তরতর করে তরবারির খেলা
আসমা
খাতুন, স্বপ্না আক্তার, সুমি আক্তার, নাজমা আক্তাররা পাঁচ দিন ধরে
অসিচালনা বা ফেন্সিংয়ের খেলায় মাতিয়ে রাখলেন মিরপুরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী
ইনডোর স্টেডিয়াম। মুখোমুখি তরবারি হাতে দুই প্রতিযোগী। কে কাকে বেশিবার
আঘাত করে বিজয়ীর বেশে বেরিয়ে যাবেন পিস্ট (১৪ মিটার গুণন ১.৫ মিটার
ট্র্যাক) থেকে, এটাই ছিল প্রতিযোগিতার মূল প্রতিপাদ্য। এঁদের কোনো
উত্তরসূরির মধ্যেই কি বাংলাদেশ ভবিষ্যতে খুঁজে পাবে একজন ভ্যালেন্তিনা
ভেৎসালি? এমন ভাবতেও দুঃসাহস লাগে। ভেৎসালি খেলাটির সর্বকালের সেরা নারী
তারকা। ইতালিয়ান এই ফেন্সার অলিম্পিকের সোনা জিতেছেন ছয়টি, সঙ্গে বিশ্ব
ফেন্সিংয়ে ১৪টি সোনা। ২০০০ সিডনি অলিম্পিক থেকে ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিক
পর্যন্ত ব্যক্তিগত ফয়েলে টানা তিনবার সোনা জিতে গড়েছেন ইতিহাস। শত বছরেও
এমন মানের একজন ফেন্সারকে আবিষ্কার করার কথা স্বপ্নে ভাবতে পারে না
বাংলাদেশ। আসমা-স্বপ্নারা ভেৎসালির নামই কখনো শোনেননি। তা না শুনুন।
ভেৎসালির খেলাটা (ভেৎসালির নামের সমার্থকই হয়ে গেছে ফেন্সিং) বাংলাদেশে
চালু তো হয়েছে। সরকারি স্বীকৃতি পেয়ে বাংলাদেশে অলিম্পিকের অন্যতম প্রাচীন
খেলাটির যাত্রা শুরু ২০০৭ সালে। এরপর থেকেই ফেন্সিংয়ের তরতর করে এগিয়ে চলা।
এ পর্যন্ত চারটি জাতীয় প্রতিযোগিতা হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর শুরু হয়ে গতকাল শেষ
হলো পঞ্চম প্রেসিডেন্টস কাপ ফেন্সিং, যেটি ফেন্সিং অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে
দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিযোগিতা। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শোয়েব চৌধুরীর মতে,
এটি এযাবৎকালের সবচেয়ে জমকালো আয়োজন। ২৬ ডিসেম্বর বিকেলে মিরপুর ইনডোর
স্টেডিয়ামে প্রধান অতিথি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর উপস্থিতিতে আতশবাজির
ঝলকানির মধ্যে শুরু প্রতিযোগিতা। তারপর প্রতিদিন সকাল থেকে শুরু করে রাত
পর্যন্ত চলেছে তা আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে। গতকাল ছিল প্রতিযোগিতার সমাপ্তি। ইপি,
সেবার ও ফয়েল—এ তিন বিভাগ মিলিয়ে ১২টি ইভেন্টে সারা দেশের প্রায় ২০০
নারী-পুরুষ ফেন্সার অংশ নিয়েছে। নতুন খেলাটি অবশ্য সারা দেশে বিস্তৃত নয়।
চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগে এটির চর্চা চলছে অল্পবিস্তর। আর ঢাকায়
সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবিতেই মূলত খেলা হয়। চলছে ঢাকা কমার্স কলেজসহ
দু-একটি ফেন্সিং ক্লাবেও। অন্য অনেক খেলার মতোই আনসার ছুঁয়ে ফেলেছে এটির
সর্বোচ্চ সাফল্যবিন্দু। এই প্রতিযোগিতারও ১২টি ইভেন্টের ৮টি সোনাই জিতেছে
আনসার। আনসারের নারী প্রতিযোগীদেরই দাপট বেশি। নারীরা জিতেছেন পাঁচটি সোনা,
তিনটি পুরুষেরা। আনসার বাদে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী দল জিতেছে তিনটি ও একটি
সোনা। আনসারের মেয়েদের মধ্যে আসমা খাতুন জিতেছেন দুটি সোনা (ইপির
ব্যক্তিগত ও দলীয়), স্বপ্না আক্তারও তাই (ফয়েলের ব্যক্তিগত ও দলীয়)।
মেয়েদের সেবারের ব্যক্তিগত সোনাজয়ী সুমি আক্তার। ইপি, সেবার ও
ফয়েল—ফেন্সিংয়ের তিনটি বিভাগ। ইপিতে মুখোমুখি দুই প্রতিযোগী পা থেকে মাথা
পর্যন্ত শরীরের যেকোনো জায়গাতেই তরবারি দিয়ে আঘাত করতে পারেন। সেবারে আঘাত
করা যায় কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত যেকোনো জায়গায়। আর ফয়েলে তরবারি দিয়ে শুধু
শরীরের কোমরের ওপর থেকে গলার নিচ পর্যন্ত জায়গাটুকুতে। আঘাত মানে প্রকৃতই
আঘাত নয়, তরবারির ডগা ছোঁয়ানো। তরবারির ডগাটা শরীর ছুঁলেই প্রতিযোগীর কোমরে
সংযুক্ত কর্ড ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে পয়েন্ট দেখাবে। প্রতিটি বাউটে (লড়াই)
তিন মিনিটের তিনটি করে রাউন্ড, মোট পয়েন্ট ১৫। মাস্ক, জ্যাকেট, গ্লাভস,
শু পরে ফেন্সাররা যখন লড়েন, মনে হয় চাঁদের পিঠে তরবারি নিয়ে দ্বন্দ্ব
যুদ্ধ করছেন নভোচারীরা। খেলোয়াড়দের সর্বোচ্চ শারীরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত
করতেই ব্যয়বহুল এই ‘কিম্ভূতকিমাকার’ সাজ। বাংলাদেশে আর্চারির সমান বয়সী
ফেন্সিং। সংগঠকদের দুঃখ: খেলাটি প্রত্যাশামতো এগোতে পারেনি। শোয়েব চৌধুরী
আগামীকাল শুরু নতুন বছরটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছেন। ২০১৯ এসএ গেমস থেকে
পদক জয়ের জন্য ফেন্সারদের সবচেয়ে ভালোভাবে প্রস্তুত করতে চান তিনি। মূল
লক্ষ্য অবশ্য বাস্তবসম্মত—২০২৪ অলিম্পিকে যোগ্যতামান পেরিয়ে অংশগ্রহণ।
এরপর...কোনো অনাগত কালে যদি দেশের ফেন্সিংয়ে আবির্ভূত হন কোনো ‘ভেৎসালি’!
No comments