সির হাতে লাগামহীন ক্ষমতা
চীন
আবারও আমাদের প্রত্যাশা উপেক্ষা করেছে। বহু মানুষ আশা করেছিল, চীনা
কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান সি চিন পিং অক্টোবরে অনুষ্ঠিত দলটির ১৯তম জাতীয়
কংগ্রেসে কঠোরতম পরীক্ষার সম্মুখীন হবেন—কংগ্রেস তো নেতা নির্বাচনের জন্যই
হয়। সি চিন পিংকে আরও পাঁচ বছরের জন্য নেতা নির্বাচন করা হয়েছে। ধারণা করা
হয়েছিল, তিনি যদি উত্তরসূরি নির্বাচিত করতে না চান তাহলে তাঁকে ব্যাপক
বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে। কিন্তু তা করেননি আর বিরোধীরাও কিছু করতে
পারেননি। কারণটা খুব পরিষ্কার: সি এর জন্য প্রস্তুতই ছিলেন। ২০১২ সালে
দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে শাস্তিমূলক
ব্যবস্থা নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই ভেবেছিলেন, তিনি যে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা
নিয়েছেন, মাও-উত্তর চীনে সেটা সম্ভব হবে না।
একই সঙ্গে, তিনি ব্যাপক
দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থাও নিয়েছেন, যার মাধ্যমে তিনি সম্ভাব্য রাজনৈতিক
বিরোধীদের দমন করেছেন এবং দ্রুত নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। এ বছরের
শুরুর দিকে চীনের নিরাপত্তাকর্মীরা যখন দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে
সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য চীনা বংশোদ্ভূত হংকংভিত্তিক ধনকুবের জিয়াও জিয়ানহুয়াকে
অপহরণ করে আনল, তখনই বোঝা গেল, সি চিন পিংয়ের ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের পথে আর
কোনো বাধা রইল না। এ ছাড়া কংগ্রেসের আগে নিজের ক্ষমতা আরও সংহত করার জন্য
সি চিন পিং পলিটব্যুরোর সদস্য ও সম্ভাব্য উত্তরসূরি এক নেতাকে জুলাই মাসে
হঠাৎ করেই দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করেন। এরপর কংগ্রেস যখন শেষমেশ হলো
তখন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের দুই মিত্রকে পলিটব্যুরোর স্থায়ী কমিটির
সদস্য নির্বাচিত করেন, যেটা দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ সংস্থা। আর
দলকে উত্তরসূরি মনোনয়নে বাধা দিয়ে তিনি ২০২২ সালে তৃতীয় দফা নেতা হওয়ারও পথ
খোলা রাখলেন। যেকোনো প্রথাগত বিবেচনায় সি চিন পিং ২০১৭ সালে আরও
শক্তিশালী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ক্ষমতা কাজে
লাগিয়ে তিনি চীনের জন্য নিজের এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবেন কি না,
বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। এই লড়াইয়ের প্রথম দফায় সি গুরুত্বপূর্ণ
অগ্রগতি অর্জন করেছেন। তিনি এককভাবে চীনা আমলাতন্ত্রকে দিয়ে উচ্চাভিলাষী ও
ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) বাস্তবায়ন
করিয়ে নিচ্ছেন। এই প্রকল্পে চীনা অর্থ, উপকরণ ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ব্যবহার কর
এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের অনেক দেশকে চীনের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ইঞ্জিনের
সঙ্গে যুক্ত করা হবে। কিন্তু সির ক্ষমতা এতটা বাড়ার পরও এই অর্থনৈতিক
স্বপ্ন বাস্তবায়নে সি চিন পিংয়ের সফলতা এখনো নিশ্চিত নয়। খুব বেশি হলে বলা
যায়, আদর্শিক অনুশাসন ও নিপীড়নমূলক শাসনের কারণে ব্যাপারটা অনিশ্চিত হয়ে
পড়েছে। প্রচার-প্রচারণায় চিন পিংয়ের স্বপ্ন নিয়ে অনেক বড় কথা বলা হলেও দলের
সদস্যসহ অনেক চীনা নাগরিক এটা বিশ্বাস করে কি না বলা কঠিন যে তাঁদের দেশের
ভবিষ্যৎ কেন্দ্রীভূত ও ভয়ভিত্তিক কর্তৃত্ববাদী জমানার মধ্যে নিহিত আছে।
বস্তুত, চিন পিংয়ের লক্ষ্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলা কঠিন বা
সেটা ইদানীং আরও কঠিন হয়ে উঠেছে, তবে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক অক্রিয় প্রতিরোধ
আছে। আর সি চিন পিংয়ের কঠিনতম প্রতিদ্বন্দ্বীরা শুধু দেশটির ক্ষুদ্র
বিরোধীপক্ষের মানুষ নন, যে দলীয় কর্তারা তাঁর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের
জ্বালা সহ্য করেছেন, তাঁরাও এই দলে আছেন। এঁরা যে শুধু বিপুল পরিমাণ অবৈধ
অর্থ হারাচ্ছেন তা নয়, একই সঙ্গে ক্ষান্তিহীন রাজনৈতিক তদন্তের মুখে
পড়েছেন। এখন সি চিন পিং যদি দলের মধ্যম ও নিচের সারির কর্মকর্তাদের সমর্থন
না পান, তাহলে তাঁর চীন পুনর্নির্মাণের স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসবে। সর্বোপরি
তিনি যতই শক্তিশালী হোন না কেন, এই চীনা প্রবাদের বাস্তবতা তিনি এড়িয়ে যেতে
পারেন না: ‘পর্বত অনেক উঁচু, আর সম্রাট অনেক দূরে’। আর যথেষ্ট বস্তুগত
পুরস্কারের সম্ভাবনা না থাকলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকর্তারা সাবেক
সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশের মানুষের সেই যুক্তির দ্বারস্থ হতে পারেন: ‘আমরা
কাজ করার ভান করি, আর তাঁরা আমাদের মজুরি/বেতন দেওয়ার ভান করেন’।
শৃঙ্খলা
ভঙ্গকারী আমলাতন্ত্রের বাইরেও সি চিন পিং কমিউনিস্ট পার্টির তথাকথিত
যুবলীগের মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন, যারা আবার সাবেক
প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। সাত সদস্যবিশিষ্ট পলিটব্যুরোর
নতুন স্থায়ী কমিটিতে হু জিনতাওয়ের দুজন অনুগ্রহভাজন আছেন। ফলে এই যুবলীগ ও
সির গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটা ঠিক, সি
চিন পিং যুবলীগের এই প্রতিরোধ সামাল দিতে পারবেন, এমন সম্ভাবনা আছে।
সর্বোপরি, তিনি ইতিমধ্যে আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিনের সঙ্গে
সম্পর্কিত গোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। আগে এরাই কমিউনিস্ট পার্টিতে
সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী গোষ্ঠী ছিল। তবে সি যুবলীগকে বাগে আনতে পারলেও
একটি ভঙ্গুর ও চেতনাহীন জমানা তাঁকে চালিয়ে নিতে হবে। সি চিন পিংকে আবার
ব্যাপক নীতিগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁকে
ক্রমবর্ধমান ঋণ ও অতি সক্ষমতার সমস্যা সামলাতে হবে, অন্যদিকে ট্রাম্পের
সুরক্ষাবাদী নীতির সঙ্গেও লড়াই করতে হবে। এতে প্রবৃদ্ধির চাকা আরও শ্লথ হয়ে
যেতে পারে। অন্যদিকে পররাষ্ট্র নীতিতে সি চিন পিংকে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক সামলাতে হবে, যার কারণ হলো, উত্তর
কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকি ও দক্ষিণ চীন সাগরে তার আগ্রাসী আচরণ। এখন মানুষ
ভাবছে, আগামী পাঁচ বছর পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, সি চিন পিং ২০২২ সালেও
সহকর্মীদের নিপীড়ন করতে পারবেন। এটা সত্য হতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক
কর্তৃত্ব ক্ষণস্থায়ী, বিশেষ করে সেই নেতাদের জন্য এটা প্রযোজ্য যাদের
অর্থনৈতিক রেকর্ড অত দৃঢ় নয়। এখন সি চিন পিং ও তাঁর সমর্থকদের উদ্যাপন
করার অনেক কারণ আছে। কিন্তু আগামী পাঁচ বছর শুধু গ্লাস গ্লাস পান করলেই
তাঁদের চলবে না।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
মিনঝিন পি: যুক্তরাষ্ট্রের ক্লেয়ারমন্ট ম্যাককেনা কলেজের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
মিনঝিন পি: যুক্তরাষ্ট্রের ক্লেয়ারমন্ট ম্যাককেনা কলেজের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক।
No comments