্ধুকে কেবল অফুরন্ত শক্তি ও ভিন্নমাত্রার উচ্চতায়ই প্রতিস্থাপিত করেনি, ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে শুরু করে স্বাধীনতার ডাক দেয়ার শক্তিরও জোগান দিয়েছে। ৯ মাসের যুদ্ধে জয় প্রান্তিক জনতার ঐক্যেরই ফলশ্রুতি।
২৩শে মার্চের পতাকা উত্তোলন দিবসে জীবনসায়াহ্নে এসে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বলতে চাই, ৭০-এর নির্বাচনে অভূতপূর্ব ম্যান্ডেটই ছিল আমাদের শক্তির উৎস। জয়তু বাংলার প্রান্তিক জনতা।
No comments