প্রেরণাই পথ দেখায়
‘ভাইয়া, ডিপ লার্নিং কীভাবে শিখব?’
‘মেশিন লার্নিং শিখতে চাই | কেমন করে শুরু করব?’
প্রশ্নগুলো শুনলে খুব অসহায় লাগে | কারণ, আমি জানি যে প্রশ্নকারীর জানতে চাওয়ার ইচ্ছা অকৃত্রিম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব প্রশ্নের খুব ভালো উত্তর আমার কাছে নেই| আমাকে সব সময় পথ দেখিয়েছে ‘অনুপ্রেরণা’। যখনই নতুন কিছু শিখতে চেয়েছি, প্রেরণাই সাহায্য করেছে; প্রযুক্তি নয় | আজ লিখছি ওই প্রেরণাগুলো নিয়ে। ১৯৯৯ সাল। স্নাতক করার জন্য মাত্র যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি। জানতে পারলাম যে আমার মা অন্তঃসত্ত্বা। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর কেউ যখন মা হন, তখন সন্তানটির ‘ডাউন সিনড্রোম’ (একধরনের শারীরিক বা মানসিক উপসর্গ)-এর আশঙ্কা থাকে। খবর পেয়েছিলাম ক্যালকুলাস পরীক্ষার দুই দিন আগে। এখনো মনে আছে, অঙ্ক বাদ দিয়ে সারা রাত ডাউন সিনড্রোম নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। আমার তাৎক্ষণিক চিন্তা ছিল যে ইঞ্জিনিয়ারিং বাদ দিয়ে মেডিকেল সায়েন্স পড়ব। ডাউন সিনড্রোম নিয়ে গবেষণা করব। কিন্তু একটু ঘেঁটে বুঝতে পারলাম যে কম্পিউটার বিজ্ঞানের মাধ্যমেও হয়তো ডাউন সিনড্রোম নিয়ে কাজ করা সম্ভব। কী করে? সেটা পরিষ্কার ছিল না। তাই ক্লাসে তত্ত্ব শেখার পাশাপাশি সব সময়ই এই তত্ত্বের সৃজনশীল প্রয়োগ নিয়ে চিন্তা করতাম | অচিরেই সুযোগ মিলল | একবার যুক্তরাষ্ট্রে ডাউন সিনড্রোমের এক স্কুলে গিয়েছি সৌজন্য সাক্ষাৎকারের জন্য। দেখলাম ওদের স্পিচ থেরাপি (শিশুদের কথা বলতে সাহায্য করার জন্য একধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা) অনেক ক্ষেত্রেই ঠিকভাবে কাজ করছে না। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা আছে। শিশুদের জন্য পদ্ধতিটা মোটেও আনন্দদায়ক নয়। তা ছাড়া থেরাপির কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভর করে থেরাপিস্টের ব্যক্তিত্বের ওপর। বাসায় ফিরেই ড্রয়িং বোর্ড নিয়ে বসে পড়লাম।
‘মেশিন লার্নিং শিখতে চাই | কেমন করে শুরু করব?’
প্রশ্নগুলো শুনলে খুব অসহায় লাগে | কারণ, আমি জানি যে প্রশ্নকারীর জানতে চাওয়ার ইচ্ছা অকৃত্রিম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব প্রশ্নের খুব ভালো উত্তর আমার কাছে নেই| আমাকে সব সময় পথ দেখিয়েছে ‘অনুপ্রেরণা’। যখনই নতুন কিছু শিখতে চেয়েছি, প্রেরণাই সাহায্য করেছে; প্রযুক্তি নয় | আজ লিখছি ওই প্রেরণাগুলো নিয়ে। ১৯৯৯ সাল। স্নাতক করার জন্য মাত্র যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি। জানতে পারলাম যে আমার মা অন্তঃসত্ত্বা। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর কেউ যখন মা হন, তখন সন্তানটির ‘ডাউন সিনড্রোম’ (একধরনের শারীরিক বা মানসিক উপসর্গ)-এর আশঙ্কা থাকে। খবর পেয়েছিলাম ক্যালকুলাস পরীক্ষার দুই দিন আগে। এখনো মনে আছে, অঙ্ক বাদ দিয়ে সারা রাত ডাউন সিনড্রোম নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। আমার তাৎক্ষণিক চিন্তা ছিল যে ইঞ্জিনিয়ারিং বাদ দিয়ে মেডিকেল সায়েন্স পড়ব। ডাউন সিনড্রোম নিয়ে গবেষণা করব। কিন্তু একটু ঘেঁটে বুঝতে পারলাম যে কম্পিউটার বিজ্ঞানের মাধ্যমেও হয়তো ডাউন সিনড্রোম নিয়ে কাজ করা সম্ভব। কী করে? সেটা পরিষ্কার ছিল না। তাই ক্লাসে তত্ত্ব শেখার পাশাপাশি সব সময়ই এই তত্ত্বের সৃজনশীল প্রয়োগ নিয়ে চিন্তা করতাম | অচিরেই সুযোগ মিলল | একবার যুক্তরাষ্ট্রে ডাউন সিনড্রোমের এক স্কুলে গিয়েছি সৌজন্য সাক্ষাৎকারের জন্য। দেখলাম ওদের স্পিচ থেরাপি (শিশুদের কথা বলতে সাহায্য করার জন্য একধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা) অনেক ক্ষেত্রেই ঠিকভাবে কাজ করছে না। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা আছে। শিশুদের জন্য পদ্ধতিটা মোটেও আনন্দদায়ক নয়। তা ছাড়া থেরাপির কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভর করে থেরাপিস্টের ব্যক্তিত্বের ওপর। বাসায় ফিরেই ড্রয়িং বোর্ড নিয়ে বসে পড়লাম।
ভাবতে শুরু করলাম, থেরাপিস্টকে
সাহায্য করার জন্য কীভাবে কম্পিউটার ব্যবহার করা যায়। কম্পিউটার সরাসরি
শিক্ষার্থীদের কথা বিশ্লেষণ করবে, আর খেলার ছলে তাদের অনুপ্রেরণা দেবে—এমন
কি হতে পারে? বুঝে গেলাম, এই সমস্যার সমাধান করতে হলে আমাকে ‘স্পিচ
প্রসেসিং’ আর ‘মেশিন লার্নিং’ দুটোই শিখতে হবে। অসংখ্য বই ঘাঁটলাম, রিসার্চ
পেপার পড়লাম, বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপকদের সঙ্গে কথা বলে কাজে হাত দিলাম। ওই
সময়ে নিজের গরজে শেখা বিদ্যা এখনো কাজে দিচ্ছে। ২০০৭ সাল। হঠাৎ খবর পেলাম,
আমার মায়ের ক্যানসার। একেবারে শেষ পর্যায়ে। তখন পিএইচডি মাত্র শুরু
করেছি। পিএইচডি বাদ দিয়ে ছুটে এলাম বাংলাদেশে। আমার মা একই সঙ্গে খুব
আত্মবিশ্বাসী এবং আশাবাদী মানুষ। আমরা তাঁকে আশাহত করলাম না। একসঙ্গে গেলাম
সিঙ্গাপুরে, উন্নত চিকিৎসা এবং হয়তো অলৌকিক কিছুর আশায়। সিঙ্গাপুরে বাঘা
বাঘা ডাক্তার আছেন। আমার মায়ের দায়িত্ব নিলেন ডক্টর টো হং চং। শুনেছি
কিছুদিন আগে তিনিই বাংলাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনের
চিকিৎসা করে তাঁকে সুস্থ করেছেন। আমাদের আশা আরও বাড়ল। ডাক্তার আমার
মায়ের রিপোর্ট দেখে সূক্ষ্মভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ক্যানসার অনেক দূর
ছড়িয়ে পড়েছে। কেমোথেরাপির চেয়ে জীবনের মান বজায় রাখাটাই হয়তো
গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সময়টা তখন আমাদের জন্য ভীষণ আবেগপ্রবণ। আমরা হার মানব
না। ডাক্তারের সূক্ষ্ম ইঙ্গিতগুলো আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। চলল একের পর এক
কেমোথেরাপি, সঙ্গে ভয়ংকর সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। একটা
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল পারকিনসনের মতো কাঁপুনি। ওষুধ খেলে কমে। একদিন
সময়মতো ওষুধ খাওয়া হয়নি বলে হঠাৎ করে মায়ের হাত কাঁপা শুরু করল। আমার মনে
আছে, শক্ত করে আমি মায়ের দুই হাত ধরে রেখেছিলাম। হয়তো ভেবেছিলাম, হাত ধরে
রাখলে আমি মাকেও ধরে রাখতে পারব। কয়েক বছর পর। আমি তখন ইউনিভার্সিটি অব
রচেস্টারের সহকারী অধ্যাপক। একদিন হঠাৎ কথা হলো আমাদের মেডিকেল সেন্টারের
এক প্রখ্যাত ক্যানসার বিশেষজ্ঞের সঙ্গে।
তিনি বললেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে এখন ৪০
শতাংশ লোকের ক্যানসার হচ্ছে এবং তাঁদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি লোক মারা
যাচ্ছে। ক্যানসারের একটা বড় সমস্যা হলো রোগী ও ডাক্তারের যোগাযোগের বিভেদ।
কোন চিকিৎসাপদ্ধতি বেছে নেবেন, সেই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি রোগীর। ডাক্তারের
দায়িত্ব হলো রোগ নির্ণয়ের তথ্যগুলো রোগীকে এমনভাবে জানানো যেন রোগী আশা না
হারান আর সঠিক চিকিৎসাটা বেছে নেন। যেমন ধরুন, কখনো কখনো ক্যানসার এমনভাবে
ছড়িয়ে পড়ে যে সেই পর্যায়ে কেমোথেরাপির উপকারের চেয়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার
পাল্লা ভারী হতে পারে...।’ তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই বললাম, ‘আমি কি তোমাকে
কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি? ’ ডাক্তার খুবই উৎসাহী হলেন, ‘হ্যাঁ, পারো |
আমরা প্রায় ৩৬০ জন চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্যানসার রোগী এবং তাঁদের ডাক্তারের
কথোপকথন রেকর্ড করেছি | আমরা কম্পিউটার বিজ্ঞানী নই | তুমি আমাদের ওদের
কথাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করতে পারো | যেমন ধরো,
ডাক্তাররা কীভাবে কথা বললে রোগীরা সহজে বুঝতে পারবেন, চিকিৎসার জন্য সঠিক
সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন...।’ এই কাজের জন্য ‘ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ
প্রসেসিং’-এর ওপর দক্ষতা দরকার| ওটা আমার নেই | তাতে কী, শিখতে কতক্ষণ? কথা
বললাম আমার এক ছাত্রের সঙ্গে | ও সঙ্গে সঙ্গে এই প্রকল্পে কাজ করতে রাজি
হলো | কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আমার বাবা মারা গেছেন ক্যানসারে। এই সমস্যা
নিয়ে কাজ করতে পারা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ |’ কয়েক দিন পর কথা হচ্ছিল
এক প্রখ্যাত স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে | পারকিনসন রোগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে
গবেষণা করছেন তিনি। আমার জিজ্ঞাসা, ‘আচ্ছা, একজন পারকিনসন রোগীর অবস্থার
উন্নতি হচ্ছে না অবনতি হচ্ছে, সেটা কী করে বোঝো? ’ সঙ্গে সঙ্গে বড় একটা বই
টেবিলের ওপর ছুড়ে দিলেন তিনি | বললেন, ‘এটাই হচ্ছে পারকিনসনের বাইবেল |
সবকিছু হয় কাগজ-কলমে। যেমন ধরো রোগীকে বলা হয়, ‘এই হাতের ব্যায়ামটা করে
দেখান’। ওটা দেখে ডাক্তাররা ১ থেকে ৫ এর মধ্যে একটা নম্বর দেন | একেক
ডাক্তার নম্বর দেন একেকভাবে।
সত্যি বলতে, এই নম্বরে ভুল হয়ে যাওয়ার একটা
আশঙ্কা থাকে।’ আমি বললাম, ‘কম্পিউটার ভিশন ব্যবহার করে এটাকে স্বয়ংক্রিয়
করলে কেমন হয়? যেমন ধরুন, রোগী তার বাসায় বসে সেলফোন অথবা কম্পিউটার
ব্যবহার করে ব্যায়ামগুলো করবে, সেটা বিশ্লেষণ করে কম্পিউটার অ্যালগরিদম
নম্বর দেবে। নম্বরটা দেখতে পাবেন নিউরোলজিস্ট। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত তাঁরই।
কেমন হবে ব্যাপারটা? ’ তিনি ইংরেজিতে যা বললেন, তার বাংলা অর্থ করলে
দাঁড়ায়, ‘এক্কেবারে তেলেসমাতি! ’ তাঁর চেম্বার থেকে ফিরছি। সঙ্গে আমার
ছাত্র রাফায়েত। আমি কিছু বলার আগেই রাফায়েত বলল, স্যার, আমি এই প্রকল্পে
কাজ করতে চাই। আমি ওকে মনে করিয়ে দিলাম, ‘তোমার কাঁধে তো এখন অনেক কাজের
ভার | তুমি নতুন করে একটা প্রজেক্টে কেন যুক্ত হবে?’ রাফায়েত বলল, ‘স্যার,
আমার মায়ের পারকিনসন আছে। এটা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’ বহু বছর আগে আমার
মায়ের কম্পিত হাতটি ধরে যেই উষ্ণতা অনুভব করেছিলাম, সেই উষ্ণতা আবার অনুভব
করলাম। সময়ের তালে সময়ের প্রযুক্তি আসবে, তাতে তাল মিলিয়ে চলাটা
গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দরকার নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করা,
মনের ভেতরের বার্তাটা জানতে পারা। সেটা পারলে বাকি সবকিছু আয়ত্তের মধ্যে
চলে আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেটা আমার ক্ষেত্রে হয়েছে, আমার ছাত্রদের
ক্ষেত্রেও হচ্ছে | আশা করি তোমাদের ক্ষেত্রেও হবে।
No comments